#যেদিন_আমি_থাকবো_না
#লেখিকা_ইভা_আক্তার
#পর্ব_১০ (শেষ পর্ব)
————————
ক্লাসে প্রফেসর তখন লেকচার দিচ্ছিলেন। এমন সময় নীল খেয়াল করে তানিশা অদ্ভুত বিহেভ করছিল। তানিশা মাথায় হাত দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর সারা মুখ ঘেমে যাচ্ছিল। নীল কিছুটা ঘাবড়ে তানিশার কাঁধে হাত রেখে বলে,
– ঠিক আছিস তানিশা? কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?
তানিশা কিছু না বলে নিজেকে সামলে দাঁড়িয়ে স্যারকে বললো,
– স্যার আমি কি ওয়াশরুম যেতে পারি।
– শিওর।
স্যারের অনুমতি পেয়ে তানিশা ধীরে ধীরে ক্লাস রুম থেকে বাইরে চলে যায়। তানিশা ওয়াশরুমে গিয়ে কয়েকবার মুখ ধুয়ে মাথার তালুতে কয়েকবার পানি দিলো। মাথাটা ভনভন করছে। হয়তো এক্ষনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবো৷ যতদিন যাচ্ছে ততই এই মাথা ব্যথা তীব্র বেড়ে চলছে।
মাথা ব্যথা কিছুটা হালকা হতেই তানিশা বাইরে বের হয়ে আসলো। বাইরে বের হতেই দেখলো নীল কপালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তানিশাকে বের হতে দেখেই বলে,
– কি হয়েছে রে তোর?
– কি হবে?
নীল সন্দেহজনক চাহনিতে তানিশার দিকে তাকিয়ে বলে,
– তোর কি মাথা ব্যথা করছে? মাথায় পানি দিয়েছিস কেনো?
– গরম লাগছিলো তাই মাথায় পানি দিয়েছি৷
তানিশা কথাটা বলেই নীলের হাত থেকে নিজের ব্যাগ নিয়ে চলে যেতে নিল। নীল পকেটে দুই হাত গুজে তানিশার পিছে যেতে যেতে বললো,
– ওহ বুজেছি। অনেক দিন যাবৎ মাথায় শ্যাম্পু না করার কারণে গন্ধ বের হচ্ছিল যার ফলে তুই মাথায় পানি দিয়েছিস।
নীল কথাটা বলেই তানিশার সামনে এসে পড়ে। এদিকে নীলের কথা শুনে তানিশা দাঁত কিড়মিড় করে দাড়িয়ে পড়ে৷
– আরে ইয়ার। মন খারাপ করছিস কেনো?চল তোকে নতুন ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু কিনে দেই৷
তানিশা রাগ করতে নিলেও করলো না। সে এক দৃষ্টিতে নীলের দিকে তাকিয়ে রইলো। হারিয়ে যেতে যেতেও হারিয়ে গেলো না নীল। তার জন্যই তানিশা এতো কস্টের ভিড়েও বেঁচে থাকা শিখেছিল। এই কয়েকটা বছরে নীল ওকে সাহস জুগিয়েছে৷
তানিশা মুচকি হাসি দিলো। নীল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। তানিশার তো এখন রেগে যাওয়া উচিত ছিল। অথচ এ কি পরিবর্তন!
