#ফিরে_আসা
২৬
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
মাথার একপাশটা ভার হয়ে আছে অরার। চোখের সামনে সবকিছু আবছা দেখছে। নিজের অবস্থান টের পেতে তার ভারী অসুবিধা হচ্ছে। কোথায় আছে সে? গ্রামের বাড়িতে? ভোর কি হয়েছে গেছে? ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে না উঠলে তাকে তো নতুন মায়ের মার খেয়ে হবে।
অরা ধীরে ধীরে উঠে বসলো। সারা শরীরে বিচিত্র ক্লান্তি ছেয়ে আছে। হাত-পা ব্যথায় টনটন করছে। একটু একটু করে বাস্তবতায় ফিরতে শুরু করেছে তার চেতনা। না, সে গ্রামের বাড়িতে নেই। আছে সিলেটের এক পাঁচতারকা হোটেলে। তাকে এখন আর নতুন মায়ের মারের ভয় করতে হয় না। সে তো এখন আরশাদ হকের ম্যানেজার!
চোখদুটো কচলে চোখ মেলে তাকালো অরা। নিমিষেই হকচকিয়ে উঠলো তার সমস্ত অন্তরাত্মা। কোথায় আছে সে? এই ঘরটা তো তাকে দেওয়া হয়নি। এটা তো আরশাদের ঘর! কী সর্বনাশ! সে এখানে এলো কী করে? আশেপাশে চোখ বোলাতেই তার নজর পড়লো নিজের হাতের দিকে। অরার হাতে স্যালাইনের ক্যানোল। স্যালাইন এখন আর চলছে না, কিন্তু একটা সময়ে যে চলছিল তা খুব ভালো করেই অরা বুঝতে পারছে।
কাল রাতের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করছে অরা। কী ঘটেছিল কাল? তার মনে আছে সোফায় বসে সে আরশাদের সঙ্গে কাজের কথা আলাপ করছিল, সবশেষে আরশাদ বলল তার ল্যাপটপে পুরো শিডিউল টাইপ করে দিতে। কিন্তু এরপরে কী হয়েছে? অরার কিছুই মনে পড়ছে না। সে কি ল্যাপটপ নিতে এ ঘরে এসেছিল? এসে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল এরকম কিছু? কিন্তু এ ঘরে আসার কোনো স্মৃতি তো নেই তার মস্তিকে। তাহলে সে এখানে এলো কী করে?
অরা চোখ বুলিয়ে আরশাদকে খোঁজার চেষ্টা করলো। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেল না তাকে। তাই আর অপেক্ষা না করে সোজা বেরিয়ে গেল এ ঘর থেকে। মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সে কি আসলেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল না-কি এ ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়েছে? নিজের ওপর নিজেই বিরক্ত হয়ে পড়লো অরা। এসব আবার কী চিন্তাভাবনা? সে আরশাদের ঘরে ঘুমিয়ে পড়তে যাবে কেন?
সিড়ি বেয়ে সাততলা থেকে পাঁচতলায় নামছে অরা। পথে যতগুলো মানুষ পড়েছে, সবাই তার দিকে একবার করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছে। এসব কী হচ্ছে তার সঙ্গে? মানুষজন তাকে এমন বাঁকা নজরে দেখছে কেন? এ নিয়ে অবশ্য খুব একটা মাথা ঘামালো না অরা। সদ্য ঘুম থেকে ওঠার পর তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। চোখেমুখেও নিশ্চয়ই লেগে আছে ঘুমের রেশ। সেজন্যেই হয়তো ওই দৃষ্টিগুলো এমনভাবে দেখতে তাকে।
নিজের ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলো অরা। এক্ষুনি আরশাদকে খুঁজে বের করতে হবে। তাকে জানতেই হবে গতকাল কী ঘটেছিল। যদি সত্যিই সে আরশাদের ঘরে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে তাহলে তো কয়েকবার ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু অরার দৃঢ় বিশ্বাস গতরাতে সে আরশাদের ঘর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। ওই ঘরে যাওয়ার আগেই কি সে অজ্ঞান হয়েছিল? তাহলে তাকে ওই ঘরে নিয়ে গেল কে? আরশাদ? ধুর! তা আবার কী করে সম্ভব?
