ফিরে_আসা ৪২+৪৩ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
809

#ফিরে_আসা
৪২+৪৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

“ওমা! কত সুন্দর ফুল!” একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে মুগ্ধ ভঙ্গিতে বলল অরা।

তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আরশাদও তাকালো গাছটার দিকে। পুরোটা গাছ জুড়ে থোকায় থোকায় সাদা রঙের বিচিত্র এক ফুল ফুটে আছে। নাম না জানা ফুল। এর থেকে সুন্দর ফুল তো আরশাদের বাগানেই রয়েছে। এটা দেখে এত উচ্ছ্বাসের কী আছে? রাঙামাটির এই পাহাড়ে ঘেরা এলাকায় পা রাখার পর থেকে অরা যা দেখছে তাতেই চমকে হচ্ছে।

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “এটা সুন্দর ফুল হলো?”

অরা আরশাদের দিকে এমনভাবে তাকালো যেন সে ভিন্ন ভাষায় কিছু একটা বলেছে। যে ভাষাটা অরা জানে না।

“কী যে বলেন আপনি! কত সুন্দর ফুলগুলো! আমাকে একটা পেড়ে দিন না।”

হাজার বিরক্ত সত্বেও গাছ থেকে এক থোকা ফুল পেড়ে দিল আরশাদ। অরার উচ্চতা মোটামুটি ধরনের। তবুও তার হাত পৌঁছায় না গেছে। অথচ ছয় ফুট উচ্চতার আরশাদের পক্ষে এ যেন কোনো ব্যাপারই না। ফুলগুলো সাবধানে ক্লিপ দিয়ে চুলের সঙ্গে আটকে দিলো অরা।

হাসিমুখে আরশাদকে বলল, “একটা ছবি তুলে দিন তো!”

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “উফ অরা! দিন দিন বিরক্তিকর হয়ে যাচ্ছো তুমি।”

অরা আহত গলায় বলল, “ঠিক আছে তুলতে হবে না। আমার নিজের ফোন নেই না-কি?”

অরা হ্যান্ডব্যাগ থেকে তার ফোন বের করতে যাবে তার আগেই আরশাদ পকেট থেকে নিজের ফোন বের করে বলল, “আমি কি একবারও সে কথা বলেছি?”

আরশাদ বেশ অনেকগুলো ছবি তুলে দিলো অরা। মেয়েটা তার সঙ্গে যেখানেই যায়, সেখানেই ছবি তুলে দিতে বলে নিজের। পরে যে নিজ থেকে সেই ছবিগুলো চায় এমনটাও নয়। আরশাদও ফেলে দেয়নি একটা ছবিও। যত্ন করে রেখে দিয়েছে অরার সব ছবি নিজের মোবাইলে।

ছবি তোলা শেষে আরশাদ সেগুলো অরাকে দেখাচ্ছে। ছবি দেখতে দেখতে অরা বলল, “আপনাকে ছবি তুলতে বলার একটা কারণ আছে।”

“কী কারণ?

“কারণ আপনি সুন্দর ছবি তোলেন।”

আরশাদ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলল, “তোমার ছবি যে কেউ তুললেই সুন্দর হবে।”

অরা রীতিমত থতমত খেয়ে গেল। এই কথার মানে কী? আরশাদ আবারও তাকে সুন্দর বলল? লজ্জায় তার গাল দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।

অরাকে সহজ করার জন্যে আরশাদ বলল, “চলো, ওই জায়গাটায় গিয়ে বসি।”

আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে বেয়ে দুজনে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে পড়েছে। রাস্তাটা খুবই বিপদজ্জনক। সামান্য অসাবধানতার কারণেও যে কেউ নিচে পড়ে যেতে পারে। অরা সেজন্যেই সাবধানে পা ফেলছে। বাড়তি সতর্কতার কারণ গতকাল এখানে বৃষ্টি হয়েছে। যদিও আজ মাথার ওপরে কড়া রোদ, তবুও রাস্তার কিছু কিছু অংশ এখনো পিচ্ছিল হয়ে রয়েছে। অরা সামনে হাঁটছে আর আরশাদ তার পিছু পিছু। দুজনের মুখেই কোনো কথা নেই। একবার এই রাস্তাটা পাড় করে যেতে পারলেই যেন বেঁচে যায় তারা।

অরা যে ভয়টা করছিল সেটাই সত্যি হলো। হাজার সাবধানতা সত্বেও একটা পিচ্ছিল জায়গায় তার পা পড়ে গেল। পা পিছলে পড়ে যাবে ঠিক তখনই আরশাদ পেছন থেকে তার ডান হাতটা খপ করে ধরে ফেলল।

আরশাদ উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “সাবধানে অরা! এক্ষুনি তো পড়ে যেতে।”

নিজেকে সামলে অরা সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “সরি! বুঝতেই পারিনি জায়গাটা এমন পিচ্ছিল।”

“সাবধানে হাঁটো।”

অরা নিজেকে সামলে নিলেও আরশাদ তার হাতটা এখনো শক্ত করে ধরে রইল। পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত তার রেহাই নেই। আরশাদের এই স্পর্শে বিচিত্র এক ভরসা খুঁজে পাচ্ছে অরা। এই হাতটা ধরে এক জীবন কাটিয়ে দিতে যেন কোনো অসুবিধাই হবে না।

এত ঝামেলা পোহানোর পর পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানো সার্থক হলো। এখান থেকে পুরো গ্রামটা দেখা যায়। পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট একটা গ্রাম। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট বাঁশের তৈরি ঘর। মারমা সম্প্রদায়ের বসবাস এ এলাকার। এরা সকলের পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। পরিবারের সকলে মিলে কুটির শিল্পের বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে। দেখা যাচ্ছে ওই ছোট্ট ঘরের উঠানে তারা সকলে বসে বাস দিয়ে কী যেন তৈরি করছে। সূর্যের তীব্রতায় পুরো গ্রামটা যেন ঝলমল করছে। অসম্ভব সুন্দর একটি দৃশ্য!

