#ফিরে_আসা
৩৭
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
“তোমার সাহস কী করে হয় আমাকে ফোন করার? তোমার সাহস দেখে আমি রীতিমত অবাক হচ্ছি।”
নওশীনের এমন কথায় হকচকিয়ে গেল অরা। বিয়ের ওই ঘটনার পর আজই প্রথম নওশীনের সঙ্গে কথা হচ্ছে তার। অরা জানত বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নেবে না সে। এতটা যে রেগে যাবে তাও বুঝতে পারেনি।
অরা ইতস্তত করে বলল, “ম্যাম…”
অরা কথার মাঝপথেই নওশীন ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “চুপ! একটা কথাও বলবে না তুমি। তোমার মতো মেয়েদের খুব ভালো করে চেনা আছে আমার। ওপরে ওপরে সাধু সাজবে, আর ভেতরে ভেতরে বদ মতলব! ছি!”
অরা ক্রমেই অবাক হয়ে যাচ্ছে। নওশীনের উচ্চারিত শব্দগুলোর থেকেও বেশি অবাক করছে তার এই আচরণ। নওশীনকে কখনো এমন রূপে দেখেনি অরা। বিগত চার বছর ধরে যার ঠোঁটে সবসময় হাসি লেগে থাকতে দেখেছে, তার এমন রূপ ঠিক হজম হচ্ছে না।
নওশীন আবারও হুংকার দিয়ে বলল, “এই মেয়ে! সত্যি করে বলো তো! কী করে ফাঁসিয়েছ শাদকে?”
অরা কম্পিত স্বরে বলল, “ম্যাম আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
নওশীন তেজী গলায় বলল, “খবরদার আমার সামনে ন্যাকা সাজবে না! তোমার মতো লোয়ার ক্লাস মেয়েকে নিজ থেকে পছন্দ করে বিয়ে করার মানুষ তো আরশাদ হক না। তোমার মতো মেয়েরা বড়লোকদের ফাঁসিয়ে বিয়ে করে। দুদিন পর একটা বাচ্চা নিয়ে সংসারে স্থায়ী হয়ে যায়। তোমার টার্গেটও সেটাই, তাই না?”
অরার দুই কান গিয়ে গরম বাষ্প বের হচ্ছে। নওশীনের এমন কথা সে মোটেও আশা করেনি। নিমিষেই অরার দুচোখে পানি ভর্তি হয়ে এলো। এমন না যে এ ধরনের কথা সে আজই প্রথম শুনছে। ওই ভিডিওটা ভাইরাল হওয়ার পর থেকে অনেকে বলেছিল, “এই মেয়েটা আরশাদকে ফাঁসানোর জন্যে অজ্ঞান হওয়ার অভিনয় করছে।”
অচেনা মানুষের কথায় অরার খারাপ ঠিকই লেগেছিল। তবে এতটা নয়, যতটা আজ লাগছে। কারণ নওশীন তো আর অচেনা কেউ নয়। এই নওশীনকেই একটা সময়ে নিজের আদর্শ বলে মনে করতো অরা।
“সত্যিটা আপনি জানেন না ম্যাম। সত্যি তো…”
নওশীন তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “তুমি সত্যির মতো করে কতগুলো মিথ্যা বলবে আর আমি তা শুনবো? আমার অত সময় নেই। কী ভেবেছিলে? আমার জায়গা নিবে?”
“না ম্যাম।”
“তাহলে আমার অবর্তমানে কেন গিয়ে আমার সাজানো সংসারটা দখল করলে? তোমার মতো বেঈমান মেয়ে এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। আমি তোমাকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছিলাম বলেই আজ তুমি এত বড় সাহস করতে পেরেছো। না হলে তো কোনোদিন শাদের ছায়াও পড়তো তোমার ওপর। মনে রেখো তুমি শাদের জীবনে দ্বিতীয় নারী হয়েই থাকবে। মানুষ তোমাকে আরশাদ হকের স্ত্রী হিসেবে চিনবে না, চিনবে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে।”
অরার মাথা প্রচন্ড এক ঘূর্ণির ন্যায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না তার কী বলা উচিত, বা কেমন অনুভব করা উচিত। সে তো কারও সংসার দখল করেনি। আরশাদ হকের স্ত্রীয়ের আসন পাবার লোভ তো তাই নেই।
নওশীন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ মলিন কণ্ঠে বলল, “কোথাও থাকো তুমি? শাদের সঙ্গে একই বিছানায় থাকো তাই না?”
অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “ম্যাম আপনি একটু আমার কথাটা শুনুন।”
নওশীন উঁচু স্বরে বলল, “Shat up! তোমার মতো নোংরা মেয়ের কথা শোনার রুচি আমার নেই। একটা কথা মনে রেখো, মানুষ জীবনে একবারই ভালোবাসে। শাদের প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা আমি। আমার মতো করে ও কাউকে ভালোবাসতে পারবে না। তোমার সঙ্গে যা করছে, তা কেবলই অভিনয়। শাদ তোমাকে উইজ করছে। উইজ করা শেষ হলে ছুঁড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেবে।”
অপরপ্রান্ত থেকে ফোনটা কেটে গেল। তবুও মোবাইল কানে ধরে বসে আছে অরা। লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে সে। তার চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। চোখের জল লুকাবার কোনপ্রকার চেষ্টা তার মধ্যে নেই।
আরশাদ এতক্ষণ দোতলায় তার ঘরে ছিল। হঠাৎ সিড়ি বেয়ে নেমে এলো নিচে। বসার ঘরে চোখ পড়তেই সে লক্ষ্য করলো, অরা সোফায় বসে আছে। তার হাত-পা রীতিমত কাঁপছে। অনবরত চোখ বেয়ে জল পড়ছে। নিজের অজান্তেই আরশাদের বুকটা ধ্বক করে কেঁপে উঠলো। এই মেয়েটার চোখে জল মানায় না। একটা সময় আরশাদ প্রচুর মানসিক কষ্টে ভুগেছে। হয়তো এখনো ভুগছে। তাই অন্যকে কষ্টে দেখতে তার ভালো লাগে না।
অরা এগিয়ে গিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “অরা কী হয়েছে? কাঁদছো কেন তুমি?”
আরশাদের উপস্থিতি টের পেয়ে অরা আঁতকে উঠলো। তড়িঘড়ি করে চোখের জলগুলো মুছতে মুছতে বলল, “কই? না তো স্যার।”
আরশাদ যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে। তার বুঝতে মোটেও অসুবিধা হলো না অরার কান্নার পেছনে প্রকৃত কারণ কী। দুদিন হলো কথাকে নিয়ে দেশে ফিরেছে নওশীন। যদিও কথা ছিল তারা কানাডায় ছয় মাস থাকবে। নির্ধারিত সময়ের চার মাস আগেই নওশীনের আগমনে মনে মনে আরশাদ অবাক হলেও বিষয়টা গায়ে মাখেনি। বরং খুশিই হয়েছে। অবশেষে মেয়েকে দেখতে পারবে সে।
ডিভোর্সের পর কথা যতবারই বাবার কাছে এসেছে প্রতিবারই অরা তাকে গাজীপুর থেকে নিয়ে এসেছে। আরশাদ তাই যথারীতি এবার অরাকেই বলেছিল, আগামীকাল কথাকে গিয়ে নিয়ে আসতে। আর আজ নওশীনের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাখতে। অরা তার নির্দেশ অনুযায়ী নিশ্চয়ই নওশীনকে ফোন দিয়েছিল। এবং এখন তার চোখে জল। কিছুই আর বুঝতে বাকি রইল না আরশাদের।
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “নওশীন কিছু বলেছে?”
