#ফিরে_আসা
শেষ পর্ব
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
তীক্ষ্ণ চোখে ফাইলটা পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে অরা। যদিও সে বেশ বুঝতে পারছে এই ফাইলে কোনো কাজের কথা নেই। তার সামনে যে লোকটা বসে আছে, তার নাম খায়রুল। খায়রুলের চোখেমুখে একরাশ আশা চকচক করছে। তার আশা, এই ফাইলে সন্তুষ্টি প্রকাশ করবে অরা। খায়রুল ইন্ডাস্ট্রির জনপ্রিয় পরিচালক রিজওয়ান আহমেদের প্রধান সহকারী পরিচালক। যদিও সহকারী পরিচালকদের সঙ্গে অরা মিটিং করে না। তার মিটিং হয় সরাসরি পরিচালকের সঙ্গে। পরিচালক সাহেব পা ভেঙে বাড়িতে বসে আছেন বলে খায়রুলকে পাঠিয়েছেন।
অরা ফাইলটা বন্ধ করে সরু গলায় বলল, “এটা কি লিখেছেন খায়রুল ভাই? হসপিটালের সেট বানাতে পঁচিশ লাখ টাকা লাগবে?”
খায়রুল ইতস্তত করে বললেন, “আসলে কী ম্যাডাম… অনেক বড় করে সেটটা তৈরি হবে। এন্ট্রি-এক্সিটের সেটও তৈরি করবো। তাছাড়া পাঁচ-ছয়টা আলাদা কেবিন লাগবে, সেই সঙ্গে ডাক্তারের চেম্বারের ব্যাপারও রয়েছে।”
বিরক্তিতে গা জ্বলে যাচ্ছে অরার। তাকে যখন কেউ অহেতুক বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করে তখন ঠিক এমনটাই অনুভব হয়। কে ফিল্মসের ব্যানারে নির্মিত হতে যাচ্ছে ‘আগুন’ নামের একটি সিনেমা। এই সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো দৃশ্য রয়েছে হাসপাতালে। আসল হাসপাতালে শুটিং করা সম্ভব নয়। অরা নিজেও চায় না রোগীদের অসুবিধা সৃষ্টি করে শুটিং করতে। সেজন্যেই সেট বানাতে নির্দেশ দিয়েছিল। তবে সেই সেটের যে এত ঝাঁঝ এটা কে জানত?
অরা স্পষ্ট গলায় বলল, “হসপিটালের সেট এর আগেও আমি তৈরি করেছি। এন্ট্রি-এক্সিট সহই তৈরি করেছি। পরস্পর সিনেমার জন্যে। ওই সেটে আমার মোট খরচ হয়েছিল বারো লাখ টাকা। আর সেখানে এসেছেন আপনি পঁচিশ লাখের বাজেট নিয়ে?”
খায়রুল কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “স্যার বলেছেন এই সিনেমার সব সেট যেন গ্র্যান্ড হয়। কোনো কমতি যেন না থাকে। তাই রিজওয়ান ভাই এই বাজেট দিয়েছেন।”
বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটে। এই অফিসে কেউ যখন তার সঙ্গে যুক্তিতে পেরে ওঠে না, তখন কোথা থেকে যেন ‘স্যার’কে টেনে আনে। কোম্পানিতে অরার ওপরে ওই একটা মানুষেরই স্থান। তাই ভাবে অরা তার নামটা শুনে দমে যাবে। বিনা বাক্য ব্যয়ে সই করে দেবে পঁচিশ লাখ টাকার বাজেটে। কিন্তু আফরোজা অরা হক কোনোদিন দমে যাওয়ার পাত্রী ছিল না, আজও নেই।
অরা ভদ্রভাবে বলল, “স্যার কী বলেছে আমি জানি। এবার আমি কী বলছি শুনুন। আপনাদের ম্যাক্সিমাম পনেরো লাখ টাকার বাজেট দেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যেই ভালো মানের একটা সেট তৈরি করে দেখাতে হবে।”
খায়রুল মাথা চুলকে বললেন, “রিজওয়ান ভাই রাজি হবে না ম্যাডাম।”
অরা ডেস্ক থেকে নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “আপনার ডিরেক্টরকে রাজি করানোর দায়িত্ব আপনার। আমার একটাই কথা, পনেরো লাখের বেশি বাজেটে আমি সাইন করবো না।”
অরা দ্রুত পায়ে হেঁটে তার কেবিন থেকে বেরিয়ে থেকে বেরিয়ে এলো। কোনো সিনেমার সেট বানানোর ক্ষেত্রে প্রচুর দুর্নীতি হয়। এদের কথামতো পঁচিশ লাখ টাকা দিয়ে দিলে পাঁচ লাখ টাকা যেত ডিরেক্টরের পকেটে। বাকি টাকার একাংশ যেত সেট ডিজাইনারের পকেটে। একটা বিশেষ দায়িত্ব পেয়েছে অরা। দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে সেই দায়িত্বের প্রতি কোনো অপমান সে করতে পারে না।
