ফিরে_আসা২ ১৪ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
451

#ফিরে_আসা২
১৪
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

পর্দা সরিয়ে দিতেই ঝকঝকে আকাশটার দেখা মিলল। এক খন্ড রোদ এসে পড়লো অরার চোখেমুখে। অসহনীয় তীব্র কোনো রোদ নয়, মিষ্টি একটা রোদ। মনের অজান্তেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটে।
দুদিন হলো হসপিটাল থেকে বাড়িতে আনা হয়েছে তাকে। এখন অরা পুরোপুরি সুস্থ। শরীরের দিক থেকেও, মনের দিক থেকেও।

আজকের দিনটার জন্যে তার উৎসাহ-উদ্দীপনার কোনো শেষ নেই। আজ কোনো উপলক্ষ নেই, অন্য দশটা সাধারণ দিনের মতোই আজকের দিনটা। তবুও অরার কাছে বিশেষ। দীর্ঘদিন পর আজ আরশাদের কোনো শুটিং বা মিটিং নেই। পুরোটা দিন আজ বাড়িতে থাকবে সে। চব্বিশ ঘন্টা ভালোবাসার মানুষটা চোখের সামনে! এর থেকে আনন্দের উপলক্ষ অরার কাছে কীই বা হতে পারে? এই উপলক্ষে অরা আজ অফিসে যাবে না। জরুরি কারণ ছাড়া অরা অফিস ফাঁকি দেয় না। আর আজকের কারণটা একটু বেশিই জরুরি।

ছোট ছোট পা ফেলে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল অরা। গভীর ঘুমে ডুবে আছে আরশাদ। কতগুলো চুল তার চোখের সামনে এসে পড়েছে। সারাটা দিন অনায়েসেই এই নিষ্পাপ মুখটার দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায়। আরশাদকে ডাকতে ইচ্ছা হলো না অরার। তবুও ডাকতে হবে।

প্রতিদিন কথাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অফিসে যায় অরা। আজ যেহেতু অফিসে যাবে না, তাই আরশাদ গত রাতে বলে রেখেছিল সেই কথাকে স্কুলে দিয়ে আসবে। পুরো একটা দিন যাতে অরা বাড়ি থেকে না বেরিয়ে রেস্ট নিয়ে কাটাতে পারে। বেচারা এতগুলো দিন পর কাজ থেকে ছুটি পেয়েছে। অরা প্রথমে চায়নি সকাল সকাল আরশাদকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বিরক্ত করতে। মনের এই কথাটা আরশাদকে জানাতেই কড়া ধমক খায় সে।

আরশাদের ভালোবাসার মাঝে নিদারুণ শৈল্পিকতা এখানেই। দীর্ঘদিন পর ব্যস্ততাবিহীন একটা দিন পেয়েছে। চাইলেই তো পারতো বেলা একটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটাতে। ভালোবাসার মানুষটাকে একটু বিশ্রাম দিতে কত আয়োজন তার!

অরা আলতো স্পর্শে আরশাদের পিঠে হাত রেখে বলল, “আরশাদ?”

স্বাভাবিকভাবেই অপরপ্রান্ত থেকে কোনো জবাব নেই। এই ছেলের প্রগাঢ় ঘুম ভাঙানো সহজসাধ্য কাজ নয়।

অরা আবারও ডাকলো, “আরশাদ ওঠো!”

আরশাদ অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ।”

মুখে “হুঁ” বললেও, ওঠার কোনো প্রয়াস নেই আরশাদের মাঝে। ঠিক আগের ভঙ্গিতেই ঘুমে তলিয়ে আছে সে।

অরা তার কাঁধে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলল, “ওঠো না আরশাদ!”

এবার আরশাদের ঘুম ভাঙলো। চোখ পিটপিট করে একবার অরার দিকে তাকিয়ে আবারও আলস্যের ভঙ্গিতে চোখদুটো বুজে ফেলল সে।

ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, “রাতে ঘুমাতে দিবে না, দিনেও ঘুমাতে দিবে না। সমস্যা কী তোমার?”

তৎক্ষণাৎ লজ্জায় লাল হয়ে অরা বলল, “এই অসভ্য! রাতে কখন ঘুমাতে দিলাম না তোমাকে?”

