ফিরে_আসা ২৮ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
709

#ফিরে_আসা
২৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

বাড়ন্ত হৃদস্পন্দন, একরাশ দুশ্চিন্তা, সমাধান খুঁজে না পাওয়ার ব্যর্থতা, বাজে মন্তব্যের প্রভাবে হৃদয় বিষিয়ে যাওয়া। সবকিছুর একসঙ্গে অবসান ঘটলো রাত নয়টা আটত্রিশ মিনিটে। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল আরশাদ এবং অরার।

বিয়ের মতো জটিল বিষয়ে সায় দেওয়ার পেছনে দুজনেরই নিজস্ব কারণ রয়েছে। মানুষের অহেতুক বাজে মন্তব্য সাধারণত গায়ে মাখে না আরশাদ। তবে এবার যেন সবটা ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। আরশাদ তার ফলোয়ার হারাচ্ছে। তাছাড়া সিনেমা হলে এখনো ‘শেষ বিকেল’ সিনেমাটা চলছে। গত কয়েক দিনে সিনেমা হল থেকে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সিনেমার আয়ে নেমেছে ধ্বস। আরশাদ খুব ভালো করেই জানে তার এই খ্যাতির পেছনে সবথেকে বড় অবদান তার ভক্তদের। আর সেই ভক্তরাই যদি তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে সেটা তার ক্যারিয়ারের জন্যে মঙ্গলজনক হবে না।

এই হোটেলের সিসিটিভি ক্যামেরা কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে থাকা ওই ছেলেটার একটা ভুলের জন্যে আজ আরশাদের খ্যাতি একপ্রকার হুমকির মুখে। ছেলেটা তার যথাযথ শাস্তি পাচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কঠিন মামলা দেওয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে। তবে তাকে শাস্তি দিলে পরিস্থিতি ঠান্ডা হবে না। ভক্তরা ধরেই নিয়েছে আরশাদের সঙ্গে অরার অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে। আর বাঙালি যখন একবার কিছু ধারণা কর নেয়, তখন সেটাই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে থাকে।

পরিস্থিতি আপাতত ঠান্ডা করতে হবে। যে মানুষগুলো আরশাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তাদের বোঝাতে হবে সে কোনো ভুল কিছু করেনি। সত্যি কথা বললে যেহেতু কেউ বিশ্বাস করবে না, আরশাদ তাই মিথ্যার আশ্রয়টাই বেছে নিয়েছে আরশাদ। অরা সায় দিয়েছে, কারণ সে চায় যত দ্রুত সম্ভব তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে। যে জীবনে কেউ তাকে সমালোচনার পাত্রী বানিয়ে দেবে না। তাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করবে না। তাকে খারাপ মেয়ে ভাববে না।

বিয়ের পুরোটা সময়ে আরশাদের মনে হচ্ছিল কোনো সিনেমার শুটিং চলছে, আর সে সিনেমায় অভিনয় করছে। সিনেমায় যেমন স্ক্রিপ্ট থাকে, পরিচালক থাকে – এখানেও আছে। তাদের বিয়ের স্ক্রিপ্ট লিখেছে হিমেল, পরিচালনাও সে করেছে। হিমেল চমৎকার কাজ করেছে। অতি উৎসুক সাংবাদিক এবং হুজুগে গা ভাসিয়ে দেওয়া জনগণের উদ্দেশ্যে সে পরপর কতগুলো বোমা ছুঁড়ে মেরেছে।

সবার আগে আরশাদ এবং অরার কোর্ট ম্যারেজ হয়। হলফনামায় হিমেল চারদিন আগের তারিখ লেখে। ভাবটা এমন যে, যেদিন তারা সিলেটে আসে সেদিনই তাদের বিয়ে হয়েছে। এরপর সেই হলফনামার ছবিটা ভাইরাল করে দেয় হিমেল, এটাই তার প্রথম বোমা। কোর্ট ম্যারেজের হলফনামায় স্বাক্ষরপর্ব শেষে কাজী সাহেবের সামনে তাদের বিয়ে হয়। দ্বিতীয় বোমা হিসেবে কাজী সাহেব তাদের বিয়ে পড়াচ্ছে এমন একটা ছবি ভাইরাল করে দেয় হিমেল।