দূর থেকে অস্পষ্ট একটা আওয়াজ ভেসে আসছে। অনেক মানুষের শোরগোলের আওয়াজ। শব্দের উৎসটার দিকে কৌতূহলী ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল অরা। শব্দের উৎস হোটেলের বাইরে, নিচে। জানালার পর্দা সামান্য ফাঁক করে বাইরের দিকে তাকাতেই দ্বিতীয়দফায় হকচকিয়ে উঠলো অরা। হোটেলের সামনে জড়ো হয়েছে শতশত সাংবাদিক।
আরশাদ এখানে শুটিং করছে, সাংবাদিক জড়ো হওয়াটাই স্বাভাবিক। গতকালও হোটেলের সামনে সাংবাদিক ছিল, তবে এত না। হোটেলের সিকিউরিটি গার্ডদের রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের সামলাতে গিয়ে। হচ্ছেটা কী আজ? বাস্তবতা যেন অরার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।
অরার ফোন বেজে উঠলো। জানালার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফোনের দিকে তাকাতেই তার চোখে পড়লো সীমার নাম।
অরা ফোন রিসিভ করতেই সীমা চিন্তিত গলায় বলল, “অরা? ঠিক আছিস তুই?”
“হ্যাঁ, ঠিক আছি।”
“তোর শরীর ঠিক আছে তো?”
অরা ব্যস্ত গলায় বলল, “হ্যাঁ। সীমা শোন, আমি তোকে একটু পরে ফোন করছি।”
সীমা আঁতকে উঠে বলল, “না! আমার কথাটা জরুরি।”
“কী কথা?”
“তার আগে বল তুই কোথায়?”
“আমি কোথায় আবার থাকবো? হোটেলে!”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সীমা বলল, “কাল রাতে কী হয়েছিল অরা?”
“তুই কী করে জানলি কাল রাতে কিছু হয়েছিল?”
“তুই কিছু জানিস না?”
অরা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “সীমা তুই কী বলতে চাচ্ছিস? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।”
“মাত্র ঘুম থেকে উঠেছিস না?”
“হ্যাঁ।”
সীমা শুকনো গলায় বলল, “অরা, শোন আমার কথা। মনটাকে শক্ত কর।”
অরা ভয়ে ভয়ে বলল, “কেন? কী হয়েছে?”
“ফেসবুকে ঢোক।”
“কেন?”
“ঢোক, নিজেই বুঝতে পারবি।”
সীমার ফোন রেখে অরা হন্তদন্ত করে ফেসবুকে ঢুকল। আজ একের পর এক বিস্ময়ের মুখোমুখি হয়েছে সে। প্রথমে সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে আরশাদের ঘরে আবিষ্কার করা, হোটেলের সামনে একরাশ সাংবাদিক, এখন আবার সীমার ব্যস্ত স্বরে ফেসবুকে ঢুকতে বলা। অরা মোটেও ভীতু প্রকৃতির মেয়ে নয়। তবুও কোনো এক অজানা কারণে তার হৃদস্পন্দন একটু একটু করে বেড়েই চলেছে। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। এখানকার নেটওয়ার্কে অসুবিধা আছে মনে হয়। ফেসবুক ওপেন হতে স্বাভাবিকের থেকেও বেশি সময় লাগছে। যা অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে অরার।
অবশেষে ওপেন হলো ফেসবুক। নিউজ ফিডের শীর্ষে থাকা ভিডিওটা দেখে অরার গা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। ভিডিওটা সিসিটিভি ফুটেজের অংশ। আরশাদ এবং অরা হলওয়ে দিয়ে হাঁটছে আর কথা বলছে। হাঁটতে হাঁটতেই আচমকা জ্ঞান হারিয়ে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়লো অরা। আরশাদ কিছু সময় চিন্তিত ভঙ্গিতে ডাকাডাকি করলো তাকে। শেষমেশ কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কোলে তুলে নিলো তাকে। কোলে নিয়ে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে।
ভিডিওটা প্রথমবার দেখে নির্বাক বনে গেল অরা। বুঝতে পারছে না তার কোন অনুভূতিটা অনুভব করা উচিত। আরশাদ তাকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে গেছে এই ব্যাপারে বেশি অবাক হওয়া উচিত না-কি এই ভিডিও ফেসবুকে ঘোরাঘুরি করছে বলে অবাক হওয়া উচিত? অরা কিছুই বুঝতে পারছে না। প্রচন্ড বেগে ঘুরপাক খাচ্ছে তার মস্তিষ্ক।
নিজের অজান্তেই অরার আঙুল চলে গেল ভিডিওটার কমেন্ট সেকশনে। কমেন্ট সেকশনে ভেসে যাচ্ছে নতুন নতুন কমেন্টে। কী সাংঘাতিক অবস্থা! তার মানে এই কান্ড জানতে কারোরই বাকি নেই? এজন্যেই হোটেলের সামনে জড়ো হয়েছে একরাশ সাংবাদিক?