দুই বছর হলো কে ফিল্মস আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। যাত্রা শুরুর পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মাত্র দুই বছরের মধ্যেই এই প্রোডাকশন কোম্পানি ইন্ডাস্ট্রির সবথেকে সফল ও অর্থবহুল প্রোডাকশন কোম্পানিতে পরিণত হয়। প্রতিবছর কে ফিল্মসই দেশে অধিক সংখ্যক সিনেমা প্রযোজনা করে আসছে।
আমাদের দেশে সিনেমার যে দুর্দিন এসেছিল সেটা ক্রমেই কেটে যাচ্ছে। কে ফিল্মসের প্রযোজনায় মানসম্মত সিনেমা তৈরি হওয়ায় দর্শক হলমুখী হচ্ছে। হলের সংখ্যা বাড়ছে। প্রথম থেকেই এই বিশাল কোম্পানিকে সামনে থেকে নির্দেশনা দিয়ে আসছে অরা। নির্মাণাধীন সবগুলো সিনেমার খুঁটিনাটি বিষয়বস্তু নিজের অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে সে।
এই কাজ একা করা তার পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিল না। অনেক সময় এমনও হয়েছে অরা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ভেঙে পড়েছে, সাহস হারিয়ে ফেলেছে। ওই সময়গুলোতে তাকে শক্ত হাতে সামলেছে তার সবথেকে প্রিয় মানুষটা, আরশাদ হক। যার সুপারস্টার পরিচয়ের সঙ্গে নতুন আরেকটি পরিচয় যুক্ত হয়েছে। কে ফিল্মসের চেয়ারম্যান।
কোম্পানির বড় বড় কিছু সিদ্ধান্ত সে নেয়। বড় বাজেটের কোনো সিনেমা প্রযোজনার আগে তার অনুমতির প্রয়োজন হয়। এছাড়া একটা সিনেমা সম্পূর্ণভাবে তৈরি হয়ে গেলে আরশাদ নিজে সেটাকে প্রিভিউ করে। কে ফিল্মসের একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে। আরশাদের কাছে যদি মনে হয় সিনেমা সেই স্ট্যান্ডার্ড স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়েছে, তাহলে তাকে সেন্সর বোর্ডে পাঠানো হয় না। আবারও প্রয়োজনীয় রিশুট বা এডিটিং করা হয়।
মূল আসনে বসে থাকলেও আরশাদ কে ফিল্মসের সফলতায় নিজের খুব বেশি একটা অবদান দেখে না। সব অবদান তার অরার। গত দুটো বছর অরার নিরলস পরিশ্রমের ফল হলো এই সাফল্য।
তড়িঘড়ি করে অরা প্রিভিউ রুমে প্রবেশ করলো। তার জন্যে সকলে অপেক্ষা করে আছে অনেকক্ষণ ধরে।
অরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “সরি, সরি। দেরি করে ফেললাম না?”
পরিচালক আশরাফ বললেন, “কোনো সমস্যা নেই আপু।”
কে ফিল্মসের প্রযোজনায় নির্মাণাধীন আরেক সিনেমা ‘অদৃশ্য প্রজাপতি’। এই সিনেমা নিয়ে দর্শকমহলের মাঝে দারুণ আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। কেননা ভবিষ্যতের গল্পের ওপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়েছে এটি। এই সিনেমার সময়কাল ২০৮৯ সাল। ভবিষ্যতের গল্প নিয়ে এই প্রথম বাংলাদেশে কোনো থ্রিলার সিনেমা তৈরি হচ্ছে।
‘অদৃশ্য প্রজাপতি’র তৈরি হয়ে গেছে। যেকোনো সিনেমার ট্রেইলার তার প্রচারণায় সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ট্রেইলার দেখেই দর্শক নির্ধারণ করে, সে সিনেমাটি দেখতে হল পর্যন্ত যাবে কিনা। তাই কে ফিল্মসের প্রযোজনায় নির্মিত প্রত্যেকটা সিনেমার ট্রেইলার প্রকাশের আগে তার প্রিভিউ করা হয়। প্রিভিউ বোর্ডের প্রধান সদস্য অরা। এছাড়াও রয়েছে কে ফিল্মসের ক্রিয়েটিভ টিম।
প্রিভিউ রুমে একটা পঁয়ষট্টি ইঞ্চির টিভি রয়েছে। টিভির সঙ্গে রয়েছে সাউন্ড বক্স। যাতে এখানে বসেই সিনেমা হলের কিছুটা রেশ পাওয়া যায়। ট্রেইলার শুরু হলো। অনবদ্য, শ্বাসরুদ্ধকর এক ট্রেইলার। নিশ্চিত এই ট্রেইলার দেখার সময় দর্শকের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে।
ট্রেইলার শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অরা মুগ্ধ গলায় বলল, “অসাধারণ ট্রেইলার হয়েছে আশরাফ ভাই!”