তানিশা সামনে আগাতে নিলেই ওর মাথা ব্যথা হতে শুরু করে। ফলে নিজের ভারসাম্য হারিয়ে নীলের বুকে পড়ে যায়। নীলও অপ্রত্যাশিতভাবে তানিশাকে জড়িয়ে ধরে। তানিশা পরম আবেগে নীলের বুকে মাথায় লুকায়। নীল তানিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ঠিক তখনই সেখানে অভি এবং আইরিন এসে পড়ে। আইরিন নীল এবং তানিশাকে এমন অবস্থায় দেখে অভিকে বলে,
– আজ পর্যন্ত কখনো আমাকে এভাবে বুকে জড়িয়ে ধরেছো? অথচ তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কত সুন্দর করে তানিশাকে জড়িয়ে ধরে আছে।
আইরিনের আওয়াজ পেতেই তানিশা নীলের থেকে দূরে সরে যায়।
– আরে হটাৎ পড়ে যেতে নিয়েছিলাম। তখনই নীল আমাকে ধরে (তানিশা)
– তাই নাকি। আমার তো মনে হয় না।
আইরিন কথাটা বলেই দুষ্টু হাসি দেয়। তানিশা ওর গালে হালকা করে চর দিয়ে বলে,
– তোর মতো নেগেটিভ মাইন্ডের মেয়ে যে কি করে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হলো আল্লাহ মাবুদ জানে।
————————–
সন্ধ্যা তখন সাড়ে সাতটা। তানিশা বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখতে পায় রোজা চৌধুরী ডাইনিং টেবিলে বিভিন্ন নাস্তা সাজাচ্ছেন। তিনি তানিশাকে দেখতে পেয়ে বললেন,
– আজ এতো দেড়ি যে? এতো সন্ধ্যা পর্যন্ত আর কিন্তু বাইরে থাকা চলবে না। এবার এসো বসে নাস্তা করো। আমি তুহিনকে ডেকে নিয়ে আসছি।
রোজা চৌধুরী উপরে চলে যান তুহিনকে ডাকতে। তানিশা ধীরে ধীরে খাবার টেবিলে বসে পড়ে। সব কিছুই জাদুর মতো হয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যটাও জাদুর মতো পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। হয়তো বা সৃষ্টিকর্তা এটা বুঝাতে চাইছেন যে আমার হয়তো আর বেশি সময় নেই ৷ তাই হয়তো তিনি আমার ভাগ্যটা পরিবর্তন করে দিয়েছেন।
কিছুক্ষণ পর খাবার টেবিলে তুহিন এসে পড়ে। তুহিন সবকিছুকে তাচ্ছিল্যসহকারে উড়িয়ে দিতে দিতে পারলো না। তানিশা তাকে ইশারায় বাধা দেয়। তুহিন খাবার টেবিলে আসতেই বাইরে থেকে রাফসান চৌধুরিও চলে আসেন। তিনি এসেই তানিশার পাশে বসে তানিশার হাতে কিছু কাগজ ধরিয়ে দেন। তানিশা কাগজ গুলো দেখতেই অবাক হয়ে যায়। রাফসান চৌধুরি মুচকি হেসে বললেন,
– আমি তোমাদের সম্পত্তি তোমাদের নামে দিয়ে দিলাম। আর তিশার যে সম্পত্তি গুলো আছে সেগুলো আমি নিজের কাছেই রেখে দিলাম। যতদিন না ও সুধরাবে ততদিন ও আমার থেকে কোনো কিছুই পাবে না৷
রাফসান চৌধুরি বাকি কাগজ গুলো তুহিনের হাতে দিয়ে দিল। তানিশা ভাবতে লাগলো কি করবে ও এই সম্পত্তি দিয়ে। ও বাচঁবেই বা আর ক দিন?
– আমার এ সম্পত্তির দরকার নেই বাবা। এগুলো দিয়ে আমি কি করবো?
– এগুলো তোমার পাওনা। তোমার অধিকার এগুলো। এই সম্পত্তির মালিক তো তুমি।
তানিশা আর কিছু বললো না৷ চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দিল।
——————————
তানিশার জীবনে আরও দুটো মাস চলে গেলো। এই দুই মাসে তানিশার মাথা ব্যথা তীব্র থেকে তীব্র হয়ে গেছে। অপরদিকে তিশা যেনো সম্পূর্ণ বোবা হয়ে গেছে। রুমের বাইরেও আর বের হয় না। ভার্সিটিতেও যাওয়া আসা করে না। সেদিন রোজা চৌধুরী তানিশার কথায় তিশাকে বাইরে আসতে বললেও আসলো না। তবে তুহিন সেসব নিয়ে পরোয়া করে নি। তার কাছে অপরাধী যেনো আজীবন অপরাধী থাকবে।
সেদিন ছিল নীলের জন্মদিন। নীলের বাড়িতে বড় করে জন্মদিনের আয়োজন করা হয়েছিল। তানিশা সাদা রঙের একটা গাউন পড়ে সেই জন্মদিনে যায়। আর মেকআপ দিয়ে তার চোখের নিচে পড়া কালো দাগ গুলো ঢাকে। আগের তুলনায় তানিশা প্রচন্ড শুকিয়েও গেছে। চোখের নিচের দাগসহ শরীরটাও দূর্বল।
তানিশা গাড়ি থেকে নামতেই সামনে দেখতে পায় সওদাগর বাড়িটা যেনো আজ মেতে উঠেছে। পুরো বাড়ি আলোয় ঝকমক করছিলো। তানিশা ভেতরে ঢুকে নীলকে খুঁজতে থাকে। কিছুক্ষণ পর পেছন থেকে কেউ ওর কোমড় ধরে কানে ফিসফিস করে বলে,
– ওয়েলকাম টু মাই হোম।
তানিশা পেছনে ঘুরতেই নীল রঙের সুট প্যান্ট পড়া নীলকে দেখতে পায়। নীলকে আজ অত্যন্ত সুদর্শন লাগছে। নীলও এক দৃষ্টিতে তার সামনে থাকা এক প্রিন্সেস কে দেখতে থাকে। নীল তানিশাকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
– এতো লেট করলি কেনো?
