#যেদিন_আমি_থাকবো_না
#লেখিকা_ইভা_আক্তার
#পর্ব_৯
———————–
– তোমাকে তাহলে ওরা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে ? (তিশা)
– না তো কি? ( জাইমা)
জাইমা বিরক্তির মুখ নিয়ে কথাটি তিশাকে বলে।
সকালের দিকে হটাৎ করেই তিশা ভার্সিটিতে জাইমাকে কল করে দেখা করার জন্য বলে। আর একারণেই ওরা দুজনে মিলে ভার্সিটির ক্যান্টিনে দেখা করতে এসেছে।
– তাহলে এখন কোথায় থাকছো তুমি?
– কোথায় আবার? হোটেলে। এই দেশে আমার কি কেউ আছে নাকি।
– এখানে থেকে কি করবে? চলে যাও। নীলের থেকে আরও ভালো ভালো ছেলে পাবে।
– ইম্পসিবল। আমার নীলকেই চাই মানে চাই।
তিশা একটা বড়সড় শ্বাস ছেড়ে জাইমার কানে কানে ফিসফিস করে বলে,
– তুমি কি আসলেই নীলকে মন থেকে ভালো বাসো?
জাইমা অবাক দৃষ্টিতে তিশার দিকে তাকালো।
– মানে?
– মানে তুমি কি আসলেই লয়াল? কিছুক্ষণ আগেই তো একটা ছেলে তোমাকে কল দিয়ে জান,বাবু ডাকছিলো।
জাইমা এবার ইতস্ততবোধ করতে লাগলো।
– তাহলে তুমি সব শুনে নিয়েছ?
তিশা মাথা নাড়ালো। জাইমা ভাবতে লাগলো ওর থেকে এতো জুনিয়র একটা মেয়ে এতো বেশি চালাক কি করতে হতে পারে?
– তুমি ধরা পড়লে কি করে?
জাইমার প্রশ্নে তিশা বিরক্তির ভাব ধরে বললো,
– কে জানে কি করে? আমাকে তো কেউ দেখেও নি তানিশাকে রুমে আটকে রাখতে। কে বলতে পারে তাহলে?
তিশা ভাবনায় পড়ে গেলেও জাইমা মনে মনে বলতে থাকে,
– তোমাকে ধরা না খাওয়ালে তো আমি ফেঁসে যেতাম। কই ভাবলাম নীল আমার উপর ইন্টারেস্ট হবে। অথচ আজ সওদাগর বাড়ি থেকে আমাকে বের হতে হয়েছে।
– আচ্ছা বাদ দাও। তাহলে তুমি যাচ্ছো কবে?
তিশার প্রশ্নে জাইমা এবার সিরিয়াস হয়ে উত্তর দেয়,
– আগে তানিশা বিদায় হবে তার আমিও এই দেশ ছেড়ে বিদায় হবো। তানিশার শেষ না দেখা পর্যন্ত আমি এতো সহজে এখান থেকে নড়বো না।
– আমার কাছে একটা প্ল্যান আছে।
– কি প্ল্যান?
তিশা বাঁকা হাসলো। আর ওর হাসির দিকেই অদ্ভুদভাবে তাকিয়ে আছে জাইমা।
————————
দুপুরের রোদ ছুই ছুই। চারিদিক তপ্ত গরমে মেখে আছে। ডাক্তার ইয়াসমিনের সামনে হাতে রিপোর্ট নিয়ে বসে আছে তানিশা। ওর চোখ যেনো হাতে থাকা রিপোর্ট থেকে সরছেই না। নিজের অসুস্থতার কথা যেনে তানিশা যেনো নিজেই নির্বাক।
– মিস তানিশা। আমি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আমি ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত একজন রোগী। মূলত টিউমারটা আপনার বেশ বড় আকারে ধারণ করেছে। খুব সম্ভত আপনাকে বাঁচানো যেকোনো ডাক্তারের জন্যই কস্টসাধ্য। এতে বিপদও হতে পারে।
তানিশা এক দৃষ্টিতে ডাক্তারের কথা শুনছে। এ যেনো সম্পূর্ণ কল্পনার জগৎ। প্রায় কয়েকমাস ধরেই তানিশা প্রচন্ড মাথা ব্যথায় ভুগছিল। সকালে ভার্সিটি যাওয়ার সময় তানিশার ব্যথা তীব্র বেড়ে যাওয়ায় ও ঠিক করে ডাক্তারের কাছে গিয়ে তারপর ভার্সিটির দিকে যাবে। কিন্তু হাতে থাকা রিপোর্ট থেকে তানিশা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।
– তাহলে আমি এখন করবো?