আরশাদ এবার চোখদুটো মেলে তাকালো অরার দিকে। স্বাভাবিক কোনো দৃষ্টি নয়। তার তাকানোর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন নেশাগ্রস্ত তার কাঙ্ক্ষিত নেশাদ্রব্যের দিকে তাকিয়ে আছে। আরশাদের এই দৃশ্য নিমিষেই এলোমেলো করে দিলো অরার ভেতরটা।

আরশাদ নেশাভরা কণ্ঠে বলল, “সারারাত জেগে তোমাকে দেখি, ঘুমানোর সময় কোথায়?”

অবিশ্বাস করার মতো কোনো কথা নয়। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মাঝেমধ্যেই অরা দেখে, এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে আরশাদ। নাটক-সিনেমায় তো এমন দৃশ্য বহুবার দেখেছে সে। প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে, নিতান্তই অবাস্তব এক দৃশ্য। দীর্ঘ সময় একটা ঘুমন্ত মানুষের দিকে কেউ তাকিয়ে থাকতে পারে না-কি? কে জানত, একদিন তার বাস্তবেই দেখা মিলবে সেই অবাস্তব দৃশ্যের!

লজ্জায় বহুকষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে অরা বলল, “আমি বলেছি সারারাত না ঘুমিয়ে আমাকে দেখতে?”

আরশাদ উঠে বসতে বসতে বলল, “আর আমি বলেছি এত সুন্দর হতে?”

খিলখিল করে হেসে উঠে অরা বলল, “নিজের বউয়ের সাথে এভাবে কে ফ্লার্ট করে?”

আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “আমি করি। তোমাকে কে মানা করেছে? তুমিও চাইলে আমার সাথে ফ্লার্ট করতে পারো!”

অরা বহুকষ্টে নিজের লজ্জায় রাঙা মুখটা সামলে বলল, “এই তুমি ওঠো তো! কথার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

আরশাদ অরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “আজ শরীর খারাপ লাগছে না তো?”

“উহুঁ।”

পাসেঞ্জার সিটে বসে রীতিমত ঝিমুচ্ছে কথা। আরশাদ ড্রাইভ করতে করতে আড়চোখে তাকালো মেয়ের দিকে। বেচারি মধ্যে এখনো সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। রাতে তো জলদিই ঘুমিয়ে পড়ে। তবুও স্কুলে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত তার চোখে স্থায়ীভাবে ঘুম লেগে থাকে। এতটুকু বাচ্চাদের স্কুল একটু দেরিতে শুরু হলে কী ক্ষতি হতো?

আরশাদ হাসিমুখে বলল, “জেগে ওঠ বাবা!”

কথা ভ্রু কুঁচকে বলল, “জেগেই তো আছি।”

“আরেকটু ভালো করে জাগ।”

কথা বাবার কথামতো চোখ ডলতে ডলতে সোজা হয়ে বসলো।

কথা আক্ষেপের সুরে বলল, “এটা কিন্তু ঠিক না বাবা।”

আরশাদ অবাক গলায় বলল, “কোনটা?”

“আমি একাই শুধু স্কুলে যাই কেন? তুমি আর অরা কেন যাও না?”

মেয়ের এমন প্রশ্নে আরশাদ হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারলো না।

খানিকক্ষণ চিন্তা করে আরশাদ কোমল স্বরে বলল, “আমি আর অরা তো স্কুলে গেছি। যখন তোর মতো বাচ্চা ছিলাম তখন। এখন তো আমরা বড় হয়ে গেছি। বড়রা কি স্কুলে যায়?”

কথা গাল ফুলিয়ে বলল, “গেলে প্রবলেম কী?”

“প্রবলেম তো কিছুই নেই। শুধু তোর মিস আমাদেরকে ক্লাসে অ্যালাউ করবে না।”

গাড়ি স্কুলের সামনে এসে থামলো। আরশাদ আজ তার বিখ্যাত গাঢ় সবুজ গাড়িটা আনেনি। সুপারস্টার আরশাদ হকের মেয়ে যে এই স্কুলে পড়ে এই তথ্য সকলেরই জানা। তার ওপরে আবার ওই বিখ্যাত গাড়ি স্কুলের সামনে এসে দাঁড়ালে ভয়ানক ভীড় জমে যাবে।

কথা পেছনের সিট থেকে তার স্কুলব্যাগটা আনতে আনতে বলল, “আজ কি তুমি আমাকে পিক করতে আসবে বাবা?”

