#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-১০
দুপুরের রোদ পড়ে এসেছে। আকাশ টা হালকা একটু মেঘলা। বৃষ্টি আসবে বোধ হয়। রবিন আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেট ঠোঁটে চেপে ধরল। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে মুখ নিচু করে বাম পাশে মুখ বাঁকিয়ে ধোয়া ছাড়ল। তারপর পাশের ড্রেনে ছুড়ে ফেলল। তারপর চায়ের দোকান টায় ঢুকল। সেখানে আগে থেকেই লিমন সহ আরো কয়জন বসে আছে। রবিন গিয়ে বসতেই চা দোকানের ছেলেটি চা এগিয়ে দিল। রবিন চায়ে চুমুক দিয়ে কাপ নামিয়ে রাখল। লিমন কিছুটা এগিয়ে এসে বলল-
“ভাই, আজকে ত তুমি গ্রামে নাই। তুহিন্যা যদি উলটা পালটা কিছু করে?”
রবিন রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে লিমনের দিকে তাকাল তারপর আবার রাস্তায় নজর ফেলে বলল-
“তুহিনের এত সাহস নাই। আমি ওরে ছোট থেকে চিনি, এক সাথে এক ক্লাসে পড়ছি। ওর মন এতটাও কুৎসিত না। ”
রবিনের কথা টা লিমনের পছন্দ হলোনা। সে আবারো এগিয়ে এসে বলল-
“কিন্তু ভাই তুহিন্যা হঠাৎ কইরা রানির পিছে লাগছে কেন?”
“নিশ্চয়ই কোনো কারন আছে। দেখা যাক কি হয়। কিন্তু আমার বিশ্বাস তুহিন রানির কোনো ক্ষতি করব না।”
লিমন এইবার হাসি হাসি মুখ করে বলল-
“চারু ভাবির কিন্তু সাহস আছে। তুহিন্যা রে কি মাইর টাই না দিল। ইট দিয়া এমন ঢিল দিছে। বেচারা তুহিন্যা!!”
রবিন ধমকে উঠল-
“হোপ!!৷ তোরে না বলছি এসব আজেবাজে কথা বলবি না চারুরে নিয়া।”
লিমন এত বড় ধমক খেয়েও দমে গেল না। সে দাঁত কেলিয়ে আবারো বলল-
“চারু ভাবির কিন্তু অনেক সাহস ভাই। ডর ভয় নাই।”
রবিন চোখ গরম করে তাকালো। তাতে লিমন একটু সরে গিয়ে আবারো একটা মধুর হাসি দিল।
রবিন হতাশ শ্বাস ফেলে রাস্তার দিকে চেয়ে চায়ে চুমুক দিল। ঠোঁট নেড়ে শব্দহীন ভাবে উচ্চারন করল-
“চারু। চারু। চারুলতা!!”
___________________
চারু রানির খবর শুনে দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হলো। এক প্রকার দৌড়ে বন- জংগল পার হয়ে সে তালুকদার বাড়ি গেল। তাদের বাড়ি থেকে শর্টকাটে তালুকদার বাড়ি ১০ মিনিটের দূরত্ব। চারু বসার ঘরে ঢুকে হাঁপাতে লাগল। রানির ঘরের সামনে গিয়ে দেখল রুবিনা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন চিন্তিত মুখে। চারুকে দেখে এগিয়ে আসলেন। তিনিই চারুকে ফোন করে আসতে বলেছিলেন।
“রানি কোনোমতেই বাথরুমের দরজা খুলতাছে না। এক ঘন্টা ধরে ঢুকছে বের হয় না। একটু দেখ না চারু।”
চারু তাড়াতাড়ি রানির ঘরে ঢুকল। বাথরুমের কাছে গিয়ে নক করে ডাকল।
“এই রানি, দরজা খোল। কি হইছে তোর?”
রানি গায়ে সাবান ডলছিল। চারুর গলার স্বর শুনে সে থামল। তার মনে হলো চারু সাথে থাকলে এই ঘটনা কিছুতেই ঘটত না। তার কিছুটা রাগ হলো চারুর উপর। বিনা কারনে স্কুল মিস দেয়ার মানে কি? তার আজকের ঘটনা টা আবারো মনে পড়ে গেল।
তুহিন বোতলের ছিপি খুলে ওর দিকে পানির মত কিছু ছুড়ে দিল। প্রথম দিকে রানি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছিল। পরক্ষনেই সে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে চোখ মুখের পানি মুছে তুহিনের দিকে তাকাল। একটা ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে লাগল। তুহিন দাঁত কেলিয়ে হাসছে। তারপর আরেকটু কাছে এসে ফিস ফিস করে বলল-
“তোমার লাইগা এই স্পেশাল উপহার রেডি করতে অনেক পরিশ্রম করছি আমি। কেমন লাগলো তোমার?”
