যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয় #আফসানা_মিমি |পর্ব: বারো|

0
240

#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: বারো|

মোল্লা বাড়িতে বিচার বসেছে। নাজিমউদ্দীন গম্ভীরমুখে বসার ঘরে বসে আছেন। দুই পাশে তার দুই ছেলে ফিরোজ এবং কায়েস। ফিরোজের কপাল কুঁচকে আছে যেন জরুরি কোনো কাজ থেকে তাকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। কায়েস নির্বিকার, সমস্ত ঘটনা তার সামনেই ঘটেছে। এমনকি সে পূর্ব থেকেই অবগত যে লায়লা বেগম নিজের দোষ ঢাকতে এবারও কোনো অসহায়ের উপর দোষ চাপিয়ে দিবে। মিষ্টিকে দেখে বুঝা যাচ্ছে সে খুব কান্না করেছে। পিয়াস বিরক্তিকর দৃষ্টিতে মাকে দেখছে। সেও জানে, আজকের দুর্ঘনার কারণ! অভ্যন্তরীণ দিক দিয়ে মোল্লা বাড়ির প্রতিটা সদস্যদের সম্পর্কে সকলেই অবগত কিন্তু কেউ প্রকাশ করে না। নাজিমউদ্দীন গম্ভীরস্বরে বলতে শুরু করেন, ” নাত বউয়ের উপর কী অভিযোগ বউমা। কী করছে সে, তোমার মুখ থেকেই প্রথমে শুনি।”

লায়লা বেগম এই সময়টারই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি তিনার অভিযোগ ব্যক্ত করতে শুরু করেন, ” আমি খারাপ আব্বা, খুব খারাপ। অন্তিক আমার পেটের সন্তান না হলেও তাকে ছেলে ভাবি তো! বউমাকেও আপন ভাবতাম। আব্বা, আমার আপন ভাবাটা বউমা সহ্য করতে পারেনি। বউ হয়েছে, সংসার তার, তারই তো সব দেখে শুনে গোছগাছ করে রাখতে হবে তাই বলেছিলাম ধুয়া কাপড়গুলো কলির সাথে রোদে শুকিয়ে দিয়ে আসতে। কিন্তু বউমা কি করল, আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলল, তুই কাজ কর বুড়ি। আব্বা আপনিই বলেন, আমি খারাপ কিছু বলেছিলাম?”

নাজিমউদ্দীন নিরুত্তর। মিষ্টির দিকে তাকিয়ে বলেন,” তুমি কিছু বলবে, নাত বউ?”

মিষ্টি দুর্বল হেসে বলে, “ সত্য বললে কী বিশ্বাস করবেন দাদা? কেননা এখানে সত্যের চেয়ে মিথ্যার পাল্লা ভারী। সত্য বললেও মিথ্যার জয় হবে, যা পূর্ব থেকেই হয়ে এসেছে।”

কিছুক্ষণের জন্য নাজিমউদ্দীন ও অন্তিক ব্যতীত মোল্লা বাড়ির সকলের চোখ চড়কগাছ হয়ে যায়। সবচেয়ে বেশি অবাক হয় লায়লা বেগম সে ভীতু চোখে স্বামীর দিকে তাকায়। ফিরোজ তখন রাগান্বিত দৃষ্টিতে স্ত্রীকে দেখছে। লায়লা বেগম তুতলিয়ে ধমক দেন মিষ্টিকে, ” মাথা ঠিক আছে? আমরা মিথ্যা বলব কীসের ফায়দায়? তুমিই তো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে।”

লায়লা বেগম কিছুদূরেই দাড়িয়ে ছিল। মিষ্টির কী হলো জানে না। লায়লা বেগমের কাছে এসে বলল, ” চাচী হাতটা এগিয়ে দিন তো?”

