স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর #লেখা_চাঁদনী_ইসলাম #পর্ব_০৮

0
428

#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_০৮

নিকষ কালো মেঘে ঢেকে গেছে পুরো পাহাড়ি এলাকা।পাহাড়ের বুকে ঝুম বৃষ্টির ঢল নেমেছে।বাহারিদের ঘরের চালা দিয়ে কয়েক জায়গায় পানি পড়ছে।বাহারির মা পানি পড়া জায়গা গুলোতে হাড়ি গামলা পেতে রাখল।নিরুর প্রচন্ড ভয় করছে।এই বৃষ্টির মধ্যে বাসায় যাবে কিভাবে? এই বৃষ্টি থামবে বলেও মনে হচ্ছে না। ঘন্টাখানেক হয়ে এলো বৃষ্টি থামার নাম নেই।
নিরু বার বার বাইরে তাকাচ্ছে।বৃষ্টি কমলে বাহারিকে বলবে,বাহারি আর বাহারির বাবা যেন নিরুকে রেখে আসে। এমন আবহাওয়ায় নিরুর প্রচন্ড ভয় হতে লাগল।বর্জপাতের শব্দে অন্যসময় নিরুর ভয় লাগে না। কিন্তু আজ নিরুর ভয় করতে লাগল।বাহারির এক হাত শক্ত করে ধরে বসে রইল।দেড় ঘন্টা পর ঝুম বৃষ্টি একটু কমে এলো।
নিরু বাইরের দিকে আরও একবার চোখ রাখল।দূরে টর্চ লাইটের আলো দেখে নিরু বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরল।আলোটা আর একটু কাছে আসতেই, নিরু আলোর ওই মানুষটার অবয়ব এক পলকে চিনে ফেলল।যতটা আনন্দ হচ্ছিলো তার চেয়ে বেশি ভয় করতে লাগলো।নিরু জানে আসাদ ভাই এখন অনেক কথা শোনাবে। ‘ সে আমার জন্য বসে থাকে না।তার অনেক কাজ থাকে।আমি এতো দায়িত্ব জ্ঞানহীন কাজ কিভাবে করতে পারি,তার মাথায় আসে না।ভয় বলতে কিছু নেই।সে পাহারা দেওয়ার জন্য সারাজীবন ঘুর ঘুর করবে না।দায়িত্ব জ্ঞান নিয়ে চলাফেরা করতে হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি!’
নিরুর এতো সব ভাবনার মধ্যে আসাদ বাহারিদের ঘরের সম্মুখে চলে এসেছে।বাহারির বাবা এগিয়ে গেল।

_ বাবা তুমি আসলে,বৃষ্টি থামলে আমি রেখে আসতাম।

_ সমস্যা নেই মামা।আম্মু বাসায় চিন্তা করছিলো।

_ তুমি তো ভিজে গেছো।গা হাত পা মুছে নাও বাবা।

বাহারির বাবার হাতে থাকা গামছাটা আসাদের দিকে এগিয়ে দিলো।

_ মামা আমি বাসায় গিয়ে মুছে নেবো।যেতে যেতে আবার ভিজে যেতে পারি।বৃষ্টি এখনো থামেনি।

_ ঠান্ডা লেগে যাবে।বৃষ্টি তো কমে এসেছে মুছে নাও।

_এই রাস্তাটা খুবই বাজে,এতো পিচ্ছিল বলার মতো না।এখন একটু বৃষ্টি কম আছে। আজ আসি মামা।

বাহারির মা এক কলস পানি নিয়ে এলো।

_ এখন কোথায় যাবে? এই মায়ের কাছে এসেছো, মায়ের হাতের খাবার খেয়ে তারপর যাবে।

_ মামানি আজ না। অন্যদিন আসবো।বাসায় খালামণিরা এসেছে।সবাই অপেক্ষা করছে।

_ তারপরও ছাড়ছি না।হাত মুখ ধোবে এসো।

আসাদ আর না করতে পারলো না। মানুষ গুলো এতো ভালো,এতো সহজ সরল।হাত মুখ ধুয়ে আসাদ খেতে বসল।নিরু পাশেই বসে রইল।বিকেলে খেয়েছে বলে নিরুর এখন আর খিদে নেই।
আসাদের ঝাড়ি খাওয়ার জন্য নিরু মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিলো।এইটাও ভেবে নিলো আসাদ যা বলে বলবে।নিরু কোন জবাব দিবে না। একদম না।

