#ফিরে_আসা
৪০
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
বহুকষ্টে এত বছর পর তিতলির নম্বর খুঁজে পেয়েছে নওশীন। এই তিতলি মেয়েটা ঢাকায় একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি চালায়। মানুষের প্রয়োজনে গোয়েন্দা সরবরাহ করা তার কাজ। নাটক-সিনেমায় আমরা দেখি কোনো খুন-খারাবি হলে এসব গোয়েন্দা কোথা থেকে যেন উদয় হয়ে অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও দক্ষতার সঙ্গে খুনিকে খুঁজে বের করে। বাস্তবে এমন হয় না। তিতলির এজেন্সির প্রধান ক্লাইন্ট বিবাহিত মানুষেরা। কখনো স্বামী স্ত্রীর পেছনে গোয়েন্দা লাগায়, কখনো স্ত্রী স্বামীর পেছনে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য – ডিভোর্সের আগে বিয়েটা যখন টিকে ছিল, নওশীন তখন একবার আরশাদের পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছিল। আরশাদ তাকে যে সময় দিচ্ছে না, সেই সময়গুলো কি অন্য কাউকে দিচ্ছে না-কি আসলেই শুটিং নিয়ে ব্যস্ত, এই কৌতূহল মেটানোর জন্যে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। আরশাদ সর্বক্ষণ দুজন বলশালী বডিগার্ড নিয়ে ঘোরাফেরা করে। তারা ওই গোয়েন্দাকে ধরে ফেলে। গোয়েন্দা বেচারা ভয়ের মুখে নওশীনের নাম বলে দেয়।
আরশাদ বরাবরই চাইতো তাদের সম্পর্কটা টিকে যাক। যখন জানতে পারলো নওশীন তাকে সন্দেহ করে তার পিছে গোয়েন্দা লাগিয়েছে, তখন গিয়ে নওশীনকে প্রশ্ন করেনি। ভেবেছে ভুলটা তার নিজেরই। সে সময় দিতে পারে না বলেই হয়তো নওশীন তাক সন্দেহ করছে। এজন্যেই মানুষকে অতিরিক্ত ক্ষমা করতে নেই। তারা প্রশয় পেয়ে যায়।
ফোন রিসিভ করেই তিতলি একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, “নওশীন ম্যাম! কতদিন পর কথা হচ্ছে আমাদের। কেমন আছেন?”
নওশীন গম্ভীর গলায় বলল, “ভালো। আমার একটা কাজ করে দিতে হবে তিতলি।”
তিতলি হাসিমুখে বলল, “অবশ্যই করবো। আপনার সেবার জন্যেই তো আমরা বসে আছি। বলুন কী করতে হবে? আবারও আরশাদ স্যারের পেছনে গোয়েন্দা লাগাতে হবে?”
নওশীন বিরক্ত গলায় বলল, “আমি কি সেই কথা বলেছি?”
“জি না।”
“একজনের সম্পর্কে কিছু ইনফরমেশন জোগাড় করতে হবে।”
“কার সম্পর্কে ম্যাম?”
নওশীন ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “মেয়েটার নাম আফরোজা অরা। ব্র্যাক ইনিভার্সিটিতে ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়ছে। আর…”
নওশীনের কথার মাঝপথেই তিতলি হতবাক গলায় বলল, “উনি আরশাদ স্যারের ওয়াইফ না?”
নওশীন চুপ করে রইল। অরাকে সে আরশাদের স্ত্রী হিসেবে এখনো মেনে নিতে পারেনি। কখনো মানতে পারবেও না। মেয়েটার কোনো যোগ্যতা আছে না-কি আরশাদ হকের স্ত্রী হবার?
