ভালোবাসার_ফোড়ন_২ #মিমি_মুসকান #পর্ব_৫৩

0
679

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৫৩

হুট করেই নানা হেসে উঠেন। তার হাসির আওয়াজ চারদিক থেকে শোনা যাচ্ছিল। নানা হাসতে হাসতে বলেন,

“বুঝলে গো আরিফের মা ( আরিফ হলো বড় মামার নাম ) তোমার নাত বউ তোমার মতোই হয়েছে। মনে আছে তোমার কথা। নতুন নতুন বিয়ে হবার পর এভাবে কাছে বসে পেয়ারা, আম , তেঁতুল কতো কিছু খেলে। কতো বকা খেয়েছিল এজন্য তোমার শাশুড়ি’র‌ কাছে মনে আছে।

নানু রুদ্ধ চোখে একবার নানা ‘র দিকে তাকাল। নানা চুপ হয়ে গেল। অতঃপর নানু বলে,
“তোমরা সবাই যাও এখান থেকে, বাড়ি যাও সবাই!

নানুর কথায় সবাই বাড়ির দিকে হাঁটা ধরে। আহিয়ান একবার থাকতে চাইলে নানু তাকেও বলে চলে যেতে। অতঃপর উনিও চলে গেলেন।
নানু এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,
“কি গো নাত বউ সারাদিন কি গাছে থাকবে বলে ঠিক করে রেখেছ নাকি। নেমে এসো জলদি!

আমি ভয়ে ভয়ে গাছ থেকে নেমে নানুর সামনে এসে মাথা নিচু করে নিলাম। নানু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর শীতল গলায় বলেন,

“বাসায় চলো!

বলেই তিনি হাঁটা ধরলেন। আমি উনার পাশে পাশে হাঁটছি। কিছুক্ষণ হাটার পর নানু বলে উঠেন,

“আমার বিয়ে অনেক কম বয়সে হয়েছিল, বুঝলে নাত বউ! আমার যখন প্রথম সন্তান হয় তখনও আমার বয়স অনেক কম। আমি কিছুই জানতাম না তখন। রান্না বান্না এসব আমার শাশুড়ি করতেন আর আমি তাকে সাহায্য করতাম। আমার কাজ ছিল শুধু গাছে চড়া আর লাকড়ি যোগাড় করা। তখন আমাদের দিঘিতে অনেক মাছ ছিল। আমরা ঘরের বউরা কাপড় পেতে মাছ ধরতে পারতাম। আহ কতোই না দিন ছিল সেগুলো!

বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। নানুও দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত রেখে বলেন,

“তোমাকে দেখে আজ সেদিনের কথা মনে পড়ল আমার। আমার সেই শৈশব স্মৃতি!

বলেই মুচকি হাসি দিলেন। অতঃপর আবারো হাঁটা ধরলেন। আমি কিছুক্ষণ সেখানেই নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কারন এই প্রথম নানু আমার দিকে তাকিয়ে হেসে কথা বললেন।‌ আমার মাথায় হাত রাখলেন।‌ কেন জানি খুব খুশি খুশি লাগছিল। কিছু একটা পেয়ে গেছি আমি!

বাড়িতে আসার পর দেখি টেনশনে সবাই অস্থির। সবাই তো ভেবেই নিয়েছিল আমাকে নাকি নানু গাছের সাথে বেঁধে রাখবে। নানুকে আমি হাত ধরে বাড়ির ভিতরে নিয়ে এলাম। নানু সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

“সবাই এখানে লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কাজ কাম নেই তোদের। না থাকলে আমি বলে দেই, রোদ চলে গেছে, সন্ধ্যা নামছে। ছাদ থেকে মরিচ আর আচার গুলো নিচে নিয়ে আয়। আর জামাকাপড় গুলো আনতে ভুলিস না।

নানুর কথায় কিছু মেয়ে মাথা নেড়ে উপরের দিকে হাঁটা ধরল আর বাকি রা রান্না ঘরে গেল। নানা কিছু বলতে গেলে নানু তার দিকে তাকাতেই তিনি চুপ হয়ে গেলেন। বোঝাই যাচ্ছে নানা খুব ভয় পায় নানু কে। অতঃপর নানুর কাছে আহিয়ান এলো। উনি আসতেই নানু তার হাত চেপে ধরলেন। বলে উঠেন,

“তোরা আয় আমার ঘরে! ( নানার দিকে তাকিয়ে) তুমিও আসো!