“হুঁ।”

“ছুটি কিন্তু দেরিতে হবে।”

“কখন?”

“বারোটায়।”

এমনিতে কথার স্কুল ছুটি হয় পৌঁনে এগারোটায়। আজ এত দেরিতে ছুটি হবে কেন এ নিয়ে তেমন একটা প্রশ্ন করলো না আরশাদ।

মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলল, “আচ্ছা। লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকবি কিন্তু।”

কথা হাসি হাসি গলায় বলল, “আমি লক্ষ্মী মেয়ে হয়েই থাকি বাবা।”

কথা গাড়ি থেকে নেমে গেট দিয়ে স্কুলের ভেতর প্রবেশ করলো। গাড়ির কলো কাঁচে ঘেরা জানালা ভেদ করে একদৃষ্টিতে সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রইলো আরশাদ। অন্যান্য বাবা-মায়েরা সন্তানদের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছে। সন্তান স্কুলের মূল দরজায় প্রবেশের আগ পর্যন্ত বাইরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরশাদ। সেই ইচ্ছা থাকলেও, পূরণ করতে পারবে না সে। খ্যাতি জিনিসটা তার ওপর বর্ষিত হয়েছিল আশীর্বাদের মতো। তবে সেই আশীর্বাদস্বরূপ খ্যাতির সঙ্গে যে এত এত বিড়ম্বনা আসবে, কে জানত?

বসার ঘরে সোফায় বসে আরশাদের অপেক্ষা করছে অরা। এই সকাল সকাল টিভিতে ভালো কোনো প্রোগ্রাম থাকে না। রিমোট হাতে নিতে আয়েশি ভঙ্গিতে একটু পর পর চ্যানেল বদলাচ্ছে অরা। একটা রান্নার অনুষ্ঠানে তার চোখ আটকালো। নতুন নতুন রেসিপি পরখ করে দেখতে তার ভালোই লাগে। এখন আর সে উপায়ও নেই, আরশাদের কারণে।

আরশাদ কড়াভাবে নিষেধ করে দিয়েছে, বাবু পৃথিবীতে আসার আগে না-কি আর রান্নাঘরে গিয়ে কাজ নেই অরার। যদিও রান্নাবান্নায় ডাক্তারের বারণ নেই। রান্না তো একটা শিল্প। খানিকক্ষণ রান্না করলে মনেও মেলে শান্তি। তবে সে কথা আরশাদকে বোঝাবে কে? সে মনে করে পৃথিবীতে অরাই প্রথম অন্তঃসত্বা হয়েছে।

দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো অরা। আরশাদ এখন কলিংবেল বাজায়নি। বাইরে থেকে পাসওয়ার্ড চেপে নিজেই দরজা খুলে নিয়েছে।

সময়গুলোকে ফ্রেমে বন্দী করার উপায় থাকলে অরা ঠিক এই মুহূর্তটাকে ফ্রেমবন্দী করে ফেলল। বাড়িতে প্রবেশ করে আরশাদ তার মোহনীয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো অরার দিকে। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে মাত্র, তবে সেই কয়েক সেকেন্ডই যথেষ্ট তাকে পাগল করে দেওয়ার জন্যে।

দরজাটা ফের বন্ধ করে আরশাদ সোফার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, “কথার না-কি আজ বারোটার ছুটি হবে?”

অরা স্বাভাবিকভাবেই বলল, “হুঁ। গতকালই বলে দিয়েছিল। ক্লাসের পর সাইন্স প্রজেক্টে কাজ করতে হবে।”

আরশাদ হতাশ কণ্ঠে বলল, “এতটুকু বাচ্চাদের দিয়ে জোর করে এসব করানোর কোনো মানে আছে?”

অরা মুগ্ধ গলায় বলল, “জোর কোথায়? কথা তো বেশ ভালোই এনজয় করছে। ও আর ওর বন্ধুরা মিলে কী যে চমৎকার একটা সৌরজগতের মডেল বানিয়েছে!”