অরা তাকালো আরশাদের দিকে। আরও একটা সুন্দর দৃশ্য যে তার জন্যে অপেক্ষা করছিল কে জানত! কফি রঙের শার্ট আর কালো জিন্সে আজ তাকে বেশ মানিয়েছে। চোখের ওপরে খয়েরী রঙের সানগ্লাস। কতগুলো চুল এসে পড়েছে তার চোখের সামনে। এই দৃশ্য এক পলক দেখার জন্যেও যে কেউ হাজার বছর তপস্যা করতে পারে। অরার মনে সুপ্ত একটা ইচ্ছা জেগে উঠলো। ইচ্ছা করছে আরশাদের চোখের সামনে পড়ে থাকা চুলগুলো আলতো স্পর্শে সরিয়ে দিতে। কিন্তু শেষমেশ সেই ইচ্ছাটা সে দমিয়েই রাখলো।

পাহাড়ের এই চূড়ায় বসার জন্যে সুন্দর একটা জায়গা আছে। বেতের তৈরি একটা প্রশস্ত বেঞ্চ। তার ঠিক ওপরেই একটা ছাতা। এই ব্যবস্থা সম্ভবত গ্রামবাসীদেরই করা। আরশাদ এবং অরা গিয়ে বসলো সেখানে। কেটে গেল প্রশান্তিময় নীরবতার হাওয়া।

অরা হঠাৎ ঝলমলে ভঙ্গিতে বলল, “Thank you.”

“কেন?”

“এত সুন্দর একটা জায়গায় আমাকে নিয়ে আসার জন্যে। আমি কখনো এত সুন্দর জায়গায় আসিনি।”

“You’re welcome.”

“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে এর আগেও এখানে এসেছেন।”

“হুঁ এসেছি তো। তবে ঠিক এখানে না, এখান থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে একটা জায়গা আসে। সেখানে একবার এসেছিলাম।”

“কবে?”

আরশাদ শুকনো গলায় বলল, “ডিভোর্সের পর পর।”

অরার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এই সুন্দর মুহূর্তে এই প্রসঙ্গটা কেন এলো? না এলেই তো ভালো হতো। দোষটা তারই। কেন জিজ্ঞেস করতে গেল কবে এসেছে আরশাদ?

আরশাদ আবারও গম্ভীর মুখে বলতে লাগলো, “ওই সময়টা আমার খুবই অস্থিরতায় কেটেছিল। পত্র-পত্রিকায় আমাকে নিয়ে একের পর মিথ্যা আর্টিকেল লেখা হচ্ছে, ইন্টারনেটে সবাই আজেবাজে কথা বলছে, পরিচিত সল্প-পরিচিত সবাই অনবরত ফোন করে যাচ্ছে। এসব থেকে বাঁচতে এখানে এসেছিলাম। লাভ হয়নি। বরং অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়।”

অরা অনুতপ্ত স্বরে বলল, “I’m sorry, আমার এই প্রসঙ্গটা তোলা উচিত হয়নি।”

আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “তুমি কোথায় প্রসঙ্গটা তুললে? আমিই তো তুললাম।”

সানগ্লাসটা খুলে আরশাদ তাকালো আকাশের দিকে। সূর্যের কিরণ সরাসরি এসে পড়ছে তার মুখের ওপরে। তবুও চোখমুখ বিকৃত করছে না সে। অরা একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তার দিকে। তবে বেশিক্ষণ পারলো না। বেশিক্ষণ আরশাদের দিকে তাকিয়ে থাকলে তার চোখে জল চলে আসে। সে মানুষটার মনে সামান্যতম জায়গা পাওয়ার জন্যে হাজারো মেয়ে ছটফট করে, তার মনও কেউ ভেঙেছিল। কী করে সম্ভব?

আরশাদ হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে শান্ত স্বরে বলল, “তোমাকেও Thank you.”

অরা অবাক হয়ে বলল, “আমাকে? কেন?”

“উত্তরটা অনেক বড়। শুনবে?”

“আপনি বললে অবশ্যই শুনবো।”

আরশাদ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ডিভোর্সের পর থেকে আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে যায়। ঠিক ডিভোর্সের পর না, যেদিন জানতে পারলাম আমি যাকে ভালোবেসেছি সে আরেকজনের সাথে…”

কথাটা শেষ করতে যেয়েও শেষ করতে পারলো না আরশাদ।

আবারও বলতে শুরু করলো, “সেদিন থেকে। প্রতিদিন সকালে উঠে আমার কী মনে হতো জানো?”

অরা মায়ামাখা কণ্ঠে বলল, “কী?”

আরশাদ ব্যথিত কণ্ঠে বলল, “মনে হতো আমার ভালোবাসায় কি কোনো খুঁত ছিল? আমি তো মনের সবটুকু দিয়েই ভালোবেসেছিলাম তাকে। তাহলে কেন আমার সঙ্গেই এমন হলো?”