আশরাফুল ইসলাম নামে একজন লিখেছে : ছি! কী চরিত্রহীন মেয়ে! এভাবে কেউ একটা পুরুষ মানুষের সামনে অজ্ঞান হয়?
রায়হান চৌধুরী লিখেছে : কোনো অজ্ঞান-টজ্ঞান হয় নাই। সবই আরশাদের কোলে উঠার ধান্দা। মেয়েমানুষ জাতটাই খারাপ!
সোবহান তালুকদার লিখেছে : আরশাদের ঘরে যাওয়ার জন্য কী নাটকটাই করলো। অসভ্য মেয়ে!
হৃদয়ের আয়না নামের আইডি থেকে কেউ একজন কমেন্ট করেছে : মেয়েটার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।
রোকসানা খানম লিখেছে : আরশাদের টাকাপয়সা দেখে মাথা ঘুরে গেছে। লোভী মেয়ে তাই আরশাদকে পটানোর জন্য নাটক করতেছে।
টনি শিকদার নামের আইডি থেকে কমেন্ট করা হয়েছে : হোটেলগুলার রুমের ভেতরেও সিসিটিভি ক্যামেরা থাকে না কেন? ভেতরে কী হইলো দেখে বিনোদন পাইতাম।
সবাই যে শুধু অরাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করছে এমনটা নয়। অনেকে আবার আরশাদের দিকেও আঙুল তাক করছে।
সায়রা তাসনিম লিখেছে : আরশাদ কী দুধে ধোঁয়া তুলসী পাতা না-কি? মানলাম মেয়েটা নাটক করে অজ্ঞান হইছে, আরশাদের কী দরকার ছিল ওকে কোলে নিয়ে রুমে নিয়ে যাওয়ার? মেয়েটা যদি সত্যিই অজ্ঞান হয়ে থাকে তাহলে লোকজন জড়ো করতো, ডাক্তার ডাকতো। নিজের ঘরে নিয়ে গেল কেন? সে কি ডাক্তার না-কি?
মাইশা ইসলাম আবার কোনো একজনের দিকে আঙুল তাক না করে বিজ্ঞের মতো লিখেছে : সিনেমা জগতের সবাই খারাপ। এরা কোনোদিনও ভালো হবে না। এজন্য সিনেমা দেখাই ছেড়ে দিসি।
আনিস রহমান লিখেছে : আরশাদকে ভালো ভাবতাম। কিন্তু এইটা কী করলো? এইভাবে একটা অসুস্থ মেয়ের সুযোগ নিলো?
রায়হান চৌধুরী আবার তার কমেন্টে রিপ্লাই করে লিখেছে : কীসের অসুস্থ? ওই মেয়ে অসুস্থ না-কি? সব নাটক।
সানিয়া তাসনিম লিখেছে : আরশাদের চরিত্রে আসলেই সমস্যা আছে। নওশীন খামাখা ওকে ছেড়ে যায় নাই।
অরা বিস্মিত, স্তব্ধ। এসব কী হচ্ছে তার সঙ্গে? তাকে নিয়ে মানুষ এত বাজে বাজে কথা বলছে কেন? তার তো গত রাতের কোনো কথা মনেও নেই। তবুও কেন সবাই খারাপ ভাবছে তাকে। অরার চোখে জল এসে গেল। জল মোছার কোনপ্রকার চেষ্টা তার মধ্যে নেই। অরা বুঝতে পারছে না সে কেন কাঁদছে। সে তো ভেঙে পড়ার মতো মেয়ে নয়। শক্ত হাতে কঠিন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো মেয়ে। তবে কেন আজ ভেঙে পড়েছে সে?
