#উজান_যমুনা
#পর্বঃ২
লেখনীতে ঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী
খাওয়া শেষ করে রুমে এসে খাটের উপর আয়েশ করে বসলো উজান। মুঠোফোনটা হাতে নিতেই ওয়ালপেপারে থাকা যমুনার একটা হাস্যজ্জল ছবি স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে। সেদিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে উজান। এই মেয়েটাকে ঠিক যতবার দেখে ততবারই তার হৃদয়ে কা’ল’বৈ’শা’খী তা’ন্ড’ব শুরু হয়। প্রেয়সীকে একবার ছুঁয়ে দিতে মন হয় মা’তো’য়া’লা, ব্যাকুল! ততক্ষণাৎ মায়াবী মেয়েটাকে যত্ন করে, আদর মাখা চুমু খেয়ে, ভালোবেসে তার চওড়া বক্ষে আগলে রাখার শখ জাগে। আরো কতশত ইচ্ছে জাগে তার। নিজের ভাবনার মাঝে হেসে উঠলো ছেলেটা।
মিনিট কয়েক সময় নিয়ে তার স্বপ্নের রাণীর ছবি খানায় ঠোঁট ছুঁয়ে মোলায়েম কণ্ঠে বলে উঠলো,
” আপনি কি আমায় কখনো বুঝবেন উপমা? জানবে কি, এই পৃথিবীর বুকে একজন পুরুষ আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসে! আপনি শুধু আমার ভালোবাসা নয় উপমা, আপনি উজান চৌধুরীর অস্তিত্ব! তার হাজার পাগলামির কারণ,না বলা কিছু বারণ,কিশোর বয়সের প্রথম আবেগ-অনুভূতি! আপনাকে অসম্ভব রকমের ভালোবাসি উপমা! একবার আপনি আমার হয়ে যান, ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখবো আপনাকে।”
ছবিটা আবারো ছুঁয়ে দিলো উজান।
তার বয়স যখন সতেরো, ঠিক সেই সময়ে শাড়ী পরিহিত এক ঊনিশ বছরী যমুনা কন্যার কাজল কালো আঁখি যুগলে প্রেমে পড়ে সে। সে এক গভীর প্রেম!
বয়সে বড় থাকা যমুনাকে লজ্জায়, ভয়ে আর সেই অনুভূতি ততক্ষণাৎ জানাতে পারেনি উজান। নিজের বুকের ভিতর অতী যত্ন করে পুষে রেখেছে নিজের এক টুকরো অনুভূতিকে।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেই অনুভূতি তার ধীরে ধীরে ভ’য়া’ব’হ ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে। বয়স যখন তার একুশ। তখন অতী সাহস নিয়ে যমুনাকে পাওয়ার বায়না নিয়ে এসেছিলো ছেলেটা।
কিন্তু সেবার তার ভালোবাসা প্রকাশের আগেই শুনতে পায়, তার প্রিয় নারী অন্য কাউকে ভালোবাসে।
এরপর আর তার কাছে ভালোবাসার দাবী নিয়ে যায়নি ছেলেটা। ভিতরে ভিতরে গু’ম’রে ম’র’ছে প্রতিনিয়ত! তবুও নিজের ভালোবাসা চে’পে দূর থেকে প্রিয় নারীর ভালো থাকা কামনা করছে উজান।
এর কিছুদিন পরই পারিবারিক ভাবে যমুনার বিয়ে হয়ে যায় তার ভালোবাসার মানুষটার সাথে। সেদিন বন্ধ রুমে চিৎকার করে কেঁদে ছিলো উজান। এরপর আর কখনো মন খুলে হাসেনি ছেলেটা। ধীরে ধীরে নিজেকে শক্ত করে পড়ালেখায় মন দিলো সে। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে বাবা’র সাথে যোগ দিলো রাজনীতিতে। তবুও দিনশেষে শখের নারীকে না পাওয়ার অসুখ চে’পে বসেছিলো তাকে।
কিশোর বয়সে একবার তাকে ভালোলাগার পর আর কাউকে তার মতো ভালো লাগেনি। হাজার চেষ্টা করেও ভুলতে পারেনি সেই রমনীকে।
যমুনার বিয়ের একবছর পর আল্লাহ আবার তার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে তার প্রিয় নারীকে।