– কিছু না। শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করুন যেনো আপনাকে সুস্থসবলভাবে বাঁচিয়ে রাখে। কেননা আপনার এই টিউমার ডিপ্রেশনের কারণে বেড়ে গেছে। যত ডিপ্রেশনে থেকে মুক্ত থাকবেন ততই ব্যথা থেকে বেঁচে যাবেন। আমি আপনাকে কিছু মেডিসিন দিচ্ছি ওগুলো নিবেন। ইনশাআল্লাহ এটা আপনাকে ব্যথা থেকে বাঁচিয়ে রাখবে।
তানিশা মাথা নাড়িয়ে সেখান থেকে উঠে যায়। তানিশা নিজেকে শান্ত করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ভার্সিিটর ক্লাস শেষ। নীলও প্রায় অনেল বার কল করেছে। তানিশা গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলো আর হাতে থাকা ফোনটা রেখে নীলকে কল দিলো।
অপরদিকে তানিশার পেছনে থাকা ট্রাক ড্রাইভার কলে কাউকে বলছিলো,
– জি তানিশা মেডাম এই মাত্র বেরিয়েছে। আমি ওনাকে ফলোও করছি। চিন্তা করবেন না সব কিছু ঠিকঠাক মতোই হবে।
তানিশা গাড়ি চালাতে শুরু করলে ট্রাক ড্রাইভারও গাড়ি চালাতে শুরু করে। এদিকে তানিশা নীলকে কল করার সময় নীল তখন আইরিন এবং অভির সাথে ছিলো। আজ সকালেই নীল তার কল থেকে তানিশাকে আনব্লক করে। নীল ভেবে পায় না একটা মেয়ে কতটা জঘন্য হতে পারে। নীল তানিশার কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে তানিশা বলে,
– তোরা কি ভার্সিটিতে?
– হুম। তুই কোথায়? আজ তোকে কল দিতে দিডে আমার ফোনের চার্জই শেষ হয়ে গেছে।
– একটা আন্টির বাসায় গিয়েছিলাম। একটু কাজ ছিলো।
– তোর আবার কোন আন্টি?
– চিনবি না। ইনশাআল্লাহ একদিন তোকে ওখানেই যেতে হবে।
– কিহ?