আশরাফকে প্রশংসায় বেশ বিগলিত বলে মনে হলো।
অরা স্বাভাবিকভাবে বলল, “তবে আমার কাছে সাউন্ডে একটু সমস্যা মনে হচ্ছে। কোনো জায়গায় বেশি আবার কোনো জায়গায় কম।”
ক্রিয়েটিভ টিমের একজন সদস্য বলল, “আর একটা শটে কালার কারেকশন একটু এলোমেলো ছিল। দর্শক পরবর্তীতে এই জিনিসগুলো পয়েন্ট আউট করবে।”
আশরাফ হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “সমস্যা নেই আপু, এই ছোটখাটো ব্যাপারগুলো কালকেই মধ্যেই কারেকশন করা যাবে।”
অরা বলল, “প্লিজ চেষ্টা করবেন। আমরা কালকেই ট্রেইলার রিলিজের ডেট দিয়েছি। কোনোভাবে যেন দেরি না হয়।”
প্রিভিউ এবং প্রিভিউ পরবর্তী আলাপ সেরে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লো অরা। অন্য দিনে বিকেল পর্যন্ত অফিস করে সে। তবে আজকের দিনটা আলাদা। আজ তার ব্যস্ততার শেষ নেই। তাই দুপুরের আগ দিয়েই বেরিয়ে যাচ্ছে।
গাড়িতে গিয়ে বসলো অরা। এই গাড়িটা আরশাদের নয়। তার নিজের। নিজের স্যালারির টাকা জমিয়ে এই গাড়িটা কিনেছে সে। যদিও এভাবে বলা ঠিক নয়। আরশাদ আর অরা তো ভিন্ন কিছু নয়। আরশাদের সবগুলো গাড়িই তার। আবার তার এই গাড়িটাও আরশাদের।
ড্রাইভিং সিটে বসে রইল অরা। অপেক্ষা করছে তার বডিগার্ড জহুরুলের জন্যে। ওই ঘটনার পর থেকে বডিগার্ড ছাড়া অরার বাইরে যাওয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে আরশাদ। সারাক্ষণ বডিগার্ড আশেপাশে থাকবে, এই ব্যাপারটা অরার ভালো লাগে না। তাই জহুরুল দূর থেকে তার দেখাশোনা করে। এমনকি এখন সে এক গাড়িতেও অরার সঙ্গে যাবে না। ভিন্ন একটা গাড়িতে অরার পিছু পিছু যাবে।
অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ অরার মনটা ইচ্ছা প্রকাশ করলো আরশাদের কণ্ঠস্বর শোনার। সেই ইচ্ছা দমিয়ে রাখতে ইচ্ছা করছে না। মোবাইলটা হাতে নিয়ে অরা ডায়াল করলো আরশাদের নম্বরে।
আরশাদ আজকাল মহাব্যস্ত। তার পরবর্তী সিনেমা ‘দূরে হারিয়ে’র শুটিং নিয়ে। এই সিনেমাটা কে ফিল্মসের এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় বাজেটের সিনেমা। পুরো সিনেমার শুটিং করা হবে বান্দরবানের গভীর অরণ্যে। সেখানেই তৈরি করা হয়েছে জমকালো সেট। শুটিংয়ের মাঝে কোনো বিরতি নেই। টানা দুই মাস এক নাগাড়ে শুটিং চলবে। এক মাসের বেশি সময় হলো আরশাদ সেখানেই রয়েছে। অরার দৃষ্টি সীমানার বাইরে।
মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করে সবকিছু ছেড়ে ছুটে যেতে আরশাদের কাছে। সেই ইচ্ছাটা আবার নিজেই লুকিয়ে ফেলে মনের মাঝে। সে তো আর কিশোরী কোনো প্রেমিকা নয়। আরশাদের পরিপক্ক স্ত্রী। তাকে বুঝতে হবে যে বড় দায়িত্বটা সে পেয়েছে, সেই দায়িত্ব চাইলেই ছেড়ে দেওয়া যায় না।
কয়েকবার রিং বাজতেই কল রিসিভ হলো। অরা হাসি হাসি গলায় বলল, “কী অবস্থা আরশাদ?”
আরশাদ অপরপ্রান্ত থেকে বলল, “এই তো! একটু পর শটে যাবো।”
অরা আগ্রহ নিয়ে বলল, “শুটিং কেমন চলছে?”
আরশাদ ব্যস্ত গলায় বলল, “ভালো চলছে। সকাল থেকে এই পর্যন্ত একটা শট হলো। এখন আরেকটা শট শুরু হবে।”
অরা কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলেছে ঠিক তখনি শুনতে পেলো কেউ একজন আরশাদকে বলছে, “স্যার, শট রেডি।”
আরশাদ দ্রুত গতিতে বলল, “অরা? এখন আমাকে শটে যেতে হবে। পরে ফোন দিই?”