লায়লা বেগম সকলের দিকে নজর ঘুরিয়ে ইতঃস্তত হয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়। মিষ্টির মুখে হাসি ফিরে আসে। সে এবার দুষ্ট স্বরে বলে, ” আপনার হাতটা তো খুব শক্ত চাচী!”
এরপর কলির দিকে ফিরে তার উদ্দেশ্যে বলে, ” এই কলি বাঁশের ফলি, এদিকে আসো। চাচীর শরীর কেমন যেন কাঁপছে ধরো তো?”

বোকা কলি তাই করল। লায়লা বেগমের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে তাকে ধরল। মিষ্টি এবার লায়লা বেগমকে ধাক্কা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে। লায়লা বেগম জায়গা পড়ে যাওয়া তো দূরের কথা এক বিন্দু পরিমাণ নড়নি।
মিষ্টি মুখে হাত চেপে হেসে বলে, ” আমি প্র্যাক্টিক্যালি দেখালাম দাদা। এবার বুঝে নিন।”

নাজিমউদ্দীন সহ সকলেই লায়লা বেগম ও কলির দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায়। লায়লা বেগম বুঝতে পেরে বলতে শুরু করে, ” এখানে পানি কোথায়। বাথরুমে পানি, সাবান ছিল বলেই অল্প ধাক্কাতে পড়ে গেছি। এই মেয়ে আপনাদের মিথ্যা গোল খাওয়াচ্ছে।”

” কিন্তু তুমিই তো বললে মা যে, মিষ্টিকে কাপড় রোদে শুকিয়ে আনতে পাঠানোর জন্য বলেছিলে। তোমার কথা অনুযায়ী বাথরুমের কাপড় ততক্ষণে ধুয়া শেষ। আর আমরা সাধারণত কাপড় ধুয়া হলে সাথে সাথে বাথরুমেও পানি ঢেলে দেই।”

পিয়াসের যুক্তির উপরে লায়লা বেগম আর কথা বলতে পারেনি। ছেলের দিকে কটমট দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মনে মনে বলে, ” এ কেমন ছেলে পেটে ধরেছিলাম আমি। যে কি না আমারই বিরুদ্ধে শত্রুতা করে বেড়াচ্ছে !”

মিষ্টির হাসি আরো দীর্ঘ হয়। সে কটাক্ষ করে বলে, ” ঘুমন্ত ব্যাক্তিকে জাগ্রত করা যায়, কিন্তু কোনো জাগ্রত ব্যাক্তিকে জাগ্রত করা কারো পক্ষে সম্ভব হয় না। আপনার থেকে দুর্বল কেউ আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বড়োজোর জায়গা থেকে নাড়াতে পারবে কিন্তু আপনাকে ফেলে দিতে পারবে না যদি আপনি ইচ্ছেকৃতভাবে না পড়েন।”

এতক্ষণ অন্তিক চুপ ছিল। মিষ্টির বুদ্ধিমত্তা দেখে মুগ্ধ সে। তার স্ত্রী নিজেকে নির্দোষ সাব্যস্ত করেছে তার বুদ্ধিতে। অন্তিক মুখ খুলে। সে লায়লা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে, ” এই বাড়ি তোমার স্বামীর সাথে আমার বাবারও। তোমার যেমন এই বাড়িতে বউয়ের অধিকার দেওয়া হয়েছে, আমার স্ত্রীও তেমন অধিকার প্রাপ্য। এ বাড়ি থেকে রুনা চলে গেছে কিন্তু মিষ্টি যাবে না। জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত এ বাড়িতে বউ হয়েই থাকবে। আজই শেষবারের মতো বলে দিলাম, আমার এবং আমার স্ত্রীর উপরে তোমার খারাপ নজর যেন না পড়ে। নয়তো আমার ক্ষমতা দেখিয়ে দিব।”

অন্তিক কথা বলে থামেনি। মিষ্টির হাত ধরে বসার ঘর থেকে বের হয়ে যায়। পিয়াস মায়ের দিকে ফিরে থুতু ফেলে বলে, ” তোমাকে মা ডাকতেও আমার খারাপ লাগছে।তোমার জন্যই আমি বাড়ি ফিরে আসি না।”