– কিছু না। আমি আসছি অপেক্ষা কর।
– ওকে।
তানিশা কলটা রাখতেই গাড়ির সামনের গ্লাসে তাকিয়ে দেখে তানিশার পেছনে একটা ট্রাক খুব দ্রুত গতিতে আসছে। তানিশা বুঝতে পারলো কেউ একজন ইচ্ছে করেই তানিশার গাড়ি এক্সিডেন্ট করাতে চাইছে। ট্রাকটা যখনি পুরো তানিশার বাম পাশ থেকে এসে ধাক্কা দিতে যাবে ঠিক তখনই তানিশা তার গাড়ি পেছনে নিয়ে ঘুরিয়ে ফেলে। ফলে ট্রাকটা ডান পাশের গাছের সাথে বারি খেয়ে বাকে হয়ে যায়। আর এদিকে তানিশা হটাৎ করে গাড়ি ঘুরানোয় তানিশার গাড়িও বাকা হয়ে উল্টে যায়।
আশেপাশে প্রচন্ড ভির জমেছে। সকলেই বোঝার চেষ্টা করছে ড্রাইভাররা কোথায়। এমন সময় ট্রাক ড্রাইভার হেলতে দুলতে ট্রাক থেকে নেমে আসে। তার শরীরের অনেক জায়গায়ই ছুলে এবং কেটে গেছে। সকলে যখন তানিশার গাড়ির সমানে আসে তখন তানিশা খিব কষ্টে গাড়ি থেকে বের হয়। তানিশার হাটু প্রায় অনেকটা ছিলে গেছে। মাথার দিকেও খানিকটা ফেটে গেছে। তানিশা গাড়ির পেছনে থাকা একটা বড় লাঠি নিয়ে নিজের চেষ্টামতো ট্রাক ড্রাইভারের কাছে গিয়ে তার কলার ধরে লাঠি দেয়ে সজোরে বারি দেয়। এতে ট্রাক ড্রাইভার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তানিশা লোকটাকে আরো কয়েকটা লাথি এবং বারি মারে। শেষে লেকটার অবস্থা যখন খারাপ হয়ে যায় তখন তানিশা লোকটাকে উঠিয়ে বলে,
– কেনে আমাকে এক্সিডেন্ট করাতে চেয়েছিলও বল? কে পাঠিয়েছে তোকে?
ড্রাইভার লেকটা তখনও বলতে চাই নি। কিন্তু পরবর্তীতে তানিশা যখন লাঠি উঠাতে যায় তখন লোকটি বলে উঠে,
– তিশা মেডাম। উনি আর ওনার এক বান্ধবী আমাকে বলে যদি আমি আপনার এক্সিডেন্ট করাই তাহলে ওনারা আমাকে টাকা দিবেন। ওনারা আমাকে বলেছিলেন যে আপনাকে বাড়ি থেকে শুরু করে ফ্রী টাইম প্রযন্ত পিছু নিতে।
তানিশার লোকটার কলার ছেড়ে দিলো। তানিশা ভাবতে লাগলো কি এমন দোষ করেছিলো যে এই পরিবারেই আল্লাহ তাকে পাঠিয়েছে। তানিশা তাচ্ছিল্য সহকারে হাসি দিয়ে একটা গাড়িতে উঠে পড়লো। কেননা তানিশার গাড়ির অবস্থা আগের তুলনায় খুব খারাপ হয়ে গেছে। রাস্তায় উপস্থিত অনেকেই তানিশার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো কিন্তু ও দ্রুত সেখান থেকে চলে আসে।
ক্যাম্পাস থেকে তখন অনেকেই বের হচ্ছিল। তবুও এখনও ভা্রিসিটি ক্যাম্পাসে লোকের অভাব নেই। নীল সেই কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে চলছে তানওশার। অথচ এই মেয়ের কোনো খবরই নেই। কলও ধরছে না। শেষে নীল, আইরিন এবং অভি বিরক্ত হয়ে উঠে যেতে নিলে ওদের চোখ পড়ে তানিশার দিকে। শুধু ওরা না বরং আশেপাশের সকলে অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে তানিশার দিকে। তানিশা একটা গাড়ি থেকে নেমে হনহন করে কলেজে ঢুকে। বা হাতে যেনো রক্তের বন্যা বইছে। সারা শরীরে ধুলে লেগে আছে। এমন কি কপালের কাছ থেকেও রক্ত পড়ছে। তবে সেদিকে যেনো তানিশার কোনো খেয়ালই নেই। তানিশার হাতে ছিলো বেশ বড় এবং মোটা একটা লাঠি। তানিশা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো দূরে বসে আছে জাইমা এবং তিশা। আর নয়। অনেক সহ্য করেছি আমি। আজ কাউকেই ছাড়বো না আমি। তানিশা দ্রুত হেটে গেলো জাইমাদের দিকে। তানিশাকে এরকম অবস্থায় দেখে জাইমা এবং তিশা দুজনেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তানিশা তার হাতে থাকা লাঠিটা দিয়ে সজোড়ে একটা বারি দেয় টেবিলের মাঝ বরাবর। সেই শব্দে জাইমা এবং তিশা দুজনেই কেঁপে উঠে। তানিশা তিশার দিকে তাকিয়ে বলে,
– কি ভেবেছিলে? আমি এতো সহজে মরে যাবো?কখনোই না। তোমাদের মতো নরপশুদের শেষ না করা পর্যন্ত আমি মরবো না।
তনািশা কথাটা বলেই তিশার গালে সজোড়ে চর মারে। সাথে সাথে তিশার মাটিতে পড়ে যায়। তানিশা এবার জাইমার চুলের মুঠি ধরে বলে,
– কি ক্ষতি করেছি আমি তোর? কেনো আমার পিছে পড়ে আছিস? আর আজ আমাকে মারতেও চেয়েছিস?