এই দুটো বোমায় ইতোমধ্যেই ইন্টারনেট তখন উত্তপ্ত। এতদিন যারা ভিডিও নিয়ে হইচই করছিল, তারা হইচই করার নতুন বস্তু পেয়ে গেছে। সুপারস্টার আরশাদ হকের বিয়ে! বাজে মন্তব্যকারীরা হঠাৎ করে সাধু হয়ে গেল। মিষ্টি ভাষায় লিখতে লাগলো, “আরশাদ বিয়ে করে আমাদের আগে জানালেই পারতো। বউকে লুকিয়ে রাখতে গেল কেন? শুধু শুধু মানুষের বাজে কথা শুনতে হলো বেচারীকে।”

তৃতীয় বোমা হিসেবে হিমেল অরাকে দিয়ে একটা ইন্টারভিউ দেওয়ায়। অরা সাংবাদিকের মুখোমুখি হতে চায়নি। তাই ফোনের মাধ্যমে ইন্টারভিউ দেয় সে। ইন্টারভিউতে সত্যর মতো করে কতগুলো মিথ্যা বলে সে। সব মিথ্যাই হিমেলের শিখিয়ে দেওয়া। অরা ইন্টারভিউতে বলে, এক বছর ধরে আরশাদ তাকে পছন্দ করে। অরা বুঝতে পেরেছিল ঠিকই, কিন্তু আরশাদ কখনো মুখ ফুটে বলেনি। চারদিন আগে সিলেটে এসে আরশাদ হঠাৎ তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। অরা এমন আকস্মিক প্রস্তাবে হকচকিয়ে গেলেও শেষমেশ রাজি হয়ে যায়।

এই ছোট্ট সুন্দর ভালোবাসার গল্পটাও পাবলিক পছন্দ করেছে। যারা আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত আরশাদকে চরিত্রহীন বলে আখ্যা দিচ্ছিল, তারাই এখন বলেছে আরশাদের মতো সোনার টুকরা ছেলে এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে, কিন্তু প্রেমের প্রস্তাব দেয়নি। সোজা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে।

সর্বশেষ বোমা হিসেবে হিমেল আরশাদকে দিয়ে ফেসবুকে তাদের দুজনের ছবি পোস্ট করিয়েছে। ক্যাপশনে আবার লিখিয়েছে, “The light to my darkness.” যদিও এতে আরশাদের সায় ছিল না, তবে কী আর করা! ইমেজ রক্ষার খাতিরে বিয়েটাই যখন কর ফেলেছে, তখন ছবি পোস্ট করা আর কী এমন কঠিন কাজ!

আরশাদের হারিয়ে যাওয়া ফলোয়ারেরা ক্রমেই ফিরতে শুরু করেছে। সকলে সুন্দর সুন্দর কমেন্টে ভরিয়ে ফেলেছে সেই পোস্টের কমেন্ট সেকশন। যদিও একটা মহলের মনে হচ্ছে ভিডিও ভাইরাল হয়ে যাওয়ার পর চাপে পরে অরাকে বিয়ে করেছে আরশাদ। তবে বেশির ভাগই ইতিবাচক কমেন্ট করছে। নবদম্পত্তিকে নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই।

আরশাদ অরাকে আশ্বাস দিয়েছে দীর্ঘদিন এই নাটক চালিয়ে যেতে হবে না তাদের। এক বছর কিংবা তারও কম সময়ের জন্যে দুজনে সংসার করার অভিনয় করবে। অরা আরশাদের বাড়িতে থাকবে। পুরো পৃথিবী মনে করবে তারা সুখী দম্পত্তি। এক বছর পর দুজনে ডিভোর্স নিয়ে আলাদা হয়ে যাবে। সবাই জানবে দুজনের সম্মতিতে মিউচ্যুয়াল ডিভোর্স হয়েছে।

জ্বর থেকে এখনো পুরোপুরি সেরে ওঠেনি অরা। মাথার ভেতরে তীক্ষ্ণ ধরনের একটা ব্যথা রয়েই গেছে। তার ওপরে আবার এই দুইদিনে প্রচুর ধকল গেছে মেয়েটার ওপর দিয়ে। বাজে বাজে ওসব মন্তব্য পড়ে বিষিয়ে গেছে তার মনটা। সেই সাথে আবার বিয়ের এই বাড়তি ধকল। সব মিলিয়ে প্রচন্ড ক্লান্ত অরা। কোনো ভাবনা-চিন্তা করার পর্যায়ে নেই তার মস্তিষ্ক।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার পর আরশাদের সঙ্গে আর কথা হয়নি তার। আরশাদ যথারীতি গম্ভীর ভঙ্গিতে নিজের ঘরে চলে গেছে। অরাও
ফিরে এল তার ঘরে। মাথাটা ভনভন করে উঠছে। বিচিত্র ক্লান্তি ছেয়ে গেছে সারা শরীরে। ঘরে এসে ফ্রেশ না হয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো অরা। তার জীবনের সবথেকে বড় ঘটনা আজ ঘটেছে। অথচ সেসব নিয়ে কোনপ্রকার চিন্তাভাবনা নেই অরার মাঝে। এই মুহূর্ত তার ইচ্ছা করছে সারাজীবনের জন্য ঠিক এভাবেই ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় পড়ে থাকতে। চুপটি করে সে হারিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে।

