#ফিরে_আসা ৬০ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
682

#ফিরে_আসা
৬০
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

স্টেজের সামনে রীতিমত ঝগড়া বেঁধে গেছে দিশা ও রনির মাঝে। কে আগে পারফর্ম করবে এই নিয়ে ঝগড়া।

রনি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “খুব না ইকুয়ালিটির গান গাও? এখন আবার এসেছো লেডিস ফার্স্টের দাবি নিয়ে? ভন্ডামীর একটা লিমিট থাকা দরকার!”

দিশা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ফালতু কথা বলবে না রনি! আমি মোটেও বলিনি লেডিস ফার্স্ট। আমরা আগে পারফর্ম করবো কারণ সবথেকে বেশি প্র্যাকটিস আমরাই করেছি।”

“বেশি প্র্যাকটিস করলে আগে নাচতে দিতে হবে এটা আবার কোন দেশি লজিক? তোমরা বেশি বেশি প্র্যাকটিস করেছো কারণ তোমরা নাচতে পারো না।”

দিশা অগ্নিদৃষ্টিতে রনির দিকে তাকিয়ে বলল,“ঠিক আছে। দেখা যাবে আজকে চেকটা কে পায়?”

আসফিয়া ছুটে এসে দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল, “কী বাচ্চাদের মতো শুরু করলি তোরা দুজন?”

দিশা ঠোঁটে উল্টে বলল, “আপা! আমরা কত কষ্ট করে দুদিন প্র্যাকটিস করলাম! এখন না-কি ওরা আগে পারফর্ম করবে।”

আসফিয়া ঠান্ডা গলায় বলল, “আয় কয়েন টস করি। যে জিতবে সে আগে পারফর্ম করবে।”

কয়েন টসের সিদ্ধান্তে রনিকে সন্তুষ্ট মনে হলেও দিশাকে খুব একটা সন্তুষ্ট বলে মনে হলো না।

দিশা গোমড়া মুখে বলল, “আমি শাপলা নিবো!”

“আচ্ছা বাবা! এই রনি? তোর কোনো আপত্তি নেই তো?”

রনি কৃত্রিম হাই তুলে বলল, “নাহ্! আমার আবার কীসের আপত্তি থাকবে? শাপলা-টাপলা এমনিতেও মেয়েদের জিনিস।”

দিশা তার অগ্নিদৃষ্টি এখনো নিক্ষেপ করে যাচ্ছে রনির দিকে। যদিও সেই দৃষ্টিতে খুব একটা গা মাখাচ্ছে না রনি। আসফিয়া একটা পাঁচ টাকার কয়েন ছুঁড়ে মারলো আকাশে। সঙ্গে সঙ্গে কয়েনটা আবারও ফিরে এলো তার হাতের মুঠোয়।

আসফিয়া হাসি হাসি মুখে বলল, “শাপলা!”

দিশা উৎফুল্ল গলায় বলল, “ইয়েস! আমি জানতাম! শুধু শুধু ঝামেলা করলে রনি।”

রনি আসনের দিকে পা বাড়িয়ে বলল, “টসে জিতলেই ম্যাচ জেতা যায় না।”

বাড়ির সামনের দিকটা আজ চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছে। গাঁদা আর গোলাপের মালায় মুড়ে দেওয়া হয়েছে বাড়িটাকে। বাড়ির সামনে বিশাল স্টেজ। স্টেজ বসানো হয়েছে আজ খুব ভোরে। ওপরে হলুদ রঙয়ের সামিয়ানা আর মরিচবাতি। স্টেজের চারপাশটাতেও ফুলের অপরূপ সজ্জা।

স্টেজের সামনে সকলের বসার আসন। সবগুলো সোফা হলুদ রঙের। সোফার প্রথম সারিতে বসেছে বিচারক প্যানেলের সদস্যরা। প্যানেলের বাইরে অরা বসে আছে প্রথম সারিতে। তার শাশুড়ি এবং মামী-শাশুড়ির মাঝখানে। দ্বিতীয় সারিতে অন্যান্য মুরুব্বীদের সঙ্গে বসেছে আরশাদ। নিজের পরিবারটার ওপরে বড্ড বিরক্ত লাগছে। বড় বড় অ্যাওয়ার্ড শোতে আরশাদের জন্যে প্রথম সারিটা বরাদ্দ রাখা হয়, অথচ নিজ বাড়িতেই তাকে সম্মান দেওয়া হচ্ছে না। প্রথম সারিতে বসা তার মূল লক্ষ্য নয়। মূল লক্ষ্য বউয়ের পাশে বসা।