জাইমার তানিশার হাত থেকে চাড়া পাওয়ার জন্য চোটাছুটি করলে তানিশা ওর মাথা ধরে প্রায় দু তিন বার টেবিলে আঘাত করে। তারপর জাইমার চুল ধরে তিশার কাছ ফালায়। তানিশা নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে তিশা ও জাইমাকে মারতে থাকে। এতোদিনের সব অপমানের বদলা যেনো আজ নিচ্ছে। এদিকে নীল চেয়ার নিয়ে বসে থেকে বলে,
– জাস্ট ওয়াও তানিশা। তোকে পাড়তে হবে। জীবনে কখনো হার মানবি না। প্রত্যেকটা মানুষের বদলা নিবি। এক একেক জনকে উচিত শিক্ষা দিবি।
পুরো ভার্সিটি ক্যাম্পাস জুড়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলো। আশেপাশে টিচাররা জোড় করে তানিশাকে ওদের থেকে ছাড়ালো। তিশা এবং জাইমা মাটিতে লুটিয়ে পরেছে। সারা শরীর থেকে রক্তও পড়ছে। তানিশাকে যখন আটকানো যাচ্ছিল না তখন নীল এবং আইরিন এসে তানিশাকে নিয়ে যায়। নীল তানিশাকে নিয়ে খানিকটা দূরের একটা চেয়ারে বসিয়ে পানি খাওয়ায়। আইরিন দ্রুত মেডিকেল রুম থেকে মলম এবং ব্যান্ডেজ নিয়ে তানিশাকে লাগাতে শুরু করে। তানিশা একে একে সকল ঘটনা খুলে বলে শুধু ওর ডাক্তার দেখানো বাদে। আইরিন একা একাই ওদের গালি দিতে থাকে। আর এদিকে সকলে মুখ গম্ভীর করে বসে থাকে। কতো বড় দূর্ঘটানাই না ওরা ঘটাতে চেয়েছিল। তানিশার ব্যন্ডেজ করা শেষ হলে তানিশা উঠে যায়।
– আল্লাহ হাফেজ। বাসায় যাচ্ছি।
– মানে? তুই কি পাগল হয়ে গেছিস নাকি? একটু রেস্ট নে তারপর যা (অভি)
– আমি ঠিক আছি।
তানিশা কথাটা বলেই হাঁটা শুরু করে। নীল কি বলবে খুঁজে পায় না। তানিশাকে কি করে শান্ত করবে সে?
এদিকে ভার্সিটির অনেক টিচাররাই তানিশাকে কল করে যাচ্ছে। কেননা তানিশা কখনোই তার ফেমিলির নম্বর কাউকে দেয় নি। তানিশা মোবাইল অফ করে বাসার দিকে রওনা দেয়।
——————
তানিশা তখন ঘুমিয়েছিল। তখনই রাফসান চৌধুরি চেচিয়ে উঠলেন।
– তানিশা। কোথায় এই মেয়ে হ্যা?