আরশাদ অরার পাশে বসতে বসতে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “পড়াশোনাটাকে কথা ভালোই এনজয় করে তাই না? আমার একেবারে বিপরীত। বইপত্র চোখের সামনে পড়লেই আমার গায়ে আগুন ধরে যেত।”

“কিন্তু তুমি তো ভালো স্টুডেন্ট ছিল আরশাদ।”

“ভালো স্টুডেন্ট হলেই যে পড়াশোনা এনজয় করতে হবে এমন তো নয়। বাধ্য হয়েই বেশি বেশি পড়তাম। তখন সময় কাটানোর জন্যে তেমন কিছু ছিল না। টিভি ছিল, তবে একটাই মাত্র চ্যানেল দেখা যেত। পড়তে বসা ছাড়া সময় কাটানোর উপায়ও ছিল না। কী যে বিরক্তিকর স্কুল আর কলেজলাইফ! মনে পড়লেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।”

অরা হেসে ফেলে বলল, “তোমার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে যেন এই মুহুর্তে কেউ তোমার কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে পড়তে বসতে বলছে। চলো, ছাদে যাই।”

“ছাদে কেন?”

অরা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “আজ আমরা ছাদে বসে ব্রেকফাস্ট করবো।”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুমি এতগুলো সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠবে?”

“তো?”

আরশাদ উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেমানুষী প্রশয় দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “বুঝেছি, সব তোমার অজুহাত।”

অরা অবাক ভঙ্গিতে বলল, “কীসের অজুহাত?”

“ছোটাছুটি করে বেড়ানোর অজুহাত।”

আরশাদ কথা বলে আর এক মুহুর্তও অপচয় করলো না। তৎক্ষণাৎ অরাকে কোলে তুলে নিলো। আরশাদের আকস্মিক এমন কান্ডে রীতিমত হকচকিয়ে গেল অরা। তবে বিস্ময়ের সঙ্গে সঙ্গে কী যেন মনে করে আবার খিলখিল করে হেসে উঠলো।

আরশাদ তাকে কোলে নিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়ে বলল, “হাসছো কেন?”

হাসি না থামিয়েই অরা বলল, “ভাগ্যিস বলোনি, তোমার কোলে ওঠার অজুহাত।”

আরশাদ ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “সেই অজুহাত তো আছেই, তুমি স্বীকার করো বা নাই করো।”

অরা মজার ছলে বলল, “আহারে! এই দৃশ্য যদি তোমার ওপরে ক্রাশ খাওয়া মেয়েগুলো দেখতো, নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক করতো।”

যতই দিন যায়, মেয়েটা ততই অবাক করে তোলে আরশাদকে। আরশাদকে নিয়ে মনে মনে স্বপ্ন সাজায় দেশের হাজারো মেয়ে। অরার জায়গায় অন্য কেউ হলে তো এটা নিয়ে হিংসায় জ্বলে যেত। অথচ অরা কিনা হাসছে তাদের নিয়ে।

অরার নির্দেশ অনুযায়ী ব্রেকফাস্টের চমৎকার আয়োজন করেছে স্টাফরা। মেঝেতে একটা চাদর বিছানো, মাথার ওপরে বিশাল ছাতা। একটা ফ্লাক্সে কফি, আর কাঁচের স্বচ্ছ জগে জুস। একটা বাস্কেটে তাদের ব্রেকফাস্ট। মনে হচ্ছে যেন আর্ষস আরশাদ আর অরা বাড়ির মধ্যে থেকেই দূরে কোথাও পিকনিকে এসেছে।

আরশাদ মজার ছলে বলল, “এই সকাল সকাল যে ডেটে নিয়ে আসবে, আগে বললেই পারতে।”

অরা কিছুই বলল না। এই ছেলে যে অরাকে বারবার লজ্জায় ফেলে দিয়ে কী মজা পায়, সেই জানে!

দুজনে বসলো পাশাপাশি। পাশাপাশি বললে ভুল হবে। আরশাদ বসেছে অরার গা ঘেঁষে। অদ্ভুত মোহনীয় এক পরিবেশের সৃষ্টি হলো। মাথার ওপরে আলোছায়া খেলা করছে আর পাশে প্রিয় মানুষটা।

ব্রেকফাস্ট করতে করতে হঠাৎ কী যেন মনে করে অরা আগ্রহ নিয়ে বলল, “আচ্ছা আরশাদ? যদি আমাদের বিয়েটা না হতো? তাহলে কী হতো?”

আরশাদ অবাক ভঙ্গিতে বলল, “বিয়ে হতো না কেন?”

