যেদিন_আমি_থাকবো_না #লেখিকা_ইভা_আক্তার #পর্ব_৮

0
179

#যেদিন_আমি_থাকবো_না
#লেখিকা_ইভা_আক্তার
#পর্ব_৮

_________________
তানিশাকে অজ্ঞান হওয়া অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে নীল এবং তুহিন দুজনেই ছুটে এলো ওকে ওঠানোর জন্য । নীল কয়েকবার তানিশাকে ডাকলেও তানিশা চোখ খুলে না । তখন তুহিন তানিশাকে কোলে তুলে নেয়।

বাড়িতে নিয়ে আসার প্রায় এক ঘন্টা পর তানিশার জ্ঞান ফেরে। নীল আর তুহিন দুজনেই তখন তানিশার পাশে বসে ছিল । রোজা চৌধুরী আর রাফসান চৌধুরী একবার এসেছিল তানিশাকে দেখতে। তানিশার জ্ঞান ফিরতেই তুহিন বলে,
– তানিশা , এখন কেমন লাগছে ?

তানিশা পিটপিট করে চোখ মেলে ধীরোস্ত কণ্ঠে বলে,
– ভালো।

তানিযশার কথা শুনে নীল এবং তুহিন শান্ত হলো ঠিকই কিন্তু তুহিন এবং নীলের মনে রয়েছে পাহাড় পরিমাণ রাগ যেটা তিশার উপর ঝারলে শান্ত হয়ে যেতো। তুহিনের বোন দেখে নীল আজ তিশাকে কিছু বলতে পারলো না । নাহয় আজ তিশার গালে চরটা নীল নিজেই মারতো।
কিছুক্ষন পর তুহিন জোড় করে তানিশাকে খাবার খাইয়ে দেয় । নীলও তখন চলে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে একবার তানিশাকে ঠিকভাবে দেখে নেয় । কতো ভয়ঙ্কর মুহুর্ত ছিল । বিশেষ করে তানিশার কি হতো যদি নীল আর তুহিন সেখানে না যেতো ?

তুহিন খাবারের প্লেটটা রাখতে নিচে এসে দেখে রাফসান চৌধুরি এবং রোজা চৌধুরী দুজনে সোফায় বসে আছে । রাফসান চৌধুরী দাড়িয়ে বলেন,
– তানিশা এখন কেমন আছে ?
– সেটা তুমি গিয়ে দেখে আসলেই তো পারো বাবা । আমাকে কেনো জিজ্ঞেস করছো ?

রাফসান চৌধুরী কিছু বললেন না । তিনি মুখ আরো গম্ভীর করে বললেন,
– আজকে তিশাকে এত জোড়ে চড় মারা টা কি তোমার উচিত ছিল তুহিন ? তানিশার বন্ধুর সামনে তুমি ওকে অপমান করলে।
– প্লীজ বাবা । তিশাকে নিয়ে কোনো কথা শুনার ইচ্ছে আমার নেই । আর কিসের অপমানের কথা বলছো ? একদিকে তানিশাকে ও আটকে রেখেছিল আর এদিকে ওর নাটক দেখতে বলছো তুমি ? ওর মতো বোন আমার প্রয়োজন নেই। তিশার নাটক তোমরাই ভালো দেখতে পারো আমি না।

তুহিন চুপচাপ সিড়ি দিয়ে উঠতে গিয়েও থেমে বললো,
– ওকে বলবে ও যেনো আর আমার সামনে না আসে । নাহলে আজকের কথা ভেবে হয়তো বা আবারো ওর গালে চড় পড়বে ।

—————–
নীল তখন ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে ছিল । আফিফা সওদাগর এবং জিহাদ সওদাগর নীলের কাছে এসে বলে,
– তানিশা এখন ভালো আছে তো ? ইশ মেয়েটার সাথে কতো ভয়ঙ্কর ঘটনাই না ঘটতে চলে ছিল ( জিহাদ সওদাগর)
– চিন্তা করো না । ও এখন ঠিক আছে । আর তিশা যদি তানিশার কোনো ক্ষতি করেও ফেলত তাহলে কি ও আর বেঁচে থাকতো ?