তানিশা ঢোলতে ঢোলতে নিচে নেমে দেখে তিশার হাত পায়ে ব্যন্ডেজ করা। অনবরত কেঁদেই চলছে। পাশে তুহিন মুখে হাত দিয়ে বসা। রোজা চৌধূরী তিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
– এদিকে এসো।
রাফসান চোধূরীর ডাকে তানিশা নিচে গেলো।
– কি করেছো তুমি? তোমার সাহস কি করে হলো তিশাকে মারার?তাও এতো জঘন্যভাবে? তুমি কি মানুষ? (রাফসান চোধূরী)
তানিশা কিছু বললো না। চুপ করে রাফসান চৌধুরির দিকে তাকিয়ে রইলো। রোজা চৌধুরী এবার হনহন করে এসে তানিশার গালে চর বসিয়ে দেয়।
– তুই বেহায়া মেয়ে একটা। তোর জন্য আর একটু হলেই আমার মেয়েটা মরে যেতো। তুই কি চাস ও মরে যাক?
– তুমি কি চাও আমি মরে যাই?
রোজা চৌধুরী চুপ করে রইলেন। রাফসান চৌধুরি বললেন,
– একদম চুপ। আর একটা কথা বললে ঘাড় দাক্কা দরে বের করে দেব। আগে বলো কেনো ওকে মেরেছো? কি করেছে তিশা?
তানিশা এখনো চুপ রইলো। রাফসান চৌধুরি রেগে গিয়ে তানিশাকে মারতে আসলে তানিশা বললো,
– একদম পা এগোবে না বলে দিচ্ছি। কি অধিকারে আমাকে মারতে আসছো তোমরা? কোন সাহসে?
– ভুলে যেও না আমি তোমার বাবা।
– বাবা না ছাই তুমি। কোথায় থাকে এই বাবা শব্দটা তোমার? সেটা আমার বেলায় কতটুকু প্রাধান্য পায়?তোমাদের কাছে তো আমি একজন আশ্রীতা। কি ভাবো আমাকে? তোমরা যা অপবাদ দেবে যা বলবে তাই আমি মেনে নেবো? এতোটা বোকা ভাবো আমায়?এই দুনিয়াতে তোমরা শুধু আমাকে মেয়ে হিসেবে নিয়ে এসেছো। কিম্তু যত্ন নিতে পারো নি। তোমরা কখনোই উপযুক্ত বাবা মা হতে পারো নি।
তানিশার চিৎকারে পুরো বাড়ি চুপ হয়ে গেলো। রাফসান চৌধুরি এক দৃষ্টিতে তানিশার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তুহিনও হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তানিশার দিকে।
তানিশা একেক করে সকল ঘটনা খুলে বললো। সব শুনে তুহিন নিজেকে আটকে রাখতে না পেরে হনহন করে গিয়ে সজোড়ে একটা চর দেয় তিশার গালে।চর খেয়ে তিশা হুহু করে কাঁদতে থাকে।
– তোমাদের মতো তোমাদের মেয়েও জঘন্যতম এবং নিকৃষ্ট মানুষ। তোমরা কেউ শান্তিমতো থাকতে দেও নি তানিশাকে। ওকে তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছো। তোমাদের মতো বাবা মা যেনো আর কাউকে আল্লাহ না দেয়। এ জীবনে আমি আমার বোনকে কিছুই দিতে পারলাম না।
তুহিন অসহায় দৃষ্টিতে তানিশার দিকে তাকালো। তুহিনের তানিশার দুই হাত ধরে বললো,
– আমাকে মাফ করে দে বোন আমার।আমি তোকে বাঁচাতে পারি নি। তোকে সুখ দিতে পারি নি। এই জঘন্যতম মানুষদের থেকে তোকে বাঁচাতে পারি নি। আমাকে মাফ করে দে বোন আমার।
তুহিনের কান্না দেখে তানিশাও এবার কেঁদে দেয়। তানিশা জানে তার ভাইয়ের এখানে কোনো দোষ নেই। ভাইয়া চেয়েছিলো আমার এইচএসসি শেষ হতেই আমাকে বিদেশ নিয়ে যাবে। কিন্তু আমি যেতে চাই নি। আমি চেয়েছিলাম আমার বাবা মার মন জয় করতে। কিন্তু আমি পারলাম না। এই দুনিয়ার প্রতিযোগিতায় আমি হেরে গেলাম। আমার জীবন শেষ পর্যায়ে চলে গেলো।
– চল বোন। আমি আজকেই তোকে আমার সাথে নিয়ে যাবো। এই জাহান্নামে তোকে আর রাখবো না।
তানিশা তুহিনকে বাঁধা দেয়।
– না ভাইয়া। আমি যতদিন বেঁচে আছি এই বাড়িতেই থাকতে চাই। আমি সবাইকে দেখে তবেই মরতে চাই। দয়া করে আমাকে জোড় করো না৷
– তুই এভাবে কেনো বলছিস তানিশা?