অরা আঁতকে উঠে বলল, “আপনার তো কোনো দোষ ছিল না।”

“আমি জানি, তখন বুঝতে পারতাম না। ডিভোর্সের পর তিন বছর জীবনটা একই জায়গায় আটকে ছিল। কাজ করেছি প্রচুর, কিন্তু নিজের জীবনটাকে উপভোগ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। তুমি নতুন করে আমাকে জীবন উপভোগ করা শিখিয়েছ।”

অরা আশ্চর্যের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে বলল, “আমি?”

“হুঁ, তুমি। এই কয়েক মাসে আমি তোমার ওপর অনেকটাই নির্ভর হয়ে গেছি। আমার মনে জমে থাকা কথাগুলো তোমার সাথে শেয়ার করে যতটা আরাম পাই, অন্য কারো সঙ্গে শেয়ার করলে তা পাবো না। Thank you again.”

কৃতজ্ঞটায় অরার চোখে জল চলে আসার উপক্রম হলো। আরশাদ কারণে অরা নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে শিখেছে। এটা সময়ে তার মনে হয় সে এই পৃথিবীতে এক গুরুত্বহীন জীব। তবে তার জীবনে আরশাদের উপস্থিতি যেন সবটা বদলে দিয়েছে।

অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “আপনাকে একটা কথা বলি?”

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “না। চুপ করে বসে থাকো।”

“আহা শুনুন না!”

“শোনাবেই যখন, তখন অনুমতি নেওয়ার দরকার কী?”

অরা খিলখিল করে হেসে বলল, “কথাটা বলি?”

“বলো।”

ঠোঁট থেকে হাসিটা মুছে ফেলে অরা আর্দ্র গলায় বলল, “ওই ঘটনার জন্যে কখনো নিজেকে দায়ী ভাববেন না আপনি। আপনার ভালোবাসায় কোনো খুঁত ছিল। শুধু ভাগ্যের বশে নিখুঁত ভালোবাসা পাননি।”

আরশাদ হালকা গলায় বলল, “তাতে কী? সুযোগ তো আর ফুরিয়ে যায়নি।”

কথাটার আগামাথা বুঝতে না পেরে অরা বলল, “হুঁ?”

“কিছু না, চলো ফিরে যাই। মেঘ করে আসছে। বৃষ্টি নামলে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ফিরতে অসুবিধা হবে।”

অরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো আসলেই আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। একটু আগেই না সূর্য ঝলমল করছিল? প্রকৃতি বড়ই অদ্ভুত! কখন যে কী করে নিজেকে বদলে ফেলতে পারে।

আরশাদ এবং অরা ফিরে যাচ্ছে তাদের কটেজে। এই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে কেউ তেমন একটা বেড়াতে আসে না। কোনপ্রকার হোটেলও তাই নেই। অনলাইনে বহু খোঁজাখুঁজির পর আরশাদ ওই কটেজটা পেয়েছে। পুরোটা কটেজই বাঁশের তৈরি, ওপরে টিনের ছাদ। তারা আজ সকালেই রাঙামাটিতে এসে পৌঁছেছে। এসেই খানিক ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে গেছে ঘুরতে।

ফেরার পথে অরা হাঁটতে হাঁটতে বলল, “আজ বৃষ্টি নামলে আমি কটেজের সামনে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজবো।”

আরশাদ প্রশংসার ভঙ্গিতে বলল, “তোমার সাহস আছে বলতে হবে!”

“কেন?”

আরশাদ রহস্যের হাসি হেসে বলল, “একবার বৃষ্টিতে ভিজে এতবড় কান্ড ঘটালে। আবারও ভিজতে চাইছো।”

সঙ্গে সঙ্গে অরার মনে পড়লো শেষবার বৃষ্টিতে ভিজে কী কান্ড ঘটিয়েছিল সে। বৃষ্টিতে ভিজেছিল বলেই তো অমন গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিল। আর অরা জ্বরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল বলেই এই বিয়ে।

অরা ভীত গলায় বলল, “তাই তো! না থাক তাহলে।”

আরশাদ ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “চাইলে ভিজতে পারো। এখানে তো আর সিসিটিভি ক্যামেরা নেই।”

“আবার যদি জ্বর আসে?”

“তাও ঠিক। ঘুরতে এসে জ্বরে পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না।”

বৃষ্টি নামলো সন্ধ্যার পর। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। কটেজের টিনের চালে শোনা যাচ্ছে বৃষ্টির শব্দ। এই কটেজে এক চিলতে বারান্দাও আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে অরা। বৃষ্টির পানি মাথায় পড়ে জ্বর আসার বাতিক না থাকলে অরা কখন নেমে পড়তো ভিজতে। তবে আজ সে কিছুতেই ভিজবে না। ঘুরতে এসে কেউ জ্বরে পড়ে থাকে না-কি? রাঙামাটিতে তারা থাকবে তিনদিন। একদিন তো আজই চলে গেল। বাকি দুটো দিন কিছুতেই নষ্ট হতে দেবে না অরা।

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময়ে বাঁধলো বড়সর বিপত্তি। একটা মাত্র শোবার ঘর, বারান্দা, বাথরুম আর উঠান নিয়ে এই কটেজে। শোবার ঘরেও একটাই বিছানা। এতকাল দুজনে থেকেছে আলাদা আলাদা ঘরে। আজ না-কি থাকতে হবে একই ঘরে। ভয়ে-উদ্বেগে অরার গা বেয়ে শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে।

আরশাদ আগেই গিয়ে শুয়ে পড়েছে বিছানায়। অরা অনিশ্চিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মাঝখানে। এ ঘরে একটা সোফা আছে, সেখানে গিয়ে শুয়ে পড়লে কেমন হয়?

