#তোমায়_যবে_পাই_দেখিতে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১২
(প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
প্রিয়ন্তি ভড়কে গেলো। মানুষটা এতো রোমান্টিক কবে হলো! আগে তো হাত পর্যন্ত ধরতো না। অবশ্য পরিস্থিতি বদলায় সাথে মানুষও। দূরে থাকতে থাকতে হয়তো অনুভূতি আরো গাঢ় হয়েছে। দু’জনে এতটা কাছাকাছি যে একজন আরেকজনের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। প্রিয়ন্তি কাঙ্ক্ষিত কিছু পাওয়ার আশায় চোখ বন্ধ করে ফেললো। কিন্তু মিনিট পাঁচেক পরেও যখন তেমন কিছু ঘটলো না তখন চোখ মেলে দেখলো তিয়াস তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। লজ্জায় তিয়াসের বুকে সজোরে কয়েকটা ঘুষি মারলো প্রিয়ন্তি। তাতে তিয়াসের হাসির মাত্রা দ্বিগুণ হয়েছে। কোল থেকে নেমে দু’হাতে কফির কাপ ধরে ঘনঘন চুমুক দিতে শুরু করলো প্রিয়ন্তি।
” পেটে ক্ষিধে মুখে লাজ! অধৈর্য প্রিয় আমার, আমার ওষ্ঠের স্পর্শ খুব করে চাচ্ছিলে বুঝি?”
” চুপ করো তুমি। অসভ্য হয়ে গেছো খুব। যাও যাও এখম বাসায় যাও।”
প্রিয়ন্তি ভীষণ লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে। কথাও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এই মুহুর্তে তিয়াস চোখের আড়ালে গেলেই মঙ্গল।
” এমনিতেই যাবো এখন। রাত হয়েছে ভালোই, আঙ্কেলও ফিরে আসবে এখুনি। ”
” পরে দেখা হবে, এসো।”
প্রিয়ন্তি দৃষ্টি মাটিতে রেখেই কথা বললো। তিয়াস ঠোঁটের কোণে হাসির টুকরো নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।
” ভাইয়া ভাবিকে খুব মিস করছি আমি। ”
খাবার টেবিলে হঠাৎ প্রিয়ন্তির কথা ওঠায় মন খারাপ হয়ে গেলো আবরিশামের মায়ের। আনহা এতটুকু সময় প্রিয়ন্তিকে খুব আপন করে নিয়েছিলো। আবরিশাম চুপ রইলো কিয়ৎক্ষণ।
” আচ্ছা আনহা অর্ষাকে কেমন লাগে তোর? ”
হঠাৎ অর্ষার কথায় চমকালো সবাই। আবরিশামের বাবা ব্যবসার কাছে অন্য শহরে গেছেন। বাসায় এখন তিনজন। আনহার চোখমুখ নিমিষেই কেমন চকচক করে উঠলো। অর্ষা ভীষণ মিশুক স্বভাবের মেয়ে। সবাই তাকে শান্তশিষ্ট মেয়ে বলেই চেনে। তাই এমন মানুষকে অপছন্দ করার কোনো কারণ নেই আনহার। ছোটো থেকেই অর্ষাদের বাড়ি গেলে আনহাকে নিয়ে প্রচুর ঘুরতে যেতো। আনহাকে কোলে নিয়ে সবুজ ধান ক্ষেতের আইল ধরে হেঁটে যেতো বাড়ির সামনের রাস্তায়। সেখানে গিয়ে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের সাথে দু’জনেই লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠতো।
” হঠাৎ অর্ষা আপুর কথা বললে?”
” হ্যাঁ রে আসলেই তো। ওর কথা বললি কেনো?”
” তুমি মামা-মামীকে বলো আমি অর্ষাকে বিয়ে করতে চাই। ”
” কী! তোদের মধ্যে কি আগে থেকেই সম্পর্ক আছে?”
” না মা। প্রিয়ন্তি নিজের ইচ্ছেতে গেছে। আমার অর্ষার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। ”
আবরিশামের মা চুপ রইলেন। আনহার মনটা নিমিষেই কেমন খুশি খুশি লাগছে। অর্ষা আপুকে সব সময় সাথে রাখতে পারবে ভাবতেই এই খুশি।
” ঠিক আছে। সবে তো তোর ডিভোর্স হলো,কয়েকদিন পর না হয় বলবো। আপনজন তো বুঝিয়ে বললে বুঝবে সবকিছুই। ”
” ঠিক আছে, মা।”
আনহার খুশি খুশি মুখ দেখে আবরিশাম হেসে বললো,
” কী রে এখন খুশি তো?”
