যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয় আফসানা_মিমি পর্ব: ১১

0
256

#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
আফসানা_মিমি
পর্ব: ১১

মিষ্টির রাগ ঊর্ধ্বে। এ রাগ নিবারক ঔষধি নেই। অন্তিকও আজ ভীতু ছানা মিষ্টির রাগের সামনে। মিষ্টি পাকেরঘরে দুধ গরম করতে গিয়েছিল। ঘরের সাজসজ্জাকরণ তারই করা। অন্তিকের অসহায়ত্ব নয়নও তার নজরে আসছে না। সে রাগে গর্জে উঠে, “ তোর মতো নির্লজ্জ মেয়ে আমি কোথাও দেখিনি, কলি ক্যাকটাস গালের ফলি।”

কলিকে ঝাড়া দিয়ে ফেলে অন্তিক দাঁড়িয়ে পড়ে। কলির আজকের সাজসজ্জা নতুন নয়। অন্তিকের বিয়ের আগেও প্রায়শই রজনীতে সেজেগুজে তার ঘরে বসে থাকতো। কোনোদিন অন্তিক বুঝতে পেরে নিচে বাবার সাথে ঘুমাতে যেত আবার কোনদিন কলিকে দুই চারটে কথা শুনিয়ে ঘর থেকে বের করে দিত। কলির বেহায়াপনা দিনদিন বেড়েই যাচ্ছিল তাই হোস্টেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অন্তিক ভেবেছিল বিয়ের পর কলি ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু তার ভাবনা ভুল প্রমানিত হয় আজকের কলির কাজে। সে মিষ্টির মতো গর্জে ওঠে, “ কথা বলছিস না কেন? তোর এখানে কী কলি?”

কলি এবার মুখ খুলে। অন্তিকের দিকে তাকিয়ে বলে,“ আমার তোমাকে চাই, অন্তিক ভাই! তুমি আমাকে বিয়ে করে নাও না!”

অন্তিকের চোখ লালচে রূপ ধারণ করেছে সে কলির গালে থা’প্প’ড় বসিয়ে বলতে শুরু করে, ” তোর মাথা ঠিক আছে? ভাই বোন নামক সুন্দর সম্পর্ককে তোর জন্য নষ্ট করেছি তা জানিস? আমি একা ছিলাম, তোকে আর পিয়াস ভাইয়াকে ভাইবোন ভাবতাম কিন্তু তুই! এই সম্পর্কটা নষ্ট করেছিস। বুঝদার হয়েও অবুঝের মতো কাজ করছিস। তোর মাথায় আমাকে পাওয়ার লোভ! আমি কী কোনো পন্য? পৃথিবীতে আম ছাড়া আর কোনো ছেলে নাই? আমাকে ভাই ভাবলে কী এমন হতো! তোকে আপন বোনের মতো আদর করেছি সর্বদাই। এখনও সময় আছে কলি, ভালো হয়ে যা। পূর্বে যা করেছিস তা সংশোধন করে সঠিকপথে ফিরে আয়। ভাই বোন নামক সুন্দর সম্পর্ককে হাসি মজা খেলায় রূপান্তর করিস না।”

কলি কী বুঝেছে জানা না গেলেও মিষ্টির রাগ এই মুহূর্তে পানি হয়ে গেছে। সে ভাবছে, মানুষটা এত সুন্দর করে বুঝাতে পারে! কলি অন্তিকের দিকে ক্রন্দনরত অবস্থায় তাকিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বের হতে নিয়ে মিষ্টিকে দেখে থেমে যায়। মুখশ্রী তার রক্তিম চোখজোড়ায় কঠোরতার ভরপুর। মিষ্টির উদ্দেশ্যে বলে, “ এই কলি তোকে কখনো অন্তিকের হতে দিবে না।”

