#আঁড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঁঠি
#৪র্থ_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
গাড়িটা পেছনের দিকে ছুটে যেতেই আমার মাথায় একটা চক্কর দিয়ে উঠলো। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ভাবী বড় ধরনের কোনো একটা চক্রের হাতে আটকে গেছে কোন কারণে । আবার মাঝেমধ্যে এও মনে হয়, চক্র ফক্র কিছু না এসব ।ভাবী অন্য কারোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে ।আর সেই সম্পর্কের ফসল তার গর্ভে এসেছিল। ভাইয়া কোনো ভাবে হয়তো বিষয়টা আঁচ করেছিল। এই জন্যই হয়তো বা ভাইয়ার সঙ্গে ভাবীর সম্পর্ক অবনতির দিকে যাচ্ছে।আর ভাবী যেহেতু অন্য কাউকে মন দিয়ে বসেছে, তো এই সংসারে, এই ঘরে তার মন না বসায় তো স্বাভাবিক।আর তার নিজের বরকেই যদি তার আপন মনে না হয়, তাহলে বরের মা কিংবা ভাইকে তার আপন মনে হবে কিভাবে?
‘
কালো চকচকে রঙের গাড়িটা মুহূর্তে চোখের আড়াল হয়ে গেল। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি কি করবো? কিংবা আমার কি করা উচিৎ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছি ।এটা গল্প সিনেমা হলে সম্ভব হতো যে আমি দৌড়ে গিয়ে কিংবা একটা চলন্ত মোটরসাইকেল তার চালকের থেকে কেড়ে নিয়ে গাড়িটির পেছন পেছন ছুটে যেতাম। এবং ফলো করে দেখতাম, ওরা কি করে! কোথায় যায়।কিন্তু এটা তো গল্প সিনেমা নয়। বাস্তব।আর বাস্তবতা বড়ই কঠিন!
হঠাৎ করেই নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষটি মনে হলো আমার । এবং এই প্রথম ভাবীর প্রতি প্রচন্ড ঘেন্না হচ্ছে আমার।ঘেন্নায় থুউক করে একদলা থুথু ফেললাম আমি মাটিতে।
রাগে আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে।
বাসায় চলে যেতে ইচ্ছে করছে। এখানে বসে থাকতে পারছি না আর। শরীর ভীষণ খারাপ লাগছে। কিন্তু বাসায় যাওয়াটা উচিৎ হবে না আমার।আমি চাই না ভাবী এসে দেখুক আমি আগে ভাগে বাসায় ফিরে এসেছি। বরং ভাবী যখনই ফিরবে, এর আরো ঘন্টাখানেক পর আমি বাসায় ফিরবো।এর আগে না। আপাতত ভাবী ফোন টোন করলে রিসিভ করবো না!
কিন্তু এখানে বসে কিছুতেই সময় কাটছে না আর।একা একা বসে থাকতেও ভালো লাগছে না। আচ্ছা আমি কি একটু হাঁটাহাঁটি করবো?
একবার দাঁড়ালাম বসা থেকে। ভাবলাম নদীর পাড় ধরে একটু হেঁটে আসি। নদীর পাড়ে নানান বুনো ফুল ফোটেছে। নদীর জলে নিশ্চয় এখন একদল হাঁস হুল্লোড়ে মেতে উঠেছে। নদীর পাড় ধরে হাঁটলে অনেক ভালো লাগবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, এটা কিছুতেই করা যাবে না।ভাবী যদি কোন ভাবে জেনে ফেলে যে আমি কোথাও যাইনি। আশেপাশেই ছিলাম। তখন সর্বনাশ হবে।খেলাটা হয়তো এখানেই থেমে যাবে। কিন্তু আমি এর সবটা না জেনে,এর রহস্য খুঁজে বের না করে কিছুতেই থামতে চাই না! কিছুতেই না!
‘
হঠাৎ করেই ফোনটা বেজে উঠলো আমার। ভাবলাম ভাবী ফোন করেছে। কিন্তু পকেট থেকে ফোন বের করে দেখি ভাবীর ফোন না।মা কল করেছেন।
ফোন রিসিভ করলাম সঙ্গে সঙ্গে।
মা ওপাশ থেকে বললেন,’ কি করো তপু?’
আমি আমতা আমতা করে বললাম,’ শুয়ে আছি।গল্প পড়ি।’
মা বললেন,’ আচ্ছা ঠিক আছে।বউমা কি করে?’