কিছুক্ষন পর জাইমা এসে আফিফা সওদাগরের পাশে বসে পড়লো। জাইমা নীলের দিকে তাকিয়ে বললো,
– সব ঠিক আছে তো নীল ?
– হুম । ধন্যবাদ । তোমার জন্যই আজ তানিশা সুস্থ আছে । তোমার এই ঋণ শোধ করার মতো নয় ।

জাইমা মুচকি হাসলো । নীল কিছু একটা ভেবে বললো,
– তো, কালকে কি আমার সাথে রেস্টুরেন্টে যেতে চাও? বিকেল বেলা ?

উপস্থিত সকলে অবাক হলেও আফিফা সওদাগর অবাক হলেন না । কারণ আসল ঘটনা তিনি জানেন। আজকের কারণে নীল জাইমার প্রতি কৃতজ্ঞ । একারণেই বোধয় ভালো আচরণ করছে । জাইমা বেশ খুশি হয়ে বলল,
– হুম অবশ্যই ।

——————
সকাল তখন নয়টা। তুহিন ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছিল। এমন সময় তিশা এসে ওর পাশে বসে । তিশাকে দেখে তুহিনের গা জ্বলে উঠতে শুরু করলো ।
– তোকে না বলেছি আমার সামনে আসতে না ? কতটা নির্লজ্জ তুই ।

তিশা কেয়ারলেস ভাব ধরে টিভির দিকে মনোযোগ দিতে লাগলো তাও আবার পায়ের উপর পা তুলে । তুহিন এবার টিভি অফ করে দাড়িয়ে গিয়ে বলে,
– আমি এই বাড়িতে যতদিন আছি ততদিন তুই আমার সামনে আসতে পারবি না । এখন থেকে সব কাজ তুই তোর ঘরে গিয়ে করবি ।
– আমি কেনো তোমার কথা শুনতে যাবো ।

তুহিন এবার প্রচন্ড পরিমাণে রেগে উঠে । নিজেকে কন্ট্রোল করে বলে,
– কারণ তোকে দেখলে আমার ঘৃনা হয় । প্রচন্ড পরিমাণে ঘৃনা হয় ।
– এতে আমার কোনো যায় আসে না । আর তুমি আমার কেই বা হাও ? ভাই ? নো। আমি তোমাকে ভাই বলে মানি না । যে ভাই নিজের বোন ছাড়া একজন আশ্রিতা মেয়েকে বোন ভাবে তাকে আমি আমার ভাই বলে পরিচয় দিতে পারবো না ।
– তিশা,

তুহিনের চিৎকারে রোজা চৌধুরী ছুটে এলেন । বাড়িতে তখন রাফসান চৌধুরী ছিলেন না ।
– কি হয়েছে তুহিন ?
– তোমার মেয়ে এখানে কি করছে ? কাল রাতের কথা কি সব ভুলে গেছ ?

রোজা চৌধুরী তুহিনকে ভয়ানক ভাবে ভয় পান । এটা সেই তুহিন যে কিনা রাগের বসে নিজের হাতে ছুড়ি চালিয়ে দেয়। এই তুহিনকে সে কোনো দিনও সামলাতে পারবেন না। রোজা চৌধুরী তিশাকে বলে,
– তিশা মামনি ,রুমে যাও ।
– কেনো ।
– কারণ আমি বলছি ।

তিশা কিছু না বলে তুহিনের দিকে এগিয়ে বলে,
– এই বাড়িতে যতদিন তানিশা আছে ততদিন তুমি এই বাড়িতে নানান রকমের খেলা দেখতে পাবে । সেটা হবে ভয়ঙ্কর আবার মজার । তুমি যেমন আমাকে দেখতে পারো না , ঠিক তেমনি আমি ওই মেয়েকে দু চোখে সহ্য করতে পারি না । ওকে দেখলেই আমার রাগ উঠে । মাথা গরম হয়ে যায় ।
– ছিঃ তিশা । আমার ভাবতেই ঘৃনা লাগে তুই আমার বোন। কি এমন ভুল করেছিলাম যে তোর মত বোন আমাকে আল্লাহ দিয়েছেন ? আমি বোন চেয়েছিলাম । পেয়েও গিয়েছিলাম । কিন্তু পরবর্তীতে তুই নামক এক হিংসুটে জঘন্য মেয়ে আমার জীবনে চলে আসিস।

