#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৯।
সারাজকে পুতুল কোনোভাবেই ছাড়ল না। তার একটাই কথা, “বিয়ের পরদিন কেউ অফিস যায় না; তাই সেও যেতে পারবে না। তার এখন একমাত্র প্রধান কাজ হচ্ছে নিজ বউকে স্কুটি চালানো শেখানো।” বেচারা সারাজ! সে জানে, বউয়ের সাথে তর্কে জড়ানো আপাতত কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তার চেয়ে বরং স্ত্রীর অন্তর তুষ্ট যেটাতে, সে তাই করবে।
পুতুলকে সামনে বসিয়ে সারাজ তাকে নিয়ে পুরো বাগান একবার চক্কর দিল। এর মাঝেই চেঁচিয়ে উঠল পুতুল। বলল,
‘এই, তুমি নামো নামো; আমি একাই এখন চালাতে পারব।’
সারাজ তাকে বাঁধা দিয়ে বলে,
‘একবার মাত্র দেখিয়েছি, এর মাঝেই পেরে যাবি? এত ভালো স্টুডেন্ট কবে হয়েছিস তুই?’
ঈষৎ ঘাড় কাত করে চাইল পুতুল। সরু চোখে চেয়ে বলল,
‘আমাকে অপমানের কোনো সুযোগই ছাড় না দেখছি। এমন করলে একদম বাপের বাড়ি চলে যাব কিন্তু।’
সারাজ ফিচেল হাসল। রাশভারী স্বরে বলল,
‘তাই! আমি তোকে অপমান করি? আর তুই যে আমাকে ছিলা মুরগী বলেছিস, সেটা কিছু না?’
পুতুল রগড় সুরে দাঁত কেলিয়ে বলে উঠল,
‘ছিলা মোরগ, মুরগী না তো।’
চটল সারাজ। ক্ষুব্ধ হয়ে পুতুলের কোমরের পাশটা চেপে ধরল। অতঃপর তার শ্রবণেন্দ্রিয়ের নিকট মুখ এগিয়ে নিয়ে বলল,
‘খুব কথা ফুটেছে মুখে, তাই না? একদম এমন অবস্থা করব যে এক সপ্তাহ আর ঘর থেকেই বের হতে পারবি না।’
পুতুল মেকি রাগ নিয়ে স্বীয় কোমর থেকে সারাজের হস্ত যুগল আলগা করে বলল,
‘অবস্থার কি আর কিছু বাকি রেখেছ, অ সভ্য লোক।’
অনবদ্য হাসে সারাজ। বলে,
‘তাই? রাতে কি একটু বেশিই অসভ্যতামো করে ফেলেছি?’
লজ্জায় ততক্ষণাৎ লাল আভা প্রস্ফুটিত হলো পুতুলের গন্ডস্থলে। ইশ, রাতের কথা মস্তিস্কে বিচরণ চালাতেই আকাশচুম্বী ব্রীড়ায় কুন্ঠিত হয়ে পড়ল যেন। স্কুটির আয়নায় তার এই লাজমাখা মুখশ্রী’টা স্পষ্ট। তাকে দেখে হাসল সারাজ। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলতে নিল,
‘পুতুল, তোর শ…’
বাকিটা সম্পূর্ণ করার পূর্বেই পুতুল দুহাতে মুখ চেপে ধরল তার। কড়া চোখে চেয়ে শাসিয়ে বলল,
‘খবরদার, আর একটাও বাজে কথা বলবে না। তুমি আসলেই একটা অ সভ্য; মারাত্মক পর্যায়ের অ সভ্য।’
__________
পরদিন প্রাতঃকালের প্রারম্ভিক ক্ষণেই শুরু হয়ে যায় সকল ব্যস্ততা। সারাজ আর পুতুলের আজ রিসিপশন। যদিও তার আয়োজন করা হয়েছে সেন্টারে। তাও বাড়িতে মানুষের হৈ চৈ এর কমতি নেই। তাই আজ খুব ভোরেই পুতুলের ঘুম ভেঙেছে। তন্দ্রা থেকে জেগে সে সারাজকে তার পাশে পায়নি। পরবর্তিতে ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে দেখে, রিসিপশনের সব কাজের তদারকিতে ব্যস্ত সে। সারাজের সঙ্গে তখন তার খুব একটা কথা বলার সুযোগ হয় না। কোনোরকমে নাস্তা সেরেই রুমে যেতে হয়। পার্লারের মেয়েরা এসেছে তাকে সাজাতে।