প্রতিযোগিতার সঞ্চালনা করছে সীমা। তার হাতে একটা মাইক্রোফোন।

সীমা স্টেজে উঠে ঘোষণা করলো, “আপনাদের ধৈর্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। অল্প সময়ের মধ্যেই দিশার নেতৃত্বে স্টেজে পারফর্ম করতে যাচ্ছে এ বাড়ির সুন্দরী মেয়েরা।”

রনি দর্শকের আসন থেকে চিৎকার করে বলল, “আর কবে পারফর্ম করবে? দুই মিনিটের বেশি দেরি করলে তাদের বহিষ্কার করে দেওয়া উচিত!”

রনির সে আশা অবশ্য অপূর্ণই রয়ে গেল। দু মিনিটের আগেই স্টেজে উঠে গেল দিশা, মেহের, টগর আর নূপুর। চারজনের পরনেই হলুদ আর কমলার সমাহারের শাড়ি। দিশা স্কুলের সকল প্রোগ্রামই নাচের দলে থাকতো। সেই অভিজ্ঞতা থেকে পুরো নাচটা কোরিওগ্রাফ করেছে সে। নাচ মোটামুটি খারাপ হয়নি। দর্শক বেশ ভালোই উপভোগ করেছে।

তাদের পারফরমেন্স শেষে আবারও মাইক্রোফোন হাতে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে সীমা বলল, “বিচারক প্যানেলের চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে মেয়েদের পারফরমেন্স তাদের খুবই পছন্দ হয়েছে। দেখা যাক এ বাড়ির ছেলেদের নাচ তাদের কেমন লাগে! এবার রনির নেতৃত্বে পারফর্ম করতে আসছে এ বাড়ির ছেলেরা।”

ছেলেদের কাছ থেকে এমনিতেও কারও কোনো প্রত্যাশা নেই। তাই তাদের পারফরমেন্সের প্রতি সকলের তেমন আগ্রহ নেই। চারজনের পরনেই নীল পাঞ্জাবি। এই বুদ্ধিটা অবশ্য আরশাদের। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে মেয়েরা তো হলুদ পরবেই। তাদের থেকে নিজেদের আলাদা করার জন্যে আরশাদের এই নির্দেশনা।

গানটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সকলের আগ্রহ যেন কয়েক গুণ বেড়ে গেল। এই গান তো আরশাদের! কোনো বিয়ে বাড়ির গান নয়, তবে গানটা শুনলেই মনের অজান্তে সকলের পা দোলাতে ইচ্ছে করে। রনি ও তার দল, শাহীনের শিখিয়ে দেওয়া স্টেপগুলো পরপর অনুসরণ করে যাচ্ছে। আরশাদ বলে দিয়েছিল, “কোনো প্রেশার নিবি না। স্টেজে উঠে মনে করবি কেউ তোদের দেখছে না। প্রেশার নিলেই পারফরমেন্স খারাপ হয়ে যাবে।” ওরা আরশাদের কথা মতো বিন্দুমাত্র প্রেশার নিচ্ছে না। সকলে হা করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। এ বাড়ির ছেলেরা এত সুন্দর নাচতে পারে?

ছেলেদের পারফরমেন্স শেষ হতেই সীমা আবারও স্টেজে উঠে বলল, “এবার শুরু হতে যাচ্ছে আমাদের মেইন প্রোগ্রাম। আমার প্রাণের বান্ধবী অরা আর আমার সুপারস্টার দুলাভাই আরশাদ ভাইয়ার গায়ে হলুদ! গায়ে হলুদের পর্ব শেষে আমাদের বিচারকেরা বিজয়ী দলের নাম ঘোষণা করবে।”

দর্শকের আসন থেকে দিশা উদগ্রীব কণ্ঠে বলল, “এটা কেমন কথা সীমা আপু? এখনি বিজয়ীর নাম ঘোষণা করো!”

সীমা মিষ্টি গলায় বলল, “দিশা, এই প্রতিযোগিতায় যেমন একটা দল জিতবে তেমনি একটা দল হারবে। যে দল হারবে তারা সারাক্ষণ গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে মন খারাপ করে থাকবে। আমরা নিশ্চয়ই চাই না গায়ে হলুদের এই অনুষ্ঠানে কেউ মন খারাপ করে থাকুক!”