তার নীরবতা লক্ষ্য করে তিতলি ভদ্রভাবে বলল, “কী ধরনের ইনফরমেশন চাচ্ছেন ম্যাম? স্পেসিফিকালি বললে আমাদের সুবিধা হতো।”
“মেয়েটা বড় হয় গ্রামে, বছর পাঁচেক আগে ঢাকায় এসেছে। ঢাকার আসার পর থেকে ওর জীবনে কী কী ঘটেছে সব ইনফরমেশন চাই আমার। কাজের বাইরে সে কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে – এভরিথিং।”
“ঠিক আছে ম্যাম। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।”
নওশীন দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “I want them as soon as possible. আর একটা কথা, আমি যে ওর সমন্ধে ইনফরমেশন চেয়েছি এটা যেন কেউ জানতে না পারে।”
ফোন কেটে নওশীন মেঝের দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। তার চোখদুটো দিয়ে যেন অগ্নি ঝরছে। ওই মেয়ের শেষ সে দেখে ছাড়বে। কত বড় সাহস, আরশাদের জীবনে জায়গা দখল করতে এসেছে! নওশীনের মতে আরশাদের জীবনে যদি কোনো নারীর প্রবেশের অধিকার থাকে, তবে সেটা আছে শুধুমাত্র তারই।
পুরো পাঁচতলা বিল্ডিং ফাঁকা পরে আছে। কোনপ্রকার ফার্নিচার না থাকায় কথা বললে বাড়ি খেয়ে আবারও তা ফিরে আসছে। অরা অবাক হয়ে দেখছে জায়গাটা। ফাঁকা বিল্ডিং দেখার কিছু নেই, তবুও তার আগ্রহ যেন কমছেই না। অরা ঘুরে ঘুরে দেখছে, আর তার পেছনে আরশাদ। আরশাদ এর আগেই বিল্ডিংটা দেখেছে, তার আর নতুন করে দেখার কিছু নেই। সে দেখছে অরার বিস্ময়।
অরা হতবিহ্বল গলায় বলল, “এই পুরো বিল্ডিংটা আপনি কিনে ফেলেছেন?”
আরশাদ স্বাভাবিক গলায় বলল, “হ্যাঁ। ভেবেছিলাম জায়গা কিনে নিজের মতো করে বিল্ডিং তৈরি করবো, কিন্তু তাতে অনেক সময় নষ্ট হতো। কেন? তোমার পছন্দ হয়নি?”
এই বিল্ডিংয়ে আরশাদের প্রোডাকশন হাউজের অফিস তৈরি করা হবে। আরশাদ হক প্রযোজকের খাতায় নাম লেখাতে যাচ্ছে এই খবরে ইন্ডাস্ট্রি এখন সরগরম। কয়েকদিন হলো আরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে মিডিয়ায় জানিয়েছে বিষয়টা।
অরা বলল, “এই বিল্ডিং কারো পছন্দ না হয়ে পারে?”
“একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির অফিস ছিল এই পুরো বিল্ডিংটায়। আমরা চাইলে ভেঙেচুরে নিজেদের মতো ইন্টেরিয়র করতে পারবো। আমি তো আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছি – নিচতলায় থাকবে আমাদের মেইন রিসিপশন, ওয়েটিং রুম আর কিছু সেট। দোতলার পুরোটা জুড়ে শুটিংয়ের বিভিন্ন সেট। তিনতলার এক অংশ কনফারেন্স আর মিটিংয়ের জন্যে। আরেক অংশে স্টাফরা কাজ করবে। চারতলার পুরোটাই স্টাফদের জন্য। আর পাঁচতলায় মেইন মেইন অফিস রুমগুলো। যেমন তোমার রুম, আমার রুম।”
অরা বিস্ময় নিয়ে বলল, “স্যার? আপনি সত্যিই আমাকে এত বড় একটা দায়িত্ব দিতে যাচ্ছেন।”
আরশাদ ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “তোমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না?”
“সত্যি বলতে কী, না। আমার কী সেই যোগ্যতা আছে?”