এক মুহুর্ত চুপ করে থেকে অরা প্রচ্ছন্ন একটা হাসি হেসে বলল, “আচ্ছা।”
অপরপ্রান্ত থেকেই কেটে গেল ফোনটা। আরশাদের দূরে থাকাটা অরার মনের মাঝে ক্ষত সৃষ্টি করলেও, তার ব্যস্ততা করে না। অরা বেশ বুঝতে পারে আরশাদের সবটুকু সময় তার জন্য বরাদ্দ নয়। তার ব্যস্ত থাকাটাই তো স্বাভাবিক। অরার মন তৃষ্ণার্ত হয়ে ছিল কেবল কয়েক মুহূর্তের জন্যে প্রিয় মানুষটার কণ্ঠস্বর শুনবে বলে। শুনতে পেরেছে, এই অনেক।
সব মেয়ে তো নওশীন নয়। যে আরশাদের খ্যাতিকে সন্তানের মতো আপন করে নিয়েছিল, কিন্তু ব্যস্ততাকে নয়। একমাত্র আরশাদ তাকে সময় দিতে পারে না বলেই তাকে ঠকাতে শুরু করে। সত্যিকারের ভালোবাসা থাকলে, ভালোবাসার মানুষটার আশেপাশে না থেকেও তাকে মনের মাঝে অনুভব করা যায়। হয়তো নওশীনের ভালোবাসা কোনোদিনই ছিল না।
সকল অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় আদালত নওশীনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতে চেয়েও কোনো লাভ হয়নি। আরশাদের ভক্তদের একাংশ এই বিচারে এতটাই খুশি হয়েছে যে, এক সপ্তাহ পর্যন্ত আনন্দ মিছিল করেছে। তবে আরেক অংশ হতাশ। তাদের মতে এমন ভয়ংকর নারীর জন্যে এই শাস্তি খুবই সামান্য।
মা বিহীন জীবনে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে গেছে কথা। বহু দিন পর পর মায়ের কথা মনে পড়লেও তার অভাব অনুভূত হয়নি কখনো। অরা সেই অভাব অনুভব করতে দেয়নি তাকে। সকাল থেকে বিকাল অফিস করে বলে যে সংসারের প্রতি তার কোনো মন নেই এমনটা নয়। সকালে কথার টিফিন বানিয়ে দেওয়া, তার চুল বেঁধে দেওয়া, তাকে স্কুলে দিয়ে আসা, স্কুল থেকে নিয়ে আসা, হোমওয়ার্ক করানো – কথার খুঁটিনাটি সকল বিষয় অরার থেকে গুরুত্ববহুল।
অরার গাড়ি গিয়ে থামলো কথার স্কুলের সামনে। নতুন স্কুলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হয়নি না। মেয়েটা এ বছর ক্লাস ওয়ানে উঠেছে। পড়াশোনা ছাড়াও স্কুলের বির্তক ক্লাবে নাম লিখিয়েছে সে। এইটুকু বয়সেই যেভাবে প্রতিপক্ষকে চুপ করিয়ে দেয়, এ থেকেই বোঝা যায় ভবিষ্যতে সে কতটা ভালো বক্তা হবে।
স্কুলের মাঠেই বন্ধুদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিল কথা। অরাকে দেখে লুকিয়ে থাকা সত্ত্বেও বেরিয়ে এসে ছুটে এল তার দিকে। হাসিমুখে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো অরা।
অরা অনুতপ্ত স্বরে বলল, “সরি সোনা, বেশি দেরি করে ফেলেছি?”
কথা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “না তো! অল্প দেরি করেছো।”
অরা প্রচ্ছন্ন এক হাসি হেসে বলল, “চল তোর ক্লাসে যাই। মিস আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে না?”
আজ কথার প্রথম সাময়িক পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। তার স্কুলের নিয়ম প্রত্যেক সাময়িক পরীক্ষার রেজাল্ট বাবা অথবা মা নিজে ক্লাস টিচারের কাছ থেকে সংগ্রহ করবে।
ক্লাস টিচার অরাকে দেখে মিষ্টি হাসি হেসে বললেন, “কেমন আছেন আপু?”
অরাও হাসিমুখে বলল, “ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন মিস?”
ক্লাস টিচার কথার রিপোর্ট কার্ড অরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “জি। দেখুন আপনার মেয়ে কী করেছে।”
কথাটা এমনভাবে বললেন, যেন কথা খুবই বাজে রেজাল্ট করেছে। অরা অনিশ্চিত ভঙ্গিতে রিপোর্ট কার্ডটা হাতে নিলো। কার্ডটা খুলতেই নম্বরগুলো দেখে চমকে উঠলো সে। সবগুলো বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে কথা। সবথেকে বেশি নম্বর পেয়েছে অংকে, ৯৮।
অরা ঠোঁটজুড়ে ফুটে উঠলো অনিন্দ্য সুন্দর এক হাসি। এক মুহূর্তও অপচয় না করে কথাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “I’m so proud of you!”