“না স্যার।”
আরশাদ হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণ করার বৃথা চেষ্টা করলো। নওশীন কী বলতে পারে সেটাও সে জানে। নির্ঘাত এই বিয়ে নিয়ে অরাকে বাজে কথা শুনিয়েছে। একটু একটু করে আরশাদের রাগটা যেন বেড়েই যাচ্ছে। নওশীন কেন অরাকে বিয়ে নিয়ে কিছু বলতে যাবে?
আরশাদ ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, “কী বলেছে নওশীন?”
অরা ঠোঁটে কৃত্রিম একটা হাসি টেনে এনে বলল, “কিছু বলেনি স্যার। আমি এমনিই…”
“আমার কাছে মিথ্যা বলার চেষ্টা করবে না অরা। কী বলেছে?”
“স্যার কিছুই বলেনি।”
“তুমি সত্যি বলবে না-কি আমি টেলিকম কোম্পানিকে ফোন করে কল রেকর্ড বের করবো?”
“এসব কিছুই করতে হবে না স্যার। আপনি আমার কথা বিশ্বাস করুন।”
আরশাদ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, “তার মানে তুমি সত্যিটা বলবে না? ঠিক আছে।”
অরার মনে তীব্র ভয় ঢুকে গেল। না জানি আরশাদ এখন আবার কী করে? তার পাগলামির কোনো সীমারেখা নেই। দেখা গেল, সত্যি সত্যিই টেলিকম কোম্পানিতে ফোন করে কল রেকর্ড বের করে ফেলেছে।
আরশাদ তার পকেট থেকে ফোনটা বের করে কার নম্বরে যেন ডায়াল করতে আরম্ভ করেছে। ডায়াল করার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন এই মুহূর্তে নিজের রাগ দিয়ে পুরো পৃথিবীটাকে পুড়িয়ে ফেলতে পারে সে।
আরশাদ ফোন করেছে নওশীনকে। নওশীনের দেওয়া একের পর এক আঘাত সে নিরবে সহ্য করেছে। তবে তাকে আর প্রশয় দেওয়ার অর্থ নিজের ক্ষতি নিজে করা।
দুটো রিং বাজতেই অপরপ্রান্ত থেকে ফোনটা রিসিভ হয়ে গেল। নওশীন হাসি হাসি গলায় বলল, “শাদ? তুমি?”
আরশাদ কড়া ভাষায় বলল, “তোমার সমস্যা কী? কী মনে করো নিজেকে?”
নওশীন কিছু না বোঝার ভান করে বলল, “কী বলতে চাইছো তুমি শাদ?”
আরশাদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “কতবার বলেছি ওই বিশ্রী নামে আমাকে ডাকবে না?”
অপরপ্রান্তে নীরবতা। নওশীন এর জবাবে কিছুই বলল না।
আরশাদ আবারও উতপ্ত স্বরে বলল, “আমার লাইফে তোমার অস্তিত্ব কোথায়? তবুও কেন বারবার আমার লাইফে ইন্টারফেয়ার করতে হবে তোমাকে?”
“আমি জানি না ওই মেয়েটা তোমাকে কী বলেছে। কিন্তু…”
আরশাদ তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বলল, “ওই মেয়েটার নাম অরা।”
নওশীন একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবারও বলল, “হ্যাঁ, আমি জানি না ও তোমাকে কী বলেছে। আমি শুধু ওকে বেসিক প্রশ্ন করছিলাম। তুমি কেমন আছো, ওই বাড়িতে কেমন লাগছে এই সব। এর থেকে বেশি কিছু না, বিশ্বাস করো।”
আরশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “বিশ্বাস? তোমাকে?”
নওশীন আবারও চুপ করে রইলো। তাকে আর যাই হোক, বিশ্বাস কোনো ক্রমে করা যায় না এটা সম্ভবত সে নিজেও জানে।
“অরা আমাকে কিছুই বলেনি। কিন্তু আমি খুব ভালো করেই জানি তুমি ওকে কী বলেছো।”
নওশীন আহত গলায় বলল, “একটা বাইরের মেয়ের জন্য তুমি আমার সাথে এমন আচরণ করছো?”
আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “কে তুমি? আমার জীবনে তোমার বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। তোমার চেহারাও আমি কোনোদিন দেখতে চাই না। আর যাকে তুমি বাইরের মেয়ে বলছো, সে আমার ওয়াইফ! Don’t you ever dare to disrespect my wife! If you do, you’ll regret that for the rest of your life.”
দূর থেকে দাঁড়িয়ে আরশাদের কথাগুলো শুনছিল অরা। আচমকা এই কথাটায় তার সমস্ত অন্তরাত্মা হু হু করে কেঁপে উঠলো। বুকের মাঝে হৃদয়টা ভয়ঙ্কর গতিতে নৃত্য আরম্ভ করলো। আরশাদ কী বলল? আরশাদ তাকে নিজের স্ত্রী বলে সম্বোধন করলো? আসলেই? না-কি অরা ভুল শুনেছে?
অপরপ্রান্ত থেকে নওশীন দৃঢ় গলায় বলল, “আর আমি তোমার বাচ্চার মা।”
“ওই একটা কার্ডই আছে তোমার কাছে। কথায় কথায় বাচ্চার মা কার্ড প্লে করো। ভুলে যেও না, কেউ বাচ্চার মা হলেই তার সাত খুন মাফ হয় না।”
“ও আচ্ছা। তাহলে কথা ওই বাড়িতে যাবে না। যতদিন পর্যন্ত ওই মেয়েটা তোমার বাড়িতে আছে, ততদিন পর্যন্ত না।”
আরশাদ জোর গলায় বলল, “কথা আসবে, কালকেই আসবে। দেখি তুমি কী করতে পারো।”
আরশাদ নিমিষেই ফোন কেটে দিয়ে সোজা সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল। রাগ তা থেকে ঝরে পড়ছে। ধপ করে সোফায় বসে পড়লো অরা। দশ মিনিটের ব্যবধানে প্রচুর ধকল গেছে তার মস্তিষ্কের ওপরে। প্রথমে নওশীনের ওই কড়া ভাষায় কথাগুলো। তার পরে আবার আরশাদের তাকে স্ত্রী বলে সম্বোধন করা।
আচ্ছা? আরশাদ কি মন থেকে তাকে স্ত্রী বলে সম্বোধন করলো? নাহ্! তা হয় না-কি? নিশ্চয়ই নওশীনকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্যে এমন কথা আরশাদ বলেছে। আরশাদ অরাকে নিজের সবথেকে ভালো বন্ধু বলে মনে করে। এর থেকে বেশি কিছুই না।
ডিভোর্সের মানে তো একে ওপরের থেকে চিরকালের জন্যে আলাদা হয়ে যাওয়া। অরা দেখেছে, আরশাদ ডিভোর্সের পর থেকে নওশীনকে নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামায় না। সে কী করলো, কোথায় গেল – এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই আরশাদের। তবে নওশীন তার একেবারেই বিপরীত। তার সকল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু যেন আরশাদ। অরা কথাকে আনতে যতবারই গাজীপুরে গেছে, ততবারই আরশাদকে ঘিরে হাজারো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে নওশীন তার দিকে। কিন্তু কেন? তাহলে কি নওশীন ডিভোর্সের পরেও ভুলতে পারেনি তাকে?
প্রকৃতপক্ষে পেরেছে। আরশাদের প্রতি ভালোবাসা জাতীয় কোনো অনুভূতি তার কাজ করে না। মূলত নিজের স্বার্থেই আরশাদের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি তার এত আগ্রহ। নওশীন আজও আশা করে, কোনো এক যাদুর বলে আরশাদ ফিরে যাবে তার জীবনে। আবারও নতুন করে সাজিয়ে দেবে তার ভেঙে পড়া ক্যারিয়ার। এজন্যেই অরার সঙ্গে আরশাদের আচমকা এই বিয়েটা তার মেনে নিতে এত কষ্ট হচ্ছে।
সূর্য ডুবে গেছে। তবুও খানিক উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। ছাদের দোলনায় ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে অরা। নওশীনের বলা কথাগুলো এখনো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না সে। সে না-কি চিরকাল আরশাদের জীবনে দ্বিতীয় নারী হয়েই রবে। আচ্ছা, অরা না হয় এক বছর পর চলে যাবে আরশাদের জীবন থেকে। কিন্তু আরশাদ যদি সত্যিকার অর্থেই কাউকে পছন্দ করে বিয়ে করতো? তাহলে কি তাকে এই একই কথা বলতো নওশীন?