– জ্যাম ছিলো রাস্তায়।
– ঠিক আছে এবার আয়। তোর জন্য আমি এখনও কেক কাটি নি৷
তানিশা নীলের কথায় ওর সাথে যায়। আসলে তানিশা ইচ্ছে করে গাড়ি খুব আস্তে চালিয়েছিল। কেননা কয়েকদিম ধরে তানিশার গাড়িতে উঠলেই মাথা ঘুরতে থাকে আর বমি আসতে থাকে।
নীল কেক কাটলো। কেক কেটেই প্রথম কেকটা তানিশা খাইয়ে দেয়। নীল যখন একে একে সকলকে কেক খাওয়াতে লাগলো তখন তনািশা নিজের অজান্তেই কেঁদে ফেলে। এই সুখময় সময়টা ও নীলের সাথে কাটাতে পেরে প্রচন্ড খুশি হয়ে যায়।
কেক খাওয়া শেষ আইরিন সবাইকে কাপল ডান্সের প্রস্তাব দেয়। সাথে নীল ঠিক করে ও তানিশার সাথে ডান্স করবে। তানিশাও খুশিমনে রাজি হয়ে যায়। এ জীবনে হয়তো কখনও ও নিজের মনের কথা নীলকে জানাতে পারবে না ঠিকই। কিন্তু নীলের সাথে বাকি সময়টা তো কাটাতে পারবে।
নীল তানিশার হাত ধরে ডান্স করতে থাকে। ডান্স করতে করতে এক পর্যায়ে তানিশার চোখ থেকে পানি বের হয়ে বসে। নীল সেটা দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে রয়। তানিশা হটাৎ কাদঁছে কেনো? তানিশা নীলের মাথায় হাত দিয়ে গেলেই তানিশা আটকে দেয়। কেননা এক তো তানিশার মাথায় প্রচন্ড ব্যথা। অপরদিকে তানিশার চুলে হাত দিলেই চুল উঠে আসে। নীল সেটাকে তোয়াক্কা না করে মুচকি হাসি দেয়। নীল ভাবলো হয়তো বা ফেমিলিতে কিছু একটা ঘটেছে। তাই নীল তানিশাকে খুশি করার জন্য ওর সাথে ডান্স করতে থাকে। হটাৎ করে তানিশার চোখ গুলিয়ে আসে। সবকিছু যেনো ঝাপসা হয়ে আসছিলো। চেহারা থেকে ঘাম ঝড়ে পড়ছিল। নীল সেটা দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়ে ডান্স থামিয়ে তানিশা দুই গালে হাত দিয়ে বলে,
– কি হয়েছে তানিশা? এমন কেনো করছিস?