রানি হতবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-
“এইটা কি ? কি দিছেন এইটা?”
তুহিন একটু দূরে সরে গিয়ে বলল-
“ছাগলের প্রস্রাব।”
তারপরেই এক দৌড়ে বাইকে উঠে বসে একটা চোখ মেরে হাসতে হাসতে চলে গেল।
রানি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়েছিল। তুহিন যে তার সাথে এমন করতে পারে তার ধারনারো বাইরে ছিল। সে আরো সাবান ঘষল। তারপর পানি ঢেলে গোসল করে বের হলো। এইটা তার চতূর্থ গোসল। বের হয়ে চারুকে দেখে মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিয়ে কাপড় হাতে ছাদে চলে গেল। চারুও গেল পিছু পিছু। রুবিনা বেগম মেয়েকে দেখে প্রশ্নে জর্জরিত করল। কিন্তু রানি এটা ওটা বলে এড়িয়ে গেল। রুবিনা বেগম আর ঘাটালেন না। রবিন আসলে রবিন কে বলবেন ভেবে তিনি নিজের কাজে চলে গেলেন। রুমে এসে চারু জোর করে রানিকে ধরল কি হয়েছে বলার জন্য। রানি ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে বলল-
“কে এমন মরছে তোর যে তুই দুই দিন স্কুল মিস দিলি?”
চারু কিছুটা অবাক হলো। ওর স্কুল মিস দেয়ার জন্য কি রানি এমন করছে। সে রানিকে বুঝানোর সুরে বলল-
“আমার মন টা অনেক খারাপ রে। মানুষের অসুখ হয় শরিরে। আমার অসুখ হইছে মনে।”
চারুর এমন ভাবের কথা শুনে রানির মুখের ভাব বদলে গেল।। সে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল-
“তোর মত চরিত্রহীন মেয়ের ত এমন হইবই। এক মন কয় জন রে দেস তুই? যত্তসব।”
রানির রাগের অবস্থা দেখে চারু বিস্মিত হলো। সে অন্বক জোরাজোরি করল রানিকে কি ঘটেছে বলার জন্য। শেষমেষ রানি যখন তুহিনের করা কান্ডকারখানার কথা বলল চারু পেট চেপে ধরে হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খেল। তারপর হাসি থামিয়ে বলল-
“তুই কি নিশ্চিত যে এই জিনিস টা ছাগলের? আমার ত মনে হয় তুহিন ভাই নিজের জিনিস টাই তোরে উপহার দিছে।”
চারুর এমন টিটকারি শুনে ঘৃনায় রানির গা গুলিয়ে উঠল। সে রাগ দুঃখ বুকে চাপা দিয়ে আবারো গোসল করতে গেল।
———-
কামরুজ্জামান তাঁর বড় ভাইয়ের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর দরজায় টোকা দিয়ে অনুমতি চাইলেন-
“ভাইজান, আসবো?”
“আয়।”
কামরুজ্জামান ঢুকেই সালাম দিলেন।
“আসসালামু আলাইকুম ভাইজান।”
“ওয়ালাইকুমুসসালাম। বস।”
কামরুজ্জামান ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে সাম্নের চেয়ারে বসলেন। শাহজাহান আলী ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন-
“স্মৃতির ব্যাপারে কি ভাবলা। মেয়েটা এত দিন ধইরা বাড়ির বাইরে। এইবার ত বাড়িত আসা দরকার। এত দিন না আইসা থাকলে মানুষে মন্দ কইব।”
“ওই মেয়ের ব্যাপারে আমি কিছু কইতে চাই না ভাইজান। আপনার যা ভাল মনে হয় করেন।”
“তা কইলে ত হয় না। মেয়ে ত তোমার। আর কয়দিন ই বা রাগ কইরা থাকবা। বাড়ির মেয়ে বাড়ি আসুক।”
কামরুজ্জামান নড়ে চড়ে বসলেন। ভাইয়ের দিকে একবার চাইলেন। তারপর যথাসম্ভব পরিষ্কার গলায় বললেন-
“আপনিও ত ফরহাদ রে দূরে সরায় রাখছেন। ও তো সৈয়দ বংশের ছেলে। ওর কি বাড়ি ছাইড়া থাকা ঠিক?”