পরদিন সকালে অরার ঘুম ভাঙ্গলো আরশাদের ফোনে। অরা ফোন রিসিভ করতেই আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “অরা, এখনই এসে আমার সঙ্গে দেখা করো।”

একলাফে উঠে বসলো অরা। অরশাদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কোনো নির্দেশও কোনোদিন অমান্য করেনি সে। আজও করলো না। বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে জল দিতেই অরার মনে পড়ে গেল কাল রাতের ঘটনা। তার বিয়ের ঘটনা। অদ্ভুত ব্যাপার, সদ্য ঘুম থেকে উঠে আরশাদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে অরার মাথা থেকে বিয়ের ব্যাপারটা উড়েই গিয়েছিল। অরা বিশ্বাসই করতে পারছে না এই মুহূর্তে সে বিবাহিত। তাও আবার যে মানুষটার সঙ্গে বিয়ের কথা সে কোনদিন কল্পনাতেও আনেনি তার সঙ্গে।

হোটেলের লবিতে বসে গম্ভীরমুখে স্ক্রিপ্টের দিকে তাকিয়ে আছে আরশাদ। আজ থেকে আবারও শুরু হতে যাচ্ছে শুটিং। অরার বুকটা ধ্বক করে কেঁপে উঠলো। গত দুই দিনে শুটিংয়ের কোনো খোঁজ খবরই নেওয়া হয়নি। নিজের দুশ্চিন্তায় অরা এতটাই মগ্ন ছিল যে কাজকে একটু বেশিই অবহেলা করা হয়ে গেছে।

অরা আরশাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আরশাদ স্ক্রিপ্টের দিক থেকে চোখ না তুলে বলল, “বসো অরা।”

অরা ইতস্তত করে বসলো আরশাদের পাশের সোফায়। এর আগেও তো বহুবার আরশাদের সামনে এসেছে সে, তার পাশে বসেছে। কই?কোনোবারই তো এমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়নি। মনের মধ্য দিয়ে কতশত প্রজাপতি যে উড়ে যাচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই অরার কাছে। একটু একটু করে তার হৃদস্পন্দন ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। কেন হচ্ছে এমনটা? অরা পাশে বসে থাকা মানুষটা আজ তার স্যার নয়, তার স্বামী। এজন্যে?

অরা চুপ করে বসে রইলো। আরশাদ কয়েক মিনিট স্ক্রিপ্টের দিকে চোখ বুলিয়ে অবশেষে বলল, “তুমি আজ ঢাকায় ফিরে যাও অরা। তোমাকে এখানে থাকতে হবে না। সেটের মানুষজন এমনিতেই তোমাকে বাড়তি আগ্রহী হয়ে উঠেছে।”

অরা শুকনো গলায় বলল, “জি আচ্ছা স্যার।”

“ঢাকায় গিয়ে তুমি সোজা আমার বাসায় উঠবে। মতিউরকে বলে রেখেছি, তোমার কোনো অসুবিধা হবে না।”

অরা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “আজই কেন স্যার?”

আরশাদ যন্ত্রের মতো করে বলল, “কারণ এয়ারপোর্টে নামার সাথে সাথে সাংবাদিকরা তোমাকে ফলো করবে। তুমি আমার বাসায় না গিয়ে নিজের বাসায় উঠলে এই নিয়ে আবার কথা উঠতে পারে।”

অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “আচ্ছা।”

“ঢাকায় গিয়েও তুমি ডিরেক্টর আর টিমের সাথে যোগাযোগ রাখবে। প্রতিদিন রাতে পরের দিনের শিডিউল আমাকে পাঠিয়ে দেবে।”

