স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর #লেখা_চাঁদনী_ইসলাম #পর্ব_০৩

0
554

#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_০৩

শীতের সকাল চারপাশ কুয়াশায় ভেজা।দশ হাত দূরের জিনিস ও ঠিকভাবে দেখা যায় না।পুরো শহর জুড়ে ধোয়ার কুন্ডলির মতো কুয়াশা জড়িয়ে আছে।বাসা থেকে চন্দ্রনাথ পাহাড়টা খুব নিকটে মনে হয়। যেন হাত বাড়ালে ছোয়া যাবে।পাহাড় দেখা যায় খুব কাছে কিন্তু হেঁটে পৌঁছাতে গেলেই জীবন যাবে যাবে অবস্থা!এতটাই উচু। আমিনা বেগম অর্ধেক গিয়ে আর পেরে ওঠে না।বয়স হয়েছে সম্ভব ও হয়না।কিন্তু আসাদ খুব দ্রুত ওঠে।আমিনা বেগম আসাদের দিকে স্নেহময় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকেন।
সীতাকুণ্ডে আসার তৃতীয় দিনে আমিনা বেগম নিরু আর আসাদকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছিলেন।উদ্দেশ্য ছিলো পাহাড়ে উঠবে।অর্ধেক উঠে আর পারেননি।নিরু ও মামানিকে ছেড়ে একা যায়নি।মামানির সাথেই বসে ছিলো।আশপাশ ঘুরে দেখছিলো।
নিরুর মন ভালো রাখার জন্যেই আমিনা বেগম বের হয়েছিলেন।মেয়েটার চোখের দিকে তাকালেই যেন বুক ফেটে কাঁন্না আসে।এতো মায়া মুখটায়।
নিরুর ঘুরতে একটুও ভালো লাগছিলো না।পুরো শরীর কাঁপছিলো।চারপাশে অনেক টুরিস্ট, নিরুর এতো মানুষের মধ্যে থাকতে ভালো লাগে না। পাহাড় হবে নিরিবিলি কিন্তু টুরিস্টদের জন্য বাজার মনে হচ্ছে। নিরু ফাঁকা একটা জায়গায় গিয়ে দূর পাহাড়ে তাকিয়ে রইল। মনের মধ্যে তোলপাড় চলছে।এখানেই শরীর এলিয়ে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে।মামানিকে কিভাবে বলবে নিরুর শরীর চলছে না।কোন শক্তি পাচ্ছে না।আম্মু থাকলে তো নিরুকে এতো ভাবতে হতো না। আম্মুকে কিছু বলতে তো ওতো কিছু ভাবতে হতো না। যখন যা মনে আসতো বলে দিতো।এখন শরীরের মধ্যে এতো অশান্তি তাও মন খুলে কাউকে বলতে পারছে না।
আমিনা বেগম নিরুর কাছে এসে দাঁড়ায়। ব্যাগ থেকে কিছু ফাস্ট ফুড বের করে নিরুকে নিয়ে বসেন।নিরুর খুব কাঁন্না পাচ্ছে।এই পাহাড়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে আম্মু তুমি ফিরে আসো।

যেদিন কুয়াশা থাকে না,বারান্দা থেকে পাহাড়টার দিকে তাকাতেই অদ্ভুত এক শান্তিতে মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়।আজ কুয়াশার পরিমাণ অনেক,দূরের কোন কিছু দেখার উপায় নেই।নয়টা বাজতে চললো এখনো রোদের দেখা নেই। আমিনা বেগম রান্নাঘর থেকে নিরুকে বেশ কয়েকবার ডাকলেন, নিরুর কোন সাড়াশব্দ নেই। অন্যদিন নিরু তো উঠে পড়ে।আমিনা বেগম নিজেই নিরুর রুমে যায়।নিরুকে পায়না।বাসার নিচে বাগানে ফুল গাছ গুলোর কাছে প্রায় সময় নিরুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ওখানেও পেল না।এতো ঠান্ডায় তো ছাদে যাবে না। তারপরও ছাদে গিয়ে দেখে নিলো।আমিনা বেগমের এবার কেন যেন দুশ্চিন্তা হতে লাগল।আজিজুল হকের কাছে কল দিলো।আজিজুল হককে ফোনে পাওয়া গেল না। আসাদ তো দরজা লক করে এখনও ঘুমোচ্ছে।না পেরে আসাদের রুমে নক করল।আসাদ কে ঘুম থেকে উঠিয়ে আশপাশটা দেখতে বলল।