যমুনাকে ঠকিয়ে তাকে ডিভোর্স দিয়ে দেয় তার প্রিয় পুরুষ। সেদিন সবাই আফসোস করলেও উজান চৌধুরী মনে মনে খুশীতে বাক-বাকুম হয়ে রবের নিকট শুকরিয়া আদায় করেছে।
এরপর আর তাকে কখনো চোখের আড়াল করেনি ছেলেটা। আড়ালে-আবডালে বা সরাসরি নিজেকে প্রকাশ করেছে বারবার। কিন্তু প্রতিনিয়ত পা’ষা:ণ নারী তাকে গুঁ’ড়ি’য়ে দেয়। এতে অবশ্য উজান চৌধুরীর কিছু যায় আসে না। সে-ও দমে থাকার পাএ নয়। তার বিশ্বাস একদিন যমুনা এই উজান চৌধুরীর চোখে হারাবে।
প্রেয়সীকে নিয়ে রঙিন ভাবনার মাঝে মুঠোফোনটা ঝংকার তুলে বেজে উঠলো তার। বন্ধু “রাফসান’ কল দিয়েছে। ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে উজান। ফোনটা রিসিভ করে বিরক্তিকর কণ্ঠে শুধালো,
“শা*লা কল দেওয়ার আর টাইম পাইলি না।”
ওপাশ থেকে রাফসান রসিকতা করে বললো,
“কেন-রে দেবদাস, পার্বতীর জন্য ধ্যানে বসেছিলি না-কি!”
“বাজে বকা বন্ধ কর রাফসান! কাজের কথা বল।”
“তুই কোথায় আছিস?
“বাসায় আছি। কেনো?”
রাফসান আফসোসের সুরে বললো,
“তোকে তো পাওয়াই চাচ্ছে না আজকাল। সারাদিন সিনিয়র ভাবির পিছনে ঘুরঘুর করিস। বিয়ের আগেই বন্ধু বান্ধব’কে পর করে দিয়েছিস। অনেকদিন হলো একসাথে সবাই মিলে আড্ডা দেই না। উওর পাড়ার মোড়ে চলে আয়, আমরা অপেক্ষা করছি তোর।”
উজান “আসছি” বলে কল কে’টে দিলো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে নিজেকে পরিপাটি করে মা’কে বলে বাইক নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো।
.
.
“তুমি আসবে বলে জ্যোৎস্না দেখি,তারায় তারায় খুঁজি সুখ! তোমায় ভালোবাসি বলেই চাঁদের মাঝে খুঁজি তোমার মায়াবী মুখ!
জানো, এলোকেশী কন্যা! তুমি আমার সুখের মাঝেও অদ্ভুত এক অসুখ!
ওগো, মায়াবিনী! ভালোবাসি তোমায় আমি, সে কথা কেনো তুমি বুঝেও বুঝো না?”
অফিস থেকে ফিরে অন্ধকার রুমে সুয়ে ছিলো যমুনা। হঠাৎ করেই নিজের ফোন থেকে ছোট বোন “জলি” এহেন এক খানা মেসেজটি জোড়ে জোড়ে পড়ছে বার কয়েক। যা শুনে দরদরিয়ে উঠে বসে যমুনা। এক হাতে বোনের মুখ চে*পে ধরে শাসিয়ে বললো,
“চুপ কর জলি! এগুলো কোন ধরনের অ’স’ভ্য:তা! তুই আমার ফোন ধরছিস কেনো?”
জলি মুখ থেকে বোনের হাত সরিয়ে দিয়ে সুর টেনে বললো,
“ওরে আমার এলোকেশী কন্যারে! ফোন না ধরলে তো জানতামই না, তুই লুকিয়ে লুকিয়ে এসব করিস। তাড়াতাড়ি বল আপু, ছেলেটা কে? নয়তো আমি কিন্তু মা-কে সব বলে দিবো।”
বোনের হু’ম’কি’র মুখোমুখি হয়ে যমুনা ফাঁকা ঢোক গিললো গোপনে। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না, এগুলো ওই বাঁ’দ’র ছেলেটার কাজ।
তবুও সেসব প্রকাশ না করে বোনকে ধমক দিয়ে সূক্ষ্ম ভাবে বিষয়টি এড়িয়ে গেলো যমুনা।
কিন্তু, জলি তবুও খোঁচাচ্ছে। দুই বোনের তর্ক বিতর্কের মধ্যে মেয়েদের জন্য চা নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো মা “তাহেরা খানম”।
উনি চায়ের কাপ দু’টো টেবিলে রেখে মেয়েদের পাশে গিয়ে খাটে কোণে বসলো। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে মিহি সুরে মেয়েদের উদ্দেশ্য করে শুধালো,
“কি হয়েছে তোদের? রুমে বসে এতো সাউন্ড করছিস কেনো?”