জীবন কোনো প্রতিযোগিতা নয় যে প্রথম নারী জিতে যাবে, দ্বিতীয় নারী হারবে। আরশাদের জীবনের প্রথম নারী হয়ে কী করেছে নওশীন? তাকে ভালোবাসতে পেরেছে না-কি তার ভালোবাসার সম্মান করতে পেরেছে? এমন প্রথম নারী হওয়া কোনো গ্রৌরবের বিষয় বলে তো মনে হয় না।
আরশাদ ছাদে এলো। নিঃশব্দে এসে বসলো অরার পাশে। অরা মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই কয়েক মুহূর্তের জন্যে চোখাচোখি হলো দুজনের। তবে সেটা কয়েক মুহূর্তের জন্যেই। আরশাদের চোখদুটো আকাশের দিকে চলে গেল। অরাও তার দৃষ্টি অনুসরন করে তাকালো আকাশের দিকে। পশ্চিমের রক্তিম আকাশে এক ঝাঁক পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। এরা কোন পাখি? অরার জানতে খুব ইচ্ছা করছে। আরশাদকে জিজ্ঞেস করবে? না থাক। আরশাদের সঙ্গে নীরবতায় কাটানো এই মুহূর্তগুলো তার কাছে খুব দামী।
আরশাদ হুট করে নীরবতা ভঙ্গ করে শুকনো গলায় বলল, “তুমি মন খারাপ কোরো না অরা।”
অরা মলিন হাসি হেসে বলল, “না স্যার। মন খারাপ করছি না। ওই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর অনেক মানুষের অনেক কথা শুনতে হয়েছিল আমাকে। আমি মোটামুটি অভ্যস্ত।”
আরশাদ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “এই মানুষটাকে আমি ভালোবাসিনি জানো। মিথ্যা ছাড়া যে কথা বলতে পারে না, প্রতিটা মুহূর্তে মানুষের সামনে যাকে অভিনয় করতে হয়। এমন মানুষকে কে ভালোবাসবে? আমি যাকে ভালোবেসেছিলাম সে ছিলই একদমই আলাদা। Kind hearted and all. সময় মানুষকে বদলে দেয়। আমার ভালোবাসাটাই ভুল ছিল।”
“মানুষ তো আর ইচ্ছা করে কাউকে ভালোবাসে না। ভালোবেসে ফেলে।”
“তা ঠিক। ভুল মানুষকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। যার জন্য আজ পর্যন্ত রিগ্রেট করতে হয়।”
ভালোবাসার অনুভূতি যেমন সুখময়, তাকে হারিয়ে পাওয়া যন্ত্রণা ঠিক ততটাই তীব্র। ভালোবাসা হারিয়ে একদল মানুষ মনে করে, আমার ভালোবাসা যদি ফিরে আসতো! আর আরেকদল মনে করে, ওই ভালোবাসা যেন জীবনেও ফিরে না আসে। আরশাদ দ্বিতীয় দলের সদস্য। ভালোবাসা নামক অনুভূতিটা যদিই সুন্দর হোক না কেন, এ জীবনে একবার ভালোবেসে যে পরিমাণ যন্ত্রণা তাকে সহ্য করতে হয়েছে তাতে তার ভালোবাসার শখ মিটে গেছে।
আরশাদ হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “অরা শোনো, তুমি কখনো ভুল মানুষকে ভালোবাসবে না।”
“কী করে বুঝবো কেউ ভুল না ঠিক?”
“বোঝা যায়। এসব ক্ষেত্রে প্রতিটা মানুষের একটা সিক্সথ সেন্স কাজ করে।”
“আপনার করেনি?”
“করেছিল। কিন্তু নিজের সিক্সথ সেন্সকে নিজেই পাত্তা দিইনি।”
অরা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “বুঝলাম না।”
“নওশীনের ছোট ছোট কিছু ব্যাপার ছিল, যেগুলো সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে তেমন বড় কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু ওই ছোট ছোট সমস্যাগুলোই পরবর্তীতে ভয়ানক রূপ নেয়।”
“যেমন?”
আরশাদ খানিক ভেবে বলল, “যেমন ও আমার কাজে কখনো অ্যাপ্রিশিয়েট করতো না। আমার কোনো সিনেমা হিট হলে বা দর্শকের প্রশংসা পেলে ও কখনো তা পছন্দ করতো না।”
অরা অবাক কণ্ঠে বলল, “সে কী?”
“হুঁ। তারপর আবার, যখনই শুটিংয়ের সময় আসতো তখনই কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যেত। আমার মনে হতো শুটিংয়ে গিয়ে বিরাট কোনো অন্যায় করছি।”
“এটা কেমন কথা স্যার? কাজ তো মানুষকে করতেই হবে। কাউকে অসম্ভব ভালোবাসলেও নিজের সবটুকু সময় তাকে দেওয়া সম্ভব নয়।”
“আমার কী মনে হয় জানো?”
“কী?”
“ওর ভেতরে এক ধরনের জেলাসি কাজ করতো।”
“জেলাসি?”
“হুঁ। স্বামী-স্ত্রী একই ফিল্ডে কাজ করলে এমন জেলাসির সৃষ্টি হতে পারে। আমি প্রতিনিয়ত শুটিং করছি, আমার সিনেমা হিট হচ্ছে। অথচ তখন নওশীন সেরকম কাজ করছিল না। ওর সিনেমাগুলোও সেভাবে ব্যবসাসফল হচ্ছিল না। তাই হয়তো এধরনের জেলাসি ওর ভেতরে কাজ করতো।”
“হয়তো।”
আরশাদ প্রসঙ্গ পাল্টাবার উদ্দেশ্যে বলল, “বাদ দাও! আমি ওকে নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। তার কোনো অস্তিত্ব আমার জীবনে নেই। তোমাকে যেতে হবে না, কাল আমি গিয়ে কথাকে নিয়ে আসবো।”
অরা শুকনো এক ঢোক গিলে বলল, “এতটা পথ আপনি ড্রাইভ করবেন।”
“না, জহির সঙ্গে যাবে। আচ্ছা আমার ড্রাইভিং নিয়ে তোমার এত ভয় কেন বলো তো? আমি তো আগে থেকে ভালো ড্রাইভ করি।”
“তাও ভয় লাগে স্যার। সেবার অ্যাকসিডেন্ট করে কী একটা অবস্থা! মনে নেই? হাতে-পায়ে কতগুলো সেলাই লেগেছিল।”
“একটা অ্যাকসিডেন্ট করেছি বলে কি ড্রাইভিং করাই ছেড়ে দেবো? ওই অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকেই তো আরও ভালো করে ড্রাইভিং শিখলাম।”
“তবুও, আপনার ড্রাইভিংয়ে আমার ভরসা নেই।”
“তাহলে তো এখন থেকে তুমি বাইরে গেলেই আমাকে ড্রাইভ করতে হবে।”
“ভয় দেখাচ্ছেন আমাকে?”
“তুমি ভয়ও পাও না-কি?”
আচমকা হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটে। খিলখিল করে হেসে উঠেছে মেয়েটা। আরশাদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই হাসির দিকে। আজ সারাদিন পর অরার ঠোঁটে প্রকৃত হাসি দেখলো সে। এই হাসিটাতেই তাকে সবথেকে ভালো মানায়।
(চলবে)