– আমি ঠিক বলছি ভাইয়া। মানুষ কবে মরবে সেটা কেউই জানে না। তবে আমি চাই এই বাড়িতেই থাকতে। যতই কষ্ট হোক না কেনো এই বাড়িতেই আমি বড় হয়েছি এবং এই বাড়ি ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না।
– ঠিক আছে। আমি আর তোকে বাঁধা দেব না। তবে আমিও এই বাড়িতেই থাকবো। তোর সাথে থাকাটা আমার প্রয়োজন। আর তোমাদের উদ্দেশ্যে বলছি। আজ থেকে তোমাদের সাথে আমার কিংবা তানিশার কারো সম্পর্ক নেই। তোমার এই কুলাঙ্গার মেয়েকে নিয়েই তোমরা আজীবন থাকো।
তুহিন তানিশার হাত ধরে সিড়ি বেয়ে উঠতে থাকে। এদিকে রোজা চৌধুরী প্রচন্ড পরিমাণে কষ্ট পান। তিনি ভুল করেছেন। তার এক মেয়ের জন্য আজ তিনি দুই ছেলে মেয়েকে হারিয়েছেন। রোজা চৌধুরী রেগে দু দুটো চর বসিয়ে দেন তিশার গালে।
– আমি সবচেয়ে বড় ভুল করেছি তোকে জন্ম দিয়ে। তোর মতো কুলাঙ্গার মেয়ে কি করে হতো পারলো আমার?
রোজা চৌধুরী কথাটা বলেই চলে গেলেন। রাফসান চৌধুরি তিশাকে পাত্তা না দিয়ে স্টাডি রুমের দিকে অগ্রসর হন। তিশা এবার কাঁদতে থাকে। ও কি করছিল নিজেই বুঝতে পারে নি। হ্যা ও ভুল করেছে তবে সেটা রাগের মাথায়। তিশা এবার মনে মনে বলতে লাগলো,
– যাই হয়ে যাক না কেনো তোকে আমি ছাড়বো না তানিশা। তোর জন্য আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। তোকে আমি ঘৃণা করি ঘৃণা।
————————–
রাফসান চৌধুরি রকিং চেয়ারে বসে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। তিনি ভেবে চলেছেন এতোগুলা বছর ধরে তানিশা এবং তিশার সাথে করা পার্থক্যের কথা। মানুষ যাতে তার দিকে আঙ্গুল না তুলতে পারে একারণে তিনি তানিশাকে নিজের মেয়ে বলে পরিচয় দিতেন না। অথচ তিনি একবারও ভাবেনও নি কতটা কষ্ট করেছে তার বড় মেয়েটা এতগুলো বছর ধরে। রাফসান চৌধুরি মাথায় হাত বুলিয়ে স্টাডি রুম থেকে বের হয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলেন। তিনি চুপিসারে প্রবেশ করলেন তানিশার রুমে। তানিশা নিশ্চুপ হয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে৷ কি মনে করে যেনো রাফসান চৌধুরি তানিশার সামনে বসে ওর মাথায় চুপটি করে হাত বুলিয়ে দিলেন। হটাৎ করেই তিনি মুখ চেপে কাঁদতে লাগলেন।
– আমাকে মাফ করে দাও তানিশা। আমি তোমার সঠিক যত্ন নেই নি। নিজের লোভে তোমাকে আমি দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। আমাকে মাফ করো। আল্লাহ তুমি আমার মেয়েটাকে সুখে রেখো। ওকে আর কষ্ট পেতে দিও না।
