স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর #লেখা_চাঁদনী_ইসলাম #পর্ব_০২

0
578

#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_০২

ডিপ্রেশনের মতো ভয়াবহ অধ্যায় আর কিছু আছে বলে নিরুর মনে হয় না।নিরুর বারো বছর বয়সে বাবা মা আর ছোট ভাইকে হারায়।নিরু তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়তো।নিরুর স্কুলের সময় বাদে পুরো সময়টা কাটতো আড়াই বছরের ছোট ভাই নিহানের সাথে আর তার মায়ের সাথে।নিরুর বাবা মোহাম্মদ আবদুল মান্নান কাজের সূত্রে ভিন্ন শহরে থাকত।ছোট একটা পরিবার খুব সুখের সংসার।

ফেব্রুয়ারি মাসের আট তারিখে নিরুর বাবা পাঁচ দিনের ছুটিতে বাসায় আসে।নিরুর মামা আজিজুল হক নিরুর মায়ের নতুন সংসারে একটা বড় সড় ফ্রিজ কিনে দেয়।সেই ফ্রিজটায় বেশ কিছুদিন থেকে বার বার লাইন বন্ধ হয়ে যায়।কিছুদিন থেকে একদমই চলছে না।ফ্রিজটা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বিকেলের দিকে শোরুমে যায় নিরুর বাবা মা, নিহানের হালকা ঠান্ডা জ্বর আসায় ডক্টর দেখাবে বলে নিহানকেও সাথে নিয়ে যায়। ডক্টর দেখিয়ে শোরুমে যায়।ফ্রিজ কিনে ভ্যানগাড়িতে তুলে দিয়ে নিরুর বাবা মা বাইকে করে বাসার উদ্দেশ্য বের হয়।বড় বাজার থেকে নিরুর পছন্দের মোঘলাই এবং নিহানের জন্য শীতের কিছু পোশাক কিনে নেয়।
বড় বাজারেই মাগরিবের আযান হয়ে যায়।

এলাকার চৌরাস্তার মোড়ে আসতেই বাম পাশের মোড় থেকে সিমেন্টবাহী বড় ট্রাকে ধাক্কা লেগে নিরু পুরো পরিবার হারায়।নিরুর মায়ের মাথায় আঘাত লেগে প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হয়।নিরুর মা আর ছোট ভাই নিহান ঘটনাস্থলের প্রাণ হারায়। নিরুর বাবা আই সি ইউতে থেকে দুইদিন পর মারা যায়।এরপর থেকে শুরু হয় নিরুর জীবনের অন্য এক অধ্যায়।নিরু কেমন যেন হয়ে যায়। কারো সাথে ঠিকভাবে কথা বলে না। নিরুর ফুফু এসে নিরুর কাছে থাকতে শুরু করে।নিরুর দেখাশোনা করে।নিরু স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।রাতে বারান্দায় বসে থাকে।ছাঁদের কিনারে যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।নিরুর ফুফু ছায়ার মতো নিরুর সঙ্গে থাকে।একটুও চোখের আড়াল করে না।কিন্তু তার ও সংসার আছে।কতদিন-ই বা এইভাবে থাকা যায়।