“না মানে, যদি ওইদিন আমি হলওয়েতে জ্ঞান হারিয়ে না ফেলতাম, আর যদি ওই সিসিটিভি ফুটেজটা ভাইরাল না হতো? তাহলে তো আমাদের বিয়েটাও হতো না।”

আরশাদ দৃঢ়ভাবে বলল, “তাহলেও হতো।”

“কীভাবে?”

আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “ভাগ্যে লেখা ছিল না? বিয়ে না হয়ে উপায় কী? হয় আমি তোমার প্রেমে পড়ে যেতাম, না হলে তুমি আমার।”

মুগ্ধ-বিস্মিত দৃষ্টিতে অরা তাকিয়ে রইল আরশাদের দিকে। এই মানুষটা ভাগ্যে বিশ্বাস করে না বললেই চলে। অথচ, ভালোবাসার বেলায় তার সকল যুক্তি যেন বিপরীতে চলে। ভাগ্য বলে সত্যিই যদি কিছু থাকে, তবে সে তো কোনোকালেই সহায় হয়নি অরার প্রতি। সে ভাগ্যই অরার জন্যে রেখে দিয়েছিল এই মানুষটাকে? আজও অবিশ্বাস্য বলে মনে হয় তার।

আরশাদ হালকা গলায় বলল, “তুমি কখনো আমার প্রেমে পড়নি?”

“পড়েছি তো।”

“বিয়ের আগে?”

“না, বিয়ের আগে না। বিয়ের পরে প্রেমে পড়েছি।”

আরশাদ কৃত্রিম হুমকির স্বরে বলল, “সত্যি করে বলবে কিন্তু!”

অরা মিষ্টি হেসে বলল, “সত্যিই বলছি। এদেশে প্রতিদিন হাজারো মেয়ে তোমার প্রেমে পড়ে। তোমার লুকস, অভিনয়, কথার বলার ধরনের প্রেমে হাবুডুবু খায়। কিন্তু আমি কোনো সুপারস্টারের প্রেমে পড়িনি। যে মানুষটা আমার আশেপাশে থাকে, নিঃসঙ্কোচে তার সিক্রেরগুলো আমাকে বলে দিতে পারে, আমি তার প্রেমে পড়েছি।”

আরশাদ অন্যরকম গলায় বলল, “উফ অরা! তুমি এত রোমান্টিক হলে কবে থেকে?”

আবারও চুপ করে রইলো অরা। এই ছেলেটার সঙ্গে আর পারা যায় না!

কিছুটা সময় চুপ করে থেকে আরশাদ বলল, “মাঝে মাঝে আমার কী মনে হয় জানো অরা?”

“কী?”

মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরশাদ বলল, “তুমি আমার জীবনে আরও আগে এলে খুব ভালো হতো।”

“আগেই তো এসেছিলাম, তুমিই খুঁজে পেতে দেরি করলে।”

আরশাদ বিস্মিত ভঙ্গিতে বলল, “আমার সেই কাজপাগল সুটেজ-বুটেজ ম্যানেজার, যাকে দিনে হাজারবার ধমক দেওয়া যায়, সে না-কি এখন আমার বউ! ভাবতেও অবাক লাগে। মাঝেমধ্যে তো ঘুম থেকে উঠে পাশে তোমাকে দেখে চমকে উঠি আমি।”

খানিক হেসে আরশাদের দিকে তাকিয়ে রইলো অরা। বাকিটা সময় তাদের নীরবতার মাঝেই কাটলো। প্রশান্তিময় নীরবতা। নীরবতা না-কি কোনো আনন্দের বিষয় না, অথচ আরশাদের সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তই অরার কাছে আনন্দময়। হোক সেটা নীরবে কিংবা সরবে।

ছাদ থেকে নিচে নেমে এসে আরশাদ লক্ষ করলো তার ফোনে কতগুলো মিসড কল। তার ম্যানেজার, সিনেমার ডিরেক্টর, কে ফিল্মসের পিআর টিমের হেড। সবই কাজের কল। আজ নিজেকে কোনপ্রকার কাজে জড়াতে চায় না আরশাদ। এই কলগুলো ব্যাক করলে কথাবার্তা সারতে সারতে অন্তত এক ঘন্টা লাগবে। কাজবিহীন দিনের এক ঘন্টা কাজকে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। পুরোটা দিনই আজ আরশাদ দিতে চায় অরাকে। ফোনটা তাই সুইচ অফ করে রেখে দিলো আরশাদ।

ব্রেকফাস্টের পরবর্তী সময়টা দুজনের কাটলো টিভির সামনে। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার টেস্ট ম্যাচ চলছে। অরা ক্রিকেট দারুণ উপভোগ করলেও টেস্ট ম্যাচ ঠিক বুঝতে পারেনি। আরশাদ তাকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে।

এক পর্যায়ে অরা আচমকা বলে উঠলো, “আচ্ছা আরশাদ? তোমার স্বপ্ন কী?”