শাহজাহান আলী স্থির চোখে ভাইয়ের দিকে তাকালেন। ঠান্ডা কন্ঠে বললেন-
“ওই ছেলে যেই অপরাধ করসে এর পর এই বাড়ির দরজা তার জন্য আর খোলা হইত না।”
“ফরহাদ যদি এই বাড়ির দরজায় পা না রাখে তেইলে ওই বেয়াদব মেয়ের ও অধিকারর নাই আসার। ”
সাজেদা বেগম চা দিতে আসার সময় দুই ভাইয়ের কথা শুনতে পেলেন। চা নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বললেন-
“কেন অধিকার নাই? এই বাড়ির দুই ছেলে মেয়েই আসব এইবার। তোমরা দুই ভাই মিল্লা ছেলে মেয়ে গুলারে বকা ঝকা কইরা দূরে রাখছো। কি এমন দোষ করছে ওরা? মাইয়াটা শহরে পড়তে চাইছিল বইলা ফরহাদ সাহায্য করছে এইটাই ত? এই জন্য ৭-৮ মাস ধইরা বাড়ি থাইকা দূরে সরায় রাখছো তোমরা। এইবার বাড়িত আসতে দাও। তোমরা না আনলে আমি চইলা যাইবাম ওদের কাছে।”
সাজেদা কঠিন ভাবে কথা গুলো বলে চা রেখে চলে গেলেন। শাহজাহান আলী চা হাতে নিয়ে কিছুক্ষন থম মেরে বসে রইলেন। তারপর কামরুজ্জামান কে উদ্দেশ্য করে বললেন-
“অনেক হইছে এইবার মেয়েটারে বাড়িত আসতে কও।”
“আপনি ফরহাদ রে বাড়িত নিয়া আসেন। আমি ওই বেয়াদব মেয়েরে একদম সোজা কইরা নিয়া আসব।”
শাহজাহান আলী উঠে দাঁড়ালেন। জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকালেন।-
“মেয়েরে নিয়া আসবা ভাল কথা। কিন্তু খেয়াল রাখবা সৈয়দ বাড়ির মেয়ের গায়ে যেন কোনো ফুলের টোকা না লাগে। দ্বিতীয় বার এরকম ঘটনা ঘটাইলে আমি তোমারে ক্ষমা করব না।”
_____________
তুহিন আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে গাড়ির উপর শুয়ে আছে। তার মন অনেক ফুরফুরে। হাসি যেন সরছেই না তার মুখ থেকে। পাশে সজল দাঁড়িয়ে থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে আবারো তুহিন কে বললো –
“কও না ভাই তুমি কি রানিরে আসলেই এইসব দিছো?”
তুহিন উঠে বসে ভ্রু নাচিয়ে বলল-
“তোর কি মনে হয় ? ”
সজল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। সে অবাক হয়ে বলল-
“এত শান্ত শিষ্ট মেয়েটার সাথে তুমি এই কাজ টা কেম্নে করলা ভাই? এত কিছু থাকতে তুমি ছাগলের………”
তুহিন সজলকে আর কথা টা শেষ করতে দিল না। হো হো করে হাসতে লাগল। তারপর হাসতে হাসতে বলল-
“জিনিসটা ছাগলের না। ”
“তেইলে?”
“তুই কি পাগল হইছস। ছাগল কোন সময় প্রস্রাব করব সেই আশায় কি আমি সারাদিন বইসা থাকবাম নাকি।”
“তাহলে কিসের থাইকা আইনা দিছো?”
তুহিন লাজুক একটা হাসি দিয়ে আবারো গাড়ির উপর শুয়ে পড়ল।
সজল কিছুক্ষন তব্দা খেয়ে চেয়ে রইল। পরক্ষনেই তুহিনের লাজুক হাসির মর্ম বুঝতে পেরে চোখ মুখ কুচকে গেল। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বিড়বিড় করে বলল-
“খবিশ। বিশ্ব খবিশ!!”
চলবে