শেষটা_সুন্দর(সিজন-২) #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৪০।

0
176

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪০।

নতুন দেশে পা রাখতেই অদ্ভুত সুন্দর কিছু অনুভূতি ঠেসে বসল পুতুলের মনে। এই হাওয়া, এই প্রকৃতি, এই মাটি সবকিছু চমৎকার ঠেকল তার। স্টেশন থেকে বেরিয়ে গাড়ি দিয়ে হোটেলে যাওয়া আগ অবধি পুরোটা সময় পুতুল জানলায় মাথা ঠেকিয়ে নতুন শহরকে অবলোকন করেছে। এই শহরের ব্যস্ত রাস্তায় ছুটে চলা হলুদ রঙের ট্যাক্সিগুলোকে নিরুপম লেগেছে তার। রাস্তায় দুপাশের প্রাচীন আধ ভাঙা দালানগুলোও ছিল অনবদ্য।

আগে থেকেই হোটেলের রুম বুকিং ছিল পুতুলদের। তাই আর তাদের খুব একটা বেগ পোহাতে হয়নি। গাড়ি থেকে নেমেই সোজা রিসিপশনে চলে যায়। সেখান থেকে যায় নিজ কক্ষে। পুতুলের কথা মতো সারাজ আগ্রাতেই একটা হোটেল ভাড়া করেছে। হোটেলও পড়েছে তাজমহলের অতি নিকটে। হোটেলের পারিপার্শ্বিক অবস্থাও বেশ ভালো। সব মিলিয়ে পুতুলের দারুণ পছন্দ হয়েছে।

সারাজ স্টাফের সাথে কথা শেষ করে রুমে আসতেই দেখে, পুতুল হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। চোখ জোড়াও নিমীলিত তার। মন্থর গতিতে তার শিউরে অবস্থান করল সারাজ। হাত নিয়ে ঠেকাল পুতুলের মাথার উপর। জিজ্ঞেস করল,

‘শরীর খারাপ লাগছে?’

চোখ মেলে চাইল পুতুল। কিঞ্চিৎ হাসল। বলল,

‘না।’

‘তবে ফ্রেশ হয়ে নে। খেতে যেতে হবে।’

উঠে বসে পুতুল। বলে,

‘আচ্ছা, আমি যাচ্ছি। তুমি মা বাবা আর মামনিকে কল দিয়ে জানিয়ে দাও, আমরা যে এসে পৌঁছেছি। নয়তো উনারা আবার টেনশন করবেন।’

সারাজ বলল,

‘আগে সিম’টা চেঞ্জ করতে হবে। তুই ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি সব করছি।’

মাথা হেলিয়ে পুতুল চলে যায় ফ্রেশ হতে।

________

নিচে নেমে খেতে আসে সারাজ আর পুতুল। দুই দিনের টানা জার্নিতে মাত্রাধিক ক্লান্ত তারা। পুতুলের জন্য তো চোখের পাতা খুলে রাখা’ই দুষ্কর হয়ে ওঠেছে। তাও কোনোরকমে এই অসাধ্য কাজ সম্পন্ন করে খেতে এসেছে সে।

ভিন্ন দেশের ভিন্ন খাবারের এই স্বাদ অতুলনীয়। পুতুল আর সারাজ বেশ তৃপ্তি ভরে তাদের আহার সম্পন্ন করেছে। তারপর এক কাপ কফি নিয়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় তারা।
কফিটা কোনোরকমে শেষ করে বিছানায় আবারও গা এলিয়ে দেয় পুতুল। সারাজ পাশে বসে বলে,

‘কফি খেয়েও ঘুম পাচ্ছে তোর?’

পুতুল জড়ানো আওয়াজে বলে,

‘হ্যাঁ, ভীষণ।’

দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে সারাজ প্রত্যুত্তর করে,

‘ঠিক আছে, ঘুমা। জার্নি করে এসেছিস বলে আজ মাফ পেয়েছিস। ভেবে নিস না কালও মাফ করে দিব।’

পুতুল চিৎ হয়ে শু’লো। হাত উঁচিয়ে সারাজের গাল টিপে বাচ্চাদের মতো আদর করে বলল,

‘তুমি খুব দুষ্টু হয়েছ, সারাজ।’

সারাজ বোকার মতো তাকায়। ওষ্ঠযুগল আপনা আপনি ফাঁক হয়। পুতুল আরেকটু আলগা ভাবে শুয়ে বলে,

‘আমাকে আর দেখতে হবে না; এবার ঘুমিয়ে পড়ো, বাবু।’

সারাজ ততক্ষণাৎ কান মলে দেয় পুতুলের। ক্ষিপ্ত সুরে বলে,

‘খুশিতে কি মাথা গিয়েছে? কীসব উল্টা পাল্টা কথা বলছিস?’

