আঁড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঁঠি #৩য়_পর্ব #অনন্য_শফিক

0
169

#আঁড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঁঠি
#৩য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক



ফৌজিয়ার সঙ্গে কথা নাই অনেক দিন।ভাবী তার কাছে গিয়ে ভাইয়ার নাম না বলে স্বামীর নামের জায়গায় কার নাম বলেছিলো তা আর আমি ফোন করে জানিনি।ফৌজিয়াও জানায়নি। ফৌজিয়া রাগ করে আছে কি না আমার সঙ্গে কে জানে! না কি এই সমস্যায় সে নিজেকে আর জড়াতে চায়ছে না?
এসব ভেবেই তাকে ফোন করলাম।দু’ বার কল দেয়ার পর রিসিভ করলো।বললো,’ তপু, কিছু মনে করো না প্লিজ তোমায় পরে কল দেই?’
আমি বললাম,’ আচ্ছা ঠিক আছে।’
মেজাজ এবার সত্যি সত্যি খারাপ হলো। ফোন রেখে দিয়ে বসে রইলাম।
কিন্তু খানিক পরই আবার মন শান্ত হলো। ভাবলাম,মানুষের ব্যস্ততা তো থাকতেই পারে। সে একজন ডাক্তার। চেম্বারে রোগীর ভীড় থাকে সব সময়। আমার মতো তো আর সে বেকার বসে থাকে না যে কেউ ফোন করলেই কথা বলতে উদগ্রীব হয়ে পড়বে!
এসব বোঝা সত্ত্বেও রাগ লাগে। হয়তো বন্ধু বলেই এমনটা হয়। আবার মাঝেমধ্যে মনে হয়, ফৌজিয়া সরাসরি কিছু না দেখালেও খুব চতুরতার সঙ্গে আমার সাথে এক রকমের একটা অহংকার দেখায়। এটা এই জন্য যে স্কুল কলেজ জীবনে সব সময় আমি শিক্ষকদের এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীদের প্রশংসায় ভেসেছি। সে কোন ভাবেই আমায় পেছন ফেলতে পারেনি। কিন্তু এখন তো সে অনেক বড়। অনেক বড় জায়গায় তার স্থান।এটা সে পরোক্ষভাবে হলেও আমায় বোঝাতে চায় হয়তো।
মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে ওর সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। কিন্তু কেন যে এটা বন্ধ করি না তা জানি না! বন্ধ করতে পারি না। কেমন দম বন্ধ লাগে।মনে হয় ওর সঙ্গে কথা না বললে, যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলে আমি থাকতেই পারবো না।

ফৌজিয়া ঠিক আধঘন্টা পরই কল করলো।বললো,’ বাবার শরীর খারাপ। হঠাৎ সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলেন তিনি।সেন্স ফিরেছে। এখন একটু ভালো।’
আমি আবার লজ্জিত হলাম।কি সব ভাবছিলাম তার সম্পর্কে! আমি অনুতপ্ত হয়ে বললাম,’ ফৌজিয়া, এখন আঙ্কেলের সেবা করো। তার কাছে থাকো।আমি না হয় এরপর কথা বলবো।’
ফৌজিয়া বললো,’ সমস্যা নাই।কি অবস্থা বল তো তপু? কিছু বের করতে পারলা খুঁজে? ‘
আমি বললাম,’ কিছুই না। কিচ্ছু খুঁজে বের করতে পারিনি।’
ভাবীকে যে গতকাল বিকেলে কারোর সঙ্গে ফোনে এসব কথা বলতে দেখলাম তা আর প্রকাশ করলাম না।এটা ঘরের বিষয়। আমাদের প্রাইভেসি। ফৌজিয়া আমার যতো ভালো বন্ধুই হোক না কেন, সে ঘরের লোক না। বাইরের লোক। তার কাছে ঘরের ভেতরের কিছু না বলাই মঙ্গল।
ফৌজিয়া বললো,’ ডায়েরি দেখেছিলাম আমি।নাম বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। স্বামীর জায়গায় তোমার ভাবী লিখেছিল —‘
এইটুকু বলেই হুট করে কথা বন্ধ করে দিলো।নামটা আর শোনা হয়নি।বলে শেষ করতে পারেনি।আমি অনেকক্ষন এপাশ থেকে হ্যালো হ্যালো করলাম। কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না।এর খানিক পর আপনা আপনি ফোন কেটে গেল। এরপর বার কয়েক ডায়েল করেছি ওর ফোনে। রিসিভ করে না।
সমস্যা কি? নাকি ফৌজিয়া এই নাম বলতে চায় না? কেন বলতে চায় না? এর পেছনেও কি কোন রহস্য আছে?
আমার মাথা সত্যি সত্যি আর কাজ করে না!