___________
অসিত রঙের ভারি কাজের এক শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে পুতুল। পার্লারের মেয়েদের অনেক বলে বলে হালকা সেজেছে। অত ভারি মেকআপ তার কোনো কালেই পছন্দের ছিল না। কান আর গলায় স্থান পেয়েছে ছোট্ট কালো রঙের পাথর খচিত নেকলেসের সেট। মাথার মাঝ সিঁথি বরাবর একখানা ছোট্ট টিকলি। আর ওষ্ঠ জোড়ার ঐ রক্তিম রঞ্জক পদার্থ’টা যেন আজ একটু বেশিই জ্বলজ্বল করছে। নিজেকে আয়নায় দেখে অন্তরে প্রশান্তি অনুভব করে পুতুল। ঠিক যেমন চেয়েছিল, তেমনই লাগছে তাকে।
____________
পার্লারের মেয়েগুলো বেরিয়ে যেতেই হন্তদন্ত দেখিয়ে কক্ষে এসে উপস্থিত হয় সারাজ। তাড়া দিয়ে পুতুলকে বলে,
‘কিরে, হলো তোর? এবার সেন্টারে যেতে না পারলে কিন্তু সত্যিই লেইট হয়ে যাবে।’
পুতুল ঘুরে তাকায়। মুচকি হেসে বলে,
‘হ্যাঁ শেষ, চলো।’
চোখের সম্মুখে মসীবর্ণ বসনে এক নারীকে দেখে কিঞ্চিৎ বুকে ব্যথা হয় সারাজের। বুকের বা পার্শ্বে হস্ত স্থাপন করে মোহনীয় সুরে বলে উঠে,
‘আমাকে মারতে চাস, পুতুল?’
পুতুল বোকার মতো তাকায়। সারাজ মন্থর গতিতে এগিয়ে এসে তার অতি নিকটে দন্ডায়মান হয়। এক হাত পুতুলের কপোলে ঠেকিয়ে স্মিত সুরে বলে,
‘সবকিছুতে তোকে এত মারাত্মক কেন লাগে, পুতুল? আমার যে দমবন্ধ হয়ে আসে তোকে দেখলে। মরে টরে গেলে তার দায়ভার কি তুই নিবি?’
লজ্জায় মাত্রাধিক সংকুচিত হয়ে চক্ষু নিমীলিত করে পুতুল। মিইয়ে যাওয়া সুরে বলে,
‘এখন এসব বলতে সময় যাচ্ছে না তোমার?’
সারাজের আরেকটু এগিয়ে পুতুলের ললাটে স্বীয় ললাট ঠেকিয়ে ঘোর লাগা আওয়াজে বলে,
‘না, যাচ্ছে না। আজ যদি সময় এখানেই থমকে যায়, আর আমি যদি তোকে অনন্তকাল এভাবেই দেখে যাই, তাহলে ব্যাপারটা খুব চমৎকার হবে না?’
পুতুল মাথা তুলে বলে,
‘না, একদমই চমৎকার হবে না। কারণ এখন আমাদের রিসিপশনে অ্যাটেন্ড করাটা বেশি জরুরি।’
‘তার থেকেও বেশি জরুরি এখন একটা চুমু খাওয়া।’
বিস্ফোরিত হয় পুতুলের অক্ষিযুগল। দু কদম পিছিয়ে গিয়ে বল উঠে,
‘খবরদার, আমার লিপস্টিক যদি নষ্ট করেছ।’
কুটিল হাসে সারাজ। বলে,
‘তা তো অবশ্যই করব।’
বলেই সে পুতুলকে হেঁচকা টানে নিজের অতিশয় নিকটে এনে দাঁড় করায়। অতঃপর …….
_______
রিসিপশনের প্রোগ্রামে মা বাবাকে দেখে অতিমাত্রায় আনন্দিত হয় পুতুল। বিয়ের দিনের মতোই অনেক ব্যস্ততার সহিত নিষ্পন্ন হয় এই দিনটাও। মেহমান সব চলে যাওয়ার পর পুতুল নেচে নেচে গিয়ে গাড়িতে তার স্থান দখল করে। এর এক পল পরেই তার পাশেই এসে সারাজ বসে। সে বসতেই পুতুল ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছো, অনুভূতি কেমন?’