রাফসান চৌধুরি নিজের চোখের পানি মুছে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। হয়তো বা তিনি তার ভুল বুঝতে পেরেছেন।
—————————
সকালে তানিশা রেডি হয়ে নিচে নামতেই থমকে যায়। টেবিলে নানা ধরণের খাবার। সকলের মুখে মিষ্টি হাসি। তানিশা পাত্তা না দিয়ে নেমে যেতেই রোজা চৌধুরী বলে উঠলেন,
– এসো তানিশা খেতে বসো। তোমার জন্য কত কিছু রান্না করেছি আজ দেখো।
তানিশা অবাক হয়ে তাকিয়ে রয় ওর মার দিকে। আজ পর্যন্ত তানিশা এতো মিষ্টি করে কথা বলতে রোজা চৌধুরীকে দেখেননি। বরাবরই তিনি গম্ভীর স্বভাবের মানুষ।
– দ্রুত এসো তানিশা। আজ আমরা সকলে একসাথে খাবো।
রাফসান চৌধুরির ডাকে তানিশা ধীরে ধীরে ডাইনিং টেবিলের দিকে গেলো। প্রতিটা আইটেমই আজ নতুন। সাধারণত রাফসান চৌধুরি সকালের খাবারে ঝাল টাইপের জিনিস পছন্দ করে না। তবে আজ বেশিরভাগই ঝাল দিয়ে তৈরি খাবার। রাফসান চৌধুরি তানিশাকে ইশারা করলো তার পাশে বসার জন্য। রোজা চৌধুরী নিজ হাতে তানিশাকে নানা ধরণের খাবার বেড়ে দিতে লাগলেন। তিনি যেনো আজ নতুন রূপে রূপান্তরিত হয়েছেন। রাফসান চৌধুরির অবস্থাও ঠিক সেরকম।
– তানিশা পড়ালেখা কেমন যাচ্ছে? ভালো তো? যদি এবার ভালো রেজাল্ট করতে পারো তাহলে উপহার হিসেবে তোমাকে আমি প্যারিসের টিকেট কেটে দেব। তুমি তোমার বন্ধুদের সাথে সেখানে যেতে পারো।
তানিশা হা হয়ে তাকিয়ে রয় ওর বাবার দিকে। আসলেই কি তার সামনে বসা লোকটা রাফসান চৌধুরি? যে লোক আজ পর্যন্ত তানিশাকে একটা কানাকড়িও দেয় নি সে প্যারিসে যাওয়ার মতো উপহার কি করে দিতে পারলো৷ অন্যদিকে দরজার সামনে দাঁড়ানো তিশা এটা দেখে মুখ চেপে কাদঁতে লাগলো। আজ নিজের দোষেই নিজেকে ফাঁসতে হয়েছে। তুহিন ধীর পায়ে সিড়ি দিয়ে নেমে এমন অবস্থা দেখে নিজেও হা হয়ে গেলো। তানিশার সাথে তারা হেসে হেসে গল্প করছে। তুহিন তাচ্ছিল্যের সাথে বললো,
– পৃথিবীতে চাঁদ দুটো হলো কবে থেকে? তাও আবার তারা দুনিয়াতে নেমে এসেছে।
তুহিনের তাচ্ছিল্যের সাথে বলা কথা সকলে বুঝতে পারলো। রোজা চৌধুরী অনুতপ্তের স্বরে বললেন,
– এভাবে কেনো বলছো বাবা?
– তোমাদের নিয়ে কি হারমোনিয়াম বাজাবো নাকি?
– এসব কথা বলতে হয় না। এসো খেতে বসো। আজকে আমরা পুরো পরিবার একসাথে মিলে নাস্তা করবো।
রোজা চৌধুরী বাড়ির কাজের মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-সামনে রাখা প্লেটটা গিয়ে তিশাকে দিয়ে আসো। ও যেনো এখানে খেতে না আসে।
চলবে,,,,,,,💜