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বিষণ্ণ হয়ে ছাদের উপর বসে আছি।ওপাশের ছাদে কিশোরী একটা মেয়ে রোজ আসে।গাছের টবে জল দেয়।দড়িতে নেড়ে দেয়া শুকনো কাপড় নিয়ে যেতে আসে। মজার বিষয় হলো, আমি যখন আসি ঠিক তখনই সে আসবে। আমার কেন জানি মনে হয় সে আমায় অনেক দিন ধরে ফলো করছে। আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার সব রকম চেষ্টা সে করেছে। এমনকি তার গানের গলা যে ভালো, গানের এই গলা দিয়ে আমার প্রিয় রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছে একদিন ছাদে দাঁড়িয়ে।
” জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে ”
আজ খেয়াল করলাম শাড়ি পরেছে। সবুজ রঙের শাড়ি হয়তো। কিন্তু ওদিকে চোখ দিলাম না। বাচ্চা মেয়ে ‌।বড় জোর ক্লাস টেনে পড়ে।এর বেশি হবার কথাই না! ওদিকে চোখ দিয়ে লাভ নেই!
আমি ভাবছি অন্য কিছু নিয়ে।এর সমাধান কিভাবে করবো।
এরমধ্যে ফোন বের করলাম। ফেসবুকে ঢু মারলাম একটু। নিউজফিড ঘাঁটতে গিয়ে অবাক হলাম। আমাদের আরেক বন্ধু পোস্ট করেছে। ফৌজিয়ার বাবা মারা গিয়েছেন একটু আগেই।নিউজটা দেখে আমার শরীর কেমন কাঁপতে লাগলো।একটু আগেই তো ফৌজিয়া বললো, এখন ঠিক আছে।বাবা সুস্থ। কিন্তু এই খানিকটা সময়ের মধ্যেই এটা কি হয়ে গেল?
মানুষের জীবন এমন কেন? এতো ছোট্ট জীবন! কিন্তু এইটুকু এক জীবনে এতো এতো রহস্য! এতো এতো কানাঘলি জীবনের!