ক্লাস টিচার মুগ্ধ গলায় বলল, “ক্লাসের কোনো স্টুডেন্ট অংকে নব্বইয়ের ঘরে পৌঁছাতে পারেনি। অথচ আমাদের কথা আটানব্বই পেয়েছে। ও নিশ্চয়ই প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ে?”
অরা তাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “না তো। মাঝে মাঝে আটকে গেলে আমি হেল্প করি। তবে বেশির ভাগ সময় কথা একাই পড়াশোনা করে।”
ক্লাস টিচার হতবাক গলায় বললেন, “এতটুকু একটা বাচ্চা একা একা পড়াশোনা করে?”
অরা গর্বিত গলায় বলল, “আমার কথা সব পারে।”
আগে কথা প্রাইভেট টিউটরের কাছেই পড়াশোনা করতো। সে অরার কাছে আসার পর অরা এই অভ্যাস ছাড়িয়ে দিয়েছে। এতটুকু বয়স থেকে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়লে একটা বদভ্যাস গঠন হয়ে যায়। পরবর্তী জীবনে পড়াশোনার ক্ষেত্রে আত্মনির্ভর হওয়া যায় না।
গাড়ি চলছে ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায়। অরা ড্রাইভ করছে, তার পাশে কথা।
কথা কৌতুহলী গলায় বলল, “এই অ্যানিভার্সেরী জিনিসটা কী অরা?”
অরা ভেবে পাচ্ছে না কী করে এই বিষয়টা সহজভাবে বুঝিয়ে বলবে কথাকে।
খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “দুই বছর আগে ঠিক এই দিনে তোর বাবা আমার জীবনে আসে। আর আমি তার জীবনে। প্রতিবছর এই দিনটাকে বার্থডের মতো করে সেলিব্রেট করতে হয়।”
কথা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “গতবছরও করেছিলে?”
“করেছিলাম তো! কেন তোর মনে নেই?”
“না। মনে পড়ছে না।”
অরা আশ্বাস দিয়ে বলল, “বাসায় গিয়ে ছবি দেখাবো, তখনই মনে পড়ে যাবে।”
আজ আরশাদ-অরার দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী। তাদের বিয়ের দুটো তারিখ আছে। একটা প্রথমবার চুপি চুপি বিয়ের, আরেকটা দ্বিতীয়বার সকলকে সাক্ষী রেখে করা বিয়ের। প্রথম বিয়ের তারিখটাই ঘটা করে উদযাপন করে তারা।
এই তারিখটাই কিনা আরশাদ ভুলে গেল! অবশ্য তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কাজের চাপে অ্যানিভার্সেরীর ব্যাপারটা বেচারার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। এতটা ব্যস্ততা না থাকলে ঠিকই মনে রেখে সেলিব্রেট করতো অরার সঙ্গে। অরা ঠিক করেছে আজকের কথা তাকে মনে করিয়ে দেবে না। বেচারা শুধু শুধু কষ্ট পাবে। গুরুত্বপূর্ণ এই তারিখটা ভুলে যাওয়ায় অপরাধবোধে ভুগবে। কী দরকার?
আরশাদ নেই বলে অরা যে আজকের দিনটা গোমড়ামুখে কাটাবে এমনটা নয়। কথা তো তার কাছেই রয়েছে। ওর সঙ্গে না হয় সেলিব্রেট করবে। পেস্ট্রি শপ থেকে কেকটা নিয়ে নিলো অরা। এই কেকের অর্ডার তারা গত সপ্তাহে করেছে। কথার পছন্দের বাটারফ্লাই শেপে তৈরি করা হয়েছে কেকটা।
কেক নিয়ে কথাকে নিয়ে সে গেল একটা লাক্সারি হাতঘড়ির দোকানে। আরশাদ সবসময় এখান থেকেই নিজের জন্যে ঘড়ি কেনে। অনেকটা সময় বাছাবাছি করে অরা। গাঢ় নীল বেল্টের ওপর কালো ডায়ালের একটা লিমিটেড এডিশন ঘড়ি পছন্দ করলো।
আরশাদ ঢাকায় ফিরে এলে অরা তাকে এটা পরিয়ে দিয়ে কৃত্রিম ক্রোধ নিয়ে বলল, “কোন সাহসে আমাদের অ্যানিভার্সেরী ভুলে গিয়েছিলে তুমি?”