শূণ্য স্টেজে সুন্দর একটা সোফা উঠানো হলো। মুহূর্তের মাঝে সোফাটাকে হলুদ আর সাদা কাপড় দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলা হলো। এই সব কাজই করছে একটা ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন কোম্পানির লোকজন। সোফার সামনে মার্বেল পাথরের একটা টেবিল এনে রাখা হলো। টেবিল ভর্তি করে রাখা হলো ফুল আর মিষ্টি।

সবার আগে আরশাদ গিয়ে উঠলো স্টেজে। তাকে দেখেই বুকে ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেল অরা। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে বহু তারকা আছে। তবে তাদের মাঝে সবথেকে উজ্জ্বল তারাটা এই মানুষটা। অরার জীবনেও তাই। তার হলুদ পাঞ্জাবীর ওপরে সোনালী কাজ করা। ওপরের দুটো বোতাম খোলা রাখার তার জিম করা বডির কিছুটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। পরিপাটি করে রাখা চুল আর চোখের সানগ্লাসে যেন হ্যান্ডসামনেস হাজারগুণ বেড়ে গেছে।

অরাকেও নেহায়েত কম সুন্দর লাগছে না। পরনে হলুদ লেহেঙ্গা। তার কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া চুলগুলো আজ বাঁধনমুক্ত। গলায় আর কানে হালকা ধরনের গয়না। আর কপালে অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটা কালো টিপ। অরাকে হলুদের ফুলেল গয়নাগুলো এখনো পরানো হয়নি। সে স্টেজে উঠলেই তাকে সেগুলো পরিয়ে দেবে দিশারা।

অরা স্টেজে উঠে আরশাদের পাশে গিয়ে বসলো। আরশাদের ভাবটা এমন যেন অরাকে খেয়ালই করেনি। ওদিকে ফিরে বড় মামাকে কী যেন বলছে। অরা বেশ বুঝতে পারছে, কাজিনদের সঙ্গে ভাব নিচ্ছে আরশাদ। কাজিনরা জানে তিনদিন ধরে অরাকে দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছে সে। তারা যে গত রাতেই চুপি চুপি সে দেখা সেরে ফেলেছে, এটা তো আর কেউ যাবে না।

দিশা আর সীমা একেক করে অরাকে ফুলেল গয়নাগুলো পড়িয়ে দিলো। এই গয়নাগুলো ছাড়া যেন গায়ে হলুদ পরিপূর্ণ হয় না। স্টেজ সাজানো এখনো শেষ হয়নি। যে যার মতো ব্যস্ত।

আরশাদ অরার কানে কাছে ফিসফিস করে বলল, “তুমি এত সুন্দর কেন বলতো? না মানে, নিজেকে সুন্দর রাখার জন্যে স্পেশাল কিছু করো, না-কি বাই বর্ন এতটা সুন্দর।”

অরা মুচকি হেসে ফিসফিস করে বলল, “এই একই প্রশ্ন তো আমিও তোমাকে করতে পারি।”

আরশাদ বাঁকা হাসি হেসে বলল, “আমি তো বাই বর্নই সুন্দর। ওয়ান পিস মেড, কারিগর ডেড টাইপ অবস্থা। কিন্তু তোমার রহস্যটা কী?”

অরা কিছুটা ভেবে বলল, “তোমার দেখার চোখ।”

আরশাদ বিভ্রান্ত গলায় বলল, “মানে?”

“আগে আমাকে যেভাবে দেখতে, সেভাবে অতটা সুন্দর মনে হতো না। কিন্তু এখন যেভাবে দেখো, সেভাবে সুন্দর মনে হয়।”

আরশাদ কিছুটা একটা বলার জন্যে মুখ খুলেছে, কিন্তু সেটা আর বলতে পারলো না। কথা গুটি গুটি পায়ে স্টেজে উঠে হাসিমুখে অরার দিকে ছুটে আসছে। হলুদ রংয়ের একটা ফ্রকে আজ তাকে রূপকথার রাজকন্যাদের মতো লাগছে।

কথা অরার কাছে এসে বায়না ধরে বলল, “অরা! আমিও এখানে বসবো।”

পাশ থেকে কথার বায়না শুনে সেলিনা হক তার দিকে তাকিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল, “এখানে বসে না দাদুভাই, চলো আমরা নিচে গিয়ে বসি।”

অরা বলল, “থাকুক না মা। এখানে বসতে চাইছে, বসুক।”