অতঃপর নানু আহিয়ানের হাত ধরে চলে গেলেন। উনার পিছন আমি আর নানা গেলাম। নানা আমার মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করছেন,

“তোমার নানু কিছু বলেছে

“না নানা, বলে নি।

“তাহলে আর বলবেও না। কিন্তু এখন কেন ডাকছে!

“সেটা তো গেলেই বুঝতে পারব

“চলো!
.
নানু বিছানায় বসা আর নানা সোফায়। তাদের মাঝে আমি আর আহিয়ান দাঁড়িয়ে আছি।‌ নানু শাড়ির আঁচল থেকে চাবির গোছা টা বেঁধে বলেন,

“আহি!

“জ্বি নানু!

“শুনলাম তুই নাকি পালিয়ে বিয়ে করেছিস!

পালিয়ে বিয়ে করেছিস শুনেই আমার বুক টা মোচড় দিয়ে উঠলো। আহিয়ান শান্ত ভাবেই বলল,

“হ্যাঁ, উকিল আনিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে বিয়ে করেছি।

“আমি এতো রেজিস্ট্রেশন বেজিস্ট্রেশন বুঝি না বাপু। ভালো করে বল।

নানা বলে উঠে,
“কাগজে কলমে বিয়ে হয়েছে।

নানু বলে উঠে,
“হ্যাঁ গো কি বলছো! তাহলে তোদের কাজী ডাকিয়ে কালিমা পড়ে বিয়ে হয় নি।

নানুর কথায় আমি আর আহিয়ান দুজনেই মাথা নেড়ে না বলে। নানু অস্থির হয়ে বলেন,

“হায় আল্লাহ কি বলে। তাহলে এই বিয়ে নিয়েই তোরা এতোদিন আছিস। কেন রে তোদের কি টাকার অভাব ছিল যে কাজী ডাকিয়ে বিয়ে পড়াতে পারলি না।

আমি আড়চোখে আহিয়ানের দিকে তাকালাম। উনিও সেই ভাবেই আমার দিকে তাকালেন। নানা উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,

“এতো অস্থির হয়ো না।

“অস্থির হবো না বলছো। আমার নাতি আর নাতবউ কি করছে তুমি বুঝতে পারছো না।

“পারছি আর তাই বলেই বলছি অস্থির হয়ো না। কাজী ডাকিয়ে বিয়ে যখন হয় নি তখন এইবার হবে। তুমি তোমার মেয়ে কে ফোন করে বলে দাও ওরা শহরে পৌঁছানোর পর’ই যেন বিয়ের ব্যবস্থা করে।

নানু আমাদের দিকে তাকিয়ে রেগে বলেন,
“তোরা দুই হতছাড়া আর হতছাড়ি বের হো ঘর থেকে।

নানুর ধমক আমরা দু’জনেই বের হয়ে এলাম। বাইরে এসে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেললাম। হঠাৎ উনি আমার মাথার‌ চুল টেনে বলে,

“তোমার জন্য আমিও বকা খেলাম নানুর কাছে।

“কি বললেন, বলুন আপনার জন্য আমি বকা খেয়েছি

“ওহ আচ্ছা গাছে তো আমি উঠেছিলাম না!

“নানু মটেও সেই কারনে বকে নি। বকেছে বিয়ের জন্য।

“সেই রাগ তো আমার উপর ঝেড়েছে।

“আপনার উপর’ই ঝাড়া উচিত। দোষ তো আপনার’ই। আমার তো বলা উচিত ছিল আপনি আমার জোড় করে বিয়ে করেছেন।

উনি চোখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,
“কি বললে তুমি!