এর আরো চারদিন পর ভাবীকে দেখলাম আবার কল করতে। ভাইয়া তখন অফিসে।মা তার বান্ধবীর বাসায় গিয়েছেন। ফিরবেন সন্ধ্যা বেলায়।আমি রুমে বসে জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি ‘ পড়ছি। তখনই চাপা গলায় কথা বলতে শুনলাম।ভাবী কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। কিন্তু এখান থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না।আমি খুব সাবধানে ভাবীর ঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর শুনতে পেলাম, ভাবী বলছে,’ আমি একটা মেয়ে মানুষ, শশুর বাড়ি থাকি। আপনি বললেই তো আর যখন তখন দেখা করতে পারি না। তবে আমি দেখা করবো। আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে এর জন্য। আমার শাশুড়ি কোথাও দু ‘চারদিনের জন্য বেড়াতে না গেলে বাসা থেকে বেরুনো আমার পক্ষে সম্ভব না।’
এরপর ওপাশ থেকে কি বলেছে কে জানে।ভাবী বললেন,’ আপনার টাকা আমি সাথে করেই নিয়ে আসবো।আমায় বিশ্বাস করুন প্লিজ! আমি আসবো। শিগগির আসবো।’
ভাবী কথা শেষ করার আগেই আমি অতি সাবধানে নিজের ঘরে চলে এলাম। এসে
বসে বসে লম্বা সময় ধরে ভাবলাম। ভাবলাম, আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ অপি ভাবী।যাকে নিজের বোনের মতোই আমি দেখি। তাকে নিয়ে খারাপ কিছু কিভাবে ভাববো? কিন্তু এই যে তার দুই দিনের ফোন কল।ভিডিও পোস্ট না করার জন্য অনুরোধ করা। বিনিময়ে যা ইচ্ছে তাই দিতে চাওয়া।মা বাসা থেকে কোথাও বেড়াতে যাবার জন্য তার অপেক্ষা করা। এতো কিছুর পর সন্দেহের তীর টা তো ভাবীর দিকেও যায়। আচ্ছা তবে কি ভাবীই এসবের মূল? ভাইয়ার সঙ্গে তার এই যে মনোমালিন্যতা, অন্তর্গত কোন্দল, এসবের পেছনে কি ভাবীই দায়ী?
কিন্তু ভাবী আসলে কার সঙ্গে জড়িয়েছে?
খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। ভাবীর মতো এমন মিষ্টি মনের একটা মানুষ কেন এসবের মধ্যে জড়াতে গেল?
ভাবলাম, এইসব কিছুর রহস্য উদঘাটন করতে হলে আমাকেও কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে।আর এটা শুরু করবো মাকে দিয়েই।

মাকে এর পরদিনই বড় খালার বাসায় পাঠিয়ে দিলাম।খালুরও অনেক দিন ধরে শরীর খারাপ।আমি বললাম,’ খালুকে তোমার দেখে আসা উচিৎ। কালকেই যাও। না গেলে এটা খারাপ হবে।সম্পর্ক নষ্ট হবে।’
মা প্রথমে না করলেন। বললেন,মনে শান্তি নাই। এখন যাবেন না।গেলেও আরো পরে যাবেন। কিন্তু মজার বিষয় হলো পরদিন দুপুর বেলা তিনি বললেন,আমায় গাড়িতে তুলে দিয়ে আয়। গিয়ে কটা দিন থেকে আসি। আমার আসলেই যাওয়া উচিৎ। না গেলে খারাপ হবে!
দুপুর বেলা মাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে এলাম। ওখান থেকে ফেরার সময় মা বললেন,’ তপু, আমার শান্তির ঘরটাতে কিসের আগুন এসে লাগলো রে বাবা! কে লাগিয়েছে এই আগুন?’
মার চোখ দুটো ভিজে উঠলো জলে। তিনি তার বুড়িয়ে আসা নরম দুটি হাত দিয়ে আমার মাথায়, গালে হাত বুলিয়ে দিলেন ‌। তারপর বললেন,’ যা। বাসায় চলে যা। সাবধানে থাকিস। খেয়াল রাখিস সবকিছু।’
মায়ের গাড়ি ছেড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি বাসায় এসে পড়লাম। সে রাতেই ভাইয়া খাবার টেবিলে বসে আমায় বললো,’ তপু, আমি সিলেটে যাচ্ছি কাল।এক সপ্তাহ ওখানে থাকতে হবে।’
আমি বেশ অবাক হলাম। বললাম,’ কেন? কেন যাবে?’
ভাইয়া বললো,’ অফিসের কাজে। ওখানে একটা শাখা খুলেছে আমাদের অফিসের। নতুন যারা জয়েন করেছে ওদের ট্রেনিং করাতে হবে ওখানে গিয়ে।’
আমি এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম,’ ভাবীও যাবে?’
ভাইয়া মুখ মলিন করে উত্তর দিলো,’ নাহ ‌।’
ভাইয়া পরদিন সকাল বেলায়ই সিলেটের উদ্দেশ্যে ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে গেল।যাবার সময় আমায় বলে গেল,’সাবধানে থাকিস। মাকে আগে ভাগে কিছু বলিনি।পরে বলিস তুই। এখন বললে মা টেনশন করবেন।’
আমি বললাম,’ আচ্ছা।’
কিন্তু ভাবীর সঙ্গে তাকে কোন রকম কথা বলতেই দেখা গেল না।