_ বাবু নিরু তো একা কোথাও যায় না।

_ আম্মু চিন্তা করো না পাশেই হয়তো হাঁটতে বের হয়েছে।

_ হাঁটতে গেলে তো আমাকে বলে যেত।

_ তুমি হয়তো ঘুমোচ্ছিলে।

_ হতে পারে। তুমি আগে দারোয়ান মামাকে জিজ্ঞেস করে নিও।আমি গেট পর্যন্ত যাইনি।

_ ঠিক আছে আম্মু

আসাদ প্রথমে দারোয়ানের কাছে গেল।

_ মামা অনিমা কি বাইরে গেছে?

_ হ্যাঁ বাবা, মামনি বাইরে গেছে।বলল সামনেই একটু হাঁটতে যাবে।

_ ওহ আচ্ছা। কোন দিকে গেছে আপনি কি দেখেছেন মামা?

_ হ্যাঁ বাবা এই যে এইদিকে গেছে।আমি পাহাড়ের ওইদিকে যেতে নিষেধ করেছি।সামনেই আছে, আমি কি সামনে এগিয়ে দেখবো।

_ না মামা। আপনি গেটে থাকেন।আমি যাচ্ছি।

আসাদ আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না।আসাদ জানে নিরু পাহাড়েই যাবে।আসাদ খুব খেয়াল করেছে নিরু সব সময় নিরিবিলি জায়গা খোঁজে। একা থাকতে চায়।আসাদ একটু দ্রুত হাঁটে। আশপাশে নিরুর সন্ধান মিলে না।আসাদের ধারণা অনুযায়ী আসাদ চন্দ্রনাথ পাহাড়ের দিকে এগোতে থাকে।আস্তে আস্তে কুয়াশা কমে আসে।সামনে একটু এগিয়েই নিরুকে দেখতে পায়।দূর পাহাড়ে নিরু আনমনা হয়ে তাকিয়ে আছে।আসাদ নিরুর পাশে যেয়ে দাঁড়ায়।নিরু কি কাঁদছে?
নিরুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে নিরুর গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।আসাদের বুকটা কেঁপে ওঠে।ফুপা ফুপির জন্য আসাদের ও কষ্ট হয়।কাঁন্না আসে কিন্তু আসাদ নিজেকে সামলিয়ে নেয়।কিন্তু ছোট্ট নিরু কিভাবে থাকে?

আসাদ ওর আম্মুকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না।আম্মু ছাড়া সে একা বাঁচতেই পারবে না।তাহলে নিরু কি পরিমাণ কষ্ট সহ্য করে।
আসাদ নিরুর মুখোমুখি দাঁড়ায়।নিরু আসাদকে হঠাৎ দেখে চমকে উঠে।কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়।তারপর চোখ মুছতে মুছতে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।

_ অনিমা তুই এখানে একা এসেছিস?জায়গাটা কিন্তু সেফ নয়।

_ আমি হাঁটছিলাম।হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ চলে
এসেছি বুঝতে পারিনি।

_ আম্মু তোকে খুঁজছে।

_ মামানি ঘুমাচ্ছিলো তাই বলে আসতে পারিনি।

_ অনিমা তুই কাঁদছিস। আমরা আছি তো।ফপা ফুপির জন্য আমারও খুব কষ্ট হয়।

নিরুর চোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পরল।নিরু ফুপিয়ে কাঁন্না করছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে।আসাদ একটু এগিয়ে গিয়ে নিরুর মাথায় হাত রাখলো।নিরু আসাদের টি-শার্ট খামছে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।আসাদ এবার নিজেকেই সামলাতে পারছেনা।নিরুকে কি বলে শান্তনা দিবে।

এই মেয়েটাকে খুব তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক করতে হবে। আসাদের খুব মনে আছে আসাদকে ফুপি কি পরিমাণ ভালবাসতো।ফুপির কাছে যতটা বায়না করেছে।ততটা বায়না মায়ের কাছেও করেনি।
নিরুর মা নিরুকে এক মুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল করেনি।একবার নিহানের অসুখ হওয়ায় পাঁচদিন হসপিটালে থাকতে হয়েছিলো।নিরুকেও সাথে রেখেছিলো।নিরুর যেন মায়ের জন্য মন খারাপ না হয়।সেজন্য নিজের সাথেই রেখেছিলো।আর সেই মেয়েকে পুরো জীবন মা বাবা ছাড়া থাকতে হবে।একান্ত নিজের বলতে আর কেউ নেই।

_ এই অনিমা আমরা আছি তো।আর ফুপি সব সময় তোর সাথে আছে।তোর বিশ্বাস না হলে আমার দিকে তাকা।আমি কি তোকে মিথ্যা বলি কখনো বল?