পুতুলের ভ্রু নাচানো দেখে কপাল কুঁচকায় সারাজ। এমন ভাবে বলছে যেন, সারাজ ঐ বাড়িতে প্রথমবারের মতো যাচ্ছে। সিটে গা এলিয়ে দেয় সে। বলে,
‘আমাদের বাড়িতে আসার সময় তোর অনুভূতি যেমন ছিল, এখন আমার অনুভূতিও তেমন।’
পুতুলও হেলান দিয়ে বসে। বলে,
‘জানো তো, আমিই বোধ হয় একমাত্র মেয়ে যে তার বিদায়ের বেলায় একটুও কাঁদেনি। যার কিঞ্চিৎ পরিমাণও কষ্ট লাগেনি, বরং খুশি লেগেছে। দেখেছো, আমি কত ইউনিক।’
সারাজ উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ভীষণ ইউনিক। তোর মতো এমন ইউনিক এক পিসকে পেয়ে আমি ধন্য।’
সারাজের কথা শুনে শব্দ করে হাসল পুতুল। অতঃপর বলল,
‘তোমাকে পেয়েও আমি ধন্য।’
সারাজ তখন স্নাত চোখে তাকাতেই পুতুল তারদিকে উড়ন্ত চুম্বন ছুঁড়ে।
________
অশ্ব গতিতে কেটে যায় বিয়ের এক সপ্তাহ। আগামীকাল পুতুল আর সারাজ যাবে ভারতে। সেই প্রস্তুতিই চলছে তাদের। পুতুলের জন্য সারাজের ঠিকঠাক মতো অফিসেও যাওয়া হয় না। পুতুলের এক কথা, একেবারে হানিমুন সেরে এসে তবেই সারাজ অফিসে জয়েন করবে; এর আগে না।
পুতুলের এক ট্রলি ভর্তি কাপড় দেখে চক্ষু চড়কগাছ সারাজের। ক্ষিপ্ত কন্ঠে সে বলে উঠে,
‘এই মেয়ে, এত কাপড় নিচ্ছিস কেন? যাচ্ছি তো কেবল তিন দিনের জন্য। এর জন্য কি এত কাপড় লাগে?’
পুতুল ব্যাগে আরো এক সেট কাপড় রাখল। বলল,
‘মেয়েদের তিনদের জন্য তিন তিরিকা নয় সেট কাপড় লাগে। আমি আরও এক সেট বেশি নিয়েছি। এতে কী এমন অন্যায় হয়েছে, বলো?’
সারাজ বিস্মিত কন্ঠে বলে,
‘দশ সেট কাপড়? এত কাপড় কখন পরবি তুই?’
পুতুল ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘তিনবেলা তিন সেট করে পরলেই হয়ে যাবে। সেসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।’
পর পর আবার মনে মনে বলে উঠে,
‘তুমি যা মারাত্মক লেভেলের অ সভ্য; সেখানে গেলে যে তোমার অসভ্যতামো আরো বাড়বে সেটা আমি ঢের বুঝতে পারছি। তাই তো এত প্রস্তুতি।’
__________
প্রত্যুষকালের প্রাতঃরাশ সম্পন্ন করেই বাড়ি ছেড়ে প্রস্থান ঘটায় পুতুল আর সারাজ। গাড়ি নিয়ে পৌঁছে যায় ঢাকা কমলাপুর স্টেশনে। সেখান থেকেই মৈত্রী এক্সপ্রেসে যাত্রা শুরু হবে তাদের। পুতুল মারাত্মক উদ্দীপিত। এই প্রথম নতুন কোনো দেশে যাচ্ছে সে। তাও যাচ্ছে পছন্দের এক জায়গায় ঘুরতে। তার স্বপ্নের তাজমহল। শাহজাহানের তাজমহল। মমতাজের তাজমহল। ভালোবাসার তাজমহল।
চলবে….
(বাসায় এখনও মেহমান। তাই ব্যস্ততার মাঝে তাড়াহুড়োয় কী যে লিখেছি কে জানে🙂)