নীলের চিৎকারে সকলে ডান্স থামিয়ে নীলদের কাছে আসে। তানিশার চোখ বন্ধ হতেই নীল তানিশাকে নিজের বুকে মাথা ঠেকিয়ে দ্রুত গাড়ি বের করার জন্য অভিকে বলে।
অপরদিকে রোজা চৌধুরী তানিশার রুমে আসে রমটা গুছিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আলমারি গুছাতে গিয়ে সেখানে তানিশার ব্রেইন টিউমারের রিপোর্ট পায়। এটা দেখে রোজা চৌধুরী চিৎকার করে সকলকে ডাকতে থাকে। তুহিম এবং রাফসান চৌধুরি রোজা চৌধুরীর চিৎকারে দ্রুত তানিশার রুমে আসতেই রোজা চৌধুরী কেঁদে কেঁদে রিপোর্টটা তুহিনের হাতে দেয়। তুহিন রিপোর্টটা ভালো করে দেখতেই ওর চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি বের হয়ে আসে। রাফসান চৌধুরি মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। রিপোর্টে স্পষ্ট দেওয়া আছে দুই মাসের ভেতরে তানিশার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। এমনকি ওর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
—————————–
হসপিটালের কেবিনের বাইরে নীল, আইরিন, অভি এবং নীলের পরিবাররা দাঁড়িয়ে আছে। নীল ভাবতে থাকে কি হয়েছে তানিশার? কয়েক মাস ধরেই তানিশা উল্টা পাল্টা বিহেভ করছে। অভি নীলের কাছে এসে বলে,
– আঙ্কেল, আন্টি সবাইকে কল দিয়েছি। তারা এক্ষনি হসপিটালে আসছে।
নীল কিছু বললো না। শুধু ডাক্তারের অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার আসতেই এক অপ্রত্যাশিত কথা বললো যেটা শুনে সকলে হুহু করে কাঁদতে থাকে। তিনি বললেন,
– তানিশার ব্রেইন টিউমার হয়েছে। টিউমারটা এতোটাই বড় হয়ে গেছে যে ওকে বাঁচানো বর্তমানে কোনো ডাক্তারের পক্ষেই সম্ভব না। তাই আমরা চাচ্ছি ওকে হসপিটালে এডমিট করাতে। দুই বা তিন দিম মেডিসিন নিক। দেখা যাক কি হয়৷।
ডাক্তার কথাগুলো বলেই চলে গেলেন। অন্য দিকে আইরিন ফ্লোরে বসে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। অভি আইরিনের পাশে বসে বললো,
– চুপ একদম কাঁদবে না৷ আমাদের তানিশার কিছু হবে না৷ এভাবে ভেঙে পড়ো না।
অন্যদিকে নীল তার বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে। নিতু নীলের হাত ধরে বলে,
– ভাইয়া শান্ত হও। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি একবার মিষ্টি আপুর সাথে গিয়ে দেখা করো।
নীল মাথা নাড়িয়ে কেবিনে ঢুকে যায়। তানিশা চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। হাতে স্যালাইন দিয়েছে। সাদা রঙের সেই গাউনটাও চেন্জ করে দিয়েছে। নীল তানিশার পাশে বসে ওর হাত ধরে। তানিশা চোখ মেলে নীলের দিকে তাকিয়ে রইলো। নীল চোখের পানি মুছে বললো,
– এতোটা কেয়ারলেস কেনো তুই?তুই আগে থেকে জানতি না যে তোর ব্রেইন টিউমার আছে?
তানিশা মুচকি হাসলো। নীলের প্রচন্ড রাগ লাগছে। ইচ্ছে করছে এই মুহুর্তে তানিশকাে দুটো চর দিলে মনটা শান্ত লাগতো।
– কিছু বলার নেই আমার। তোর উপর আর বিশ্বাস ভরসা কোনোটাই নেই। তুই তো আমাকে ধোঁকা দিয়েছিস৷
– এভাবে বলিস না প্লিজ। তোদের জন্যই তো আমি কয়েকটা মাস হাসিখুশি তে ছিলাম। যখন আমার পরিবারের কেউ আমার পাশে ছিল না তখন তোরা ছিলি।
– আর সেই আমাদেরকেই তুই ধোঁকা দিলি?
তানিশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
– যদি আগেই বলে দিতাম তাহলে কি তোদের সাথে খুশিতে সময় কাটাতে পারতাম?
নীল তানিশার এক হাত মুঠোই নিয়ে চোখের পানি ফেলতে থাকে।
– তোকে ছাড়া কি করে থাকবো আমরা বল?বিশেষ করে আমি কি করবে থাকবো?তুই তো আমার সবকিছু।
– চুপ বোকা। এভাবে কাঁদছিস কেনো হুম? আমি তো আছি তোর সাথে। আর আজিবন থাকবো। সবসময় আমাকে মনে রাখিস কেমন?