জলি কিছু বলতে যাবে অমনি যমুনা তাকে চোখ পাকিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“কিছু হয়নি আম্মু। ”
জলি বোনের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। তাহেরা খানম এগিয়ে আসলো, বড় মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“তোর কিছু হয়েছে মা, মন খারাপ? অফিস থেকে এসেই সেই থেকে রুমে ঘাপটি মে*রে বসে আছিস, খাবারটাও খাসনি।”
“থাকছি কি আর স্বাধে! তোমার সেই পিচ্চি ভাতিজা রিতীমত তোমার মেয়ে’কে রাস্তা-ঘাটে বিরক্ত করে, মে*রে ফেলার হুমকি দেয় মা। বাচ্চা একটা ছেলে না-কি তোমার মেয়ে’কে বিয়ে করবে। বেয়াদব একটা!”
মায়ের কথা শুনে বিড়বিড় করে বলো উঠলো যমুনা।যা কান অবধি পৌঁছায়নি মায়ের। উনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে সন্ধিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে শুধালো,
“কিছু বললি?”
চেপে গেলো যমুনা। এমনিতেই মা তাকে নিয়ে সারাদিন টেনশনে থাকে। আবার এসব শুনলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। যমুনা লম্বা শ্বাস ছেড়ে নিজেকে ধাতস্ত করে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“আমার কিছু হয়নি মা, একটু মাথাটা ব্যথা করছে আজ। চিন্তা করো না, মেডিসিন নিয়েছি ঠিক হয়ে যাবে।”
মা চায়ের কাপটা মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
“আচ্ছা চা-টা খেয়ে নে ঠিক হয়ে যাবে।”
যমুনা চায়ে একবার চুমুক দিয়ে বললো,
“বাবা খেয়েছে মা?”
“তোর বাবা তো এখনো আসেনি বাসায়। স্কুল থেকে ফিরে বাজারে গেলো, এখনো খোঁজ নেই মানুষটার।”
বিরক্ত হয়ে বললো তাহেরা খানম। দুই মা-মেয়ের কথার মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হলো যমুনার বাবা “কাসেম তালুকদার”। উনি মেয়ের পাশে বসে খানিকটা হেসে বললো,
“এইতো বাবা এসেছে আম্মা।”
যমুনা মৃদু হাসলো। বাবা বড় মেয়ের হাতে পলিব্যাগে মোড়ানো কিছু ভাপা পিঠা তুলে দিলো। মেয়েদের জন্য গরম গরম ভাপা পিঠা নিয়ে আসছে বাজার থেকে। বাবা’র কথা শুনে ছুটে আসলো জলি। পরমুহূর্তে সবাই মিলে পিঠা খেতে খেতে আড্ডার আসর জমালো।
কাসেম তালুকদার পেশায় একজন প্রাইমারী স্কুলের টিচার। দুই স্ত্রী আর দুই মেয়ে’কে নিয়েই তার ছোট্ট সংসার। মেয়ে দু’টো তার বড়োই আদরের।
___________
মেঘলা আছন্ন একটি সকাল। ঘনো কুয়াশায় চাদরে মুড়িয়ে আছে রাস্তা ঘাট। রাস্তার পাশ ধরে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে হাঁটছে উজান। পরিপাটি ছেলেটাকে আজ ফ্যাকাশে লাগছে। উস্কো-খুস্কো চুল তার, চেহারায় চিন্তার ছাপ। একটার পর একটা সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে ছেলেটা।
আজ তিন’টে দিন হলো তার প্রেয়সীকে দেখছে না সে। মেয়েটার কিছু হলো না তো? অফিসেও যাচ্ছে না আজকাল।
চলবে…..
(সবাই একটি রেসপন্স করবেন দয়া করে!)