আজকের শুটিং স্থগিত করা হয়েছে। ওই একটা ভিডিও ক্লিপের জন্যে সারা দেশ আজ উত্তপ্ত। ফেসবুকের প্রতিটা গ্রুপে গ্রুপে রীতিমত ভাইরাল যাচ্ছে ভিডিওটা। আর বাঙালি তার অভ্যাস মতো ঘটনার আদি-অন্ত না জেনেই নিজের অহেতুক মন্তব্য লিখতে ব্যস্ত।
আরশাদের সামনে বসে আছে এই হোটেলের ম্যানেজার আসিফ আলী। লোকটার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, দেখতে ছোটখাটো। আরশাদ সেই কখন থেকে লোকটার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে যাচ্ছে। সেই অগ্নিদৃষ্টির ভয়ে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে লোকটা। যার কারণে তাকে আরও ছোট দেখাচ্ছে।
আরশাদ শীতল গলায় বলল, “আপনার কাছে তাহলে কোনো উত্তর নেই?”
আসিফ আমতা আমতা করে বলল, “স্যার, আমরা এখনো জানি না কে এই কাজটা করেছে কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি জেনে যাবো।”
“এতক্ষণেই যখন জানতে পারলেন না, তখন খুব তাড়াতাড়ি জানবেন কী করে?”
“আমরা ছয় সদস্যের একটা ইনভেস্টিং টিম গঠন করেছি। তারা ইনভেস্টিগেশন করে বের করবে কে…”
আরশাদ দৃঢ় গলায় বলল, “I don’t care! I really don’t. একটা সহজ-স্বাভাবিক প্রশ্ন করেছি, প্রশ্নটার উত্তর দিন। কে লিক করেছে ভিডিও?”
আসিফ ভয়ে ভয়ে বলল, “স্যার ভিডিওটা আমাদের সিসিটিভি কন্ট্রোল রুম থেকে লিক হয়েছে। ওখানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউই কাজটা করেছে।”
“আমি জানতে চাচ্ছি সেই কেউটা কে?”
“স্যার, আমরা এখনো জানি না।”
আরশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “কেন শুধু শুধু মিথ্যা বলছেন? আপনি তো জানেন।”
আসিফ নামের লোকটার মুখভঙ্গি নিমিষেই বদলে গেল। আরশাদের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন কোনো কিছু চুরি করে সে ধরা পড়ে গেছে।
“ভালোয় ভালোয় ধরিয়ে দিন। তাতে আমার সময় বাঁচবে, আপনারও। আর হলে অন্য পদ্ধতিও আমার জানা আছে।”
“স্যার…?”