তিশা রাগে ফেটে যেতে লাগলো । কিন্তু সব রাগই যেনো তানিশার উপর। তুহিন উপরে তাকাতেই দেখলো তানিশা কাধে ব্যাগ আর বাইরে যাওয়ার ড্রেস পরে নিচে নামছে । তুহিন তানিশার কাছে গিয়ে বলল,
– কথায় যাচ্ছিস তুই ? তোর তো শরীর খারাপ । এখন তুই বেরোতে পারবি না ।
– আমি ঠিক আছি ভাইয়া । চিন্তা করো না ।

তানিশা এগিয়ে গেলো তিশার দিকে । তিশার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
– কেনো আমার উপর এত রাগ তোমার ? এই জীবনে আমি তোমার কিছুই কেড়ে নেই নি । উল্টো তুমি আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে । আমার বাবা,মা এমনকি এই পুরো পরিবারটাকে । কই আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করি নি। কোনো শত্রুতামিও তো করি নি। অথচ তুমি সবকিছু পেয়েও হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছো।
– আমার এই রাগ আর হিংসা তোমাকে শেষ করে না দেওয়া পর্যন্ত নিভবে না । তুমি আমার জীবনের অনেক বড় ঝামেলা ।
– এত সহজ না তিশা ? আমি চুপ থাকি মানে চুপ থাকবো এটা কখনো ভেবো না । একদিন না একদিন তোমাকে পঁচতাতে হবে । খুব খারাপ ভাবে পচঁতাবে তুমি । তুমি আফসোস করবে । কিন্তু কুল পাবে না ।

তানিশা কথাগুলো বলেই চলে যায় । এদিকে তুহিন তানিশার পিছু করতে করতে বাইরে চলে যায় ।
– তানিশা ।
– হুম ভাইয়া।
– চুপচাপ ঘরে চল । পড়ে শরীর খারাপ হয়ে গেলে কে দেখবে হুম?
– কেনো এতো চিন্তা করো তুমি ? যদি আজ তুমি না থাকতে তাহলে আমাকে কে দেখে রাখতো ? সেই তো আমাকে পড়ে থাকতে হতো তাই না ?
– কে বলেছে তোকে ? এত সহজে তুই হার মেনে জাবি কি ? তুই তো আমার সাহসী বোন । তোকে শক্ত থাকতে হবে । আল্লাহ তোর পাশে আছে । কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা তো তিনি করে দেবেন ।

তুহিনের কথায় তানিশা মুচকি হেসে বেরিয়ে পড়লো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।

তানিশাকে ভার্সিটি আসতে দেখে আইরিন,অভি এবং নীল অবাক হয়ে যায় । সাথে প্রচন্ড রেগেও যায় । এতক্ষন নীল সবকিছু খুলে বলছিল ওদেরকে । তানিশা ওদের পাশে বসে নীলকে বলে,
– যা তো একটা আইসক্রিম নিয়ে আয় । প্রচুর গরম পড়েছে ।
– শুধু কি আইসক্রিম খাবি নাকি দুটো চরও খাওয়ার ইচ্ছে আছে? (আইরিন)
– মানে?
– মানে তুই এখানে কি করছিস? যা বাসায় যা।

তানিশা বুঝতে পারলো যে নীল ওদের সব বলে দিয়েছে।
তানিশা চেয়ারে বসে বলে,
– হয়েছে বাদ দে। আমি ঠিক আছি । তোদের জন্য কি এখন শান্তি মতো বাইরে ঘুরতেও পারবো না নাকি ?

আইরিন কিছু বলতে নিলে নীল ওকে ইশারায় বাধা দেয় । কখন জানি তানিশা রেগে উঠে ।

ক্লাস শেষে তানিশা নীলকে হটাৎ করে বলে উঠে,
– নীল আজকে সন্ধায় বাইরে যাবি ?