আরশাদ কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়েই বলল, “হঠাৎ এই প্রশ্ন? তোমাকে তো বলেছিলাম, ছোটবেলায় আমার স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার হবো।”

“একটা স্বপ্ন পূরণ না হলে কি মানুষের মনে আরেকটা স্বপ্ন জাগতে পারে না? এই যেমন আমার স্বপ্ন ছিল একদিন অনেক অনেক সাকসেসফুল হবো। সাকসেসফুল হয়েও গেলাম। তবে স্বপ্ন পূরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।”

আরশাদ আগ্রহ নিয়ে বলল, “তাই না-কি? তা নতুন স্বপ্নটা কী?”

অরা দুষ্টুমির ছলে, “আগে আমি প্রশ্ন করেছি!”

আরশাদ পরাজয় স্বীকার করে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “আমার স্বপ্ন হলো ভিন্ন ভিন্ন সিনেমা করা। একটা সিনেমার গল্পের সাথে আরেকটার মিল থাকবে না। এদেশের মানুষের একটা অংশের তো এখনো দেশী সিনেমার ওপর ভরসা গড়ে উঠতে পারেনি। আমি সেই ভরসাটা গড়তে চাই। মানুষ যাতে গল্পের টানে হলে যায়, আমার জন্যে না।”

অরা মুগ্ধ গলায় বলল, “বাহ্! চমৎকার।”

“আর তোমার স্বপ্ন?”

অরা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়ে বলল, “বেশি কিছু না। আমার স্বপ্ন রিটায়ারমেন্টের পর সমুদ্রের পাড়ে থাকবো। ছোট্ট একটা কাঠের ঘর থাকবে আমাদের সমুদ্রের পাড়ে। এমন একটা জানালা থাকবে, যেটা দিয়ে ঘর থেকেই সরাসরি সমুদ্র দেখা যায়। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই তোমার হাত ধরে সমুদ্রের পাড়ে হাঁটবো।”

আরশাদ ভ্রু ওপরে তুলে বলল, “বাব্বাহ! তুমি এত রোমান্টিক স্বপ্নও দেখতে পারো?”

অরা লজ্জিত গলায় বলল, “তুমি আবার শুরু করলে?”

“রিটায়ারমেন্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে কেন? ডেলিভারির আগ দিয়েই চলো তোমার স্বপ্নটা পূরণ করে আসি। মাসখানেক সমুদ্রের পাড়ে থাকবো।”

“ডেলিভারির আগে আমি না হয় মেটার্নিটি লিভে থাকবো। কিন্তু তুমি যাবে কী করে? তোমাকে তো কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হবে।”

আরশাদ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “আমি যে লিভ নিবো না সেটা কে বলল তোমাকে?”

অরা হতবাক গলায় বলল, “মানে?”

আরশাদ সহজ গলায় বলল, “পেটার্নিটি লিভ। তোমার প্রেগন্যান্সির আট মাস থেকে বাবুর তিন-চার মাস বয়স পর্যন্ত সব কাজ থেকে আমার ছুটি। এই সময়টা তোমাদের সঙ্গে থাকবো।”

অরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “আরশাদ! তুমি কি একেবারেই পাগল হয়ে গেলে? কাজের কতটা ক্ষতি হয়ে যাবে বুঝতে পারছো?”

“তুমিও তো লিভে থাকবে। তোমার কাজের ক্ষতি হবে না?”

“আমাকে তো লিভে থাকতেই হবে আরশাদ।”

“আমাকেও লিভে থাকতেই হবে। প্রেগন্যান্সির শেষ সময়টাতে তুমি কষ্ট করবে, বাবু আসার পর একা একা ওকে সামলাবে। আর আমি স্বার্থপরের মতো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকবো?”