আসিফ লোকটা ইনিয়ে বিনিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তার চোখ পড়লো হোটেলের মূল দরজার দিকে। লোকাল থানার ওসি সাহেব তার দলবল নিয়ে প্রবেশ করছেন। পুলিশ দেখে আসিফের মুখে ভয় ভয় ভাবটা যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেল।
ওসি সাহেব আরশাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বিনয়ী গলায় বললেন, “আরশাদ সাহেব! কতদিন পর দেখা।”
আরশাদ তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, “Thank you for coming, ওসি সাহেব।”
“এটা তো আমাদের দায়িত্ব আরশাদ। আপনি বলুন কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি।”
“আমি একটা কেস ফাইল করতে চাচ্ছি ওসি সাহেব, এই হোটেলের ম্যানেজারের বিরুদ্ধে। তার আন্ডারেই কেউ একজন আমার সিসিটিভি ফুটেজ আমার পারমিশন ছাড়া ইন্টারনেটে লিক করে দিয়েছে।”
আসিফ আঁতকে উঠে ব্যস্ত গলায় বলল, “স্যার! আমার এত বড় ক্ষতি করবেন না স্যার।”
আরশাদ বলল, “আপনি তো বলতেই পারলেন না কে ভিডিও লিক করেছে। কেসটা তো আপনার ওপরেই করা উচিত।”
“আমি জানি স্যার। রাসেল করেছে এই কাজ। আমাদের সিসিটিভি কন্ট্রোল রুমে কাজ করে। আমি এক্ষনি ওকে নিয়ে আসছি।”
এতক্ষণ পর তাহলে সত্যিটা বের হলো। আরশাদ খুব ভালো করেই জানতো ভিডিও প্রকাশকারী ব্যক্তির নাম হোটেলের ম্যানেজারের অজানা নয়। তাকে ভয় দেখানোর জন্যই পুলিশকে খবর দিয়ে এনেছে। একটা হোটেলে সিসিটিভি ক্যামেরা রাখা হয় হোটেলের অতিথিদের নিরাপত্তার জন্যে। কিন্তু সেই সিসিটিভির ফুটেজ যদি অতিথির অনুমতি না নিয়েই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয় তবে তাকে বলা হয় নিরাপত্তালঙ্ঘন। এই হোটেল তার নিরাপত্তা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। আরশাদের ইচ্ছা করছে এই হোটেলের নামেই একটা আলাদা কেস ফাইল করতে।
রাসেল নামের ছেলেটা আরশাদের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সুযোগ পাচ্ছে না। একরাশ ভয় নিয়ে চোখদুটো স্থির হয়ে আটকে আছে মেঝের দিকে।
ওসি সাহেব ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “কী রে? খুব শখ না ভিডিও লিক করার?”
রাসেল আঁতকে উঠে বলল, “স্যার আমাকে মাফ করে দেন স্যার। আমি ভাবছি, আরশাদ স্যারের ভিডিও ফেসবুকে দিলে আমি কিছু লাইক পাবো। আমার ফলোয়ার বাড়বে।”
আরশাদ কিছু বলল না। শীতল দৃষ্টিতে তাকালো ওসি সাহেবের দিকে। ওসি সাহেব আশ্বাস দিয়ে বলল, “চিন্তা করবেন না আরশাদ সাহেব। আমরা ওর খেয়াল রাখবো।”
“Thank you, ওসি সাহেব।”
আরশাদ উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়ালো লিফটের দিকে। আজ সকাল থেকে অরার কোনো খবর নেই। অন্য দিনে সকাল সকাল সে আসে আরশাদকে “গুড মর্নিং” জানাতে, সারাদিনে কোন কোন দৃশ্যের শুটিং হবে তাকে বুঝিয়ে দিতে। শুটিং যে হচ্ছে না এটাই তো অরা জানে না। মেয়েটা এখনো অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে কিনা কে জানে?
নিজের ঘরে গিয়ে অরাকে খুঁজে পেল না আরশাদ। তার মানে মেয়েটার ঘুম ভেঙেছে। ঘুম ভেঙে থাকলে তো নির্ঘাত ভাইরাল ভিডিওটাও তার চোখ এড়িয়ে যায়নি। অরা এমনিতেই অসুস্থ। ওই ভিডিও নিয়ে তাকে বাড়তি দুশ্চিন্তা করতে দেওয়া যাবে না। আরশাদ চলে গেল পাঁচ তলায়। ভিডিওর ব্যাপারে তাকে তেমন চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে না। এটাই প্রথম বার নয় সুপারস্টার আরশাদ হক ভাইরাল হয়েছে।
অরার ঘরের কলিংবেল চাপার কয়েক মুহূর্তের মাঝেও ভেতর থেকে দরজা খুলে গেল। অরাকে দেখেই আরশাদ ধমকের সুরে বলল, “কী ব্যাপার অরা? ঘরে ঘাপটি মেরে বসে আছ কেন? সেই সকাল থেকে আমি তোমাকে খুঁজছি।”
“সরি স্যার।”
অরাকে দেখে ভীষণ ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে বেচারি কোনপ্রকার বিশ্রাম নেয়নি। ধমক দিয়ে মনে মনে আরশাদের নিজেরই খারাপ লাগলো। বারবার সে নিজেকে কথা দেয়, এই মেয়েটাকে কম বকাঝকা করবে। কিন্তু প্রতিবারই নিজেকে দেওয়া কথা রাখতে ব্যর্থ হয়।
ঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আরশাদ বলল, “এখন ঠিক আছ তুমি?”