তানিশার কথায় নীল খুব খুশি হয়ে যায় । কতদিন পর আবারো ওরা বাইরে যাবে । নীল তানিশার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় । সন্ধ্যা সাতটায় ওরা পার্কে দেখা করবে । এদিকে নীল ভেবে নেয় জাইমা কে সন্ধার আগে বাড়িতে নামিয়ে দিতে হবে।
যেই ভাবা সেই কাজ । নীল বিকেল বেলা জাইমাকে নিয়ে বের হয় রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে। রেস্টুরেন্টে নীল জাইমার সাথে খুব একটা কথা বলে না । কিই বা বলবে ! ওর সব কথায় তো জমা থাকে তানিশার জন্য। এদিকে নীলকে ব্যস্ত দেখে জাইমা বলে উঠে,
– তুমি এত তাড়াহুড়ো করছো কেনো ? আমি তো ভেবে রেখেছি আজ রাত পর্যন্ত আমরা ঘুরবো ।
– সরি জাইমা । তানিশার মন খারাপ তাই ওকে নিয়ে আজ সন্ধায় একটু বের হবো ।

তানিশার নাম শুনতেই জাইমার মাথায় আগুন লেগে যায় । জাইমা এবার মনে মনে প্রচন্ড ক্ষেপে উঠে । নীল জাইমাকে উঠতে বলে জাইমা চুপচাপ উঠে যায় । রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার আগেই জাইমা পা মোচকানোর নাটক করে । জাইমা সেখানেই বসে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে । এদিকে নীল সেটা দেখে জাইমা কে উঠিয়ে আবারো চেয়ারে নিয়ে গিয়ে বসায় ।
– ঠিক আছো তুমি ? কি হয়েছে ।
– বুঝতে পারছি না । বের হতে গিয়ে পা মোচকে গেছে । ঠিক মতো দাড়াতেই তো পারছি না নীল ।
– কি বলছো কি ? তাহলে বাড়িতে যাবো কি করে ?
– জানি না ।

নীল এখন বাধ্য হয়ে জাইমাকে কোলে তুলে নেয়। এতে জাইমা তো মহা খুশি হয়ে যায় । নীল জাইমাকে নিয়ে হসপিটালে যায় । কিছুক্ষন পরই মাগরিবের আজান দিলো। অর্থাৎ সাতটা বাজতে কিছুক্ষন বাকি । নীল এবার তাড়াহুড়ো করতে লাগলো । ডক্টর কে দ্রুত কাজ করতে বললো। কিন্তু ডক্টর পা মোচকানো মতো কিছু খুজে না পেয়ে বললো,
– আমরা ওনার পায়ে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি। হয়তো বা এতে ভালো হয়ে যেতে পারে।

ডক্টরের কাজ শেষ হতে হতে প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে যায় ।
অন্যদিকে তানিশা বেশ কিছুক্ষন ধরে পার্কে দাড়িয়ে আছে। তবুও নীলের আসার কোনো নামগন্ধ নেই । রাত আটটা বাজার পরও যখন নীল না আসে তখন তানিশা কল দেয় নীলকে । কিন্তু নীল তখন ডক্টরের সাথে বাইরে ছিল । নীলের মোবাইল ছিল টেবিলের উপর । জাইমা তানিশার কল দেখে তানিশার ফোন কেটে ওকে ব্লক করে দেয় । এতে তানিশা প্রচন্ড অবাক হয়ে যায় । তানিশা বুঝতে পারলো না হটাৎ নীলের ফোনে কি হলো । তানিশা এবার কল করে নীলের বোন নিতুকে। নিতু কলটা রিসিভ করে বলে,
– কেমন আছো মিষ্টি আপু ?
– ভালো আছি পাখি । তুমি কেমন আছো?
– আমিও ভালো ।
– তোমার ভাই কোথায় ?
– ভাইয়া তো জাইমা আপুকে নিয়ে ঘুরতে গেছে ।

নিতুর কথা শুনে তানিশা থমকে যায় । তাহলে কি নীল আজ আসবে না ? নীলকে ওকে ভুলে যাচ্ছে ?
– আচ্ছা ঠিক আছে ।

