ফোনে একটানা রিং বেজে চলেছে।কল রিসিভ করবেনা বলে নিরু ফোনটা উপর করে রেখে ওয়াশরুমে চলে গেল।ওয়াশরুম থেকে এসে হাত মুখ মুছে বিছানায় বসে ফোনটা নিয়ে দেখে এখনও রিং বেজে চলেছে।এই একটা মানুষের কল মন প্রাণ দিয়েও নিরু এড়িয়ে যেতে পারেনা।যতভাবেই চেষ্টা করুক না কেন শেষ পর্যায়ে ফোনটা হাতে উঠেই যাবে।নিরু বুঝে উঠতে পারেনা,এখনও ওই মানুষটার কি দেখে এতো ভালবাসে।মনের মধ্যে কেন এত জায়গা নিয়ে বসে আছে।নিজেকে আর কবে সামলাতে পারবে?
নিরুর মসৃণ গাল বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। কোন রকম চোখের জল মুছে নিরু ফোনটা হাতে নিল।হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কল কেটে গেল। ‘নাহ নিরু তো কল ব্যাক করবে না।কখনোই না।এতটাও দূর্বল তুমি নও নিরু।’
বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে টানা একটা শ্বাস নিয়ে নিরু উঠে দাঁড়ায়।বিছানা গোছাতে হবে।অনেক দিন হলো বিছানা গোছানো হয় না। ঘরটা ভাপসা গন্ধ, কতদিন যেন হলো ঘরে আলো বাতাস আসে না।এইভাবে আর কতদিন, গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা উচিত।নিরু বিছানা গোছাবে বলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ফোন ওয়ারড্রবের উপরে রাখতেই আবার রিং বেজে ওঠে।নিরু এবার কলটা রিসিভ করেই ফেলল।
_ হ্যালো! কি সমস্যা আপনার, এতো কেন জ্বালান?
_ আমি তোকে জ্বালাই নিরু?
_ নিরু নয়।অনিমা রহমান বলুন।
_ এতো কঠিন হওয়ার ভান ধরছিস কেন?
_ আসাদ ভাই,আপনার কী মনে হয় আমি কঠিন না?
_ প্লিজ নিরু! আমাকে বোঝার চেষ্টা কর।আমি আর এইভাবে থাকতে পারছিনা।পাগল পাগল লাগে।আমার সেই চঞ্চল নিরুকে চাই।
_ আসাদ ভাই, নিরু আর সেই আগের নিরু নেই।আর না আছে তার চঞ্চলতা।আর না আছে তার একান্ত নিজের সেই আসাদ ভাই।এখন নিরু আর সেই ছোট্ট নেই।বাই দ্যা ওয়ে আপনার মিহিদানা চঞ্চল নয়।
_ নাক টানছিস কেন নিরু।তোর কি ঠান্ডা জ্বর হয়েছে?আমি কি ঠান্ডার ঔষধ নিয়ে আসবো।আমি গেলে অবশ্য ঠান্ডার ঔষধ লাগবে না।আমি তোর সব ঠান্ডা নিমিষেই সারিয়ে দেবো নিরু।আসিনা প্লিজ!
_ ছি আসাদ ভাই! আপনি এতো অসভ্য কেন ?
– একদম ছি ছি করবিনা নিরু।তুই কি ভুলে গেছিস মাঝরাতে ছাঁদের রেলিঙে বসে কতবার তোকে জড়িয়ে বসে থেকেছি।
– আপনি ভয়ংকর পীড়াদায়ক মানুষ আসাদ ভাই।
– কতদিন দিন হলো তোর ঠোঁটে আমার ঠোঁট ভিজে না।আমার ঠোঁট শুকিয়ে শুকনো খড়খড়ে পাতার মতো হয়ে আছে। আমি তোকে আবারও চুমু খেতে চাই নিরু।আসিনা প্লিজ!