নীলের চুপ হয়ে রইলো। তানিশা মনে মনে বললো,
” তুমি না হয় আমার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাও। এ স্বপ্নকেই আমি বাস্তব রূপে ধরে নেব প্রিয়”
কেবিনের দরজা খুলেই হনহন করে রুমে প্রবেশ করলেন রাফসান চৌধুরি, রোজা চৌধুরী এবং তুহিন। রোজা চৌধুরী অঝোরে কেঁদে চলেছেন। তানিশা সেটা দেখে কেনো জানি ভালো লাগলো। তার মা তার জন্য কাদঁছে।অর্থাৎ মা এবং বাবা দুজনেই আমাকে ভালোবাসে। রাফসান চৌধুরি প্রচন্ড বকাঝকা করতে লাগলেন। সাথে তুহিনও। ওদের প্রশ্ন কেনো এই রোগের কথা তানিশা আগে বললো না। তখন হয়তো বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করা যেতো। কিন্তু এখন তো প্রচন্ড দেড়ি হয়ে গেছে।
—————————–
রাস্তায় কোলাহল কমে গেছে। চারিদিক নিস্তব্ধ। তানিশা চুখ বুজে শুয়ে আছে। হয়তো ঘুমিয়েও পড়েছে। রাত এগারোটার কাছাকাছি। এসময় সাধারণত কেবিনে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। কিন্তু নীলের জেদে জিহাদ সওদাগর তার ব্যবস্থা করে দেন। সকলে গেছে ক্যান্টিনে খাবার খেতে। জিহাদ সওদাগর এবং আফিফা সওদাগর সাথে নিতুও চলে গেছে বাড়িতে। আইরিন আর অভি নাকি এখানেই থাকবে। এদিকে রোজা চৌধুরীকে এতো বার বলার পরও তিনি গেলেন না। হয়তো মেয়ের জন্য একটু হলেও মায়া জন্মেছে। আর কতোই বা অবহেলা করবেন?
নীল শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তানিশা ধীর কন্ঠে বললো,
– পানি খাবো নীল।
নীল ঝটপট পানির গ্লাসটা নিয়ে তানিশার মাথায় হাত দিয়ে খাওয়ালো। নীল খেয়াল করলো তানিশার বালিশে বেশ কয়েকটা চুল লেগে আছে। এমনকি নীলের হাতেও উঠে এসেছে। নীলের কন্ঠ ভারি হয়ে গেলো। মেয়েটার মুখটা কতোই না মলিন হয়ে গেছে। এক দিনে এতো পার্থক্য?
– তুই যাস নি?
– তোকে ছাড়া কি করে যাই?
তানিশা মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলে,
– দুই দিনের এই পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষকেই চলে যেতে হবে ,তেমনি করে আমাকেও নিতে হবে। যে দিন আমি থাকব না সে দিন থেকে বুজে নিও তোমার নতুন দিন শুরু। সূর্য টা ঝিকমিক কিরণ দিবে।পাখিরা নতুন সুরে গান গাইবে। তবে আমি না থাকলে তোমার আমিটা কে অযত্ন করো না। আমার খুব শখের জিনিস টা তোমার কাছে আমানত রেখে গেলাম। দেখে রেখো তোমার আমিটা নামক আমার শখের আমানত কে।
নীল নিজের কান্না আটকে বললো,
– এভাবে বলিস না প্লিজ। কেনো এতো দূরে থাকতে চাইছিস বল?
তানিশা কিছু বলার আগেই ওর মাথা আবারো যন্ত্রণা করতে শুরু করলো। নীল সেটা দেখে কোনো উপায় না পেয়ে তানিশা পাশে বসে ওর মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলাতে থাকে। এক পর্যায়ে তানিশা ঘুমিয়ে যায়। নীলের ওর পাশের বালিশে চুপটি করে শুয়ে যায়। চোখ থেকে টিপটিপ করে পানি পড়ছে নীলের। এতো বছরের সম্পর্ক কি তাহলে শেষ হয়ে যাবে? কি করে থাকবো আমি তানিশাকে ছাড়া?