তানিশা আর কিছু না বলে কেটে দেয়। তানিশার মনে প্রচন্ড কষ্ট হতে লাগলো । যদি জাইমার জন্য আসলেই নীল ওকে ভুলে যায় তাহলে ? এ জীবনে তানিশার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা নীল । নীলকে ছাড়া ও কি করে সুস্থ থাকবে ?
তানিশা ঠায় সেখানেই দাড়িয়ে থাকলো । কোলাহলযুক্ত পার্কে ধীরে ধীরে মানুষও কমতে লাগলো । হটাৎ করে শুরু হয়ে গেলো বর্ষণ । আশেপাশের সকলে বৃষ্টি থেকে বাচাঁরর জন্য ছোটাছুটি করতে থাকে । অথচ তানিশার হাভভাবের কোনো পরিবর্তন নেই । ও ঠায় সেখানেই দাড়িয়ে আছে ।
অপরদিকে জাইমার পা ঠিক হচ্ছে না কেনো এটা ভেবে নীল রেগে উঠে। নীল বাড়িতে যাওয়ার কথা বললে জাইমা বলে ওর নাকি পা নাড়াতেই ব্যাথা করছে । এটা বলেই কেঁদে উঠে । নীল প্রচন্ড পরিমাণে বিরক্ত হয়ে যায় । এদিকে জাইমাকে রেখেও তো যাওয়া যায় না । আমার সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে জাইমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়া । বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে এটা নীলও বুঝতে পেরেছে । হয়তো তানিশা বাড়ি ফিরে গেছে । কাল যে করেই হোক তানিশাকে সরি বলতে হবে ।

রাত তখন দশটার কাছাকাছি । কিছুক্ষন পর পরই বৃষ্টি শুরু হচ্ছে আবার থেমে যাচ্ছে । জাইমা বুঝতে পারলো তানিশা বোধয় এখন আর নেই । জাইমা নীলকে বললো ওর পা আগে থেকে ভালো আছে । তাই ও হাঁটতে পারবে । জাইমা নীলের কাধে হাত রেখে গাড়িতে গিয়ে উঠলো । নীল বিরক্তির মুখ নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
নীল যখন পার্কের সামনে দিয়ে গাড়ি টানছিল তখন দেখতে পেলো পার্কের ভেতর তানিশার মতো দেখতে একটা মেয়ে বসে আছে । বৃষ্টি তে ভিজে যা তা অবস্থা হয়ে গেছে। তবুও মেয়েটা নড়ছে না । নীল এবার ভয় পেয়ে গেলো । গাড়ি থামিয়ে দৌঁড়ে গেলো সেদিকটায় । এটা দেখে জাইমাও অবাক হয়ে যায় । এতো রাতে তানিশা এখনও এখানে ?
নীল সামনে গিয়ে দেখতে পায় হ্যা এটা তানিশা । তানিশা নীলকে দেখে দাড়িয়ে যায় ।
– তানিশা তুই এখনও এখানে?

তানিশা হাসতে শুরু করে । মলিন হাসি । তানিশার হাসিতে আশেপাশে সব কেঁপে উঠছিল । নীল বুঝতে পাড়লো এই হাসি কোনো আনন্দের না। নীল তানিশার কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে । তানিশা হাত ছাড়িয়ে বলে,
– হায়রে নীল, একবারও বলতে পারলি না আজ আমি তোর সাথে নয় আমার হবু বৌয়ের সাথে ঘুরবো ?
– তানিশা আমাকে মাফ করে দে প্লিজ।। আমি বুঝতে পারি নি তুই এতক্ষন ধরে দাড়িয়ে থাকবি।
– আমার জন্য তুই কেনো আফসোস করছিস ? কামন নীল । আমি তোর জাস্ট বেস্ট ফ্রেন্ড । এছাড়া কি আমি তোর কেউ হই নাকি ? তোর আপন তো জাইমা । কয়দিন পর তোরা সারাজীবনে জন্য এক হয়ে যাবি । তখন বোধয় আমাকে আর তোর মনে থাকবে না।
– তানিশা প্লিজ চুপ কর । কিসব ফালতু কথা বলছিস ?
– কোনো কিছুই ফালতু না । তুই আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছিস না নীল । আমি কেমন আছি তুই কি সেটা জানিস ?