কলি চলে যেতেই মিষ্টি অন্তিকের দিকে এগিয়ে আসে।হাতের গ্লাস টেবিলের উপর রেখে বলে, ” কয়লা যেমন হাজারবার ধুয়ে মুছলেও পরিষ্কার হয় না তেমনি তোমার বোন ও চাচী কখনো ভালো হবে না, অন্তু।”

অন্তিক ভাবনায় পড়ে। তার মা চলে যাওয়ার পর থেকে কাউকে পাশে পায়নি। চাচী সর্বক্ষণ ভয় ও হুমকির মধ্যে রাখতো। সেও চাচীকে মানতো বলেই মীরবে সব সহ্য করতো। কিন্তু কেন সব সহ্য করতো? তার পাশে কেউ ছিল না বলে? একাকীত্ব তাকে অন্ধকার কালকুটুরীতে আবদ্ধ করে রেখে তার মনকেও ভয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছে। মিষ্টি অন্তিকের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে পাশে এসে দাঁড়ায়। অন্তিকের কাঁধে হাত রেখে বলে, “ ভয়কে জয় করতে শিখো,অন্তু! আপনজনের মাঝের শত্রুকে প্রশ্রয় দিও না। তুমি দুর্বল হলে অপরপক্ষ সারাজীবন তোমাকে ডুবাতে থাকবে, একসময় তুমিও তলিয়ে যাবে।”

অন্তিক মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে। মিষ্টির কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে, “ তুমি কেন আরো আগে আমার জীবনে আসলে না, মিষ্টু!”

——————————-

লায়লা বেগম রাগে গড়গড় করছেন। তার কারণ কলি। সকালে থেকেই মেয়েটা বিনা কারণে উলটা পালটা কাজ করছে। যেই মেয়ে কখনো কাপড় ভাজ করা তো দূরের কথা ধুয়েও দেখে না সে আজ নিজের কাপড়ের সাথে সাথে লায়লা বেগমের কাপড়ও ভিজিয়েছে। জিজ্ঞেস করলেই বলছে, “ মায়ের কাজ করলে কী ক্ষতি হয়?”
লায়লা বেগমের বুঝে আসছে না তিনার অকার্যকরী মেয়ে কীভাবে কর্মঠ হয়ে গেল। নির্বোধ মেয়েটাকে এনেছে সে মিষ্টিকে তাড়ানোর জন্য কিন্তু তার মেয়ে কি না পাগলামি করছে!

মিষ্টি এই পথেই যাচ্ছিল, মা মেয়ের অবস্থা দেখে পেট চেপে হাসতে শুরু করে। কাছে এসে শুধায়, “ কাজ করলে হাত পা, শরীরের সাথে মনও পরিস্কার হয়ে যায়। চাচী আপনিও হাত লাগান, কলি বাঁশের ফলির কষ্ট হচ্ছে তো!”

লায়লা বেগম রাগে ঝাড়ি দেয় মিষ্টিকে, “ অসভ্য মেয়ে, যাও এখান থেকে।”

মিষ্টি হাসতে হাসতে চলে যেতে নিতেই পিছন থেকে কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজ শুনতে পায়। মিষ্টি পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখতে পায়, লায়লা বেগমকে বাথরুমে পড়ে আছে। কলি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপরাধবোধ মুখশ্রীতে ছেঁয়ে আছে তার। মিষ্টি দৌঁড়ে গিয়ে লায়লা বেগমকে ধরে। কলির মায়ের দিকে তাকালে মায়ের শয়তানী হাসি নজরে আসে। কলিও মায়ের হাসির তালে হেসে গগনবিদারী চিৎকার করে উঠে,“ ও আল্লাহ গো! কে কোথায় আছো! নতুন ভাবী মাকে মে’রে ফেলছে গো!”