————————
রোজা চৌধুরী এবং রাফসান চৌধুরি সকাল হতেই বাড়ি এসেছেন। রোজা চৌধুরী এসেছেন তানিশার জন্য নাস্তা আর জামা কাপড় নিয়ে যেতে। বাড়ির সকলের মুখ মলিন হয়ে আছে। তুহিন এখনও হসপিটালে। রাফসান চৌধুরি গোসল করে চেন্জ করছিলেন। রোজা চৌধুরী তখন নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। তখনই তাদের বাসায় কেউ কলিং বেল টিপে। তিশা তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। কলিং বেলের শব্দে ও রুমের বাইরে বের হয়। কারণ ও জানে তুহিন ভাইয়া নেই।
দরজা খুলতেই কোর্টের এক লোক তিশার হাতে কয়েকটা খাম ধরিয়ে দেয়। তিশা সিগনেচার করে খামটা হাতে নেয়। সেখানে তিশা চৌধূরী নামটা লেখা। তিশা অবাক হয়ে খামটা খুলতেই বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। এখানে স্পষ্ট লেখা তানিশা তার সকল সম্পত্তি তিশার নামে লিখে গেছে। সাথে তিশার পাসপোর্ট এবং প্যারিসে যাওয়ার ভিসাও বানিয়ে গেছে। প্যারিসে যাওয়া তিশার গত চার বছরের স্বপ্ন। কিন্তু বাবা মায়ের আদরে মেয়ে হওয়ায় তারা তিশাকে একা ছাড়তে চায় নি।
তিশা ভেতরের খামে চিঠি পেলো। চিঠিটা তানিশার লেখা।
” কেমন আছো?
সরাসরি কখনো জিজ্ঞেস করা হয় নি তাই না? আজ হটাৎ এতো উপহার সাথে খাম দিলাম কেনো জানো?
কারণ আমার সময় প্রায় শেষের পথে। আমি ঠিক করে রেখেছি আমার সকল সম্পত্তি আমি তোমাকে দিয়ে দেব। কারণ বাবা মার তোমার প্রতি বিশ্বাস আর ভালোবাসা সব কিছু উঠে গেছে। এ জন্য অবশ্য আমিই দায়ী।
তোমার ভিসা পাসপোর্ট সব আমি নিজে করেছি। আমার জন্য যদি তোমার উপকার হয় তাহলে ক্ষতি টা কি?
তুমি আমাকে হিংসে করো জানি। কিন্তু কখনো আমার দিক থেকে দেখতে চাও নি আমি কতটা অবহেলা আর অসহায়ভাবে বড় হয়ে গেছি। বাবা মা কখনো একটু আদর করে ডাকে পর্যন্ত নি। জীবনে ব্যথা পেলেও তাদের কোনো সাপোর্ট পায় নি। আমি সেই মেয়ে যে বাবা মা থাকা সত্বেও এতিম ভাবে বড় হয়েছি। হ্যা আমি তাদের এডোপ্ট মেয়ে। কিন্তু আমিও মামুষ। আমারও তো ভালোবাসা দরকার তাই না। তুমি নীলকে ভালোবাসো। প্রথম পরিচয় থেকেই। আর আমি তিন বছর ধরে ওকে ভালোবাসি৷ কিন্তু কখনো বুঝতে দেই নি। শুধুমাত্র সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয়ে। মেয়েদের প্রতি ওর কোনো আকর্ষণ ছিল না। অন্যন্য ছেলেরা যেমন মেয়েদের গায়ে গায়ে লেগে থাকে। ও ঠিক তার বিপরীত। জাইমা চলে যাওয়ার পর নীল আবারও ফিরে এসেছিল ঠিকই৷ কিন্তু আজও আমি নীলকে মনের কথা জানাই নি শুধুমাত্র ক্ষনিকের জন্য বাঁচবো বলে।
কখনো হিংসে করো না বোন। তুমি আমার আপন বোন না হও। তুহিন ভাই আমাকে যেমন আপন বোন হিসেবে দেখেছে আমিও তোমাকে সেভাবেই দেখি। শুধু আমাদের সম্পর্কটা কখনো ভালো যায় নি। তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো বা বিশ্বাস করো আমি জানি না। তবে এতোটুকু জানি তুমিও আমার পরিবার। আমি গোটা পরিবারের ভালোবাসা পেয়েছি। শুধু তোমার বাদে।
ইতি
তোমার অপছন্দের বোন
তানিশা ”
পুরো চিঠিটা পড়া শেষ হতেই তিশা হাঁটু গেরে বসে পড়ে। এই প্রথম তিশা কারো জন্য কাঁদছে। তাও আবার তানিশার জন্য যাকে কিনা সে কখনো দেখতেও চায় নি। অথচ সেই বোন আজ তাকে নিজের সব সম্পত্তি দিয়ে গেলো। তিশার কান্না দেখে রোজা চৌধুরী ছুটে এলেন।তিনি তিশার হাতের কাগজ এবং চিঠি দেখেও নিজেও বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন।
———————————
নীল তানিশাকে একবার ভালো করে দেখে তারপর ক্যান্টিনে চলে গেলো৷ কাল রাত থেকেই কিছু খাওয়া হয় নি তার। অভি আছে তানিশার সাথে আর তুহিনও। নীল আর আইরিন টুকিটাকি খাবার নিয়ে টেবিলে বসে। আইরিন আর নীল দুজনের মুখটাই মলিন হয়ে আছে। আইরিনের খুব ইচ্ছে করছে নীলকে সব কিছু বলে দেওয়ার। কিন্তু তানিশার পারমিশন ছাড়া এটা করা কি ঠিক হবে?