অরা আরশাদের কাছ থেকে সরে গিয়ে কথার জন্যে জায়গা করে দিলো। কথাও তড়িৎ গতিতে উঠে বসলো দুজনের মাঝে। দৃশ্যটা দেখে যেন সেলিনা হকের চোখ জুড়িয়ে গেল। সুন্দর সুখী পরিবারের দৃশ্য। তিনি মনে মনে প্রার্থনা করলেন, ওরা যেন আজীবন এমন সুখেই থাকে।

গায়ে হলুদের পর্ব শুরু হলো। একেক করে আত্মীয় স্বজনেরা স্টেজে উঠছেন, দুজনের গালে বা কপালে কাঁচা হলুদ ছুঁইয়ে দিচ্ছেন আর সেই সঙ্গে তাদের মিষ্টি খাইয়ে দিচ্ছেন। এরই নাম তাহলে গায়ে হলুদ? অরা কখনো কোনো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যায়নি বলে জানতো না এ অনুষ্ঠানে বর-কনের ওপর এমন মিষ্টির অত্যাচার করা হয়। মিষ্টি খেতে খেতে বেচারির মুখের স্বাদই চলে গেছে। ওদিকে সুপারস্টার সাহেবের ডায়েটের বারোটাও ইতোমধ্যে বেজে গেছে।

একের পর এক ছবি তুলতে তুলতে এবং প্রতিটা ছবি ঠোঁটের হাসি বজায় রাখতে রাখতে অরার গালে রীতিমত ব্যথা শুরু হয়েছে। ওদিকে লাউডস্পিকারে বিয়ে বাড়ির গান বাজছে। আত্মীয়-স্বজনেরা হলুদ ছোঁয়াতে এসে কী বলছেন, বোঝার কোনো উপায় নেই।

উচ্চ শব্দের মাঝেও অরার কানে এসে পৌঁছালো আরশাদের ডাক।

“অরা?”

অরা তার দিকে ফিরে তাকাতেই আরশাদ কাঁচা হলুদের বাটিতে একবার হাত ডুবিয়ে কোমল স্পর্শে হলুদ ছোঁয়ালো অরার গালে। লজ্জায় অরা স্তম্ভের আকার ধারণ করলো। এত নির্লজ্জ কেন এই ছেলেটা? পরিবারের সকলের সামনে কেউ এভাবে বউকে ছুঁয়ে দেয়? ভাগ্যিস ব্যাপারটা কেউ লক্ষ্য করেনি। লক্ষ্য করলেও কিছু মনে করেনি।

ওদিকে ফটোগ্রাফারের ক্যামেরায় সুন্দর একট ছবি ধরা পড়লো। আরশাদ অরার গালে হলুদ ছুঁইয়ে দিচ্ছে, আর কথা চকচকে চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বসার ঘরে বড় করে বাঁধাই করে রাখার মতো একটা ছবি।

গায়েহলুদের পর্ব শেষে আরশাদ আর অরা কথাকে নিয়ে স্টেজ থেকে নেমে গিয়ে বসলো দর্শকের আসনে। এবার আর কেউ তাদের আলাদা বসাতে পারেনি। সীমা দুই দলকে স্টেজে ডেকে নিলো। সীমার ডান দিকে দাঁড়িয়েছে টিম দিশা আর বাম দিকে টিম রনি।
এরপর সে ডেকে নিলো বিচারক প্যানেলের
সদস্যদের।

সীমা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “এখন সেই মুহূর্ত যার জন্যে আমরা শুরু থেকে অপেক্ষা করে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আজকের বিশেষ ড্যান্স কম্পিটিশনের বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে। আপনাদের আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি, বিজয়ী দল পাবে এক লক্ষ তেষট্টি হাজার টাকার চেক। আর পরাজিত দল সান্তনা পুরস্কার হিসেবে পাবে হাফ কেজি কালো জাম।”

সীমা হেঁটে গিয়ে সেলিনা হকের কাছে দাঁড়িয়ে বলল, “খালা তোমরা বিজয়ীর নাম নির্ধারণ করেছো?”

সেলিনা হক হাসিমুখে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।

সীমা উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে বলল, “তাহলে কে হতে যাচ্ছে আজকের বিজয়ী? টিম দিশা না-কি টিম রনি?”