মাথাটা উঁচু করে তাকায় পুতুল। ঈষৎ ক্রোধান্বিত হয়ে বলে,

‘তাহলে তুমি না ঘুমিয়ে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছো কেন? চুপচাপ ঘুমাও গিয়ে, যাও।’

সারাজ ভ্রু ভাঁজ করে অবাক কন্ঠে শুধায়,

‘তুই আমাকে ধমক দিচ্ছিস?’

‘অবশ্যই। বউ’ই তো বরকে শাসন করে। তাই আমিও করছি।’

‘আচ্ছা! তাই না?’

বলেই উঠে দাঁড়ায় সারাজ। অতঃপর হস্ত চালায় নিজের শার্টের বোতামের উপর। বিস্ফোরিত হয় পুতুলের অক্ষিযুগল। সাবাধান বাণী ছুঁড়ে বলে,

‘এই, তুমি কিন্তু নিজেই না করেছিলে।’

ফিচেল হাসে সারাজ। বলে,

‘হ্যাঁ, প্রথমে না করেছিলাম। তবে এখন সিদ্ধান্ত পাল্টে নিয়েছি। আর আমাকে ধমকানোর জন্যও একটা পানিশমেন্ট তোকে দেওয়া উচিত।’

পুতুল উঠে চট করে কাঁথা দিয়ে মুখ ডাকে। অস্ফুট স্বরে বলে উঠে,

‘না না, আমার ঘুম পাচ্ছে।’

কিন্তু তার এই আবেদন কঠিনভাবে অগ্রাহ্য করা হয়। এবং সূচনা ঘটানো হয় রোমাঞ্চকর এক শাস্তির। যার প্রতিটি স্পর্শে শরীরের লোমকূপ দন্ডায়মান হয়। বক্ষঃস্থলের ভেতরের হৃদপিন্ডের কম্পন তড়ান্নিত হয়। শরীর জুড়ে বয়ে যায় উষ্ণ স্রোত। মস্তিষ্ক হয়ে পড়ে অকেজো। এত এত যন্ত্রণা সহ্য করার পরও শাস্তি দাতা এবং শাস্তি গ্রহিতা উভয়ই তাতে চমৎকার মজে যায়। চিত্তের একচ্ছত্র অংশ তখন আওড়াতে থাকে, “আরেকটু শাস্তি বেশি পেলে ক্ষতি নেই।”

_________

পরদিন প্রাতঃকালের প্রথম প্রহর সমাপ্তির পূর্বেই হোটেল রুম ছাড়ে পুতুল আর সারাজ। উদ্দেশ্য তাদের, আশেপাশের এলাকা ঘুরে পরবর্তীতে একটু বেলা হলেই তাজমহলে পদার্পণ ঘটাবে। চিন্তা মোতাবেক’ই হলো সব। প্রভাতের প্রাতঃরাশ একটা লোকাল হোটেলে সম্পন্ন করেই তাজমহলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল তারা। গাড়ি দিয়ে সেখানে যেতে সময় নিল পনেরো মিনিট। সারাজ গিয়ে টিকিট কাটল। অতঃপর ভেতরে তাদের চরণস্থাপন করল। গেইট পেরিয়ে ঠিক সম্মুখে দাঁড়াতেই স্তব্ধ হলো পুতুল। ঐ সাদা রঙের মারবেল খচিত প্রাসাদ’টা সে আগে টিভি আর মোবাইলে অনেক দেখেছে। অথচ আজ সেটা ঠিক তার চোখের সম্মুখে। চোখের পল্লব জোড়া সংকুচিত করে প্রগাঢ় শ্বাস টানল পুতুল। ততক্ষণাৎ নাকে এসে ঠেকল তার এক অন্যরকম ভেজা মাটির ঘ্রাণ। অনুভূতিতে নাড়া পড়ল। চাইল আবার। সারাজকে তাড়া দিয়ে বলল,

‘চলো চলো, তাড়াতাড়ি ভেতরে যেতে হবে। আমার আর তর সইছে না।’