এরপর দিন বাসায় শুধু আমি আর ভাবী।আর কেউ নেই। খুব ভালো একটা সুযোগ এসেছে।আমি সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইলাম।আর আমার চালটা চাললাম। ভাবীকে সকাল বেলা খাবার খেতে খেতে বললাম,’ ভাবী, একটা সমস্যা হয়ে গেছে। কিন্তু তুমি বাসায় একা। কিভাবে যে বলি!’
ভাবী বললো,’ কি হয়েছে? বল। সমস্যা নাই।’
আমি বললাম,’ আমার এক বন্ধুর বাবা মারা গেছেন। কিশোরগঞ্জ ওদের বাড়ি।গ্রামে। কিন্তু না গেলেও হচ্ছে না।আমি গিয়ে জানাজা পড়ে এসে পড়বো। কিন্তু তোমাকে বাসায় একা রেখে কিভাবে যাই!’
ভাবী খানিক সময় চুপ করে রইলো। তারপর বললো,’ কেমন সময় লাগবে? রাতের মধ্যে ফিরবি না?’
আমি বললাম,’ দশটার মধ্যে ফিরবো ইনশাআল্লাহ!’
ভাবী বললো,’ আচ্ছা।যা তাহলে।দশটার মধ্যেই ফিরিস কিন্তু।আর ফিরতে দেরি হলে বা রাতে ফিরতে না পারলে আগে ভাগেই ফোন করে বলিস।’
আমি বললাম,’ আচ্ছা।’
বলেই ভালো জামাটা পরে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু দূরে আর কোথাও গেলাম না। বাসার আশেপাশেই আড়াল থেকে নজর রাখতে লাগলাম বাসার দিকে। দেখতে লাগলাম বাসায় কেউ আসে নাকি ভাবী নিজেই বাসা থেকে বেরিয়ে যায় কোথাও!

অপেক্ষা করছি লম্বা সময় ধরে।প্রায় তিন ঘন্টা। এখন আর ভালো লাগছে না। অসহ্য লাগছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ভাবী আজ কোথায় বেরুবে না। কিংবা কেউ আসবেও না এখানে।আমি উঠে পড়তে চাইলাম এখান থেকে, ঠিক তখনই কলটা এলো। ভাবীর কল। ভাবী বললো,’ তুই পৌঁছেছিস গিয়ে?’
আমি বললাম,’ না ভাবী।গাড়ি পেতে সময় লেগেছে। এখনও রাস্তায়।আরো ঘন্টাখানেক লাগবে পৌঁছাতে।’
ভাবী বললো,’ আচ্ছা সাবধানে যা।রাখি।’
বলেই ফোন রাখলো। ফোন রাখার ঠিক দশ মিনিট পর কালো গাড়িটাকে এসে আমাদের বাসার গেটের সামনে দাঁড়াতে দেখলাম।আর মিনিট দুয়েকের মধ্যে গাড়ির একটা ডোর খুলে গেলো। তখনই গেট খুলে বেরিয়ে এলো ভাবী। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে উঠে বসে পড়লো।ভাবী গাড়িতে উঠার সঙ্গে সঙ্গেই ডোরটা আবার বন্ধ হয়ে গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা ঘুরিয়ে পেছনের রাস্তার দিকে নিয়ে চলে গেল।

(প্রিয় পাঠক, যারা গল্পটি পড়ছেন সবাই রেসপন্স করবেন কষ্ট করে।এতে লিখার আগ্রহ বাড়ে।গল্প সুন্দর হয়। ধন্যবাদ।)
‘#আড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঠি
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here