– আপনার মতো অসভ্য বেহায়া মানুষ আমি ইহজন্মে দেখিনি।এখন অন্তত মুখে বেড়ি দেন।
– তোর কাছে আমার ওতো বেড়াবেড়ি দেওয়ার কি আছে।আমি কতকাল হলো তোর ঠোঁট ছুয়ে তাকিয়ে থাকতে পারিনা।আমার কষ্টটা বুঝিস তুই।আমি তোর ঠোঁট ছুঁতে না পেরে শুকিয়ে যাচ্ছি।
– চুপ করবেন।
– শোন না আমি ট্রেনিং করেও এতোটা শুকোয়নি,যতটা শুকিয়েছি তোকে চুমু না খেতে পেরে।
– এতোটা অসভ্য ও মানুষ হয়।
– দেখ নিরু গুণে গুণে এক বছর চার মাস সতেরো দিন আট ঘন্টা তোকে আমি চোখে দেখিনি।সেকেন্ডটা অবশ্য মনে নেই।যেখানে তোকে আমি চোখেই দেখিনি। সেখানে অসভ্যতার কি করলাম।তুই তো জানিস চোখের সামনে ছাড়া অসভ্যতামি আমি করতে পারিনা।
– শোনেন আসাদ ভাই।আপনি আর আমাকে কল দিবেন না।
– নিরুরে আমি আর দু’টো দিন আছি।
নিরুর বুকটা কি মোচড় দিয়ে উঠল,নিরু অনেক কিছু বলতে চেয়েও আর পারলো না।ফোনটা কেটে দিয়ে ফ্লোরে বসে রইল।নিরু আর কখনো এই অসভ্য লোকের ফোন রিসিভ করবে না।কখনো না।
নিরু জানে তার আসাদ ভাই এতো অসভ্য কথা বলে না।শুধু নিরুর মুখে কড়া কড়া কথা শোনার জন্যই নিরুকে জ্বালাচ্ছিল।নিরুকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিলো।
‘ নিরুরে আমি আর দু’টো দিন আছি’কথাটা কে যেন বার বার কানের কাছে বলে চলল।নিরু আর এতো কিছু নিতে পারছে না। এবার একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে আসা প্রয়োজন।
দু’টো দিন পার হয়ে গেছে। আসাদের ফোন থেকে আর কল আসেনা।শেষ দু’টো দিনে একশত পঁয়ত্রিশ বার কল এসেছে।সাথে মেসেজ ও, নিরু মেসেজ বক্স ধরে রিমোভ করে দিলো।একটা মেসেজ ও পড়বে না।নিরু আর দূর্বল হতে চায় না।
বহুদিন পর নিরু জানালা খুলে দাঁড়ায়। এখনো ভোরের আলো ফোটেনি।পাশের রুম থেকে নিরু কোরআন তেলওয়াত শুনতে পাচ্ছে।ছয়মাস ধরে নিরু শেষ রাতে ঘুমায়।ওঠে দুপুরের সময়,খাওয়া গোসলের কোন নিয়ম নেই।কখনো সন্ধ্যায় গোসল করে তো কখনো মাঝরাতে,সব অনিয়ম যেন তার জীবনে। আজ এই ভোরটা নিজের মনে হচ্ছে। একদম একান্ত নিজের বলে মন ছুয়ে যাচ্ছে।ওযু করে এসে বারান্দায় জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ায়। নামাজ আদায় করে কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে।কি যেন ভেবে জুতার ফিতা বেঁধে বাইরে হাঁটতে বের হয়।বাসার পাশে বাগানে নিরুর দাদু আনাস মোল্লাকে জগিং করতে দেখা যায়।
– শুভ সকাল দাদু!
আনাস মোল্লা পিছন ফিরে তাকাল। অবাক হলেও প্রকাশ করল না।হাসি মুখেই হাত বাড়িয়ে দিলো।নিরু দাদুর হাতজোড়া ধরেই কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।আনাস মোল্লা নিরুকে বললেন,
– ঘুম হয়নি দাদুভাই?