কথাকে নিয়ে আইস্ক্রিম খেয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আরও ঘন্টাখানেক সময় লাগলো তাদের। এতক্ষণে স্টাফরা বাড়ি থেকে চলে গেছে। অরা দরজার লকে পাসওয়ার্ড চেপে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো।
পুরো বাড়িটা অন্ধকারে ছেয়ে আছে। স্টাফরা তো কখনো সবগুলো বাতি নিভিয়ে যায় না। আজ হঠাৎ কী হলো তাদের? অন্ধকারে অরার পায়ে হালকা এক বস্তুর স্পর্শ লাগলো। এই স্পর্শ অগ্রাহ্য করে অরা সুইচবোর্ডের দিকে এগিয়ে গেল।
সুইচ টিপে সবগুলো বাতি জ্বালিয়ে দিয়েই যেন চোখের সামনে অষ্টম আশ্চর্য দেখলো অরা! পুরো বাড়িটা রঙ-বেরঙের রিবন আর বেলুনে সাজানো। মেঝেতেও বেলুন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বসার ঘরের কেন্দ্রে বিশাল একটা টেবিল। টেবিলের ওপরে পুতুল-আকৃতির কেক। দুটো ছেলে-মেয়ে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে এমন একটা কেক।
অরা সবই বুঝতে পারছে আবার যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। এই আকস্মিক ঘটনা আয়ত্বে আনতে সময় লাগছে তার মস্তিষ্কের। অরাকে আরও একবার স্তম্ভিত করে দিয়ে তার চোখের ওপর এসে পড়লো দুটো হাত। চোখদুটো অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকেলও মনটা যেন আলোর হদিস পেলো। অরা জানে এই স্পর্শ কার। এই পৃথিবীতে একমাত্র যার তাকে স্পর্শ করার অধিকার আছে।
কথা আনন্দে আত্মহারা হয়ে লাফিয়ে উঠে বলল, “বাবা!”
অরা তড়িৎ গতিতে পেছনে ফিরে তাকালো। তার সামনে সেই মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে যাকে দেখার জন্যে দীর্ঘ একটা মাস ধরে চোখদুটো তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। তার একান্ত আরশাদ। আরশাদের ঠোঁটে লেগে থাকা হাসিটা যেন হৃদয়ে প্রশান্তি বহুগুণে বাড়িয়ে দিলো।
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না অরা। ধপ করে বসার ঘরের সোফার ওপর বসে কান্নায় ভেঙে পড়লো। আনন্দের অশ্রু যে এতটা তীব্র হয়, কে জানত?
আরশাদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে অরার পাশে বসে হাসিমুখে বলল, “এই অরা? কাঁদছো কেন? আমি কি এত কষ্ট করে তোমার কান্না দেখতে এসেছি?”
কান্না থামানোর কোনো ভাব-লক্ষণ অরার মাঝে প্রকাশ পাচ্ছে না। বরং আহ্লাদে কান্না কয়েকগুণ বেড়ে গেল। অরা হঠাৎ আরশাদকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ লুকালো। আরশাদের নীল পাঞ্জাবিটা তার অশ্রুতে ভিজে একাকার। আরশাদ আজ সকালে অফিসের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে দেখেছিল অরা নীল রঙের শাড়ি পরেছে। তাই সেও একই রঙ বাছাই করেছে।
আরশাদ অরার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে ভয় দেখিয়ে বলল, “এত কাঁদলে আমি কিন্তু আবার চলে যাবো।”
কথা অরার আরেকপাশে বসতে বসতে বলল, “জানো বাবা, অরা ভেবেছিল তুমি অ্যানিভার্সেরীর কথা ভুলে গেছ।”
আরশাদ দৃঢ় গলায় বলল, “আর তোর অরা ভুলে গিয়েছিল, আমার মেমোরি কতটা শার্প। এত সহজে ভুলে যাবো।”
অশ্রুতে চোখের কাজল লেপ্টে গেছে অরার। চোখের চারপাশে ছড়িয়েও গেছে কিছুটা। চোখের জল মোছার কোনপ্রকার চেষ্টা না করে অরা আরশাদের বুক থেকে মুখ তুলে বলল, “তুমি অনেক খারাপ!”
আরশাদ ভ্রু ওপরে তুলে বলল, “তাই না-কি? তা কবে থেকে খারাপ?”
অরা আবারও আরশাদের বুকে মাথা রেখে বলল, “তুমি আসবে, এ কথা একবার বললে কী হতো?”
আরশাদ অরার চুলে হাত বুলিয়ে দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, “বললে সারপ্রাইজ দিতাম কী করে? আমি তো চেয়েছিলাম রাত বারোটায় সারপ্রাইজ দিতে। পারলাম কই?”
অরা বাচ্চাদের মতো প্রতিবাদ করে বলল, “রাখো তোমার সারপ্রাইজ! তুমি আমাদের অ্যানিভার্সেরী ভুলে গেছ ভেবে আমি কতটা কষ্ট পেয়েছিলাম জানো?”