মনে মনে হাফ ছেড়ে বাঁচলো অরা। তার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে হয়তো, ঢাকায় বসে কাজ করতে হবে শুনে দুঃখে শেষ হয়ে যেতেই। অরা বলেই খুশি হচ্ছে। কাজ ছাড়া জীবনযাপন করা তার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।

আরশাদ আবারও বলল, “যাদের সঙ্গে মিটিং ফিক্সড করেছ তাদের কাছে ফাইনাল ডেটটা পৌঁছে দেবে। আর যাওয়ার আগে মিটিংয়ের শিডিউলটা কোনমতে আমার ল্যাপটপে পাঠানোর ব্যবস্থা করো।”

“জি স্যার।”

আরশাদের কথাবার্তার ভঙ্গিতে কোনপ্রকার পরিবর্তন আসেনি। তার কথা শুনে কেউ বুঝতেই পারবে না, যার সঙ্গে সে কথা বলছে, সে তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী। আরশাদ অরার সঙ্গে এখনো ম্যানেজারের মতো করেই কথা বলছে। অবশ্য এটাই তো স্বাভাবিক। বিয়েটা হয়েছেই ক্ষণিকের জন্যে। এই বিয়ের কোনো ভিত্তি তার কাছে না থাকাই স্বাভাবিক। অরার কাছে কি আছে? সে নিজেই বুঝতে পারছে না।

আরশাদের ধারণাই ঠিক হলো। এয়ারপোর্টে নেমেই একরাশ সাংবাদিকের ভীড় লক্ষ করলো অরা। আরশাদের ড্রাইভার আগে থেকেই গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে অপেক্ষা করছিল তার জন্যে। ভীড় এড়িয়ে একা একা গাড়ির কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই হাঁপিয়ে উঠলো অরা। উৎসুক সাংবাদিকের দল বাড়ি পর্যন্ত ফলো করেছে তাকে। অরা বাড়ির ভেতরে চলে যাওয়ার পর সকলে জড়ো হয়েছে বাড়ির সামনে। যদিও এ বাড়ির সিকিউরিটি গার্ডরা বাড়ির সামনে কোনো সাংবাদিককে ভীড় করতে দেয়নি। তাই তারা গিয়ে জড়ো হয়েছে খানিক দূরে। অপেক্ষায় আছে আরেকবার অরাকে ক্যামেরাবন্দী করার।

মতিউর অরার জন্যে এ বাড়ির গেস্ট রুমটা খুলে দিয়েছে। সে তো একবছরের জন্যে এ বাড়ির গেস্টই। আরশাদের এ বাড়িতে আগেও অগণিতবার এসেছে অরা। তবে কোনোবারই এমন অনুভূতি হয়নি। এই অনুভূতির কোনো নাম নেই, একে ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য।
এই বিচিত্র অস্থিরতা কিছুতেই থামতে চাইছে না।

সীমাকে ফোন করে খবর দিলো অরা। এ বাড়িতে তার কোনো জিনিসই নেই। নিজের জামা-কাপড় আর অন্যান্য জিনিস ছাড়া তো আর থাকা সম্ভব নয়। সীমা যখন অরার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ির সামনে এলো, দূরে থাকা সাংবাদিকদের ভীড়ে যেন প্রবল ঢেউ খেলে গেল। সবাই ব্যস্ত হয়ে গেল, আরশাদ হকের স্ত্রীর সঙ্গে যে দেখা করতে এসেছে তাকে ক্যামেরাবন্দী করতে।

সীমাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো অরা। মনের ভেতরে জমিয়ে রাখা অনুভূতিগুলো কেবল আপন মানুষের সামনেই প্রকাশ করা যায়। সীমা তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু ক্রমে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে। অরার কী হয়ে গেল হুট করে? তার দেখা সবথেকে সাহসী মেয়েটা এমন করে ভেঙে পড়লো। অবশ্য অরাকে দোষ দিয়েও কোনো লাভ নেই। যে ধরনের বাজে বাজে মন্তব্য তাকে করা হয়েছে, এতে ভেঙে পড়াটাই স্বাভাবিক।

বেশ অনেকটা সময় লাগলো অরার শান্ত হতে। চোখের জল মুছে অরা চুপচাপ গিয়ে বসলো বিছানার ওপরে। সীমা তার সামনে বসতে বসতে হালকা গলায় বলল, “বাপ রে বাপ! আমার তো বিছানায় পা উঠিয়ে বসতেই ভয় করছে। আরশাদের বাড়ির গেস্ট রুমের বিছানায় বসে আছি। ভাবা যায়!”