পিয়াসও প্রস্থান নেয়। নাজিমউদ্দীন ফিরোজের উদ্দ্যেশ্যে বলে ওঠেন, ” তোমার বউকে সাবধান করে দাও। রুনার সাথে যেই অন্যায় হয়েছে সেই অন্যায় নাত বউয়ের সাথে হতে দিব না।”

নাজিমউদ্দীন প্রস্থান নিতেই ফিরোজ উঠে দাঁড়ায়। স্বামীকে এগিয়ে আসতে দেখে লায়লা বেগম ভীত পায়ে পিছিয়ে যেতে থাকে তার সাথে কলিও ভয়ে মায়ের আড়ালে গিয়ে পেছাতে থাকে। ফিরোজের চক্ষুদ্বয়ে লালচে হয়ে আসে। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে লায়লা বেগমের গালে থাপ্পড় দিয়ে বসে। এরপর লায়লা বেগমের হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে নিজের ঘরের দিকে আগাতে থাকে। কলি বার বার বাবার হাতে পায়ে ধরে ধরছে যেন এই যাত্রায় মাকে ছেড়ে দেয়া হয়। ফিরোজ কলিকে লাথি দিয়ে ফেলে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। কলি বারকয়েক বার দরজায় কড়াঘাত করে মা মা বলে চিৎকার করে কিন্তু লাভ হয় না। ঘরের ভেতর থেকে লায়লা বেগমের আর্তচিৎকারের কাছে কলির আওয়াজ কিছুই না। বসার ঘরে কায়েস তখনো বসা অবস্থায়। সে চুপ করে চেয়ারে বসে জীবনের হতে সাব মিলাচ্ছে। কলিকে আসতে দেখে ভরাট কণ্ঠস্বরে সে বলে, ” পাপ বাপকেও ছাড়ে না। অন্যায় করলে দুনিয়াতে অর্ধেক ফল ভোগ করতে হবে। এটাই নিয়ম।”

কলি কিছু বুঝলো কী না কায়েস তা জানে না। মুখে তৃপ্তির হাসি, চোখে জল নিয়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করে।

———————————–

জমিনে ওড়নার আঁচল ছড়িয়ে মিষ্টির উরুতে অন্তিক শুয়ে আছে। অন্তিক ঘরে প্রবেশ করার পর থেকেই নিশ্চুপ। মিষ্টিকে জমিনে বসিয়ে নিজেই চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। শত ডাকার পরও চোখও খুলেনি,কথাও বলেনি। মিষ্টি মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে শুরু করে, ” আপনার জীবনের গল্প শুনবো,জনাব। শুনাবেন?”

অন্তিক উপুড় হয়ে শুয়ে দুই হাতে মিষ্টির পেটে মুখ গুঁজে দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে, ” কতটুকু শুনবে?”
” পুরোটা।”
“ পুরো জীবন শেষ হোক, পরে বলব।”

মিষ্টি দুম করে অন্তিকের পিঠে আঘাত করে বলে, ” জীবন এতো সস্তা নাকি যে এতো তাড়াতাড়ি মুক্তি পেতে চাও!”

” তুমি জীবনে আসার পর ধূসর রং ভুলে গেছি। প্রতিদিন রংধনুর সাত রঙের মতো রঙিন লাগে। প্রতিদিন নতুন রূপে নিজেকে আবিস্কার করি। প্রতিদিন এক মিষ্টি চন্দ্রিমাকে ভালোবাসি। আমার জীবনে এতটুকু পেয়েই শান্তি। তোমাকে পেয়ে সুখী, আমার মিষ্টি চন্দ্রিমা!”