আমি বললাম,’ ভাবী তার ঘরে।কি করে জানি না।’
মা মনমরা গলায় বললেন,’ আমার না কেমন যেন লাগছে! মন অশান্ত হয়ে আছে ভীষণ। ছটফট করছে শুধু। সাবধানে থেকো তোমরা। অপুকে ফোন দিয়েছিলাম।সে অফিসে।বলেছি, দেরি না করতে। সকাল সকাল অফিস করে চলে আসতে।’
আমি বললাম,’ অতো টেনশন করো কেন তুমি মা? এই জন্যই তোমার শরীর খারাপ লাগছে! হাসব্যান্ড -ওয়াইফের মধ্যে একটু আধটু ঝগড়া হতেই পারে।এটা কদিন থাকেও অনেক সময়।এটা তো তেমন কোন বিষয় না! সব ঠিক হয়ে যাবে।’
মা বললেন,’ তুমি ছোট মানুষ তপু। তোমাদের পেটে রেখেছি আমি।আদর করে বড় করেছি। তুমি আমার কষ্ট, যন্ত্রণা বুঝবে না।আমি যে তোমার বড় খালার বাসায় হঠাৎ চলে এসেছি।যদিও তুমি বলেছো আসতে। তোমার এই বলায় কিন্তু আমি কোনদিন আসতাম না তোমার খালার বাড়ি। নিজের বাড়ি রেখে, সন্তানাদি রেখে আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না।আমি এখানে এসেছি মনের শান্তির জন্য।ঘরের ভেতর যে একটা যুদ্ধ চলছে। এই যে গোপন এক দ্বন্ধ।এসব আমার সহ্য হচ্ছে না আর।তাই ওখান থেকে আড়ালে এসে থাকতে চেয়েছি কটা দিন। কিন্তু এখানে এসেও কোন লাভ হয়নি। আমার মন এখন আরো বিঁষিয়ে গেছে। কিন্তু বাসায় ফিরতেও আর সাহস হচ্ছে না।মন টানছে না।আমি এখানে বেশ কদিন থাকবো। তুমি সাবধানে থাকবে তপু। অপুকে নজরে রাখবে।বউমাকেও।আমি জানি বউমা উপরে যতোটা সরল, ভেতরে ততোটাই চতুর।আমি বলছি না সে মেয়ে হিসেবে মন্দ।এটা কোনদিন বলবোও না আমি।বউমা আসার পর থেকে আমি তাকে নিজের মেয়েই মনে করেছি।সে আমায় আদর দিয়ে, সান্নিধ্য দিয়ে,যত্ন দিয়ে আমার মেয়ে সন্তান না থাকার চাপা দুঃখটা গুছিয়ে দিয়েছিল।
সে যায়হোক, তোমার সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না।অপু আমার গর্ভের সন্তান।সেও মুখ ফুটে কিছু বলছে না।অপিকে যে আমি নিজের মেয়ে ভাবলাম।এতো সোহাগ- আদর দিলাম।সেও কোনদিন কিছু বললো না। আমি অপিকে বলেছিলাম, সব গোপন রাখলে সমস্যা কমে না।বাড়ে।অপিও আমার কথা শুনেনি।আচ্ছা এখন রাখি। ভালো লাগছে না আর কথা বলতে। সাবধানে থেকো তুমি।’
বলে মা ফোন কেটে দিলেন।
মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর থেকেই মন ভীষণ ছটফট করছে। ভীষণ খারাপ লাগছে আমার।
শেষের কয়েকটি কথা বলার সময় মায়ের গলা ভিজে এসেছিল।আমি মায়ের থেকে বহু দূরে থাকার পরেও টের পেয়েছি মা কাঁদছেন।তার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে গালের উপর।বুড়ো হাতের পিঠ দিয়ে এখন মা নিশ্চয় তার দুটি গাল মুছছেন। আহা বেচারি! মা হবার এই এক দুঃখ।তার নিজের সব সুখ শান্তি আরাম আয়েশের কথা ভুলে গিয়ে নিজের সন্তানের জন্য সব সময় উদগ্রীব থাকতে হয়। সন্তানের ভালো মন্দ নিয়েই সব সময় ভাবতে হয়।
কিভাবে এসবের সমাধান করবো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ভাইয়ার কাছে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করবো নাকি আসলে তার আর ভাবীর মধ্যে কি ঘটছে?
অনেক ভেবে চিন্তে দেখলাম, এটা করা ঠিক হবে না। ভাইয়া অফিসের কাজে এক শহর ছেড়ে দূরে অন্য একটা শহরে গিয়েছে। তাকে কোন ভাবেই এই মুহূর্তে বিরক্ত করা উচিৎ হবে না!