– বাসায় চলে যা আইরিন। অসুস্থ হয়ে পড়বি তো।
– তুই যা। তোকে কে থাকতে বলেছে?
– তানিশাকে ছাড়া আমি যাবো না।
– এতো ভালোবাসিস তানিশা কে?
নীল কেঁপে উঠলো। আইরিনের কথা কি সত্যি? নীল তো নিজেও বুঝতে পারে না যে ও কি আসলেই তানিশাকে ভালোবাসে নাকি না। তানিশা যদি নীলকে ভালো না বাসে?
– তুই তানিশাকে অনেক ভালোবাসিস তাই না?
– জানি না।
– এতো বোকা কেনো তুই? ভালোবাসিস সেটা বলতে এতো দ্বিধা কেনো তোর? অথচ দুজন দুজনাকে ভালোবাসে তবুও কেউ কাউকে বলে না।
নীল অবাক হয়ে জিজ্ঞাসাবোধ চিহ্ন নিয়ে তাকালো আইরিনের দিকে৷ আইরিন রাগী দৃষ্টিতে নীলের দিকে তাকিয়ে আছে।
– কি বললি?
– তানিশা তোকে ভালোবাসে। প্রচন্ড ভালোবাসে রে নীল। শুধু জাইমার জন্য ওর মনের কথা তোকে বলতে পারে নি। ও ভয় পেয়েছিল যদি তুই বন্ধুত্বের সম্পর্কটাও নষ্ট করে দিস। অথচ দেখ। শেষ সময়টায় এসেও ও তোকে ভালোবাসি বলতে পারে নি। কারণ ও জানে ও বেশিদিন বাচবেঁ না।
– তুই আমাকে এসব আগে কেনো বলিস নি?
– তানিশা বারণ করেছিল তাই।
নীল খাবার রেখে দৌড়ে চলে গেলো তানিশার দিকে। এদিকে আইরিনের চোখ থেকে পানি পড়ছে। কেনো সবার মতো নীল আর তানিশার ভালোবাসাটা দীর্ঘ হলো না?
নীল দৌড়ে গেলো তানিশার কেবিনের ভেতরে। নীলকে এভাবে দৌড়ে তানিশার কেবিনে ঢুকতে দেখে তুহিন এবং অভিও ভয় পেয়ে গেলো।
তানিশা শুয়ে আছে। নীল ধীরে ধীরে ওর পাশে বসলো।
– তানিশা।
– হু
– ভালোবাসিস আমায়?
তানিশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
– আইরিন বলেছে?
– হুম
– ভুলে যা সব। নতুন করে বাঁচতে শুরু কর। আমাকে ভুলে যা।
– যদি তোকে ভুলা যাওয়া এতোটাই সহজ হতো তাহলে তোকে নিয়ে আমার মনে কোনো আফসোস থাকতো না।
– অনিশ্চিত জীবনে তোমাকে নিশ্চিত করে পাবার জন্য কঠিন ভাবে চেষ্টা চালিয়েছিলাম, কিন্তু আফসোস তুমি আমার হলে না। আমি তোমাকে পেলাম না। আমার জীবন ফুরিয়ে গেলো। তবুও তোমার মুখ থেকে ভালোবাসি শুনলাম না।
নীল হুহু করে কেঁদে উঠলো। তানিশার কপালে মাথা ঠেকিয়ে বললো,
– ভালোবাসি তানিশা। আমি তোকে অনেক ভালোবাসি।কখনো ভাবি নি তোকে এতো দ্রুত হারিয়ে ফেলবো। কেনো আমাকে আগে বলিস নি যে ভালো বাসিস? কেনো?