মিষ্টি লাজরাঙা অঙ্গে সর্বাঙ্গে। অন্তিকের পিঠে আঁকিবুঁকি করে কিছু একটা লেখে অন্তিককে বলে,” বলো তো,কী লেখেছি?”
অন্তিক মিষ্টির নাভিতে গভীর চুমু খেয়ে বলে, ” ভালোবাসি।”
মিষ্টি খিলখিল করে হাসতে থাকে। অন্তিক আবার বলে ওঠে, ” উত্তর দাও?”
” লিখিত জবানবন্দি ভেবে নাও, প্রিয়!”

অন্তিক মিষ্টির কোমর আরেকটু চেপে ধরে। পর পর কয়েকবার উদরে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে, ” তোমাকে কিছু বলতে চাই, চন্দ্রিমা!”

মিষ্টি চোখ বন্ধ অবস্থায় ছিল।অন্তিকের ছোঁয়ায় সে অন্য জগতে চলে যায়। যেখানে সে এবং তার ভালোবাসার মানুষ বাস করে। অস্পষ্ট স্বরে উত্তর দেয়, ” অনুমতি তার থেকেই নিতে হয় যার কাছে তুমি অপরিচিত বা যারা গুণিজন তাদের থেকে। অথচ আমি তাদের একজনও নয়! প্রত্যেক স্ত্রীর কাছে স্বামীরা বুঝি অনুমতি নিয়েই কথা বলে?”

কথা শেষ হতেই মিষ্টি পেটের মধ্যে ব্যথা অনুভব করে। সে সাথে সাথে অন্তিকের চুল ধরে নিজের দিকে ফিরায়। অন্তিকের চোখে মুখে অন্যরকম নেশা। মাতাল চোখে হাসছে সে। চোখগুলো লাল টকটকে। মিষ্টি বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, ” কী হলো! আমি কী ভুল বলেছি?”

অন্তিক উঁচু হয়ে মিষ্টির নাকে কামড় বসিয়ে উত্তর দেয়, ” অনেক বরো ভুল করেছো,চন্দ্রিমা! আমার বুকে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছো। সেই আগুনে দগ্ধ হয়ে আমি জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাচ্ছি।”

” পানি নিয়ে আসবো?”
হাতের কাছেই পানির জগ ছিল। মিষ্টি সেটা হাতে নিয়ে বলে, ” ঢেলে দেই?”

” এ আগুন পানি দিয়ে নিভবে না পাগলী! এর ঔষধী শুধু তোমার কাছেই আছে।”

মিষ্টি লজ্জায় রাঙা হয়ে হাত দ্বারা মুখ ঢেকে নেয়। অন্তিক জীবনের এই মুহূর্তটাকে স্পেশাল করতে মিষ্টির মাথায় ঘোমটা টেনে দেয়। প্যান্টের পকেট থেকে সোনার একটি আংটি বের করে বলে, ” আমার জীবনে আগমনের জন্য তোমার প্রথম উপহার,চন্দ্রিমা।”

মিষ্টি অন্তিককে জড়িয়ে ধরে। মুখে তার হাসি।অন্তিকের কাঁধে চুমু খেয়ে বলে, ” হয়তো তোমার জীবন রাঙাতেই আমার ভাগ্য এখানে নিয়ে এসেছে। আজকের মুহূর্তটা থেমে থাকুক, অন্তু! আমার শুধু অন্তু চাই, আর কিছুই না।”

মিষ্টিকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় অন্তিক। দিবালোকের আলোয় মন ভরে দেখে নেয় নব বঁধুর মিষ্টি হাসি। সর্বাঙ্গে লাজের অধিকারী মিষ্টির ঠোঁট জোড়া আয়ত্ত করে নেয়। এরপর! এরপর নব বঁধুর লাজরাঙা মুখশ্রীতে দৃষ্টি রেখে বলে, ” আমার ধ্যান মন প্রাণ সব উজাড় করে দিলাম, চন্দ্রিমা! আজকের দিবালোক শুধুই তোমার আমার।”

চলবে……………..

[সবাইকে নতুন বছরের অগ্রিম শুভেচ্ছা। হ্যাপি নিউ ইয়ার ২০২৪]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here