সীমা তার মাইক্রোফোন নিয়ে ধরলো সেলিনা হকের সামনে। সেলিনা হক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে রহস্যের সৃষ্টি করলেন। দিশা এবং রনি দুজনেই ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। অবশেষে সেলিনা হক নীরবতা ভঙ্গ করে হাসিমুখে বললেন, “টিম রনি!”

রনি, আকাশ, পবন আর মিশান উচ্ছ্বাসে ঝাঁপিয়ে পড়লো একে অপরের উপর। ওদিকে দিশা, মেহের, টগর ও নূপুরের চোখেমুখে যেন অন্ধকার নেমে এসেছে। দিশা ধরেই নিয়েছিল তার দল বিজয়ী হবে। তবে এটা কী হয়ে গেল? রনিরা যে বিজয়ী হতে পারে এটা তার কল্পনাতেও আসেনি।

রনি ছুটে গিয়ে স্টেজ থেকে নেমে আরশাদকে জড়িয়ে ধরলো। আরশাদ তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “Proud of you.”

রনি আবারও ফিরে গেল স্টেজের দিকে।

অরা আরশাদের দিকে তাকিয়ে সন্দেহযুক্ত কণ্ঠে বলল, “ওদের জেতার পেছনে তোমার হাত আছে তাই না?”

আরশাদ হালকা গলায় বলল, “থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে।”

অরা আগ্রহ নিয়ে বলল, “কাহিনীটা কী?”

আরশাদ অন্যরকম গলায় বলল, “সব গল্প এখনই শুনবে?”

অরা জবাব না দিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো স্টেজের দিকে। এই ছেলেকে ভরসা নেই। যখন তখন এত মানুষের ভিড়ে নিজের লাগামছাড়া কথার মেলা খুলে বসবে।

সীমা গিয়ে ঘরের ভেতর থেকে চেকটা নিয়ে এলো। আবার মাইক্রোফোন হাতে বলল, “এবার আমাদের বিচারক প্যানেলের সদস্যদের অনুরোধ করছি এক লাখ তেষট্টি হাজার টাকার এই চেক টিম রনির হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে।”

সীমার এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রনি হাত তুলে বলল, “আমি কিছু বলতে চাই!”

সীমা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে মাইক্রোফোনটা তুলে দিলো রনির হাতে।

রনি মাইক্রোফোন হাতে দৃঢ় গলায় বলল, “আমরা এই পুরস্কার টিম দিশার সঙ্গে শেয়ার করতে যাই।”

উপস্থিত সকলে অবাক না হয়ে পারলো না। কেউ ভাবতেই পারেনি রনি এমন একটা কথা বলবে। এ যেন রনিদের জয়ের থেকেও বড় বিস্ময়!

দিশা ভ্রু কুঁচকে বলল, “তোমাদের পুরষ্কার আমরা নিতে যাবো কেন?”

রনি খানিক হেসে বলল, “এই কম্পিটিশনের জন্যে আমরা দুই দলই কষ্ট করেছি। তাই পুরষ্কার আমাদের সবার প্রাপ্য। আমরা এখানে জিতছে এসেছিলাম, পুরষ্কার নিতে না। জিতেছি এটাই অনেক। পুরষ্কার দুইদলের মধ্যে ভাগব হলেই আমরা খুশি।”

রনির এমন কথায় মুগ্ধ হয়ে গেল সকলে। দিশাও মনে মনে মুগ্ধ না হয়ে পারলো না। তার দল জিতলে সে মোটেও পুরষ্কার ভাগাভাগি করে নিতো না রনিদের সঙ্গে। কিন্তু রনির ভাবনাচিন্তা একেবারেই আলাদা।

দিশাকে দ্বিধা-দ্বন্দে দেখে রনি বলল, “মনে করো আমাদের টিমের পক্ষ থেকে এটা তোমাদের জন্য গিফট। আর গিফট তো ফিরিয়ে দিতে হয় না কখনো।”

রনির ইচ্ছা অনুযায়ী শেষমেশ দুটো দলই পেলো চেকটা। এক লাখ তেষট্টি হাজার টাকার চারভাগ না হয়ে হলো আটভাগ। রনির প্রতি দিশার দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই বদলে গেল। আগে তার মনে হতো এই ছেলে নিতান্তই বেকার টাইপ। দিনভর বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যার কাজ। অথচ আজ তার মনে হচ্ছে, রনির অসম্ভব সুন্দর একটা মন আছে।