– হয়েছে দাদু,আজ বাগানে না বাইরে জগিং করতে যাবো চলো।তোমার মতো স্ট্রং হতে হবে। শরীরে মরিচা ধরেছে।মরিচা দূর করতে হবে।
আনাস মোল্লা মনে মনে ভীষণ উৎফুল্ল আর কিছুটা চিন্তামুক্ত অনুভব করলো। নাতনির হাত ধরেই জগিংয়ে বেড়িয়ে পরল।আজ আনাস মোল্লার জীবনের তৃতীয়তম সুন্দর দিন।
নিরু দেড় বছর পর নিজেকে আবিষ্কার করছে।এই দেড় বছর নিজেকে কোথায় ফেলে রেখেছিলো।কি ভীষণ অন্যায় সে নিজের সাথে করেছে।নিজের উপরেই প্রচন্ড রকম রাগ হলো।জগিং থেকে ফিরে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে যোগ ব্যায়াম করল।তারপর নিজের রুমের ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসল।আয়নায় নিজের এই রুক্ষ গাল দু’টো দেখে নিজের গালেই থাপ্পড় বসাতে ইচ্ছে হলো।ঠোঁট দু’টোর-ই বা কি হাল। নিরুর দাঁত গুলো কি পরিষ্কার আছে।না দাঁতেও জাম খাওয়ার পর যেই আভা লেগে থাকে তেমন কালচে হয়ে আছে?নিরু দাঁত বের করে আয়নার সামনে নিজের ঝকঝকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দাঁত গুলো দেখে কিছুটা স্বস্তি পেল।নাহ দাঁত গুলোতে মরিচা ধরেনি।মনে মরিচা, রুপে মরিচা,দাঁতেও যদি মরিচা ধরতো নিজের সাথে একটু বেশিই অন্যায় হয়ে যেতো।নিরু নিজেকে অনেকক্ষণ দেখলো।কতকাল যেন আয়নায় নিজের মুখ দেখেনি।নিজের জন্য নিজেরই এতো মায়া হলো, নিরু তখনই নিজের সাথে ওয়াদা করল আর একটা সেকেন্ড ও নিজের সাথে অবহেলা নয়।
নিরুর চাচাতো বোন সুমাইয়ার কাছ থেকে ফেস প্যাক নিয়ে মুখে লাগালো।উসকো খুসকো চুল গুলো শ্যাম্পু করে সুমাইয়ার কাছ থেকেই আগা ছেঁটে নিলো।সুমাইয়াও অনেকটা অবাক হলো। ঠিক কতদিন পর যেন নিরু স্বাভাবিক আচরণ করছে,মন খুলে কথা বলছে সুমাইয়া ঠিক হিসেব করতে পারলো না।
বিকেলের দিকে নিরু বের হলো।আজ সে হাঁটবে, নিজের সাথে কথা বলবে।নিরু বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাইরে কাটালো।লেনে হাটল।ফুটপাতের পাশে ফাঁকা জায়গাটায় পথশিশুদের নিয়ে কানামাছি খেলল।তাদের সাথে হাওয়াই মিঠাই খেল।কিছুক্ষণ বসে রইল।পুরোনো কিছু স্মৃতি ধাওয়া করলেও খুব সুক্ষ্ম ভাবে এড়িয়ে নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলল যানজটের ভিড়ে,মানুষের মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করল আসলে এই সুন্দর জীবনে কে কতটা সুখী।বা কে কতটা বুকে পাথর বয়ে বেড়ায়।নিরু আরও মানুষ চেনার একটা খেলায় নামলো। মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইলো কে কতটা পরিশ্রমী। কতটা বুঝলো নিরু জানেনা।তবে একেকটা মানুষকে একেক রকম উপাধি দিয়ে দিলো।কাউকে দেখে মনে হলো এই মানুষটা বেশ পরিশ্রমী।আবার অন্য একটা মানুষকে দেখে মনে হলো।নাহ এই মানুষটা উড়নচণ্ডী। নিরুর আচরণে নিরু নিজেই খিলখিল করে হেসে উঠল।
পুরো সময়টা এইভাবেই পার করে নিরু বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিলো।
পরের দিন থেকে নতুন রুটিনে নিজেকে আরও সুন্দর করে গুছিয়ে নিলো।ভোরে উঠে নামাজ পড়া, কোরআন তেলওয়াত করা।হাঁটাহাঁটি করা, বাসায় ব্যায়ামের সরঞ্জাম নিয়ে ব্যায়াম করা।পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়া। আর নিজেকে সবটুকু গুরুত্ব দেওয়া। যেই একটা বছর নিজের হাতে শেষ করেছে। সেই একটা বছরকে নিজের সবটুকু দিয়ে পরিপূর্ণ করবে।
চলবে….
#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_০১