অরাকে একটু সহজ করার জন্যে এমন হালকা ধরনের কথা বলছে সীমা। তবে হলো হিতে বিপরীত। অরা বিরক্ত হয়ে বলল, “আমার জীবনের বারোটা বেজে গেল আর তুই ফাজলামি করছিস?”

সীমা আহত গলায় বলল, “বারোটা বাজতে যাবে কেন? তুই তো রীতিমত স্টার হয়ে গেছিস। ফেসবুকের সমস্ত সিনেমার গ্রুপে তোকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। মানুষের তো তোকে নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই!”

অরা ক্লান্ত গলায় বলল, “বিরক্ত লাগছে আমার। মানুষের অ্যাটেনশন পেয়ে অভ্যস্ত না তো, তাই।”

“এটা তো পজিটিভ অ্যাটেনশন। ওই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর মানুষজন বাজে কথা বলছিল। কিন্তু বিয়ের খবর সামনে আসার পর থেকেই তো সব বদলে গেল।”

অরা ভয়ার্ত গলায় বলল, “তুই কি এর মাঝে ভার্সিটিতে গিয়েছিলি সীমা? ওখানেও কি সবাই আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলছে?”

“আরে না! পৃথিবীর সবাইকে খারাপ মনে করিস না-কি? ভার্সিটির সবাই বলাবলি করছিল, অরার মতো ভালো মেয়ে কোনো খারাপ কাজ করতেই পারে না।”

কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। ভার্সিটিতে এই কয়দিনে বিশাল ঝামেলা বেঁধে গেছে। ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর একদল সাধু শিক্ষার্থী ডিপার্টমেন্ট হেডের কাছে গিয়ে বলেছে, এই মেয়েকে অবিলম্বে ভার্সিটি থেকে বহিস্কার করা হোক। ওই সময়ে বেশ দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে সীমাকে। ডিপার্টমেন্ট হেডকে সে বুঝিয়েছে ভিডিওতে অরার কোনো দোষ নেই। তার সঙ্গে কোনপ্রকার কথা না বলে এভাবে বহিষ্কার করা অযৌক্তিক।

ডিপার্টমেন্ট হেড শেষমেশ সীমার কথা শুনেছে। এ ছিল গতকালের ঘটনা। আজ তো বিয়ের খবরটাই সামনে চলে এলো। এতক্ষণে ভার্সিটির উত্তাপ নিশ্চয়ই শান্ত হয়েছে। এ কথাটা আপাতত অরার না জানলেও চলবে। বেচারির মনের অবস্থা এমনিতেও ভালো না।

সীমা হঠাৎ কী যেন মনে করে খিলখিল করে হেসে উঠলো। হাসির তীব্রতা এতটাই যে হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার মতো অবস্থা।

অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “হাসছিস কেন?”

সীমা হাসি না থামিয়েই বলল, “এমনি।”

“এমনি এমনি এমন পাগলের মতো কেউ হাসে?”

“আমি বলেছিলাম না?”

“কী?”

সীমা ফুর্তির ভঙ্গিতে বলল, “আরশাদের সঙ্গে তোর কিছু একটা হবেই। তখন তো বিশ্বাস করিসনি।”

অরা কঠিন গলায় বলল, “স্যার আমাকে শখের বশে বিয়ে করেনি সীমা, পরিস্থিতির চাপে পড়ে বাধ্য হয়েছে।”

সীমা আক্ষেপজড়িত কণ্ঠে বলল, “এটাই একমাত্র আফসোস বুঝলি! কোথায় ভেবেছিলাম আরশাদ তোর প্রেমে পড়বে, রোমান্টিকভাবে প্রোপজ করবে। কিন্তু না! থাক কী আর করা। বিয়ে যে হয়েছে এতেই আমি খুশি।”

“তুই ভুলে যাচ্ছিস সীমা, বিয়েটা এক বছরের জন্যে হয়েছে। এক বছর মানুষের সামনে হ্যাপি ফ্যামিলির অভিনয় করতে হবে আমাকে।”

“আরে ধুর! এক বছরে কতকিছু বদলে যায়। আপাতত তুই আরশাদ হকের বউ। এই সত্য কেউ পাল্টাতে পারবে না।”

‘আরশাদ হকের বউ’ কথাটা ঝনঝন করে বেজে উঠলো অরার কানে। গায়ে কাঁটা দিয়ে গেল। মনের মাঝে একরাশ অস্থিরতা খেলে বেড়াচ্ছে। সে অস্থিরতা থেকে নিস্তার পাবার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।