উৎসবের আমেজ যেন শেষই হচ্ছে না এ বাড়িতে। সকালের আনন্দঘন গায়ে হলুদের পর্ব শেষ হতে না হতেই সন্ধ্যায় শুরু হলো হাত মেহেদিতে রাঙানোর উৎসব। ঢাকা থেকে প্রায় দশজন গুণী মেহেদি আর্টিস্ট এসেছেন এ বাড়ির মেয়েদের হাত রাঙিয়ে দিতে। বাড়ির সামনে মেয়েরা ছোট ছোট আসনে বসে হাতে মেহেদি দিচ্ছে। সবথেকে আয়োজন করে মেহেদি দেওয়া হচ্ছে অরার হাতে। সে যে আসনটায় বসেছে সেটা ফুলে সাজানো। আসনের চারিদিক আবার কুশনে ভরে গেছে। আরাম করে কুশনে হেলান দিয়ে বসে হাতে মেহেদি পরছে অরা।

দুজন ফটোগ্রাফার বিভিন্ন জায়গা থেকে এই দৃশ্য ধারণ করছে। তবুও অরার পাশে বসে পুরো দৃশ্যটার ভিডিও মোবাইলে ধারণ করছে সীমা।

অরা ক্লান্ত স্বরে বলল, “আর কত ভিডিও করবি? যা তুইও গিয়ে মেহেদি লাগিয়ে ফেল!”

সীমা বিরক্ত গলায় বলল, “আরে বাবা, আরশাদ ভাইয়ার নামটা লেখা হলেই চলে যাবো। তোর হাতে ভাইয়ার নাম লেখা হচ্ছে, এই জিনিসটা ভিডিও করা দরকার না?”

মুক্তার মতো অক্ষরে বাংলায় অরার হাতে লেখা হলো, ‘আরশাদ’। লেখাটার ওপর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অরা। এই নামটা একান্তই তার। এ পৃথিবীতে আর কারও সাধ্য নেই নামটাকে নিজের করে নেওয়ার।

মেহেদিতে হাত রাঙানো শেষে অরা অপেক্ষা করে রইলো মেহেদি শুকাবার। হাতে যতক্ষণ মেহেদি রেখে দেওয়া হয়, রঙ না-কি ততই গাঢ় হয়। প্রায় ঘন্টাখানেকের পর অরার ধৈর্য হারিয়ে গেল। হাত ধুয়ে চোখে পড়লো টকটকে লালে ফুটে ওঠা ডিজাইন। আর সেই সঙ্গে অতি প্রিয় ওই নামটা।

নিজের হাতে ফুটে ওঠা মেহেদির রঙ কাউকে দেখালো না অরা। যার নামে হাত রাঙিয়েছে তাকেই আগে দেখাবে। আরশাদকে পাওয়া গেল তার ঘরেই। তার গম্ভীর চোখদুটো আটকে আছে ল্যাপটপের দিকে। সবগুলো ব্যস্ত চোখকে ফাঁকি দিয়ে অরা তার ঘরে প্রবেশ করে তৎক্ষণাৎ দরজা লাগিয়ে দিলো। দরজার শব্দে আরশাদের ধ্যানভঙ্গ হলো।

চোখ তুলে অরাকে দেখতে পেয়েই দুষ্টুমিমাখা গলায় বলল, “সবসময় আমাকে অসভ্য অসভ্য বলে এখন নিজেই অসভ্যতা করছো?”

অরা চমকে উঠে বলল, “আমি আবার কী করলাম?”

“ভরা বাড়িতে দরজা বন্ধ করছো কেন?”

অরা লজ্জাভরা গলায় বলল, “ফালতু কথা বলবে না তো! এমনিতেই একটা জরুরি কাজে এসেছি।”

“কী কাজ?”

অরা এসে আরশাদের পাশে দাঁড়িয়ে তার হাতটা আরশাদের দিকে বাড়িয়ে দিলো। কোমল স্পর্শে তার হাতটা ধরলো আরশাদ। ভাবটা এমন যেন কোমল পদ্ম ফুল ধরছে সে। একটু জোর দিয়ে ধরলেই ফুল ছিঁড়ে যাবে।
অরা মেহেদিরাঙা হাতটা দেখেই প্রচ্ছন্ন এক হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটে। তার সবথেকে বেশি আনন্দ লাগছে নিজের নামটা দেখে। একটু একটু করে শেষমেশ অরার সবটাই নিজের অধিকারে নিয়ে ফেলল আরশাদ!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here