পুরো তাজমহলের আনাচে কানাচে ঘুরে ফেলেছে পুতুল। শ’খানেক ছবিও তুলেছে। এতদিন ছবিতে দেখে আসা এই জিনিসটা চোখের এত সামনে দেখে অভিভূত সে। হাতের স্পর্শ মেখেছে তার প্রতিটি দেয়ালে।

মাথার উপর রোদ বাবাজি চড়াও হতেই পুতুলকে নিয়ে একটু সাইডে এসে দাঁড়ায় সারাজ। পানির বোতলের ঢাকনা’টা খুলে এগিয়ে দেয় পুতুলের দিকে। বলে,

‘নে, পানি খা। খুব গরম এইদিকে।’

ঢকঢক করে দুই ঢোক পানি গিলল পুতুল। সারাজের দিকে এগিয়ে দিল বোতলটা। অতঃপর আহ্লাদী সুরে বলল,

‘শুনো, আমি মারা গেলে তুমি আমার জন্যও এইরকম একটা তাজমহল বানাবে। তারপর মানুষ সেই তাজমহল দেখবে আর ভাববে, আহ! সারাজ আর পুতুলের ভালোবাসার প্রতীক; কী নিদারুণ চমৎকার!’

সারাজ পুতুলের মাথায় গাট্টি মেরে বসে। ক্ষিপ্ত সুরে বলে উঠে,

‘বাজে কথা বললে এক্ষুনি মেরে এখানেই কবর দিয়ে দিব। তাজমহল বানানোর শখ তখন একেবারে মিটে যাবে।’

পুতুল হাত দিয়ে মাথা ঘষে নাক ফুলিয়ে বলে,

‘তুমি আমাকে এতগুলো মানুষের সামনে মারলে?’

‘মারলাম কোথায়? তবে বাজে বকা বন্ধ না করলে মারও খেতে পারিস।’

গাল নাক উভয়ই ফুলাল পুতুল। ফোঁস ফোঁস করতে করতে পা বাড়াল সামনের দিকে। ভ্রু কুঁচকাল সারাজ। পেছন থেকে ডেকে উঠে বলল,

‘কোথায় যাচ্ছিস?’

‘জাহান্নামে যাচ্ছি।’

সারাজ ব্যস্ত গলায় উত্তর দিল,

‘দাঁড়া, আমিও আসছি।’

পুতুলের পদযুগলের গতি বাড়ে। সারাজ ডাকলেও সেই স্বর কানে তুলে না সে। হাঁটতে হাঁটতে ঠিক তাজমহলের সম্মুখের বিশাল গেইটের সামনে এসে স্থির হয়। সারাজও দ্রুত পা চালিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ায়। তেতে উঠে বলে,

‘কী সমস্যা তোর?’

পুতুল ক্ষিপ্ত সুরে জবাবে বলল,

‘অনেক সমস্যা। আর সবথেকে বড়ো সমস্যা তুমি।’

সারাজ কপাল গুঁটিয়ে শুধাল,

‘আমি কী করেছি?’

‘কিছুই করোনি। তুমি তো নিত্যান্তই এক ভদ্র মানুষ।’

প্রসন্ন হাসল সারাজ। রগড় সুরে বলল,

‘তা অবশ্য ঠিক। আমার মতো এমন ভদ্র মানুষ আর দুটো হয় না। তুই কিন্তু খুব লাকি, পুতুল।’

তপ্ত শ্বাস ছাড়ল পুতুল। পুতুলের নিঃস্পৃহ মুখাবয়ব দেখে সারাজের অধর কোণের হাসি দীর্ঘ হলো। আচমকা এক হাঁটু ভাঁজ করে নিচু হয়ে বসে পড়ল সে। পুতুল বিস্মিত হয়ে এক কদম পিছিয়ে গিয়ে বলল,

‘কী হলো?’

ঠোঁটের সেই ঈষৎ হাস্যরেখা বজায় রেখেই সারাজ সহসা এক হাত এগিয়ে দিল পুতুলের পানে। পুতুল ফ্যালফ্যাল করে চাইল। মনে মনে আওড়াল, “কী করতে চাইছে লোকটা?” ইশারায় পুতুলকে তার হাতের উপর হাত রাখতে বলল সারাজ। পুতুলও তাই করল। সারাজের হাতের পিঠে পুতুলের নরম হাতের স্পর্শ পেতেই সেই হাতখানা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল সে। পুতুল নির্নিমেষ চেয়ে আছে কেবল। কোনোকিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। সারাজ আওয়াজ তুলল। কোমল সুরে বলল,