কায়েস ও পিয়াস বাড়িতেই ছিল। কলির চিৎকার শুনে এসে দেখতে পায়, মিষ্টির কোলে লায়লা বেগম শায়িত অবস্থায় পড়ে আছে। পিয়াস ও কায়েসকে দেখে গলার স্বর আরো বাড়িয়ে আহাজারি করতে থাকে, “ দেখো চাচা, দেখো ভাইয়া, মা নতুন ভাবীকে বলেছিল শুধু আমার সাথে কাপড়গুলো রোদে দিতে। ভাবী কাজ করতে না চাইলে সুন্দর করেই বলতো তা না করে মাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিছে। ও আমার কী হবে গো! মা ও মা চোখ খুলো মা!”

কলির আহাজারি শুনে মিষ্টি ভ্রু যুগল কুঁচকে কলির দিকে তাকায়। তার চেহারায় ভয়, চিন্তা কিছুই নেই। অপরাধীরা অপরাধ করলে মুখশ্রী দেখে ধরা পড়ে যায় মিষ্টি মুখশ্রী দর্শন করলে অপরাধের কোনো আলামত পাওয়া যাবে না। পিয়াস মাকে ধরে ঘরে নিয়ে আসে। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে জ্ঞান ফিরাতে চেষ্টা করতে থাকে তখন কলি আবারও বলতে শুরু করে,“ ভাবীকে মা কতো আদর করতো! আর ভাবী কী করল, মাকে মে’রে ফেলতে চাইলো; ও ভাবী তোমার মনটা কী একটুও পোড়ায়নি?

কলির কথার প্রত্ত্যুত্তরে মিষ্টি শান্ত স্বরে বলে, “ অপরাধীরা অপরাধ করে সবসময় অন্যের উপরই দোষ চাপিয়ে দেয়। চাচীর মতো পালোয়ান মহিলাকে আমার মতো শুঁটকি কী ধাক্কা দিতে পারবে?”

মিষ্টির কথাটা হাস্যকর শোনা গেলেও ভুল বলেনি। কায়েস নিজেও জানে, মিষ্টি এরূপ কাজ কখনোই করতে পারে না। লায়লা বেগমের স্বভাব সম্পর্কে অবগত আছে তার। নিজের সার্থ হাসিল করার জন্য কতোটা নিচে নামতে পারে তাও জানা আছে। কলির আহাজারি থামছেই না একসময় পিয়াস জোরে ধমক দেয় কলিকে।
” তোর ম’রা কান্না বন্ধ করবি, কলি? মায়ের কিছু হয়নি, ভয়ে অজ্ঞান হয়েছে মাত্র। আমি ফার্মেসির নুরুলকে ডেকে নিয়ে আসি।”

পিয়াস চলে যেতেই কলি তেড়েমেড়ে আসে মিষ্টির দিকে। মিষ্টির হাত ধরে জমিনে ফেলে দেয় সে। কিড়মিড় করে বলতে শুরু করে,” আমার অন্তিককে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিস, তোর জীবন আমি নরক করে ছাড়বো।”

মিষ্টির রাগ হয়। শরীর কাঁপুনির মতো রাগ। কায়েস তখন সামনেই ছিল। শ্বশুর বাবাকে উপেক্ষা করে মিষ্টি উঠে কলির হাত মুচড়ে ধরে বলে, “ মিথ্যা অভিযোগ এই মিষ্টি পছন্দ করে না। দোষ আমার হলে অবশ্যই স্বীকার করব ক্ষতিপূরণও দিব। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ছড়ালে তোমাকে শেষ করে দিব কলি বাঁশের ফলি।”