আরশাদ হঠাৎ বলল, “কী ব্যাপার অরা? দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

অরা অনিশ্চিত গলায় বলল, “আমি কোথায় ঘুমাবো?”

আরশাদ মজার ছলে বলল, “উঠানে ঘুমাতে চাচ্ছো?”

“না।”

আরশাদ অত্যন্ত স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, “এত ড্রামা করার কিছু নেই। এখানে এসে শুয়ে পড়ো।”

অরা ইতস্তত করে বলল, “এখানে? কিন্তু…”

“এত ইতস্তত করার কী আছে অরা? তুমি তো একটা প্র্যাকটিকাল মেয়ে। এখানে ঘুমানো ছাড়া আর কোনো উপায় আছে? এই কটেজে তো আর অন্য কোনো ঘর নেই।”

“আপনার কোনো অসুবিধা হবে না?”

“আমার অসুবিধা হলে আমি নিজেই তোমাকে এখানে ঘুমাতে বলতাম?”

ভয়ে-লজ্জায় চুপসে অরা এসে শুয়ে পড়লো আরশাদের পাশে। নির্ঘাত আজ রাতে তার ঘুম হবে না। তার ঠিক পাশেই শুয়ে আছে আরশাদ। যে মানুষটাকে ঘিরে তার এতশত অনুভূতিরা খেলে বেড়ায়।

অরার গা থেকে মিষ্টি একটা সুগন্ধ আসছে। সুগন্ধ আবেশে একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে আরশাদ। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে তার। আরশাদ প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল, আচমকা তার ঘুম ভেঙে গেল অরার কারণেই। দুমিনিট পর পর এপাশ-ওপাশ করছে মেয়েটা।

আরশাদ ক্ষীণ বিরক্তি নিয়ে বলল, “উফ অরা! তুমি কি সারারাত এমন নড়াচড়া করেই কাটাবে।”

“এটা আমার অভ্যাস। আমার ঘুম না এলে আমি এমন এপাস-ওপাশ করি।”

“এমন নড়াচড়া করলে তো মুশকিল!”

“মাত্র কয়েকটা রাতেরই তো ব্যাপার। সহ্য করে নিন না!”

আরশাদ বিড়বিড় করে বলল, “মাত্র কয়েকটা রাতের ব্যাপার হলে তো হয়েই যেত।”

“কী?”

“কিছু না। ঘুমাও।”

পরদিন সকাল সাড়ে ছয়টা। পাখির কলরবে ঘুম ভেঙে গেল অরার। ঘুম ভাঙতেই ঠোঁটে ফুটে উঠলো হাসির রেখা। বহুকাল পর আজ এভাবে ঘুম ভাঙলো তার। ছোটবেলায় প্রতিটি সকাল তার পাখির কিচির-মিচির শব্দের মাঝেই শুরু হতো। শহরের যান্ত্রিকতার মাঝে তো আর সেই উপায় নেই।

আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই অরার খেয়াল হতো গত রাতে সে কার পাশে শুয়েছিল। তড়িৎ গতিতে পাশে তাকাতেই অরা লক্ষ্য করলো আরশাদ ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে। সামান্য পাখির ডাকে আরশাদের গাঢ় ঘুম ভাঙার কথা নয়।

অরা উঠে গিয়ে হিটারে গরম পানি বসিয়ে দিলো। এই কটেজে তেমন কোনো সুবিধা না থাকলেও এই হিটারটা আছে। পানি গরম হতে হতে অরা হাত-মুখ ধুয়ে এলো। নিজের জন্যে এক কাপ কফি বানিয়ে এসে বসলো উঠানে। স্নিগ্ধ একটা সকাল। অদ্ভুত একটা গন্ধে ছেয়ে আছে চারপাশটা। বৃষ্টির পর মাটির সোঁদা গন্ধ। এই গন্ধটা তো ঢাকাতেও পাওয়া যায়। তবে পাহাড়ি এলাকার মাটিতে যেন অন্যরকম একটা ব্যাপার আছে।

অরা কফি খাওয়ার মাঝে টের পেলো আরশাদ ঘুম থেকে উঠে কার সঙ্গে যেন ফোনে জরুরি কথা বলে আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছে না বিছানায় পড়ে আছে?একবার ঘুম ভেঙে গেলে আরশাদ তো আবার ঘুমিয়ে পড়ার মতো মানুষ নয়। আজ তার কী হলো?

অরা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “আপনি ঠিক আছেন?”

আরশাদ অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ।”

“তাহলে উঠছেন না কেন?”

আরশাদ ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল, “মাথা ব্যাথা করছে।”

অরা উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে বিছানায় আরশাদের পাশে বসতে বসতে বলল, “মাইগ্রেন উঠেছে?”

“হ্যাঁ।”

অরা আঁতকে উঠে বলল, “সে কী? আমাকে বলবেন না?”

অরা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ব্যাগ থেকে আরশাদের ওষুধগুলো বের করলো। ভাগ্যিস মনে করে এগুলো নিয়ে এসেছিল সে।

অরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “নিন! ওষুধগুলো খেয়ে নিন তো।”

আরশাদ উঠে বসতে বসতে বলল, “ওষুধের কথা মনে ছিল তোমার?”