– তুই আমার বন্ধু। আমার কাছের মানুষ। ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে যদি তোকে হারিয়ে ফেলি?
– তুই অনেক বোকা রে তানিশা। নাহলে সামান্য ভালোবাসার কথাটা বলতে এতো দ্বিধাবোধ করলি।
তানিশা মুচকি হাসলো। মাথাটা ভার হয়ে আছে। বসার মতোনও অবস্থা নেই কোনো। নীলকে অনুরোধ সুরে বললো,
– আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবি প্লিজ? তোর বুকে মাথা রাখার অনেক সখ আমার জানিস?
নীল ধীরে ধীরে তানিশা মাথা ওর বুকে রাখলো। নীলের বুক কেঁপে উঠছে। তানিশার চোখের পানিতে নীলের শার্ট ভিজে গেলো। এই সম্পর্ক দীর্ঘ হলো না ঠিকই কিন্তু নীলের আফসোসটা রয়েই গেলো। তবে তানিশার শেষ ইচ্ছেটা তো পূরণ হলো।
নীল খেয়াল করলো তানিশার শ্বাস ভারি হয়ে যাচ্ছে। নীল অস্থির হয়ে তানিশাকে ডাকতে থাকে।
– তানিশা, এই তানিশা। কি হয়েছে কথা বল?
নীল তানিশার মুখখানা ধরে বলে,
– কি হলো কথা বলছিস না কেনো?এই যে আমার দিকে তাকা। অন্তত আমাকে এবার দেখ।
তানিশা ধীরে ধীরে চোখ মেলে বললো,
– তুমি গল্প হলেও গল্প না।
তুমি বাস্তব হয়েও কল্পনা।
তানিশার চোখ বন্ধ হয়ে গেলো। শেষ নিশ্বাস নীলের বুকেই ত্যাগ করলো।
নীল পাগলের মতো চিৎকার করতে রইলো। তানিশা তানিশা বলে এতো বার ডাকার পরও তানিশার চোখ আর খুললো না। তানিশার মলিন কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। এদিকে নীলের কান্নায় তুহিন,অভি এবং আইরিন দৌড়ে রুমে চলে আসে। ডাক্তাররাও এখন আফসোসের চোখে তাকিয়ে রইলো। কিছু কিছু নার্স অনবরত নিজের চোখের পানি মুছতে রইলো। রোজা চৌধুরী, রাফসান চৌধুরি এবং তিশাও চলে আসে। তানিশার নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে থাকে। নীলের কান্না যেনো থামছেই না। প্রিয় মানুষটাকে পাওয়ার আশায় উল্টো হারিয়ে ফেলার মতো কষ্ট যেনো কারো ভাগ্যে না জুটে। তিশা তানিশার হাত ধরে বলে উঠে,
– আমাকে মাফ করে দিও আপু। এই নোংরা মেয়েটাকে একটু হলেও ক্ষমা করে দিও। আমি পারি নি তুমি বেঁচে থাকা অবস্থায় নিজের মনের কথা বলতে। আমি অনেক দেড়ি করে ফেলেছি। আমাকে তুমি ক্ষমা করো।
কিছু আফসোস আজীবন থেকেই যায়। হয়তো তানিশার আফসোস থাকলো না। কিন্তু সকলের আফসোস একটু হলেও থেকে গেলো। সর্বপ্রথম নীলের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা হারিয়ে গেলো। ভালো থাকুক সকল প্রেমিকের ভালোবাসা। হয়তো না পাওয়া ভালোবাসা। কিন্তু হারিয়ে না যাক সেই ভালোবাসার আফসোসটুকু। ভালো থাকুক নীলের হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা।
আর এখানেই শেষ হয়ে গেলো #যেদিন_আমি_থাকবো_না গল্পটা।
[ সমাপ্ত ]