আমাদের সমাজের ওই এক ভ্রান্ত ধারণা। সন্তান জন্ম দেবে মেয়েরা, তাই শুধুমাত্র তাদের কাজ থেকে বিরতি নিলেই চলবে। অথচ সন্তান জন্মদানের সময় একটা মেয়ের তার ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে যে কী পরিমাণের মানসিক সহায়তার প্রয়োজন হয়, এটা তারা বোঝে না। আরশাদ বোঝে, সেজন্যেই অরার পাশে থাকতে চাইছে। প্রকৃতি যে এই ছেলেটাকে কীভাবে তৈরি করেছে কে জানে!

দিনটা এভাবেই প্রশান্তির মাঝে কেটে গেল। কথা স্কুল থেকে ফেরার পর আরশাদ আর অরা দুজনেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো তার স্কুলের গল্প শুনতে।

দুপুরের দিকে ফোনটা সুইচ অন করতেই আরশাদ দেখতে পেলো, আশফিয়ার মিসড কল। এই মানুষটার কল এড়িয়ে গিয়ে কাজ নেই। শেষমেশ কঠিন ধমধমকির মুখোমুখি হতে হবে তাকে।

আরশাদ কলব্যাক করতেই অপরপ্রান্ত থেকে আশফিয়া হড়বড় করে বলল, “আরশাদ শোন! আগামী সপ্তাহে তুই আর অরা ফ্রি আছিস।”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “না নেই।”

আশফিয়া ধমকের সুরে বলল, “আমি কোনো প্রশ্ন করিনি গাধা। আমি বলেছি ফ্রি আছিস, তার মানে ফ্রি আছিস।”

“তুমি বললেই ফ্রি থাকা যায় না-কি? আমার শুটিং শুরু হবে, দম ফেলারও সময় থাকবে না আগামী সপ্তাহে।”

আশফিয়া বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “শুটিং পিছিয়ে দে না বাপ! এমন তো না যে প্রোডিউসারের সিনেমায় অভিনয় করছিস। তুই নিজেই প্রোডিউসার, এত চিন্তা কীসের?”
“আগামী সপ্তাহে কী সেটা তো বলবে?”

“মায়ের জন্মদিন।”

আরশাদ বিস্ময়মাখা কণ্ঠে বলল, “মায়ের আবার জন্মদিনও আছে?”

আশফিয়া গর্ব করে বলল, “এত দিন ছিল না। কিন্তু আমি শার্লক হোমসের মহিলা ভার্সনের মতো খুঁজে বের করেছি।”

“কীভাবে খুঁজলে?”

“আমি যখন সিলেটের বাড়িতে ছিলাম না? তখন পুরনো কিছু চিঠিপত্র ঘাটাঘাটি করে নানীর লেখা একটা চিঠি খুঁজে পাই। নানাকে লিখেছে। নানার তখন চিটাগংয়ে পোস্টিং। নানী লিখেছে তাদের ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে। জন্মের দিন, তারিখ, সময় স্পষ্টভাবে লেখা। মেয়ের নাম কী রাখবে তাই জানতে চেয়েছে নানী।”

“জন্মদিনটা কবে?”

“ষোলো তারিখ। আরশাদ শোন, আমি কিন্তু কোনো অজুহাত শুনছি না। আগামী শুক্রবার আমরা সবাই দলবেঁধে সিলেটে গিয়ে মেয়ে জন্মদিন সেলিব্রেট করবো। এটাই আমার ফাইনাল কথা।”

(চলবে)

[আবারও অপেক্ষা করালাম আপনাদের। গল্প নিয়মিত না আসার কারণটা হয়তো আপনাদের অনেকেরই জানা। আমার কলেজ শুরু হয়ে গেছে। এসএসসির পর আলসেমিতে কাটানো চার মাসে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে নিয়মিত কলেজে যাতায়াত আর পড়াশোনার পর ক্লান্তিতে শেষ হয়ে যাই। তবুও সারাক্ষণ আমার মাথায় গল্পের টেনশন। যখন যেখানে সময় পাই, সেখানেই লিখি। আজকে সকালে উঠে হাতমুখ না ধুয়েই এই পর্বটা শেষ করে ফেলি। ক্লাসে বসে বসে পরের পর্বের প্ল্যানিং করি। মানুষ শুক্র-শনির অপেক্ষায় থাকে ছুটি কাটানোর জন্যে, আর আমি শান্তিতে গল্প লেখার জন্যে। আশা করি আপনারা কেউ রাগ করে নেই আমার ওপরে। ❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here