অরা পানির গ্লাস আরশাদের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, “হুঁ। আপনার মাইগ্রেন তো আর বলে কয়ে আসে না। হুট করে চলে আসে।”

“Thank you.”

অরা সামান্য ভ্রু কুঁচকে বলল, “ছোট ছোট বিষয়ে থ্যাংক ইউ বলতে হবে না। এটা আমার দায়িত্ব।”

আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “মোটেই না। ম্যানেজার হিসেবে তোমাকে দায়িত্ব আমার কাজগুলোকে গুছিয়ে রাখা। দুদিন পর যখন আমার প্রোডাকশন হাউজ সামলাবে তখন তোমার দায়িত্ব হবে ভিন্ন কিছু। মনে করে আমার ওষুধ নিয়ে আসা তোমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।”

অরা তার মায়ামাখা কণ্ঠে বলল, “আপনার জন্যে চিন্তা হয়। নিজে তো মনে করে ওষুধটা আনবেন না।”

“তোমার চিন্তা হয়? কেন?”

“উফ! অমন তীব্র মাথা ব্যাথা নিয়ে কেউ বলে এত কথা বলে। আপনি চুপ করে থাকুন তো।”

আরশাদ আবারও শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, “অরা?”

“হুঁ?”

আরশাদ অরার চোখের দিকে তাকিয়ে কোমল স্বরে বলল, “আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেবে?”

অরার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। আরশাদের এই নিঃসংকোচ আবেদনকে না করার সাধ্য তার নেই। অরা তার কম্পিত হাতটা রাখলো আরশাদের কপালে। আরশাদ চোখদুটো বুজে ফেলল। তার ভাবভঙ্গি এমন যেন এতটা আরাম সে এ জীবনে পায়নি।

আরশাদের মাথাব্যথা পুরোপুরি সেরে গেল দুপুরের দিকে। অসুস্থতার সময়ে ওষুধের থেকেও কার্যকরী ওষুধ একটা ভরসার মানুষ। অরাকে পাশে পেয়েছে বলেই হয়তো আরশাদ এত দ্রুত সেরে উঠলো। এমনিতে তার মাথাব্যথা তো সারাদিনেও সারে না।

কটেজ থেকে সল্প দূরত্বে একটা গ্রামীণ রেস্টুরেন্ট আছে। আরশাদ আর অরা সেখানে গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলো। সেই সকাল থেকে কিছুই খায়নি অরা। ক্ষুধায় তার মাথা কাজ করাও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। আরশাদ হক গ্রামীণ রেস্টুরেন্টে বসে আছে এই দৃশ্যটা দেখার মতো। ঢাকায় তো নামি-দামি রেস্টুরেন্টেও বেচারা বসতে পারে না। মুহূর্তেই তাকে দেখতে জড়ো হয়ে একরাশ মানুষ।

খাওয়া-দাওয়া শেষে তারা নদীর পাড় থেকে একটা খেয়া নৌকা ভাড়া করলো। এই গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ছোট্ট একটা নদী। নদীর নাম কাচালং। এটা না-কি কর্ণফুলীর উপনদী। নদীর জলে কচুরিপানা ভেসে বেড়াচ্ছে। দূরে আরও একটা নৌকা দেখা যাচ্ছে। আশেপাশে তারা ছাড়া আর কেউ নেই।

নৌকার পাটাতনে পাশাপাশি বসে রয়েছে আরশাদ এবং অরা। দুজনের মুখে কোনো কথা নেই। নীরবতায় উপভোগ করে যাচ্ছে তারা প্রকৃতিকে।

“অরা?”

“হুঁ?”

“তোমার জীবনে কেউ আছে?”

আরশাদের এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল অরা। সে হঠাৎ এমন প্রশ্ন করছে কেন? উত্তরটা অরার জানা। তার জীবনে কেউ নেই। জানা উত্তর দিতে এতটা গা কাঁপছে কেন তার।

অরা শুকনো ঢোক গিলে বলল, “হঠাৎ এমন প্রশ্ন?”

আরশাদ হেয়ালির স্বরে বলল, “কেন করতে পারি না?”

“পারেন।”

“তাহলে উত্তর দাও।”

কিছুটা সময় চুপ করে থেকে অরা বলল, “না নেই।”

আরশাদ আবারও আগ্রহ নিয়ে বলল, “কাউকে ভালোও লাগে না?”

অরার গা বেয়ে শীতল হওয়া বয়ে গেল। যাকে তার ভালো লাগে সেই প্রশ্ন করছে কাউকে ভালো লাগে কিনা। অরার তো ভালো লাগে, প্রচন্ড ভালো লাগে আরশাদকে। অসম্ভব সাহস করে এই কথাটা কি বলে দেবে আরশাদকে? না, এতটা সাহস তার নেই।

অরা বলল, “লাগলে কী করবেন? এনে দেবেন তাকে?”

আরশাদ হালকা গলায় বলল, “দিতেও পারি।”

“একজনকে ভালো লাগে।”

“সেই একজনটা কে?”