‘সেই ছোট্ট সাত বছরের বালক যখন প্রথমবার একটা ছোট্ট প্রাণকে দেখেছিল, তখন সে অভিভূত হয়েছিল। অবাক হয়ে, বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে কেবল সেই ছোট্ট প্রাণকেই দেখছিল সে। কী চমৎকার সুন্দর সেই প্রাণ! সঙ্গে সঙ্গেই সেই বালকের মনে হয়েছিল, এই প্রাণটা নির্ঘাত এক পুতুল; জ্যান্ত পুতুল। তাই সেই পুতুলকে ঘরে আনতে উতলা হয়ে পড়ল সে। পুতুলও এল ঘরে। তার অতি নিকটেই থাকতে আরম্ভ করল। সময়ে অসময়ে দেখা হতো দুজনের। বেশ ভাব জমে গিয়েছিল কিন্তু। তবে এর মাঝেই সেই বালক একবার এক অনাকাঙ্খিত কাজ করে বসল। কী করল জানিস? সে সেই ছোট্ট পুতুলকে দিয়ে বসল তার মন। আর তারপর থেকে আজ অবধি সেই মন আর ফিরিয়ে আনতে পারেনি সে। হয়তো বেঁচে থাকা আগ অবধি আর পারবেও না। কী করে পারবে বল? কাউকে কিছু দিলে বুঝি সেটা ফিরিয়ে আনা যায়? যায় না তো। তাই আমি শিওর, সেও পারবে না। কিন্তু এতকিছুর মাঝেও আসল মজার ব্যাপার কি জানিস? সেই পুতুলের আজ বিয়ে হয়েছে। সে আজ একজনের স্ত্রী। কার স্ত্রী জিজ্ঞেস করবি না?’

পুতুল মৃদু ঢোক গিলে। অস্ফুট স্বরে বলে,

‘সেই বালকের।’

হাসল সারাজ। বলল,

‘বাহ, ধরে ফেলেছিস? হ্যাঁ, সে এখন ঐ বালকের’ই স্ত্রী। অথচ সেই বালক এখনও তাকে তার মনের কথা বলে উঠতে পারেনি। এত বোকা, এত আহাম্মক কেউ হয়?’

পুতুল তৃষ্ণার্ত চোখে চেয়ে আছে। কিছু একটা শোনার জন্য বক্ষঃস্থলে যুদ্ধ বেঁধেছে তার। অশান্ত মনকে শান্ত করা বড্ড দায় হয়ে ওঠেছে। সারাজ নিজ থেকে বলে,

‘জানিস পুতুল, আজ সেই বালক সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, সে তার মনের কথা তার পুতুলকে বলবে। অনেক সময় নিয়েছে আর না। এবার বলা উচিত। বল, উচিত না?’

অস্থির হয়ে মাথা নাড়ায় পুতুল। যেন মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করছে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই বলা উচিত। বলে তার অশান্ত মনটাকে শান্ত করা উচিত। আর অপেক্ষা করানোটা ঠিক হবে না। শেষে তার পুতুলের মনক্ষুন্ন হবে যে।”

সারাজ এবার পুতুলের দুহাত আঁকড়ে ধরে। আশেপাশের মানুষ সব হা করে তাদের দেখছে। ঢোক গিলে পুতুল। ক্ষণে ক্ষণে হৃদপিন্ডের কম্পন তীব্র হচ্ছে। সে কম্পনের শব্দ কানে এসে ঠেকছে তার। আমজনতা উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে তাদের দিকে। কেউ কেউ আবার ভিডিও ও করছে।
সারাজ এক পল সময় নিয়ে মৃদু আওয়াজে বলল,

‘ভালোবাসি, পুতুল। প্রচন্ড রকম ভাবে ভালোবাসি। আর জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি এইরকম ভাবেই ভালোবেসে যেতে চাই। আমায় সেই অধিকার দিবি তো, পুতুল?’

চোখ জোড়া সিক্ত পুতুলের। যেন একটু নড়লেই টুপ করে সবটা জল কোটর ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে। বক্ষঃস্থলের ঝড় এখন কমেছে। চিত্ত ফুরফুরে হয়ে উঠেছে যেন। ঠোঁট জোড়া মৃদু কাঁপছে। কিছু একটা বলতেও গিয়েও আটকে যাচ্ছে যেন। কেবল সারাজ না, বেশ কয়েক জোড়া উৎসুক চোখ চেয়ে আছে তার পানে; তার উত্তরের অপেক্ষায়।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here