দিনভর শুটিং শেষে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো আরশাদ। গত দুই দিনে তার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ের লেশমাত্র প্রভাব পড়েনি শুটিংয়ে। আরশাদ যখন কাজ করে, তার পূর্ণ মনোযোগ দিয়েই করে। দিনশেষে এই কাজটাকেই তার সবথেকে আপন বলে মনে হয়।

হঠাৎ তার বিশ্রামে ব্যাঘাত সৃষ্টি করলো ফোনের রিংটোন। আরশাদ বিরক্ত দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে তার মায়ের নাম। সর্বনাশ করেছে! বিয়ের ব্যাপারটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে তার কানে পৌঁছে গেছে। বিয়ের আগে মা বা আপাকে জানানোর কোনো প্রয়োজন মনে করেনি আরশাদ। বিয়ে তো আর সত্যিকার অর্থে হচ্ছে না। পরিস্থিতির চাপে পড়ে বিয়ে। এতে আবার জানানোর কী আছে?

আরশাদ ফোন রিসিভ করে কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগেই সেলিনা হক অপরপ্রান্ত থেকে উদগ্রীব গলায় বললেন, “আরশাদ? তুই অরাকে বিয়ে করেছিস?”

আরশাদ ক্লান্ত গলায় বলল, “হুঁ।”

“কেন?”

আরশাদ হাই তুলতে তুলতে বলল, “এমনি।”

সেলিনা হক ধমকের সুরে বললেন, “এটা কী ধরনের উত্তর আরশাদ? ঠিক করে উত্তর দে।”

“তুমি ঠিক করে প্রশ্ন করো, আমি তাহলে ঠিক করেই উত্তর দেবো।”

“কবে বিয়ে করেছিস তুই?”

“তিন-চার দিন হলো।”

যদিও বিয়েটা হয়েছে গতরাতে তবে গণমাধ্যমে জানানো হয়েছে, বিয়ে হয়েছে চারদিন আগে। প্রকৃত সত্যিটা আপাতত মাকে জানালো না আরশাদ।

সেলিনা হক ব্যথিত কণ্ঠে বললেন, “আমি কি এতটাই পর হয়ে গেছি আরশাদ? বিয়ের আগে আমার অনুমতি নেওয়া তো দূরে থাক, একটাবার আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলি না?”

আরশাদ আর কথা না বাড়িয়ে বলল, “সরি মা। ভেবেছিলাম তুমি রাগ করবে। তাই জানাইনি।”

“আমি রাগ করবো কেন। বরং আমি খুশি হয়েছি।”

আরশাদ অবাক গলায় বলল, “খুশি হয়েছো?”

সেলিনা হক হাসি হাসি কণ্ঠে বললেন, “হ্যাঁ। অরার মতো ভালো মেয়ে দুটো হয় না। আমি তো সেই কবে থেকে ওকে তোর জন্য পছন্দ করে রেখেছিলাম। তুই রাগ করবি দেখে কখনো বলিনি। তোরা নিজেরা নিজেরা বিয়ের ঝামেলা মিটিয়ে নিয়েছিস ভালোই হয়েছে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরশাদ। বিয়ে নিয়ে মায়ের এই আনন্দ তার মোটেও সহ্য হচ্ছে না। এক বছর পর ডিভোর্সের সময় মাকে বোঝাতে গিয়ে আবার কাঠখড় পোড়াতে হবে তাকে। কার ভালো লাগে বারবার একই ঝামেলার সম্মুখীন হতে?

(চলবে)

[গতকাল মধ্যরাতে নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করে পেজে একটা পোস্ট করেছিলাম। ভেবেছিলাম ওই পোস্ট হয়তো কারো চোখে পড়বে না। কিন্তু আপনাদের চোখে ঠিকই পড়লো। আপনারা আমাকে ভাসিয়ে দিলেন সুন্দর সুন্দর কমেন্টে। আমি আসলেই অনেক বেশি কৃতজ্ঞ এই সুন্দর পাঠকদের পরিবারটা পেয়ে। আপনারা আছেন বলেই আমি লিখে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাই। তিন-চার ঘন্টা কষ্ট করে একটা পর্ব লেখার পর আপনাদের ভালো লেগেছে জানলে কষ্ট সার্থক বলে মনে হয়। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে। ❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here