তানিশা আবারো হাসতে শুরু করে,
– তুই বুঝবি না নীল । কখনোই বুঝবি না । আমার এই জীবন জনমানবহীন । এই জীবনে কোলাহল নিষিদ্ধ । একারণেই বোধয় আফসোস ছাড়া আর কিছুই নেই ।

তানিশা এবার চুপচাপ নীলের কাছ থেকে চলে যেতে লাগলো । কিন্তু নীল ওকে আটকালো না । নীলের হাত পা কাঁপছে। ও কখনো কল্পনাও করে নি তানিশা এতক্ষন ওর জন্য অপেক্ষা করবে । ধীরে ধীরে তানিশা সেখান থেকে চলে যায় ।
দূর থেকে জাইমা নীলকে একা দাড়িয়ে থাকতে দেখে দৌঁড়ে নীলের কাছে আসে ।
– নীল চলো এখান থেকে । এতো রাতে এখানে থাকা ঠিক হবে না ।

নীল জাইমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর হাত ঝাড়া দেয় ।
– আমার সামনে থেকে এই মুহূর্তে চলে যাও বলছি । নাহলে আজ এই মুহূর্তে তোমার গায়ে হাত উঠাবো আমি ।

জাইমা অবাক হয়ে যায় । নীলের চোখ সম্পূর্ণ রক্তবর্ণ হয়ে আছে । জাইমা ভয়ে ভয়ে সেখান থেকে অন্য একটা গাড়িতে উঠে চলে যায়।
প্রায় সকাল ছয়টা পর্যন্ত নীল সেখানেই চুপচাপ বসে থাকে । মাঝখান দিয়ে হয়তোবা বেঞ্চেই ঘুমিয়ে পড়েছিল । সকালে উঠে নীল দেখতে পায় আশেপাশের মানুষকে ।
আজ দেখলো নিজ চোখে ভয়নাক দৃশ্য । ওর জন্য তানিশা কতই না কষ্ট পেয়েছে । নীলের মাথায় হটাৎ কাল রাতের একটা ঘটনা মনে আসে। কাল রাতে জাইমা গাড়ি থেকে দৌঁড়ে নেমে আসে। কিন্তু কি করে ? ওর না পা মোচকে গিয়েছিল । অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে পা ঠিক হয়ে গেলো কিভাবে? নীলের আর বুঝতে বাকি রইলো না এসব ওর নাটক ।
নীল ধীরে ধীরে সেখান থেকে উঠে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো নিজ বাড়িতে । আজ ও সবকিছু শেষ করবে । হয়তো জাইমাকে নাহলে ওর পুরো পরিবারকে ।
নীল গাড়ি থেকে নেমেই হনহন করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে । নীলকে এভাবে দেখে জিহাদ সওদাগর বললেন,
– একি নীল ? এই অবস্থা কেনো তোমার? জামা কাপড় ভেজা কেনো ? আর সারারাত কই ছিলে তুমি ?

নীল ওর বাবার কথার উত্তর না দিয়ে বলে,
– জাইমা কোথায় ? জাইমা ।

নীলের চিৎকারে রুম থেকে জাইমা নিচে নেমে আসে । জাইমা সিড়ি থেকে নামতেই নীল ওর কাছে গিয়ে সজোরে গালে একটা চর মেরে বসে । নীলের এমন কান্ডে আফিফা সওদাগর মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। নিতু নীলের কাজে ভাইয়া বলে চিৎকার করলো। জাইমা গালে হাত দিয়ে কাঁদতে শুরু করে।
– বেরিয়ে যা আমার বাড়িতে থেকে। এই মুহুর্তে এক্ষনি। তোর মতো মেয়ের মুখে আমি থু মা/রি। আজ শুধুমাত্র তোর নাটকের জন্য তানিশা কষ্ট পয়েছে। সত্যি করে বলতো? আসলেই কি তোর পাঁ মোচকে গিয়েছিল, নাকি সবই তোর নাটক ছিল?