দরজা বন্ধ করতে করতে অরা বলল, “জি স্যার।”
“জ্বর আছে এখন আর?”
“আছে, সামান্য।”
আরশাদ সোফায় বসে বলল, “কালকে একবার বললেই পারতে তুমি অসুস্থ, শুধু শুধু তোমার ওপরে কাজের প্রেশার দিয়েছি।”
অরা চুপ করে বসে পড়লো সোফার এক কোণে। জ্বরের কথাটা তার মাথা থেকে উড়ে গিয়েছিল। সেই তখন থেকে মাথায় ঘূর্ণির আকারে ঘুরপাক খাচ্ছে কেবল ওই মন্তব্যগুলো। মানুষজন তাকে নিয়ে এত বাজে বাজে চিন্তা করছে? কিন্তু কেন? সে তো খারাপ মেয়ে নয়। সবসময় ভালো একটা মেয়ে হয়ে থাকার চেষ্টা করেছে। তাহলে তার সাথেই কেন হচ্ছে এমনটা?
আরশাদ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “কাল রাতে তুমি সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলে। ডক্টর এসে বলেছে তোমাকে বেডরেস্টে থাকতে।”
“স্যার?”
“কী?”
অরা ইতস্তত করে কম্পিত স্বরে বলল, “ওই ভিডিও…”
আরশাদ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “ভিডিও নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না অরা। তুমি রেস্ট নাও।”
“স্যার সবাই আমাকে নিয়ে অনেক বাজে বাজে কথা বলছে।”
আরশাদ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো অরা কাঁদছে। শব্দ করে কাঁদছে। তার চোখদুটো বেয়ে অবিরাম বয়ে চলছে অশ্রুধারা। অবশ্য অরাকে কোনো দোষ দেওয়াটাও ঠিক নয়। একটা সময় আরশাদকে নিয়েও পত্র-পত্রিকায় আজেবাজে কথা লেখা হয়েছে। ফেসবুকের গ্রুপে গ্রুপে তাকে নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। সে জানে কোনো কারণ ছাড়া একরাশ মানুষের কটাক্ষের শিকার হওয়াটা কতখানি যন্ত্রণার।
আরশাদ অরাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলল, “কী আশ্চর্য! তাই বলে কাঁদতে হবে না-কি?অরা কান্না থামাও!”
কান্না থামানোর কোনো ভাব-লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না অরার মাঝে। কী এমন কমেন্ট অরা দেখেছে কে জানে? সকাল সকাল আরশাদ কেবল দেখেছিল তার এবং অরার ভিডিও ঘোরাঘুরি করছে ফেসবুকে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায় ম্যানেজারকে ধরতে। কমেন্ট পড়ার সময় সুযোগ আর পায়নি। তবে সে আঁচ করতে পারছে কী ধরনের কমেন্ট অরার চোখে পড়েছে। একদল বাঙালি আছে যারা অশোভন ভাষা ব্যবহার না করে সেলিব্রিটিদের পোস্টের নিচে কমেন্ট করতে পারে না।
আরশাদ বলল, “তোমার ফোনটা আমাকে দাও।”
অরা টু শব্দ না করে তার ফোন এগিয়ে দিলো আরশাদের কাছে।
ফোনটা হাতে নিতে নিতে আরশাদ বলল, “এটা আমার কাছে থাকুক। ওসব কমেন্ট দেখে তোমাকে প্যানিক করতে হবে না।”
আরশাদ চিন্তিত গলায় বলল, “আমার এখন কী করা উচিত বলো তো।”
অরা কান্নাজড়িত গলায় বলল, “আমি জানি না স্যার।”
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “জানো না মানে? ম্যানেজার হয়েছ কেন তাহলে?”