নিরু আস্তে আস্তে মুখ তুলল।নাক টেনে শালটা ভালো ভাবে জড়িয়ে নিলো।চারপাশে চোখ বুলিয়ে আসাদের দিকে তাকাল।

_ চল এবার বাসায় যাই।আম্মু চিন্তা করছে।একা আর কখনো আসবিনা।আমাকে বলবি আমি নিয়ে আসবো।

_ আসাদ ভাই!

_ কিছু বলবি?

_ আমি আম্মুর কাছে যাবো ভাইয়া।

_ তুই সারাজীবন আমার সাথে থাকবি। ফুপি আমাদের সাথেই আছে।এমন কথা আর কখনো বলবি না।আজকের পর থেকে তুই একা নস।সব সময় আমাকে পাবি।আর কাঁন্না করিস না ভাই।এবার যাই চল আম্মু দুজনকেই পিটাবে না হয়।

সত্যি সেদিনের পর থেকে নিরুকে আর একা কোথাও যেতে হয়নি।স্কুলে যাওয়ার সময় আজিজুল হক পৌঁছে দেয়।না হয় আসাদ পৌঁছে দেয়।নিরুর পড়াশোনা নিয়ে কেউ বেশি কথা বলে না। প্রাইভেট মাস্টার রাখা হয়েছে।প্রতিদিন বিকেলে পড়াতে আসে।নিরু রান্না আর ঘর গোছাতে বেশি পছন্দ করে। কাজের মেয়েটা যতই গুছিয়ে যাক নিরুর পছন্দ হয় না।নিরু এলোমেলো করে আবার গোছায়।একেকদিন একেক রকম রেসিপি রান্না করে সবাইকে চমকিয়ে দিতে চায়।প্রথম বার খারাপ হলেও সবাই ভালো হয়েছে বলে নিজেরা সবটা ভাগাভাগি করে খেয়ে নেয়।খারাপ হয়েছে নিরুকে বুঝতে দেয় না।নিরুর অবশ্য তাতে মন খারাপ হয় না। আরও মজা পায়। কিন্তু পরের বার ঠিকই পারফেক্ট হয়।মনে হয় পুরোনো রাধুনি। রান্নার হাত বেশ ভালো। এই বয়সেই রান্নায় বেশ পারদর্শী।

আমিনা বেগম নিজের আত্নীয়দের বাসায় বেড়াতে গেলে নিরুকে সঙ্গে নিয়ে যায়। নিরুকে একা কোন সময় রাখেনা।একটু একা থাকলেই মন খারাপ করে, আনমনা হয়ে বসে থাকে।কাঁন্না করে।নিরু মাঝে মাঝে দাদুর কাছেও বেড়াতে যায়।কিন্তু সেইটা দুই থেকে তিনদিনের জন্য,আজিজুল হক নিরুকে কোথাও বেশিদিন থাকতে দেয় না।

এইভাবেই একটা বছর কেটে গেল।এতদিন নিরুর পড়াশোনা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি।কিন্তু নিরুর ফাইনাল রেজাল্ট দেখে সবার মাথায় হাত।পাঁচ সাবজেক্টে ফেইল এসেছে।নিরুকে কেউ কিছু বলেনি। কিন্তু নিজেদের উপর-ই রাগ হচ্ছে।পড়াশোনাটা নিয়ে সবার ভাবা উচিত ছিলো।এমন রেজাল্ট আসবে কেউ আশা করেনি।কেননা আসাদ অনেক ভালো স্টুডেন্ট।সবাই ভালো রেজাল্ট শুনেই অভ্যস্ত। আর নিরুর দাদু দিদা চাচা ওনারায় বা কি বলবেন।এবার অন্তত নিরুর পড়াশোনায় গার্ড দেওয়া প্রয়োজন।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here