কলিকে ফেলে মিষ্টি হনহনিয়ে বাড়ির বাহিরে চলে আসে। অন্তিক অফিসে সকালেই গেছে। এই মুহূর্তে ফোন করা ঠিক মনে হয়না তার কাছে। সে মোল্লা বাড়ির পিছনের জামরুল গাছের আড়ালে গিয়ে কান্না সংবরণ করার বৃথা চেষ্টা করে। আমরা মেয়েরা সাধারণত কোমল হৃদয়ের হয়ে থাকি। যতোই লোকজনের সামনে নিজেকে সাহসী অথবা শক্ত করতে চেষ্টা করি না কেন। দিনশেষে আমাদের কোমলপ্রাণ গলে নরম হয়ে যায়। পুরো পৃথিবীর সামনে সাহসী সাজলেও আড়ালে নিজেকে একাই মনে হয়।মিষ্টির ক্ষেত্রেও তাই! গোটা একটা পরিবারের সামনে সে সাহসী নারী কিন্তু অন্তরস্থ তো তার কোমল, নমনীয়! সেও চায় একটু আদর, একটু সোহাগের। কেউ তাকে মা বলে ডাকুক, কেউ তার মাথায় হাত রাখুক। বাবা মা ছাড়া একাকী সে নিজের ও অন্তিকের জন্য লড়াই করেই যাচ্ছে দিনের পর দিন। আজকের ঘটনায় মিষ্টির মনকে অভ্যন্তরীণ দিক দিয়ে দুর্বল করে তুলেছে। এই মুহূর্তে তার একজন আপনজন প্রয়োজন যার বুকে মাথা গুঁজলে সে শান্তি পাবে।

সময় তার যায় পার হতে থাকে। কতোটা সময় মিষ্টি সেভাবে ছিল জানা নেই। পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চেতনা ফিরে আসে। বিপরীত মানুষটাকে কলি মনে করে আঘাত করতে গেলেই অন্তিকের মুখশ্রী দেখতে পায় সে। সময় বিনষ্ট না করে মিষ্টি অন্তিকের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। মনের যতো দুখ যাতনা এই বুকে মাথা রেখেই মুর্ছে নেয় সে। অন্তিক মিষ্টির কান্নার আওয়াজ পেয়ে বিচলিত হয়ে যায়। মিষ্টি পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করে। মিষ্টি শান্ত হয় না। অগত্যা অন্তিক মিষ্টিকে পাঁজা কোলে তুলে এক জায়গায় গিয়ে বসে। অন্তিকের বুকের সাথে মিষ্টি তখনো লেপ্টে। পর পর মিষ্টির মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে যাচ্ছে। মিষ্টি কিছু সময় পর শান্ত হয়, অন্তিকের কাছ থেকে দূরে সরতপ নিতেই বাঁধা প্রদান করে সে। মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে ভরাট কণ্ঠস্বরে বলে, “ আজ যা যা ঘটেছে, সব আমাকে জানাও। একটা কথাও গোপন করবে না বলে দিলাম।”

অন্তিকের এরূপ আচরণের সাথে মিষ্টি পূর্ব পরিচিত। সে পুরো ঘটনা জানায়।অন্তিক তখন রাগে কাঁপছে।যেই কাজ তার করার কথা ছিল তা মিষ্টি করছে এবং কষ্টও পাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে সে রাগ সংবরণের চেষ্টা করে। মিষ্টির কপালে চুমু এঁকে বলে,” আমার জীবনের একটি বিশেষ সত্যি চাচী জানে বলে এতদিন চুপ ছিলাম। অন্যায় না করেও নত হতাম। আজ মনে হচ্ছে, এসব করে চাচীকে সুযোগ করে দিয়েছিলাম এতদিন। আর না, তোমার সাথে করা প্রতিটা অন্যায় চাচী এবং কলিকে শাস্তি পেতেই হবে।”

মিষ্টি হতবিহ্বল দুর্বল দৃষ্টিতে অন্তিককে পর্যবেক্ষণ করে।সে মনে মনে ভাবে, ” মানুষটা কী তার সেই ভোলা ভালা, গাধা স্বামী, যাকে ভালোবেসে সে বিয়ে করেছে? একদিনে এতোটা পরিবর্তন হলো কীভাবে?”

চলবে………………..

[লোডশেডিংয়ের জন্য গল্প দিতে দেরী হয়েছে, দুঃখিত]

#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here