” ভীষণ। ”
ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বললো আনহা।
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে প্রিয়ন্তি মায়ের সাথে কথা বলেছে কিছুক্ষণ। কিন্তু মায়ের কথায় এটুকু বুঝতে পেরেছে উনার মনটা ভালো না। প্রিয়ন্তি অর্পার সাথে যতবারই রেজওয়ানকে নিয়ে বলতে গেছে অর্পা ততবারই মেয়ের সাথে রেগে গেছে। আসলে মানুষ একবার মন থেকে উঠে গেলে কিছুতেই আর আগের মতো মনে বসতি গড়তে পারে না। মানুষের অবহেলায় তার প্রতি সমস্ত অনুভূতির মৃত্যু ঘটায়। রেজওয়ান প্রতিদিন নিয়ম করে একবার তিয়াসের বাড়ির সামনে গিয়ে অপেক্ষা করে। তিয়াসের সাথে কথা বলে চলে আসে। অর্পা রেজওয়ানের সামনে পর্যন্ত আসে না। ঘরটা খালি খালি লাগে অর্পাকে ছাড়া। ঠিক কী করলে যে প্রিয়ন্তির মা ফিরবে বুঝতে পারছে না।
ঘড়িতে সময় রাত এগারোটা। উঠোনে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে তিয়াস। আজকের চাঁদটা ভীষণ সুন্দর দেখতে। প্রায় চাঁদ দেখে সে। এতো সুন্দর মোহনীয় চাঁদের স্নিগ্ধ আলো যে চোখ সরছে না। হঠাৎ ফোনের রিংটোনে ধ্যান ভেঙে যায় তিয়াসের। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো মামার নম্বর থেকে কল এসেছে। এতো বছর পর মামার কল আসায় কিছুটা অবাক হলো তিয়াস। কোনো আপদবিপদ হলো কী না ভাবতে ভাবতে দ্রুত কল রিসিভ করলো তিয়াস।
” আসসালামু আলাইকুম মামা,কেমন আছেন? ”
” ওয়া আলাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ, তুই কেমন আছিস?”
” আমিও ভালো। হঠাৎ কল দিলেন! সবকিছু ঠিক আছে? ”
” হ্যাঁ বাবা সবকিছু ঠিক আছে। তোর মামি অনেক দিন ধরে বলছিলো কল দিতে কিন্তু ব্যস্ততার জন্য আর হয়ে উঠছিলো না।”
” ওহ আচ্ছা। ”
” তা একবার তো আসতেও পারিস অভাগা এই মামার বাড়িতে। কত বছর দেখিনি তোকে। ”
তিয়াস তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। কিন্তু নিঃশব্দে। গিরগিটির চেয়েও মানুষ মনে হয় বেশি রঙ বদলায়। আজকে নিজের একটা মোটামুটি শক্ত জায়গা হয়েছে বলেই যে মামার এতোটা দরদ তার প্রতি,সেটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তিয়াসের।
” সময় হবে না মামা,খামারে কাজ থাকে। তাছাড়া নতুন জমি রাখবো কয়েকদিনের মধ্যে। সবকিছু নিয়ে ব্যস্ততা দারুণ। তোমরা এসো বরং।”
” তোর নিজের বাড়ি হলে যাবো। তোর খালার বাড়িতে আমরা গেলে কি বিষয়টা ভালো দেখায়!”
” উনারা ভীষণ ভালো মানুষ। কিছু মনে করবেন না। রাখছি এখন,ভালো থেকো।”
” তুইও ভালো থাকিস।”
” বুঝছো নিতু,ছেলেটার মনে বড়ো কষ্ট। ছোটবেলার আচরণ ভোলেনি সে।”
ফোনে কথা বলা শেষ করে পাশে শোয়া স্ত্রী’র দিকে তাকিয়ে বললো জসিম। নিতু সহসাই রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,
” তুমি রাখো তোমার কষ্ট, কীভাবে তোমার ভাগ্নেকে বশ করবে সেটা ভাবো। যেভাবেই হোক আমার পরিকল্পনা সফল হওয়া চাই। ”
জসিম স্ত্রী’র কথার পিঠে কোনো কথা বললো না। এই মহিলা বড্ড জেদি ও একগুঁয়ে স্বভাবের। তাই বরাবরই চুপচাপ স্ত্রী’র জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয় জসিম। উল্টো দিকে ফিরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে জসিম। বয়স তার পঞ্চাশের আশেপাশে কিন্তু বয়সের তুলনায় মাথার চুলগুলো একটু অস্বাভাবিকভাবে সাদা হয়ে গেছে। আর তার স্ত্রী নিতু বলতে গেলে আগুন সুন্দরী। বয়স চল্লিশ হলেও দেখে মনে হয় না সেটা। মাধবী ও নয়ন তাদের দুই সন্তান। তাদের নিয়েই সংসারের সুখদুঃখ আবর্তিত হয়।
প্রতিদিন একবার দেখা করা,টুকটাক গল্প করা,একটু আলিঙ্গনে বেশ ভালো কাটছে তিয়াস ও প্রিয়ন্তির সময়। এরমধ্যে সবাই মিলে জমি কিনার জন্য গিয়েছিল। প্রিয়ন্তির পছন্দমতো একটা অবস্থানেই জমি কেনার সিন্ধান্ত নিয়েছে তিয়াস। অর্পা আর রেজওয়ানের মধ্যে বুঝি আর কিছু ঠিক হওয়ার নয়। অর্পা কিছুতেই রেজওয়ানের নাম পর্যন্ত সহ্য করতে পারে না। সেই নিয়ে আশেপাশের লোকজন কতকিছু বলে ইদানীং। কেউ কেউ তো এটাও বলে,মা যেমন তার মেয়েও তেমন। মা যেরকম সংসার ছেড়ে অন্যত্র গিয়েছে মেয়েও তালাক নিয়ে ঘরে বসে আছে। শুধু বসে থাকলেও হতো! এসে থেকেই অন্য একটা ছেলের সাথে লটরপটর শুরু করে দিয়েছে। অর্পার ভীষণ খারাপ লাগে এসব শুনে। যদিও তিয়াসের খালা,খালু,ও তিয়াস লোকের কথায় কান দিতে বারণ করেছে তাকে কিন্তু কষ্ট তো লাগেই! যখন রেজওয়ান এতো অন্যায় করলো তখন তো কোনো লোকজন এভাবে উঠেপড়ে লাগেনি। পুরুষ মানুষ করলে সাত খুন মাফ আর মেয়ে মানুষ করলেই দোষ? তা-ও অর্পা তো রেজওয়ানের মতো অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়ায়নি। শুধু নিজের মতো থাকার চেষ্টা করছে। শুধুমাত্র মেয়ে বলেই কি নিজের মতো করে বাঁচার অধিকারও দিবে না সমাজ?
” বলছিলাম কি খালামনি একবার মামার বাড়ি যাবো।”
দুপুরের খাওয়াদাওয়া চলছে। মুজিবুর আর তিয়াস খাচ্ছে। অর্পা আর তিয়াসের খালা পাশে বসে আছে। উনারা আগেই খেয়েছেন। কাজ করতে দেরি হওয়ায় তিয়াসদের খেতে একটু দেরি হলো।
” হঠাৎ মামার বাড়ি যাবি? কিছু হয়েছে? ”
মুজিবুর বিস্ময় মিশ্রিত নয়নে তিয়াসের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো।
” কিছু হয়নি। কিছুদিন ধরে কল দিচ্ছে মামা,মামিও কথা বলেছেন কয়েকবার। যাইহোক, উনারা তো আমার মায়ের বংশের লোক। ”
” তোর যদি মনে হয় যাওয়া উচিত তাহলে যাবি।”
তিয়াসের প্লেটে এক চামচ তরকারি দিয়ে বললেন খালামনি।
” সামনের সপ্তাহে যাবো। ”
অর্পা চুপচাপ শুনলো সবার কথা। কেনো জানি তিয়াসের মামার বাড়িতে যাওয়ার বিষয়টা ভালো লাগেনি উনার। কিন্তু সেসব নিয়ে কিছু বলা ঠিক মনে হলোনা অর্পার।
চলবে,
আগের পর্বের লিংক https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=372282772119341&id=100080128645410&mibextid=Nif5oz