“আমি তোমাকে অনেক কনফিডেন্ট মেয়ে বলে মনে করতাম অরা। আর এই তোমার কনফিডেন্সের অবস্থা?”
অরা কোমল স্বরে বলল, “কনফিডেন্স আছে, তবে এতটাও নয় যে এতবড় কোম্পানি সামলাবো। আমার খুব ভয় করছে স্যার।”
আরশাদ আশ্বাস দিয়ে বলল, “শুধু শুধু ভয় করছো অরা। আমার বিশ্বাস সবকিছু পারফেক্টলি সামলে নিবে তুমি। আর ছোটখাটো কোনো ভুল হয়ে গেলে তা শুধরে দেওয়ার জন্যে আমি তো থাকবোই।”
অরার গা বেয়ে শীতল হাওয়া বয়ে গেল। আরশাদ তাকে পাশে থাকার আশ্বাস দিচ্ছে? এই আশ্বাসের জন্যেই যেন বহুকাল অপেক্ষা করে ছিল সে। আচ্ছা? আরশাদ কি ঠিক এভাবেই তার পাশে থাকবে আজীবন? যদি কোনো কারণে দূরে সরে যায়। তবে তো তা কোনো ক্রমেই সহ্য হবে না অরার।
বাইরে জহির গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে অরা যেই গাড়ির কাছে যাবে, তখনই আরশাদ বলে উঠলো, “অরা! চলো এক কাজ করি। আজ রিকশায় করে বাড়ি ফিরি।”
অরা অবাক হয়ে বলল, “আপনি উঠবেন রিকশায়?”
সুপারস্টার আরশাদ হক সাধারণ মানুষের মতো রিকশায় ঘোরাঘুরি করছে এই দৃশ্য একেবারেই হজম করার মতো নয়। তাকে রিকশায় দেখলে হাজারো মানুষের ভীড়ে জমে যাবে, রাস্তায় জ্যাম বেঁধে যাবে। তাই আরশাদ বহু বছর হলো রিকশায় ওঠে না। তবে আজ কেন জানি মনের ভেতর থেকে এই ইচ্ছাটা জেগে উঠলো।
গাড়ির কাছে গিয়ে আরশাদ নিজের সানগ্লাস আর একটা মাস্ক বের নিলো। দুটোতে নিজের চেহারা পুরোপুরি ঢেকে ফেলল সে। ভালো করে খেয়াল করলেও বোঝা যাবে না রাস্তা দিয়ে আরশাদ যাচ্ছে।
রাত তেমন হয়নি। আটটার মতো বাজে। ঢাকাবাসীর ব্যস্ততা এখনই শেষ হয়ে যাবার কথা নয়। তবুও আজ রাস্তা কোনো কারণে ফাঁকা। দুয়েকটা রিকশা দেখা গেলেও খুব একটা যানবাহন নেই। ভালোই হলো। একে তো অন্ধকার তার ওপরে জনমানবশূন্যতা। কারোর আরশাদ চিনে ফেলার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।
রিকশা অরাই ঠিক করলো। বাংলাদেশের সবগুলো রিকশার বসার জায়গাটার সাইজ একই রকম নয়। কোনটায় বেশি জায়গা থাকে আবার কোনোটায় কম। বেছে বেছে আজকের রিকশাটার বসার জায়গাই কম হতে হলো। এসব রিকশা একজনের জন্যে উপযুক্ত। দুজন বসতে হলে চাপাচাপি করে বসতে হবে।
আরশাদ আগে রিকশায় উঠে বসলো। অরা উঠে বসতেই খেয়াল করলো জায়গা স্বল্পতার কারণে সে বসেছে আরশাদের গা ঘেঁষে। কী সর্বনাশের ব্যাপার! এক নিমিষেই অরার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। আরশাদের এতটা কাছকাছি কখনো বসেনি সে। অন্য সময় হলে অরা ভাবতো এটাই তো স্বাভাবিক। রিকশায় জায়গা নেই তাই বসতে গেলে গায়ের সঙ্গে গা লেগে যেতেই পারে। তবে আজ বিষয়টাকে কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না অরা। লজ্জায় তার গাল দুটো রক্তিম হয়ে এসেছে। অরা সাবধান আরশাদের কাছ থেকে সরে বসার চেষ্টা করলো।
আরশাদ হঠাৎ ধমকের সুরে বলল, “কী করছো? পড়ে যাবে তো! এদিকে সরে এসো!”