নীলের কথায় জাইমা কোনো উত্তর দিতে পারলো না। নীল এবার রাগে যখন আরো একবার থাপ্পর মারতে যাবে তখনই নিতু বলে ওঠে,
– ভাইয়া প্লিজ। জাইমা আপুর গায়ে আর একটা হাতও তুলবে না। যদি তুলো তাহলে আমি চিৎকার করবো।

নীলের রাগ আরও দ্বিগুণ বেরে গেলো। এই মেয়ের জন্য নিতুর আবার কিসের এতো মায়া? নীল কিছু বললো না। নিতু এবার নীলের কাছে এসে বললো,
– তুমি এতো তানিশা আপুর পিছে পড়ে থাকো কেনো বলো তো? তানিশা আপু শুধু তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু জাইমা আপু তো তোমার হবু বউ।

নীলের এবার নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে না পেরে নিতুর গালেও চর বসিয়ে দেয়। যে ভাই এই জীবনে কোনোদিনও নিজের বোনকে ধমকও দেয় নি সেই বোনকে আজ নীল চর মেরেছে। নিতু অপলক দৃষ্টিতে নীলের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই ভাই যেনো ওর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত।
নিতুকে চর মারায় এবার আর জিহাদ সওদাগর চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি নীলের কাছে গিয়ে এবার গর্জে উঠলেন,
– সাবধান নীল। ভুলে যেও না তুমি তোমার বাবার সামনে জাইমা এবং নিতুর গায়ে হাত তুলছো। আমি বাধ্য হবো তোমার গায়ে হাত তুলতে।
– প্লিজ ড্যাড আমাকে উষ্কাবে না। নাহলে আমি এমন কিছু একটা করে বসবো যার ফলে তুমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারবে না৷
– বেয়া/দপ ছেলে নিজের বাবাকে ভয় দেখাচ্ছো? এভাবে মানুষ করেছিলাম আমি তোমাকে? বেরিয়ে যাও বাড়ি থেকে।
– আমি না। গেলে জাইমা যাবে। এই মুহুর্তে জাইমা এই
বাড়ি থেকে বিদায় নিবে।
– চুপ থাকো নীল। এই বাড়ি আমার না তোমার? তুমি আমাকে উপদেশ দিচ্ছো? বিয়ে করলে তোমাকে জাইমাকেই করতে হবে।
– চুপ তাকো ড্যাড। আর একটা কথা বলবে না।
– আবারো তুমি বেয়াদবি করছো কিন্তু নীল। তুমি কোন সাহসে জাইমার গায়ে হাত তুলেছো?
– ড্যাড লাস্ট ওয়ার্নিং আর একটা কথা বললে খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি।

নীল এবার যখনই জাইমাকে কিছু বলতে যাবে তখনই জিহাদ সওদাগর বলে উঠলেন,
– কিসের এতো তানিশা হ্যা? ওই মেয়ের জন্য তুমি জাইমার গায়ে হাত তুললে কোন সাহসে। ওই বাইরের মেয়ের জন্য আজ তুমি এরকম রুড বিহেভ করছো? ওই মেয়ে তো রাফসান চৌধুরির বাড়ির আশ্রীতা, এডোপ্ট মেয়ে ও। না আছে ওর আসল পরিচয় না ওর বাবা-মার আসল পরিচয়।

তানিশার ব্যপারে এত্তগুলো আজেবাজে কথা শুনে নীল নিজের আনমনেই পেছনে ঘুরে জিহাদ সওদাগরের মুখের সামনে ঘুষি দিতে নিলো। ঠিক তখনই মনে পড়লো এটা ওর বাবা। নীল তার হাত তখনই আটকে নেয়। নীলের এরকম দুঃসাহস দেখে বাড়ির সকলের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। নীল হাত সরিয়ে বললো,
– আগেই বলেছিলাম আমাকে উষ্কাবে না।

নীল কথাটা বলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। নীল চলে যেতেই জিহাদ সওদাগর নিজের বুকে হাত দিয়ে বলে,
– এরকম কুলাঙ্গার ছেলেকে কি করে জন্ম দিলাম আমি.

চলবে,,,,🌹

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here