“শুনেন নি বলেছি আপনি আমায় জোর করে তুলে এনে বিয়ে করেছেন। ভুলে গেছেন সেই কথা।

“ভূতনি একটা! দাঁড়িয়ে আছো কেন যাও বলে দিয়ে আসো।

“হ্যাঁ তাই যাবো!
বলেই নানুর ঘরে দিকে যেতে নিলাম। এর আগেই আহিয়ান আমার হাত ধরে টেনে তার সামনে নিয়ে আমার দুই হাত পিছনে করে জোরে চেপে ধরে বলে,

“যাও এখন।

“এটা কি ধরনের কথা। হাত ধরে আটকে রেখে বলছেন যেতে।

“হ্যাঁ যাও, তুমি তো ভূতনি,তোমার তো পাখা আছে যাও উড়ে উড়ে যাও।

“বেশি হচ্ছে কিন্তু, এখন চেঁচিমেচি করলে কি হবে জানেন।

উনি আমার দিকে তাকিয়ে হেসে টেনে আমাকে ঘরে নিয়ে এলেন। অতঃপর ছেড়ে দিয়ে বলেন,

‘নাও চেচাও!

আমি রেগে জোরে চিৎকার করে নানু কে ডাকতে যাবো এর আগেই উনি আমার মুখে ফট করে মোয়া ঢুকিয়ে দিলেন। আমি পাশে তাকিয়ে দেখি কিছু মোয়া নাড়ু এসব প্লেটে ছিল। আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি হাসতে হাসতে বলেন,

“নাও এবার যতো ইচ্ছে চেচাও!

বলেই প্লেট টা নিয়ে বিছানায় উঠে খেতে লাগলেন। আমি মোয়া হাতে নিলাম। ইশ ফট করে মুখে ঢুকিয়ে দেওয়ায় ব্যাথা পেয়েছি। বজ্জাত লোক একটা!
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি উনি এখনো ঘুমাচ্ছেন। ঘরে আবছা আবছা আলো এর মানে বাইরে আলোকিত হয়ে গেছে। বাইরে পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমি বিছানায় ছেড়ে উঠে জানালার পর্দা টা টেনে সরিয়ে দিলাম। পুরো ঘর আলোয় ভরে গেল। জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। বসন্তের শেষ সময় চলে আসছে। কোকিলের ডাক শোনা যাচ্ছে। সেও ডাকছে নাহ গান গাইছে। ভালোই লাগছে এমন একটা দৃশ্য। বাইরে চারদিক গাছপালায় ঘেরা এখানে পাখির আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। আকাশের পাখিরা একের পর এক উড়ে যাচ্ছে নিড়ের সন্ধানে। আমি এখানে বসে দু নয়ন দিয়ে দেখছি এসব। বাতাস জোরে বেয়ে যাচ্ছে। আমি জানালার সাথে ঘেসে দাঁড়িয়ে সেই বাতাস অনুভব করার চেষ্টা করছি। জানি না আর কবে দেখতে পারবো এসব। আবার কবে ভাগ্য হবে আমার এসব দেখার। আমার সময়ও যে ঘনিয়ে আসছে। আজ’ই চলে যাবো এখান থেকে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার কাছ থেকে সরে বিছানায় এসে বসলাম। উনার আর আমার মাঝে বালিশের দেওয়াল। আজ পর্যন্ত কখনো ঘুমের ঘোরে উনি এদিকে আসেন নি আর না আমি গেছি। আমরা দুছনেই কমফোর্টেবল হতে শিখে গেছি।

হঠাৎ’ই ফোনটা বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখি মা ফোন করেছে। আমি ফোনটা রিসিভ করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে মা বলেন,

“নিহা!

“জ্বি মা।

“উঠেছ ঘুম থেকে।

“মাত্র উনি এখনো ঘুমাচ্ছেন।

“এটা তো জানা কথাই। আচ্ছা তোমারা কখন আসছো।

“রাতের দিকে রওনা দেবো।

“দেখো রাতে সাবধানে এসো।

“জ্বি মা আসবো। ইয়ানের কথা শুনতে পাচ্ছি, ও আছে আশেপাশে।

“আছে বৈ কি, এখানে ইয়ান যে জ্বালিয়ে মারছে আমাকে। পাগল হয়ে গেছে তোমাকে আর আহি কে দেখার জন্য।

আমি হেসে বলি,
“আচ্ছা একটু দিন ইয়ান কে।

অতঃপর ইয়ান কে ফোন দেওয়া হল। খানিকক্ষণ কথা বললাম ওর সাথে। আহা বেচারা আমার আর আহিয়ানের জন্য বেশ কষ্ট পাচ্ছে। তার সাথে কথা বলার সময় বুঝলাম তার গলা ভারী হয়ে আসছিল।

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here