অরা চোখের জল মুছে কিছুটা সময় চিন্তা করে বলল, “আপনি হিমেল সাহেবকে একটা ফোন দিন স্যার, উনি ভালো বলতে পারবেন।”
হিমেল আরশাদের আইনজীবী। ডিভোর্সের সময় থেকেই এই মানুষটা আরশাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। যেকোনো সময়ে বিপদে পড়লে বিনা দ্বিধায় সে দ্বারস্থ হয় হিমেলের। হিমেল বুদ্ধি করে ঠিকই একটা উপায় বের করে দেয়। আরশাদ তার রাগের বশে টিমের সবাইকে নিজের কথায় চলতে বাধ্য করে। হিমেলই একমাত্র মানুষ যে আরশাদের রাগকে ভয় করে না।
আরশাদের ফোন পেয়ে হিমেল কল রিসিভ করে ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “আমি তোমাকেই ফোন দিতে যাচ্ছিলাম আরশাদ। এসব কী হচ্ছে?”
আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “দেখতেই তো পাচ্ছ কী হচ্ছে। Everything is under control now. যে ছেলেটা ওই ভিডিও লিক করেছে, পুলিশ তাকে এসে ধরে নিয়ে গেছে।”
“Nothing is under control Arshad. পুলিশ ওই ছেলেকে ধরে নিয়ে গেলে কী হবে? এদিকে তো তোমার রেপুটেশনের বারোটা বেজে যাচ্ছে।”
আরশাদ অবাক গলায় বলল, “মানে?”
“ফেসবুক ফেটে পড়ছে ওই একটা ভিডিওর কারণে। সবার মুখে মুখে শুধু ওই ভিডিও নিয়েই কথা।”
“সেটা তো আমিও জানি। তাতে রেপুটেশনের বারোটা বাজলো কী করে?”
হিমেল ইতস্তত করে বলল, “একটা দল তোমাকে খারাপ মনে করছে। মনে করছে তুমি… মেয়েটার অসুস্থতার সুযোগ নেওয়ার জন্য তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেছ।”
আরশাদ বিরক্ত গলায় বলল, “What rubbish!”
“ঠিকই বলছি আরশাদ। মেয়েটা তোমার ম্যানেজার অরা না?”
“হুঁ, অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তাই ওকে আমার রুমে নিয়ে গেছি। একটু পরে সেখানে ডক্টরও এসেছিল। আর মানুষ এটা নিয়ে এত বড় একটা ইস্যু তৈরি করে ফেলেছে?”
হিমেল অভিজ্ঞ গলায় বলল, “কারণ আছে আরশাদ। প্রথমত, কিছু মানুষের খেয়েদেয়ে কাজ নেই। দ্বিতীয়ত, যে ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে সেখানে তোমাকে আর অরাকে ছাড়া কাউকে দেখা যায়নি। একটা বিষয় কী তুমি জানো?”
“কোন বিষয়ে?”
হিমেল কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “আজ সকাল থেকে তোমার ফেসবুক পেজে দেড় লাখ ফলোয়ার কমে গেছে।”
মনে মনে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল আরশাদ। জল তাহলে এতদূর গড়িয়েছে? ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পুরো ব্যাপারটাকে এতক্ষণ হালকাভাবে নিয়েছিল আরশাদ। বাঙালির স্বভাব কয়েকদিন একটা জিনিস নিয়ে অনলাইনে মাতামাতি করে, আবার কয়েকদিন পর সারাজীবনের জন্যে সেটা ভুলে যাওয়া। আরশাদ ভেবেছিল এবারও ব্যতিক্রম কিছু হবে না। তবে দেড় লাখ ফলোয়ার কমে যাওয়া নিতান্তই তাচ্ছিল্যের বিষয় নয়। ভক্তদের ব্যাপারে খুবই সচেতন আরশাদ। নিজের একটা ভক্তও কখনো হারাতে চায় না। ওই ভন্ডদের কারণেই তো আজ সে সুপারস্টার হতে পেরেছে।
আরশাদ চিন্তিত গলায় বলল, “আমি এখন কী করবো?”
হিমেল আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “পরিস্থিতি সহজে ঠান্ডা হবে না আরশাদ। মানুষ তোমার ওপরে ক্ষেপে আছে। আমি কাল সকালের ফ্লাইটে সিলেটে যাচ্ছি। তোমার সঙ্গে সামনাসামনি ডিসকাশন করতে হবে।”
(চলবে)