পুরো পৃথিবীর সামনে শক্ত-পরিপক্ক অরা ঠিক এভাবেই আরশাদের কাছে গলে যায়। তখন আর তাকে শক্ত-পরিপক্ক মনে হয় না। মনে হয় একটা বাচ্চা মেয়ে। যে কিনা সর্বক্ষণ ভালোবাসার মানুষের সকল আগ্রহের কেন্দ্রে থাকতে চায়।
অরার চোখের জলগুলো মুছে দিয়ে আরশাদ বলল, “চলো, কেকটা কাটি।”
কথা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “আমরাও তো একটা কেক নিয়ে এসেছি বাবা।”
আরশাদ জোর গলায় বলল, “দুটোই কাটবো!”
অরা আর কথার আনা কেকটা বক্স থেকে বের করলো আরশাদ। সেটাকে টেবিলের ওপর তার আনা কেকের পাশে রাখলো। কথা হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে আরশাদকে কেক অর্ডার দেওয়ার পুরো ইতিহাসটা শোনাচ্ছে। আরশাদও মনোযোগী শ্রোতার ন্যায় শুনছে মেয়ের কথা। দুজনের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল না। জাগতিক দৃষ্টিতে পৃথিবীটা বিশাল। তবে তার পৃথিবী এক দুটো মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই দুটো মানুষ আশেপাশে থাকলে আর কোনো কিছুর প্রয়োজন পড়ে না অরার।
কেক কাটতে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কথা আঁতকে উঠে বলল, “দাঁড়াও! দাঁড়াও! আমি তো স্কুল ড্রেস পরে কেক কাটবো না।”
অরা বলল, “যা চেঞ্জ করে আয়। আমরা ওয়েট করছি।”
কথা এক দৌড়ে দোতলায় নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো।
অরা আরশাদের দিকে তাকিয়ে রহস্যমাখা গলায় বলল, “শট রেডি না?”
আরশাদ কিছুই বলল না। তার মোহনীয় হাসিটা ছুঁড়ে দিলো কেবল।
অরা কৌতুহল নিয়ে বলল, “কে বলেছিল কথাটা?”
“আমাদের বাড়ি ডেকোরেশন করতে একটা ডেকোরেশন টিম হায়ার করেছিলাম। তোমার ফোন রিসিভ করার আগে ওই টিমের একটা ছেলেকে শিখিয়ে দিয়েছিলাম।”
অরা আহত গলায় বলল, “কী দরকার ছিল এত ড্রামা করার?”
আরশাদ অরার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে নিজের বুকের ওপর ফেলে বলল, “ভাবলাম আরেকটু খারাপ হই!”
দুটো বছর হয়ে গেল বিয়ের। এই দুই বছরে অসংখ্যবার অরার কাছে এসেছে আরশাদ, অসংখ্যবার গভীরভাবে স্পর্শ করেছে তাকে। তবে প্রতিবারই ঠিক প্রথমবারের মতো লজ্জায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করে আরশাদ গালদুটো। ছেলেটার দিকে চোখ তুলে তাকানো যেন দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে।
আরশাদ অরার কানের সঙ্গে ঠোঁট মিশিয়ে বলল, “এত কষ্ট করে সারপ্রাইজ দিলাম, আমার গিফট কই।”
অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “গিফট এনেছি তো। কেক কাটার পরে দিই।”
“ওই গিফট না তো!”
অরা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, “তাহলে?”
আরশাদ দুষ্টুমিমাখা গলায় ফিসফিস করে বলল, “এই গিফট!”
আর এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে অরার ঠোঁটদুটো আকড়ে ধরলো আরশাদ নিজের ঠোঁট দিয়ে। নিজের মাঝে হারিয়ে যাওয়ার মতো একটা মুহূর্ত। যে মুহূর্তে সমগ্র পৃথিবী অরার কাছে মূর্ছা যায়। তার অন্তরাত্মা কেবলই আরশাদ নামের গান গায়।
কিছুটা সময় পর অরার ঠোঁট ছেড়ে আরশাদ তার কানে ফিসফিস করে বলল, “I love you!”
হাজারো প্রজাপতি উড়ে গেল অরার মনে। এই কথাটা এর আগেও বহুবার বলেছে আরশাদ। প্রতিবারই সমস্ত শরীরে বিচিত্র এক শিহরণ খেলে যায়।
অরা লজ্জাসরমের মাথা খেয়ে বলল, “I love you too.”
কথার চেঞ্জ করে নেমে আসতে আরও কিছুটা সময় লাগলো। অবশেষে হাজারো আনন্দের মাঝে কেক কেটে আজকের বিশেষ দিনটাকে আরেকটু বিশেষ করে তুলল তারা তিনজন।
রাত আটটা। উদযাপন শেষে বাগানের সুইমিং পুলে পা ডুবিয়ে বসে আছে আরশাদ-অরা। কথা ওদিকে পুরো বাগান জুড়ে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে।
আরশাদের কাঁধে মাথা রেখে অরা হাস্যোজ্বল কণ্ঠে বলল, “Thank you.”