“সেটা বলা যাবে না। টপ সিক্রেট।”

“ঠিক আছে বলতে হবে না। সব সিক্রেট কিন্তু মুখে বলতে হয় না। বোঝা যায়।”

গা কাঁটা দিয়ে এলো অরার। আরশাদ কী বলতে চাইছে? সে জানে অরার ভালো লাগার মানুষটা কে? কিন্তু তা কী করে সম্ভব? অরা তো এই পৃথিবীর কাউকে বলেনি কথাটা। আরশাদ কী বুঝে বসে আছে কে জানে? অরার হৃদস্পন্দন যেন ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে।

পরের দিনটা তাদের কাটলো ঘোরাঘুরি মাঝেই। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তায় হাটাহাটি আর দুজনের অফুরন্ত কথোপকথন। অরার ইচ্ছা করছে সময়টাকে ফ্রেমে বন্দী করে রাখতে। তারা যদি আর কোনোদিন ফিরে না যেত! সারাটা জীবন পার করে দিত নিভৃতে প্রকৃতির মাঝে! বেশ হতো তাহলে। সব কিছুরই শেষ আছে। শেষ আছে সকল সুখানুভূতিরও। আগামীকাল তারা ফিরে যাচ্ছে ঢাকায়। আরশাদ ফিরে যাবে তার ব্যস্ত সুপারস্টার জীবনে। অরাও প্রোডাকশন হাউজের বড় দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিতে হবে।

উঁচু এক পাহাড়ের চূড়ায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে দুজনে। চোখের সম্মুখে সূর্যাস্তের দৃশ্য। দিনভর তেজে দাঁপিয়ে বেড়ানো সূর্যটা শান্ত ভঙ্গিতে লুকিয়ে পড়ছে আকাশের বুকে। আকাশের চারদিকে লালের ছড়াছড়ি।

অরা মুগ্ধ গলায় বলল, “কী সুন্দর দৃশ্য! এখানেই আজীবন থেকে যেতে পারতাম।”

আরশাদ হতাশ কণ্ঠে বলল, “ভালোই হতো তাহলে। শহরের যান্ত্রিক জীবনে আর ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না।”

“আপনাকে তো ফিরে যেতেই হবে। হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষা করে আছে আপনার জন্যে।”

“তোমার জন্যে কেউ অপেক্ষা করছে না?”

“না। আমার জন্যে কে আবার অপেক্ষা করবে?”

“কেউ হয়তো করছে। তুমি নিজেও জানো না।”

কথাটার মানে বুঝতে পারলো না অরা। কিংবা হয়তো মানে বোঝার চেষ্টাও করলো না। এখানে আসার পর থেকে আরশাদ এমন উদ্ভট সব কথা বলে যাচ্ছে। ছেলেটার হঠাৎ কী হলো কে জানে?

আরশাদ নরম স্বরে বলল, “প্রতিবছর এখানে আসবে আমার সাথে?”

অরা হাসিমুখে বলল, “আসবো। অবশ্যই আসবো।”

“জায়গাটা ভালো করে দেখে রাখো। প্রতিবার ঠিক এই জায়গাটাতে দাঁড়িয়েই সূর্যাস্ত দেখবো।”

“আচ্ছা।

“তার আগে একটা কাজ করতে হবে।”

“কী কাজ?”

“ঢাকায় ফিরে ঠিক এমনই একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে যেখান থেকে সূর্যাস্ত দেখা যায়।”

“বাড়ির ছাদ থেকেই তো সূর্যাস্ত দেখা যায়।”

“না, ওভাবে হবে না। বাড়ির ছাদ থেকে কতগুলো বিল্ডিংয়ের ফাঁক দিয়ে ডুবন্ত সূর্যটা দেখতে হয়। আমার দরকার এমন একটা জায়গা যেখানে গাছপালার ফাঁক দিয়ে সূর্যাস্ত দেখা যায়।”

অরা আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “ঠিক আছে। এমন জায়গা আমিই আপনাকে খুঁজে দেবো।”

আরশাদ ইতস্তত করে বলল, “তোমাকে একটা রিকুয়েস্ট করবো?”

“কী রিকুয়েস্ট?”

“আজ আমরা বেড়াতে আসার শেষ রাতটা সেলিব্রেট করবো। সেই উপলক্ষে তুমি একটা শাড়ি পরবে?”

“শাড়ি?”

“হুঁ। শাড়িতে তোমাকে অন্যরকম লাগে। সেই অ্যাওয়ার্ড শোতে দেখেছিলাম তোমাকে শাড়িতে। আর সুযোগ হলো না।”

অরার মনের মাঝে আকুলি-বিকুলি করছে। শাড়িতে নারী না-কি ছেলেদের প্রধান দুর্বলতা। আরশাদ কেন শাড়িতে দেখতে চাইছে অরাকে।

অরা বলল, “পরতেই পারি। কিন্তু এখানে শাড়ি পাবো কোথায়? আমি তো সঙ্গে করে নিয়ে আসিনি।”

“সেটা কোনো বিষয় না।”

“আপনি আমার জন্যে শাড়ি নিয়ে এসেছেন।”
“হুঁ।”

“কিন্তু কেন?”

“তোমাকে দেখবো বলে। আর শোনো, কপালে ছোট্ট একটা টিপ দিবে। চুলগুলো খুলে রাখবে। গয়না-টয়না কিছু পরার দরকার নেই। তোমাকে এমনিতেই সুন্দর লাগে।”

আরশাদের দুচোখে বিচিত্র এক চমক লক্ষ্য করলো অরা। যেন চোখের ঠিক সামনে সে অরাকে নিজের মন মতো দেখতে পাচ্ছে। অরার বুকের মাঝে হৃদয়টা প্রচন্ড কম্পনে নেচে উঠছে। আরশাদের চোখেমুখে একরাশ আনন্দ খেলে বেড়াচ্ছে। এতগুলো বছরে অরা কখনো তাকে এতটা খুশি দেখেনি। কীসের এই খুশি?