নিরু জলে ভাসা খড়কুটোর মতো ভাসতে থাকে।কখনো এখানে তো কখনো ওখানে।স্থায়ী ভাবে কোথাও আর থাকা হয় না। মামার কাছে দুইদিন থাকলে দাদু ফুপিরা এসে নিয়ে যায়।এইভাবে এক মাস চলে যায়।
নিরুর দাদু দিদা চাচা চাচি চাচাতো ভাই বোন চাকরির সূত্রে অন্য শহরে থাকতো।যার যার কর্মস্থলের পাশাপাশি বাসা নিয়ে,বছরে দুই থেকে তিনবার সবাই এক সাথে হতো।নিরুর দাদু নিরুকে নিজেদের কাছে রাখবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।নিরুর চাচা বলে নিরু তাদের সাথে থাকুক।সুমাইয়া আছে এক সাথে পড়াশোনা করে বড় হোক।কিন্তু নিরুর মামা এডিশনাল ডি আই জি আজিজুল হক আর কারো কথা শোনেনি।নিরুকে নিজের কাছে রাখার সিদ্ধান্তের উপর নিরুর দাদা চাচা কেউ কোন কথাও বলতে পারেনি।আনাস মোল্লা আজিজুল হক কে খুব স্নেহ করেন।আজিজুল হক যতটা যত্নে নিরুকে রাখবেন ততটা যত্নে আর কেউ রাখতে পারবেনা বলেই মনে হয়। নিরুর মা ছিলেন ছোট থেকে মাতৃহারা নিরুর ও একই অবস্থা।আজিজুল হকের কলিজা ছিলো নিরুর মা।নিরুর স্কুল ভর্তি থেকে শুরু করে সব কিছু আজিজুল হকের হাত ধরে।বাবাকে সব সময় পেতো না।একই শহরে নিরুর মামার পোস্টিং থাকার সূত্রে নিরু সব প্রয়োজনে মামাকে পেয়ে যেত।
নিরু মামার সঙ্গে যেতে রাজি হয়।এক মাস না যেতেই আজিজুল হকের সীতাকুণ্ডে পোস্টিং হয়ে যায়।নিরুকে নিয়ে সীতাকুন্ড গার্লস হাই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়।আজিজুল হক স্ত্রী আমিনা বেগমকে সহ পুত্র আসাদ রহমান ও নিরুকে নিয়ে সীতাকুণ্ডে সেটেল হয়ে যায়।
আজিজুল হকের ছেলে আসাদ রহমান এস এস সি পরীক্ষা দেওয়ার পর পর-ই আজিজুল হকের সীতাকুণ্ডে পোস্টিং হয়।কলেজ চয়েজ দিতেও আসাদের সুবিধা হয়।সীতাকুণ্ড সরকারি কলেজে আসাদ ভর্তি হয়।নিরু ও আসাদের ভর্তির কাজ শেষ করে আজিজুল হক যেন চিন্তামুক্ত হয়।নিরু পড়াশোনায় খুবই অমনোযোগী,পড়াশোনা না করলেই নয় এইজন্য বইটা সামনে মেলে ধরে।মায়ের সামনে তো বিনাদ্বিধায় বলে দিতো পড়তে ভালো লাগে না।আগে নিহানের সাথে খেলার ছুতোয় মা’কে বোকা বানাতো।নিহানকে কাঁন্না করাতো তারপর পুরো ঘরময় পায়চারি করতো।ছাঁদে যেয়ে বসে থাকতো গান গাইতো।নিরুর গান খুবই পছন্দ। একা একা গুনগুনিয়ে গান গাইতে তার খুবই ভালো লাগে।বইয়ের জায়গায় গান করাটাই যদি প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ হতো তাহলে তো নিরু প্রতি ক্লাসে প্রথম হতো।নিরুর বিশ্বাস কেউ নিরুকে পিছিয়ে দিতে পারতো না।ছাঁদে বসে এই গুলো নিয়েই একা একা গবেষণা করতে থাকে।

আজ নিরু কাকে বলবে আম্মু ভাই ছাদে যাবে আমি ভাইকে নিয়ে ছাঁদে যাই।ভাই মনে হয় আজ আমাকে পড়তে যেতে দিবে না। দেখোনা কেমন গলা জড়িয়ে আছে।

– নিরু দুষ্টুমি না।পড়ে এসে ভাইকে ছাদে নিয়ে যাবা।আমিও যাবো।

– আম্মু তুমি কি বোঝো না পড়াশোনা আমার ভালো লাগে না।

– তাহলে ভাইয়ের দোহাই দাও কেন?

– ভাই ও তো আমাকে ছাড়তে চায় না। ভাই যতদিন না বড় হচ্ছে ততদিন আমি স্কুলে যাবো না। ভাই বড় হলে এক সাথে স্কুলে ভর্তি হবো।

আম্মুর উচ্চস্বরে হেসে ওঠার মুহূর্তটুকু নিরুর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের মতো যন্ত্রণা দিচ্ছে।বুকের মধ্যে জ্বালাপোড়া হচ্ছে।নিরু এই যন্ত্রণাটা একদম নিতে পারে না। চারপাশের কিছুই আর দেখতে ইচ্ছে হয় না। নিরুর চোখ ভিজে যায়।বুকে ব্যাথা ওঠে।চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়।নিরুর যন্ত্রণা কি নিরুর আম্মু বোঝেনা?কেন হলো নিরুর সাথে এমন?নিরু এই যন্ত্রণা নিয়ে কিভাবে পুরো একটা জীবন কাটাবে?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here