যখন কোন সমাধান মাথায় আসছে না ঠিক তখন আবার ফৌজিয়ার কথা মনে পড়লো।
আঙ্কেল মারা গিয়েছেন দশ বারো দিন হয়েছে। এখন কি তাকে একটা ফোন করা যায়?
এছাড়া তো সমাধানের কোন পথও নাই আমার কাছে। ফৌজিয়ার কাছে বিরাট এক তথ্য আছে।সে জানে, অপি ভাবী ভাইয়ার নাম না বলে আর কার নাম বলেছিল সেদিন। আমার মন খুব করে বলছে, আমি যদি সেই নামটি জানতে পারি, আর খুঁজে বের করতে পারি লোকটিকে। তবেই এর সমাধান আমি খুঁজে বের করে ফেলবো।সব রহস্যের উদঘাটন তখন হয়ে যাবে।
ফোন করবো কি করবো না এরকম করতে করতে একটা সময় ফোন করেই ফেললাম।
কিন্তু বার বার ডায়েল করার পরেও তার ফোনে রিং হলো না।
ফোন বন্ধ। এখন আর তার প্রতি আমার কোন রকম রাগ হচ্ছে না। ফোন বন্ধ থাকতেই পারে। নিজের জন্মদাতা পিতা হলো বটবৃক্ষের মতো।বাবা না থাকলে সবকিছু অন্ধকার লাগে। ফৌজিয়া যেহেতু পরিচিত মানুষ, পেশায় নামিদামি ডাক্তার। হয়তো তার নম্বরে রোজ অনেক অনেক কল আসে।এসব থেকে আপাতত দূরে থাকতেই হয়তো সে ফোন বন্ধ করে রাখে। হয়তো সে এখনও তার বাবার হঠাৎ করে মৃত্যু বরণ করার শোকটা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
মাগরিবের আজান পড়েছে তখন। এই সময় ভাবী ফোন করলো আমায়। পরপর অনেক বার। কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই ফোন রিসিভ করলাম না। ফোন রিসিভ না করার সুন্দর একটা যুক্তি আছে।যুক্তিটা হলো, আমি ফোন রিসিভ করলেই ভাবী জিজ্ঞেস করবে আমি কতোদূর? তখন কি বলবো! এরচেয়ে ফোন রিসিভ না করাই ভালো।
কালো রঙের গাড়িটা ভাবীকে আবার নামিয়ে দিয়ে গেল মাগরিবের ঠিক বিশ মিনিট পর পর।ভাবী গাড়ি থেকে নেমে অতি সতর্কতা নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে তাড়াহুড়ো করে গেট খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর ভেতর থেকে গেট আটকে দিলো।
আমি সামান্য দূরে বসে এসব কান্ড দেখে অসহায়ত্বের কিংবা ঘেন্নামাখা হাসিটা হাসলাম। তারপর বিড়বিড় করে বললাম, আড়াল থেকে কে নাড়ে এই কলকাঠি? কে? কে এই জঘন্য পিশাচ ?
‘
বাসায় ফিরলাম এশার আজানের পর পর।ফিরে দেখি ভাবী রান্না করছে। এবং এই এতোদিন পর সে আমার সঙ্গে একটু সহজ হয়েছে। হাসিমুখে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে আমি ভীষণ রকম অবাক হলাম। ভাবীর গায়ে কোন রকম অলংকার নাই।কান,নাক,হাত,গলা সব খালি।অথচ আজ সকালেও দেখেছি তার শরীরে সবগুলো গহনাই ছিল। তাহলে এখন এগুলো কোথায় গেল?
কিন্তু ভাবী যেন বুঝতে না পারে আমি তাকে এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি এই জন্য আর তার দিকে তাকালাম না। খাবার হলে খেয়ে আমার ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম।
এবং সে রাতেই ফেসবুকে স্ক্রল করার সময় সবচেয়ে বেশি অবাক হবার মতো ঘটনাটা ঘটলো। নিউজফিডে এমন কিছু ছবি আমার সামনে পড়লো যা দেখে আমি একেবারে আঁতকে উঠলাম!
‘
আশা করি সবাই কমেন্টে জানাবেন কেমন লেগেছে। সবাই কমেন্ট করলে লেখকের লেখার আগ্রহ বেড়ে যায়। সবাই রেসপন্স করবেন প্লিজ।নতুন পর্ব দিলে কমেন্টে লাইক দিয়ে জানানো হয়
#আড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঠি