#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: তেরো|
সন্ধ্যা লগনে লাজরাঙা নব বঁধু চা হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত লাজ তার বদনে। রাঙা মুখশ্রীতে কৃত্রিম আলো ছড়াচ্ছে দেখতে অনেকটা মোহনীয় লাগছে। অন্তিক নব বঁধুর দিকে মায়াবী মুখশ্রী দেখছে। ভেজা চুল থেকে টুপটুপ পানি ঝড়ছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অন্তিক চোখ বন্ধ করে নেয়। সেদিন বাবার কাছে থেকে শুনেছে তার মায়ের হাতের স্বাদও প্রায় এমন হতো। চোখ বন্ধ করে সে রুনা উপস্থিতি অনুভব করতে চেষ্টা করে। মায়ের শরীরের ঘ্রাণ কেমন ভুলেই বসেছে সে। মিষ্টি অন্তিকের অবস্থা বুঝতে পারে। চঞ্চল বঁধু কৌশলে অন্তিকের পাশে আবদার রাখে, ” ঘুরতে নিয়ে যাবে, অন্তু?”
মিষ্টিকে আগকে ধরে অন্তিক হাসে। চায়ের কাপে পরবর্তী চুমুক দিয়ে বলে, ” এখনই যেতে হবে?”
” বেশ বড়ো আবদার করে ফেলেছি বুঝি?”
অন্তিক চায়ের কাপ ফিরিয়ে প্রসস্থ হেসে উত্তর দেয়, ” তিন কবুল করার মাধ্যমেই তোমার আবদার, অভিমান, হাসি দুঃখ সব আমার নামে করে দিয়েছো চন্দ্রিমা! তোমার কাছে এই অন্তিক স্বপ্নের রাজকুমার হতে না পারলেও মাতাল প্রেমিক হয়ে দেখাবে।”
” বাহ, বেশ কাব্যিক কথা বলতে শিখেছো দেখছি, অন্তু। তা গুরুটা কে শুনি?”
অন্তিক ঘর থেকে বের হতে হতে বলে, ” সঙ্গ দোষ বুঝলে! আমার চন্দ্রিমার মুখের প্রতিটা শব্দ শুধু আমার জন্য। তার নিঃশ্বাসও বলে দেয় আমার জন্য ব্যাকুলতা। আমি চন্দ্রিমার থেকেই শিখেছি।”
মিষ্টি লজ্জায় লাল হয়ে হাসে। অন্তিকের চলে যাওয়ার আভাস পেয়ে লজ্জায় মুখ ঢেকে নেয়। অন্তিক চলে গিয়েও ফিরে এসে পুনরায় শুধায়, ” ওহে মোর কলঙ্কতিলক প্রেয়সীনি। একটি আর্জি শুনবে?”
অন্তিকের মাতাল কণ্ঠে মিষ্টি মোহিত হয়ে উত্তর দেয়,” এই মানবী কলঙ্কিত পুরুষের সব আর্জি শুনতে প্রস্তুত।”
” আজকে শাড়ি পরবে? সাথে কাঁচের চুড়ি, মোটা করে কাজল, আর!”
” আর কী?”
” ফিরে বলব।”
মিষ্টি পাগল বলে নীল রঙের শাড়ি নিয়ে বাথরুমে প্রবেশ করে।
অন্তিক হাসিমুখে বাগানের দিকে যাচ্ছিল তখনই কলি পথ আগলে দাঁড়ায়। কলির চোখে তখন জলের স্রোত বইছে। নাক টেনে বলে,” আমায় ক্ষমা করো,অন্তিক ভাই। মায়ের কথায় ভাবীর পিছনে লেগেছিলাম। আজ তুমি আমার চোখ খুলে দিলে। আমি আর কোনদিন তোমার আর ভাবীর পিছনে লাগবো না। কালই হোস্টেলে চলে যাব।”
অন্তিক তীর্যক দৃষ্টিতে কলিকে দেখে। মেয়েটা আদৌও সত্যি বলছে নাকি মিথ্যা বুঝার উপায় নেই।
” ঘরে যা।”
” আব্বা মাকে মে’রে ফেলবে। মাকে বাঁচাও অন্তিক ভাই!
অন্তিক চলে যাচ্ছিল। কলির কথা শুনে থেমে হাঁটার গতি থামিয়ে পথ পাল্টে নেয়। লায়লা বেগমের ঘরের সামনে এসে দরজায় চার পাঁচবারের মতো কড়াঘাত করে।
” দরজা খুলো, চাচা।”
ভেতর থেকে ফিরোজের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ” শু’য়ো’রে’র বাচ্চা, যা এখান থেকে।”
অন্তিক চোখ বন্ধ করে রাগ সংবরণের চেষ্টা করে। মুষ্টিবদ্ধ হাত পুনরায় দরজায় রেখে কড়াঘাত করে বলে,” দরজা খুলবে, নাকি পুলিশ ডেকে আনবো। জীবনের প্রথম মোল্লা বাড়ির চৌকাঠে পুলিশের পা মাড়াবে। সম্মান কী থাকবে?”
খটাখট দরজা খুলে পুরুষালি হস্ত এগিয়ে আসে অন্তিকের মুখ বরাবর। যথা সময় অন্তিক সেই হস্ত আটকে নেয়। লাল বর্ণ চোখে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ” দ্বিতীয়বার এই ভুল করলে হাত কে’টে ফেলব। শান্ত বলে অবজ্ঞা করেছো কিছু বলিনি কিন্তু অন্যায়ভাবে আমাকে হরণ করবে তা হতে দিব না। মোল্লা বাড়ির প্রত্যেকটা দেয়াল সাক্ষী, একজন ছেলেকে দিনের পর দিন যা সইতে হয়েছে তা যেন অন্যকাউকে সইতে না হয়।”
অন্তিক হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে ফিরোজকে চলে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়। ছোট থেকে সবাই তার শান্ত দিক দেখেছে কিন্তু আজ! অন্তিকের এই রূপ সকলের মনে ভীতি সৃষ্টি করে দিয়েছে। ফিরোজ রক্তিম চোখে অন্তিককে দেখে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। কলি দৌড়ে ঘরে পৌছে লায়লা বেগমকে আঁকড়ে ধরে। অন্তিক ঘরে আর প্রবেশ করে না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাচ্ছিল্য করে হেসে বলে,” কারো খারাপ চাইতে গেলে নিজেরই খারাপ হয়। বদ দোয়া মুখে বলতে হয় না নিশ্বাসের সাথেই বের হয়ে যায়, চাচী।”
—————–
” হ্যালো গোলাপি, বরের সাথে ঘুরতে গেলে কোন পাশে হাঁটতে হয়?”
অন্তিকের ফিরতে বেশ দেরী হচ্ছে। মিষ্টি ভাবলো, এই সুযোগে বন্ধুদের খোঁজ খবর নেওয়া যাক। বহুদিন পর প্রিয় বান্ধবীকে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস না করে অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসে। অপর প্রান্ত থেকে গোলাপি নামক মানবী বলে ওঠে, ” আগে আমার নাম ঠিক করে বল, তারপর বুদ্ধি দিব।”
” গোলাপি রাণী! বল না?”
অপর প্রান্ত থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ” প্রথমে বলি, আমার নাম পিংকি। পিংকও যদি নাম হতো তাহলে মনকে আশ্বাস দিতে পারতাম। কিন্তু তুই পিংকি থেকে কেন গোলাপি বানালি আজও বুঝতে পারলাম না।”
মিষ্টি খিলখিল করে হেসে শুধায়, ” তোর গাল শীত নাই, গরম নাই; প্রেমিক নাই, জামাই নাই; লজ্জা নাই, শরমও নই বারো মাসে গোলাপি থাকে তাই গোলাপি ডাকি। এবার বল না!”
পিংকি হতাশ হয়ে উত্তর দেয়, ” বরের ডানেও না, বামেও না একদম বুকের সাথে মিশে থাকবি।”
মিষ্টি চিন্তায় পড়ে যায়। তার বান্ধবী দিনে দিনে তাকে ছাড়াই পেকে যাচ্ছে এটা সে মানতে পারছে না। মিষ্টি দুঃখ ভরা কণ্ঠে বলে, ” তুই একা একাই দুষ্ট হয়ে যাচ্ছিস রে, গোলাপি। আর পাকিস না দোস্ত! আমি আসলে একসাথে পেকে টসটসে হবো। এখন রাখি রে!”
পিংকিকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই মিষ্টি ফোন কে’টে দেয়। এবার সে আরেক বন্ধুকে কল লাগায়, ” হ্যালো মিঠাইওয়ালা, জামাইকে বশ করার কবিরাজের সন্ধান কর তো! আগামীমাসে বাড়ি ফিরলে বিনিময়ে তোকে লজেন্স খাওয়াব।”
” আমার চেয়ে বড়ো কবিরাজ দুনিয়াতে পাবি না রে, মিষ্টি। বাড়ি ফির, পানি পড়া, তেল পড়া জানাই পড়া দিয়ে তোর জামাইকে বশ করব।”
মিষ্টির হাসিমাখা মুখটা তেঁতো হয়ে যায়। রাগে ফুসফুস করে অপর প্রান্তের মানুষটাকে বলে, ” তোর দশ নাম্বার প্রেমিক বিরিয়ানির বদলে তোকে গোবর খাওয়ায় যেন হারামি।”
কথা শেষ করে মিষ্টি বিছানায় ফোন ছুড়ে মারে। পিংকি ও মাধবী তার প্রাণের বন্ধু। তাদের সাথে কথা বললে মুখের ভাষা সংযত করা তার জন্য দায় হয়ে যায়। সে জানে তার দুই বান্ধবী এখন কাঁদছে। মিষ্টিকে কল করার তাদের অনুমতি নেই। পড়াশোনা বাদ দিয়ে অচেনা, অদেখা মানুষের প্রতি ভালোবাসা দেখে দুজনেই তাকে বেশ বুঝিয়েছে। কিন্তু মিষ্টি তাদের পাত্তা দেয়নি। তার লক্ষ্যে এগিয়ে আসে। আর আজ সে অন্তিকের বউ রূপে অবস্থান করছে।
ঘরে ফিরে অন্তিকের অশান্ত মনে শীতল হাওয়া ছুঁয়ে যায়। অন্তিকের বর্ণনানুযায়ী মিষ্টি সেজেছে। নীল শাড়ির সাথে কাজল কালো চোখ, দুই হাতে শোভা পাচ্ছে রেশমি নীল চুড়ি। মাথার অবাধ্য কেশবহুল এলোমেলো হয়ে আছে। অন্তিক এগিয়ে এসে মিষ্টির কোমড় চেপে ধরে। মিষ্টি অন্তিকের আগমন ঠাহর করতে পারেনি খানিকটা চমকে তাকাতেই অন্তিক মিষ্টির অধর যুগল আয়ত্ত করে নেয়। দীর্ঘসময় রসালো ঠোঁটের স্বাদ পরখ করে বলে ওঠে, “বলেছিলাম না, ফিরে এসে কিছু বলব! কৃত্রিম সাজসজ্জায় নয় তোমার ঠোঁট রঙিন করতে আমার স্পর্শই যথেষ্ট। দেখো শুষ্ক ঠোঁট জোড়া গোলাপি হয়ে আছে। তাঁর সাথে লজ্জায় রাঙা হওয়া গালদুটো গোলাপি হয়ে আছে। তোমার এরূপ সৌন্দর্যের কাছে কৃত্রিম সাজসজ্জা ফিকে, চন্দ্রিমা!”
মিষ্টি হতভম্ব হয়ে আছে। অন্তিকের রোমান্টিকের চক্করে তার মাথা দুলছে। সে অন্তিকের বুকে কয়েকটা ঘা বসিয়ে বলে, ” বাহিরে বের হতে হবে না, অন্তু। এখানেই থেকে যাই!”
” মন্দ বলোনি। আচ্ছা, ভিটামিন-এ কী ছেলেরাই আদায় করে নেয়! নাকি তোমার মতো মেয়েরাও আদায় করে!”
মিষ্টি হতবাক। মনে মনে আফসোস করে তার পুরোনো অন্তুর জন্য। ভদ্র অন্তুকে অভদ্র বানিয়ে সে খুব ভুল করেছে। যার মাশুল সে প্রতিদিনই দিচ্ছে।
—————
সময় বাধাবন্ধহীন। মিষ্টির আগমনের আজ চার মাস পাড় হয়েছে। কলি বাঁশের ফলির ছায়া সেদিনের পরেই সরে গেছে। হোস্টেলে চলে যাওয়ার পর লায়লা বেগম আরো পাগলাটে হয়ে গেছে। দিনরাত মিষ্টিকে অপদস্ত করার প্রচেষ্টায় থাকে। মিষ্টি খুবই বুদ্ধিমত্তার সাথে লায়লা বেগমের সব পরিকল্পনা থেকে মুক্ত হয়ে নাকের ডগায় তেল লাগিয়ে চলে ফিরে। বাদ জুম্মায় মিষ্টি রান্না করছিল। আজ খাবার তৈরী হতে দেরী হয়ে গেছে। ইদানীং তার শরীর বেশ খারাপ লাগে। অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠে, মেজাজ খিটখিটে থাকে। লায়লা বেগম লাগতে আসলে মুখে যা আসে তাই বলে বকতে থাকে। আজকেও তার মন মেজাজ খারাপ। বাসায় কেউ নেই তার উপর কাজ এখনো বাকী। এমন সময় মোল্লা বাড়ির কলিং বেল বেজে ওঠে। একবার নয় দুইবার নয় একসাথে বেজেই চলছে তো বেজেই চলছে। মিষ্টির মেজাজ আরো খারাপ হয়ে যায়। সে ধুপধাপ পা ফেলে দরজা খুলে দেয়। বাহিরে অন্তিক দাড়িয়ে আছে। পরিধানে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী ও মাথায় সাদা টুপি। অন্তিকের পাশেই একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মহিলাটির কোলে ফুটফুটে একটি কন্যা সন্তান। বয়স তিন চার বছর হবে। মিষ্টি একবার অন্তিক তো একবার বাচ্চাসহ মহিলার দিকে তাকিয়ে বলে, ” আমি কী তবে তোমার দ্বিতীয়া ছিলাম!”
মিষ্টি কথাটা বলে স্থির থাকতে পারেনি। সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারিয়ে জমিনে লুটিয়ে পড়ে।
চলবে……………….
[ আমার ফুফু পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর প্রিয় হয়ে গেছেন। ফুফুর বাড়িতেই ছিলাম। গল্প দিতে তাই দেরী হয়েছে। ভালো থাকবেন সবাই। আমার ফুফুকে দোয়ায় রাখবেন। আসসালামু আলাইকুম।]