কটেজে ফিরে অরা সাজলো আরশাদের মন মতো। তার নিয়ে আসা শাড়িটার রঙ ধবধবে সাদা। সাদা শাড়িতে সোনালী পাড়। চোখে গাঢ় করে কাজল দিলো অরা। আরশাদ বলেছিল কপালে টিপ দিতে। টিপ তো তার সঙ্গে নেই। হঠাৎ লক্ষ্য করলো সে ব্যাগে তার শাড়িটা ছিল সেখানেই রয়েছে এক পাতা কালো টিপ। সামান্য টিপের খেয়ালও ছিল আরশাদের? কপালে টিপ দিয়ে অরা তার খোঁপা করা চুলগুলো ছেড়ে দিলো।

বাঙালি মেয়েদের সৌন্দর্য যেন পূর্ণতা পায় শাড়িতে। অরাকে আজ অপূর্ব সুন্দর লাগছে। তবুও তার ভয় হচ্ছে। আরশাদ তার সাজটা পছন্দ করবে তো? সে কি পেরেছে তার মনমতো সাজতে?

ঘর থেকে বেরিয়ে অবাক বনে গেল অরা। কটেজের সামনে পুরো অংশ সাজানো ফুলের পাঁপড়ি আর ছোট-বড় ক্যান্ডেলে। অরার বুঝতে বাকি রইলো না এসব কান্ড কার। অরার সাজগোজের ফাঁকেই আরশাদ কটেজের সামনের দিকটা এত সুন্দর করে সাজিয়েছে। এমনকি এখনো সাজিয়ে যাচ্ছে। আরশাদ ওদিকে ফিরে ক্যান্ডেল জ্বালাতে ব্যস্ত।

অরা বিস্ময়ে খাবি খেয়ে বলল, “এতসব কখন সাজালেন?”

আরশাদ উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকালো। একরাশ মুগ্ধতা ছেয়ে গেল আরশাদের মাঝে। অরাকে ঠিক এভাবেই কল্পনা করেছিল সে। নাহ্! এভাবে কল্পনা করেছিল বললে ভুল হবে। অরাকে তার কল্পনার থেকেও একটু বেশি সুন্দর লাগছে।

আরশাদের এমন চাহনিতে লজ্জায় লাল হয়ে গেল অরা। অরার লজ্জায় নিজেকে সামলে নিয়ে আরশাদ বলল, “এখন।”

“খুব সুন্দর হয়েছে! এই ক্যান্ডেলগুলো আপনি ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছেন।”

“হুঁ।”

“এত কষ্ট করতে গেলেন কেন?”

“বললাম না, সেলিব্রেট করবো।”

অরা মজার ছলে বলল, “ওষুধ আনার কথা মনে নেই, অথচ সেলিব্রেটের কথা ঠিকই মনে আছে।”

আরশাদ সামান্য হেসে বলল, “বসো।”

দুজনে পাশাপাশি বসলো কটেজের সামনের সিড়িতে। সিড়িতেও আরশাদ মোমবাতি আর ফুলের পাঁপড়ির কারসাজি করেছে। অরা আড়চোখে বারবার তাকাচ্ছে তার দিকে। শুভ্র পাঞ্জাবিতে আরশাদকে দারুণ লাগছে। চুলগুলো পরিপাটি করে আঁচড়ে রাখা। অরার তো উচিত নিজেকে ভাগ্যবতী বলে মনে করা। যাকে এক পলক সামনাসামনি দেখার জন্যে হাজারো মেয়ে মূর্ছা যায়, তাকিয়ে রোজ এতটা কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছে সে।

অরা বলল, “কেমন লাগছে আমাকে?”

আরশাদ মুগ্ধ গলায় বলল, “ঠিক যেমনটা চেয়েছিলাম।”

লজ্জায় অন্যদিকে ফিরে তাকালো অরা। আজ এত লজ্জা লাগছে কেন তার?

আরশাদ তার মোহনীয় স্বরে বলল, “তোমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছি বলো তো।”

কিছুটা অবাক হলো অরা। তাদের এখানে আসার পেছনে আবার কোনো উদ্দেশ্য আছে না-কি? অরা তো ভেবেছিল ব্যস্ত জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছে আরশাদ, তাই তাদের এখানে ঘুরতে আসা।

অরা কৌতূহলী গলায় বলল, “কেন?”

আরশাদ ঠোঁটে এক চিলতে হাসি নিয়ে বলল, “একটা সিক্রেট বলবো বলে।”

“সিক্রেট বলতে এত দূরে আসতে হয় না-কি?”

“না। তবে সব সিক্রেটের থেকে এটা আলাদা।”

“তাহলে বলুন।”

আরশাদ ভয় দেখানোর ভঙ্গিতে অরাকে বলল, “এত তাড়াতাড়ি বলবো? সহ্য করতে পারবে তো?”

অরা হেসে বলল, “সহ্য না করতে পারার কী হলো?”

“তুমি আমার অনেক বড় ক্ষতি করেছ।”

“আমি?”

“হুঁ। পৃথিবীর কাছ থেকে আমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। আনন্দ-উল্লাস, কষ্ট-যন্ত্রণা কোনো অনুভূতিই কাজ করতো না আমার মাঝে। নিজেকে মোটামুটি অনুভূতিহীন করে সকলের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছিলাম। প্রত্যেকটা মানুষকে আমার মনে হতো অসহ্যকর। তোমার কারণেই সব এলোমেলো হয়ে গেল।”

অরার বুকের মাঝে যেন উত্তাল তুফান শুরু হয়েছে। কী বলতে চাইছে আরশাদ?

আরশাদ ঠিক অরার চোখের দিয়ে তাকিয়ে গাঢ় স্বরে বলল, “যে আমি এতটা অনুভূতিহীন ছিলাম তাকে না জানি কতকিছু অনুভব করিয়েছ তুমি। হাজার কাজের মাঝেও আমার মস্তিষ্কে তোমার চিন্তা স্থায়ী হয়ে থাকে। কীভাবে করলে আমার এত বড় ক্ষতি?”

অরা বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এর মানে কী?

আরশাদ হেসে বলল, “প্রশ্নটা নিজেকেও করেছিলাম, উত্তর পাইনি। আমি জানি না এসবের মনে। শুধু জানি, ইদানিং বারবার তোমার ঠোঁটে হাসি দেখতে ইচ্ছা করে। তুমি কি জানো? যখন তুমি হাসো, তোমার সাথে সাথে আশেপাশের সবকিছু হেসে ওঠে।”

“সেই কবে থেকে দেখছি তোমাকে। প্রায় চার বছর হয়ে গেল না? না-কি আরও বেশি?”

“হুঁ।”

“অথচ আমি ভেবে পাই না, যে মানুষটাকে গত চার বছর ধরে প্রতিদিন দেখছি তাকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম কি করে? আগে তুমি আমার চোখের সামনে দিয়ে গেলে ফিরে তাকানোটাও প্রয়োজন মনে করতাম না। অথচ আজ নতুন নতুন অজুহাত খুঁজে বের করি তোমাকে দেখার জন্যে।”

অরার দুচোখে জল চলে এলো। অশ্রুগুলো আড়াল করার কোনপ্রকার চেষ্টা তার মাঝে নেই। অরা বুঝতে পারছে আরশাদের গোপন কথাটা কী। বুঝতে পারছে বলেই হয়তো বুক ভেঙে কান্না আসছে। যন্ত্রণার কান্না নয়। সুখের কান্না, আনন্দের কান্না।

“আমার অবচেতন মন এতদিন যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল, সেই মানুষটা যে এত আমার কাছেই ছিল কে জানত?”

“তার মানে?”

“আমি নিজেও জানি না আমার কী হয়েছে অরা। খুব চেষ্টা করছি নিজেকে আটকে রাখার, কিন্তু প্রতিনিয়ত একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছি তোমার মাঝে। আমি জানি না কখন, কীভাবে ভালোবেসেছি ফেলেছি তোমাকে।”

ভালোবাসা। এই তো! নামহীন ওই অনুভূতিগুলোর নাম পেয়ে গেছে অরা। কাউকে কোনোদিন ভালোবাসিনি তো, তাই আরশাদকে ভালোবেসে ফেলার পরেও অরা বুঝতে পারেনি এই অনুভূতিটার নাম ভালোবাসা। তরঙ্গের ন্যায় বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে অরার সমস্ত শরীরে। আরশাদ তাকে ভালোবাসে? তাকেই?

আরশাদ আর্দ্র গলায় বলল, “আমার কি এবার নিজেকে আটকানো উচিত?”

অরা তড়িৎ বেগে না সূচক মাথা নাড়লো। সে তো কোনোদিনও চায় না আরশাদ নিজেকে এই ভালোবাসার জালে জড়িয়ে পড়া থেকে নিজেকে আটকানোর কোনপ্রকার চেষ্টা করুক। বরং অরা তো চায় এই জালে আষ্টেপৃষ্ঠে নিজেকে জড়িয়ে রাখুক।

আরশাদ তার মোহনীয় হাসিটা হেসে বলল, “তাহলে হাতটা ধরো প্লিজ। তোমার স্পর্শ পাওয়ার জন্যে আমি মরে যাচ্ছি।”

অরা তার কম্পিত হাতটা বাড়িয়ে স্পর্শ করলো আরশাদের হাত। আরশাদ নিজেই শক্ত করে চেপে ধরলো অরার হাতটা। এভাবেই কেটে গেল অনেকটা সময়। আরশাদের বলা কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে অরার মস্তিকে। “আমি জানি না কখন, কীভাবে ভালোবেসেছি ফেলেছি তোমাকে।”

নীরবতা ভঙ্গ করে আরশাদ দৃঢ় কন্ঠে বলল, “অরা শোনো, এক বছর পর ডিভোর্সের প্ল্যান কিন্তু ক্যানসেল। তোমাকে আমার কাছেই থাকতে হবে আজীবন। তুমি আমার। অন্য কেউ তোমার দিকে চোখ তুলে তাকানোরও সাহস পাবে না।”

অরা চমকে উঠে তাকালো আরশাদের দিকে। এতটা ভাগ্য নিয়ে কি সে আসলেই এসেছিল পৃথিবীতে? মোমবাতিগুলো গলে দিয়ে একপর্যায়ে নিভে গেল। তবুও দুজনে ঠিক এভাবেই পুরোটা রাত নিঃশব্দে, হাতে হাত রেখে কাটিয়ে দিলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here