আরশাদ জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে বলল, “কেন? সারপ্রাইজ দিলাম বলে?”
“না। সবকিছুর জন্যে। আমার জীবনে আসার জন্যে, আমাকে ভালোবাসার জন্যে, তোমাকে বাসতে দেওয়ার জন্যে।”
“ভালোবাসার জন্যে থ্যাংক ইউ বলতে হয় না। শুধু ভালোবেসে যেতে হয়।”
অরা মলিন কণ্ঠে বলল, “তুমি কি কালই চলে যাবে?”
আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “যেতে হবে। শুধু আজকের দিনটার শিডিউল দিইনি।”
অরা চুপ করে সুইমিং পুলের জলের দিকে তাকিয়ে রইলো।
অরার মনটাকে একটু ভালো করে দেওয়ার জন্যে আরশাদ বলল, “এই মরার শুটিং শেষ হলে আমরা কোথাও বেড়াতে যাবো।”
অরা আগ্রহ নিয়ে বলল, “কোথায় যাবো?”
আরশাদ খানিকটা চিন্তা করে বলল, “দেশের বাইরে কোথাও! তুমি কখনো মালদ্বীপে যাওনি, তাই না?”
অরা না-সূচক মাথা নাড়লো।
আরশাদ হাসিমুখে বলল, “আমি আর কথা একবার গিয়েছিলাম। অসম্ভব সুন্দর জায়গা! এই শুটিং শেষ হলে আমরা তিনজন একসঙ্গে যাবো।”
অরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আরশাদের কাঁধ থেকে মাথা তুলে কম্পিত স্বরে বলল, “তিনজন না, চারজন।”
আরশাদ যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে। তার বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না অরা কী বোঝাতে চাইছে। চমকে তার চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। হতবাক দৃষ্টিতে অনেকটা সময় আরশাদ তাকিয়ে রইল অরার দিকে। আরশাদের এমন প্রতিক্রিয়ায় আনন্দে জল চলে এলো অরার চোখে।
একটা ছেলে বাবা হবার সংবাদে এতটা খুশি হতে পারে, আরশাদকে না দেখলে কখনোই বুঝতো না অরা। আরশাদের চোখদুটো জুড়েও জড়ো হতে শুরু করেছে আনন্দের অবাধ্য অশ্রুগুলো।
শক্ত করে অরাকে জড়িয়ে ধরলো আরশাদ। যেন বাঁধন একটু আলগা হলেই অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে তার প্রাণপাখিটা। হারিয়ে গেলেও অবশ্য ক্ষতি নেই। নিখাদ ভালোবাসার শক্তি দিয়ে অরাকে ঠিকই ফিরিয়ে আনবে আরশাদ।
(সমাপ্ত)
[এই পর্বটা লেখা শেষ করে আমি যে কী লেভেলের ইমোশনাল হয়ে গেছি! পর্বের সাথে সাথে গল্পটাও শেষ হয়ে গেল! আড়াই মাস ধরে আমার চিন্তা-ভাবনায় যে আরশাদ আর অরা ঘোরাফেরা করে আসছে, আজকের পর থেকে তারা আর আসবে না। এই গল্পের শুরুর দিকে অনেক মানুষের অনেক কথা শুনছি। অনেক সময় মনে হয়েছে, গল্পটা বন্ধ করে দিই। কিন্তু আমি গল্প বন্ধ করিনি, শেষ পর্যন্ত লিখে গেছি। আমার এই সাহসের মূলে আছেন আপনারা। প্রতিটা পর্বে আমার পাশে থেকে, আমাকে সাহস যুগিয়ে, আমাকে লিখতে বসার অনুপ্রেরণা দিয়ে এসেছেন আপনারা। আমার প্রিয় পাঠকমহল! ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না আপনাদের। শুধু এতটুকু বলে রাখতে চাই, আপনারা প্রত্যেকে আমার জন্যে অনেক অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আপনারা আছেন বলেই আমার জীবনটা এত সুন্দর! এতগুলো দিন আমার সাথে থাকলেন, শেষ পর্ব পড়ে নিশ্চয়ই আমার মতো মনটাও খারাপ হয়ে গেছে। আসেন আপনাদের মনটা ভালো করে দিই! আরশাদ আর অরার গল্প এখনো শেষ হয়নি। গল্প তো সবে শুরু। হ্যাঁ, আমি এই গল্পের সিজন ২ লিখবো। সিজন ১ যেখানে শেষ করেছি, সিজন ২ ঠিক সেখান থেকেই শুরু হবে। তবে তার জন্যে আপনাদের কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। কথা দিলাম ফিরে আসবো ফিরে আসা নিয়ে। ❤️]