আরশাদের এক ধমকে অরা হিমবাহের মতো জমে ঠিক আগের জায়গাতেই বসে রইল। অনবরত আরশাদের শরীরের স্পর্শ তাকে ভেতরে প্রবল তুফান সৃষ্টি করছে। নিজেকে কেমন এলোমেলো লাগছে অরার।
অস্বস্তিকর এই পরিবেশ কিছুটা সহজ করার জন্যে অরা নিজেই বলল, “আপনাকে এই প্রথম রিকশায় উঠতে দেখলাম।”
আরশাদ রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “কত বছর পর যে রিকশায় উঠলাম নিজেই জানি না। অথচ একটা সময় ছিল, প্রতিদিন রিকশায় যাতায়াত করতাম। একবার স্টারলাইফে পা রাখলে আর সহজে সাধারণ জীবনে ফিরে যাওয়া যায় না। সাধারণের মতো কাজ করা যায় না।”
“কখনো কখনো এমন ছদ্মবেশ নিয়ে রিকশায় উঠলেও তো পারেন!”
“এখন আর কত অ্যাডভেঞ্চারের শখ নেই।”
অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “আমি বললে আসবেন?”
পরমুহূর্তেই মনে হলো বিরাট বোকামি হয়ে গেছে। কী মনে করে সে আরশাদকে এমন প্রশ্ন করলো কে জানে? সে বললে কেন ছদ্মবেশ নিয়ে রিকশায় ঘুরতে আসবে আরশাদ? তার কী দায় পড়েছে?
অরাকে আশ্চর্যের চূড়ায় পৌঁছে দিয়ে আরশাদ বলল, “আসবো।”
আরেকদফায় এলোমেলো হয়ে গেল অরার অন্তরাত্মা। আরশাদ কেন এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে তাকে? এই গুরুত্ব তো দিন দিন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।
আরশাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বলল, “আজ চাঁদ-টাঁদ নেই না-কি?”
অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “উহুঁ, অমাবস্যা। চাঁদ থাকলে ভালো হতো। রিকশায় ঘুরতে ঘুরতে চাঁদ দেখা যেত।”
“সবাই শুধু চাঁদের প্রশংসাই করে। অথচ খেয়াল করেছ? অমাবস্যার অন্যরকম একটা সৌন্দর্য আছে?”
অরা কতক্ষণ আকাশের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে বলল, “তাই তো!”
আরশাদের এই গুণটা অরাকে সবথেকে বেশি মুগ্ধ করে। সাধারণের সঙ্গে তার চিন্তাধারা সমরেখায় চলে না। এজন্যেই তো সাধারণের থেকে সে এতটা আলাদা, এতটা অনন্য।
পোড়া পোড়া একটা গন্ধ নাকে এসে লাগায় চোখ মেলে তাকালো অরা। যা দেখলো তা দেখার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। বাড়িতে আগুন ধরেছে। পাশের ঘরটায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুনের তীব্রতায় চোখের সামনে জানালাটা ভেঙে পড়লো। প্রচন্ড ধোঁয়ায় অরার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চোখ জ্বালাপোড়া করছে। আগুন লাগলো কী করে? তার থেকেও বড় কথা আগুন লাগার পর কেউ তাকে ডাকলো না? সে ওভাবেই পড়ে ছিল?
পাশের ঘর থেকে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। যেখনো সময় এ ঘরে ঢুকে পড়বে। স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনার পর্যায়ে রইল না অরার মস্তিষ্ক। ভয়ে-আতঙ্কে তার পুরো শরীর হিম হয়ে গেল। এখন সে কী করবে? কী করে বাঁচাবে নিজেকে?
এক মুহূর্তও অপচয় না করে উঠে দাঁড়ালো অরা। বাড়ির মূল দরজা পাশের ঘরের সঙ্গে। ওখানে যাওয়ার উপায় নেই। তবে তার এই ঘরটা থেকেও বাড়ির পেছন দিকে যাওয়া যায়। অরা ছুটে গিয়ে দরজাটা খোলার চেষ্টা করছে, তবে পারছে না। কেউ যেন বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে রেখেছে তাকে। অরা বিকট শব্দে আর্তনাদ করছে, বাইরে যাওয়ার আকুতি করছে – কেউ তার ডাক শুনতে পাচ্ছে না।
আগুন এ ঘরে আসতে শুরু করেছে। ধোঁয়ার মাত্রা আরও বেড়ে গেল। অরার মনে হচ্ছে আগুন গায়ে এসে লাগার আগে এই ধোঁয়ার তীব্রতাতেই সে মরে যাবে। হঠাৎ তার মনে পড়লো জানালাটার কথা। জানালা খুলতেই অরা দেখতে পেল বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তার নতুন মা। তার পাশে দাঁড়িয়ে তার ছোট ছোট ভাইরা।
অরা চিৎকার করে বলল, “নতুন মা! আমাকে বের করো!”
আয়েশা মুখ বিকৃত করে বললেন, “তোর তো মাইয়ারে বাইর করমু আমি? ক্যান রে ছেমরি? বাপের মুখ কালা কইরা পালানের সময় মনে ছিল না? অহন তুই পুইড়া মরবি। এইটাই তোর শাস্তি।”
আগুন একটু একটু করে এগিয়ে আসতে অরার দিকে। সে আকুতির স্বরে বলল, “আমাকে বাঁচাও নতুন মা!”
নতুন মা আর কিছুই বলল না। একগাল হেসে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর মুখেও হাসির ছড়াছড়ি। যেন অরাকে পুড়ে মরতে দেখে তাদের খুব আনন্দ হচ্ছে। অরা অনবরত চিৎকার করে এই বদ্ধ ঘর থেকে রেহাই পাবার চেষ্টায় ব্যস্ত। তার আর্তনাদ আর কারও কানে পৌঁছাতে পারলো না। তার আগেই আগুন এসে স্পর্শ করলো তাকে।
বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠে বসলো অরা। দুঃস্বপ্ন! এটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। মানুষের দুঃস্বপ্ন এতটা ভয়াবহ হতে পারে? ওদিকে অরার চিৎকারের আওয়াজ এতটাই প্রবল ছিল যে তা দোতলায় আরশাদের কানে গিয়ে পৌঁছলো। আরশাদ এখনো ঘুমায়নি। পরবর্তী শুটিংয়ের স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসেছিল। সে বুঝতে পারছে চিৎকারটা অরারই। শুধু শুধু একটা মেয়ে এমন চিৎকার করবে না? অরা ঠিক আছে তো? বিচিত্র এক উদ্বেগ খেলে গেল আরশাদের মনে। অরাকে নিয়ে তার উদ্বেগ যেন দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।
স্ক্রিপ্ট বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো আরশাদ। এভাবে হাত গুটিয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। একবার গিয়ে মেয়েটাকে দেখে এলে তো ক্ষতি নেই।
দরজায় টোকা পড়লো। বিছানায় বসে এখনো রীতিমত কাঁপছে অরা। তার পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে। অরা বুঝতে পারলো আরশাদ এসেছে। এ বাড়িতে তারা দুজন ছাড়া এই মুহূর্তে কেউ নেই।
অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “আসুন স্যার।”
আরশাদ ঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে চিন্তিত গলায় বলল, “অরা? চিৎকারটা তুমি করেছিলে?”
অরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।
আরশাদ এসে অরার পাশে বসতে বসতে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “কী হয়েছে তোমার?”
অরা কিছু বলতে পারছে না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আরশাদের দিকে। আরশাদ হক, যে মানুষটা পৃথিবীর কাউকে তোয়াক্কা করে না সে কেন এসে খোঁজ নিচ্ছে তার। ওই দুঃস্বপ্নের মতো অরা যদি সত্যি সত্যি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, তাতে তার কী? এই ভয়ঙ্কর মুহূর্তটায় নিজের পাশে একেবারেই আরশাদকে আশা করেনি অরা। তার ওপরে তার এই মায়াময় উদ্বেগ দেখে যেন অরার চোখে জল চলে এলো।
আরশাদ ব্যস্ত গলায় বলল, “কী আশ্চর্য! কাঁদছো কেন? কী হয়েছে?”
অরা কম্পিত স্বরে বলল, “স্বপ্ন দেখেছি।”
“তাই বলে কাঁদতে হবে না-কি?”
“অনেক ভয়ঙ্কর ছিল স্বপ্নটা।”
আরশাদ বিছানার পাশের সাইড টেবিল থেকে পানিভর্তি গ্লাসটা নিয়ে অরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,“পানিটা খাও।”
অরা এক ঢোকে সমস্ত গ্লাসের পানি শেষ করে ফেলল। তবুও তার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠছে।
অরা এলোমেলো গলায় বলতে লাগলো, “জানেন স্যার, পৃথিবীর কাছে আমি নিজেকে দেখাই একজন সাহসী মেয়ে হিসেবে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি প্রচন্ড ভীতু। ভয় আমাকে শেষ করে দেয়। আমার এই সিক্রেটটা পৃথিবীর কেউ জানে না। আপনাকে জানালাম।”
আরশাদ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো।”
অরা অবাক গলায় বলল, “কোথায়?”
“ওপরে, আমার পাশের রুমটায়। এখন থেকে ওখানেই থাকবে।”
“কিন্তু…”
“উফ! চলো তো অরা। এখানে একা একা থাকলে আরও ভয় পাবে।”
আরশাদের পাশের ঘরে এসে অরার ভয়টা অনেকাংশেই কেটে গেল। সে তো ভেবেছিল আজ রাতে আর ঘুমই হবে না। ভয়ে- আতঙ্কে নির্ঘুম কাটাতে হবে বাকিটা রাত। তবে ভাগ্যক্রমে বিছানায় শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দুচোখে ঘুম জড়িয়ে এলো। এতটা স্বস্তির ঘুম তার বহুদিন হয়নি। বারবার মনে হচ্ছে, তার কিচ্ছু হবে না। দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেলেই তো পাশের ঘর থেকে ছুটে আসবে ওই মানুষটা।
(চলবে)
[কালকের দিনটা যে কী ছিল! কলেজে ভর্তির ফর্ম তোলার পর আমার দিনটা কাটে আত্মীয়-স্বজনদের ফোন রিসিভ করতে করতে। ভালো কথা, অনেকে জানতে চাচ্ছিলেন কোন কলেজে চান্স পেয়েছি। আমি দেশের স্বনামধন্য কলেজ হলিক্রসে চান্স পেয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। এই কলেজে পড়াশোনা করার স্বপ্নটা অনেক দিনের ছিল। অবশেষে পূরণ হলো। কালকের ক্লান্তিময় দিন শেষ হলেও ওদিকে গল্পের টেনশনে আমার ঘুম হয় না। রাত দুইটায় ঘুম ভাঙে। আজকের পর্বটা লিখে তিন ঘন্টা পর আবারও ঘুমিয়ে পড়ি। আরশাদ আর অরাকে এখন কেমন লাগছে আপনাদের? আপনাদের রেসপন্সের অপেক্ষায় রইলাম। ❤️]