নিরু সেই যন্ত্র গুলোর আবার টুংটাং শব্দ শুনতে পেল।নিরুর আফসোস যেইটার জন্য থাকতে চাইলো,সেইটাই শোনা হলো না।আসাদ খাওয়া শেষ করে বাহারির বাবা মায়ের সাথে কথা বলল।

_ এখন তাহলে যাই মামা।

_ আমি রাস্তা পর্যন্ত দিয়ে আসি বাবা।

_ না মামা আপনাকে আর আসতে হবে না। আমার কাছে টর্চ আর ছাতা আছে।আর এখনো বৃষ্টি হচ্ছে আপনাকে বের হতে হবে না। আসছি তাহলে,

আসাদ নিরুকে নিয়ে চলে এলো।এখনো টিপটিপ করে বৃষ্টি পরছে।নিরুর বুকটা কাঁপছে।

_ এই যে ম্যাডাম ছাতা নেন।ভিজে যাচ্ছেন।

_ আপনিও তো ভিজে যাচ্ছেন।

_ আমি আগেই ভিজে গেছি।এইটুকুতে সমস্যা হবে না।

নিরু কথা না বাড়িয়ে ছাতাটা নিলো।নিরু জানে যেকোন সময় বিশাল এক ধমক খাবে নিশ্চিত।
বিয়ে বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে।শিল্পীতে গান ধরেছে।

_ নিরু শোন।

নিরুর বুকটা ধক করে উঠেছে।এই বুঝি রাগে আসাদ নিরুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে।আসাদ এমনিতেই বৃষ্টিতে ভেজা পছন্দ করে না।আর আজ নিরুর জন্য তাকে ভিজতে হচ্ছে।
নিরু মিনমিনে গলায় বলল।

_ বলুন।

_ যেই গানের জন্য এতক্ষণ থাকলি।সেই গান শোনা হয়েছে?

_ না, বৃষ্টির জন্য শোনা হয়নি।

_ এখানে একটু দাঁড়া।একটা গান শুনিয়ে নিয়ে যাই।এই যে গাছটার নিচে আয়।

নিরুর আনন্দে লাফাতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু ভয়টা এখনও পুরো কাটেনি বলে আনন্দ প্রকাশ করতে পারলো না। টুংটাং শব্দ, সুর, নিরুর অনেক ভালো লাগছিলো।গানের কথা গুলো তখন বোঝা যাচ্ছিলো না।তারপরও সুরটা নিরুর মনে গেঁথে ছিলো।এখন কাছ থেকে শুনতে পাবে।তাই আনন্দ ও লাগছে।
আসাদ গাছটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।নিরু পাশেই ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

কেন এলে না, আমার ঝরে আঁখি জল।
কেন এলে না,আমার ঝরে আঁখি জল
কেমন আছে রাধা বল,
আমার কাঁদে কৃষ্ণ মন, কেমন আছে রাধা বল।
উতলা এই ব্রজধামে নিজাম গাহে রাধা নাম,সে যদি হয় আমার সুবল।শূন্য কেন আমার প্রাণ
উতলা এই ব্রজধামে………………..প্রাণ
আইলা না রাই বাশির সুরে,
আইলা না রাই বাশির সুরে, যমুনাতে নিতে জল
কেমন আছে রাধা বল,
আমার কাঁদে কৃষ্ণ মন,কেমন আছে রাধা বল।
শিশিরে ভেজে না মাটি বিনা বরষণে,তপ্ত প্রাণ হয়না শীতল বিনা দর্শনে,

আসাদ ঘোর লাগা দৃষ্টি নিয়ে পাশে থাকা মায়াবতীর দিকে মোহগ্রস্ত হয়ে চেয়ে আছে।এই একজন রমণীর দর্শন না পেলে পুরো পৃথিবীটায় আসাদের এলোমেলো লাগে।তা না হলে এইভাবে পাগলের মতো কেউ ছুটে আসে ?
দুপুরের আগ থেকে আসাদ আজ বাইরেই ছিলো।সন্ধ্যার সময় বাসায় আসবে। কিন্তু বৃষ্টিতে আটকে যাওয়ায়,বাজারেই বসে ছিলো।বৃষ্টি একটু কম হলে বাসায় আসে।এসে দেখে খালামণি মাহিয়া সবাই ড্রয়িংরুমে গল্প করছে।আসাদের চোখ জোড়া নিরুকেই খুঁজছিলো।এতো গল্প হাসাহাসির মধ্যে থেকে আসল দর্শকটা কোথায় গেছে।বেশ কিছুক্ষণ পর আসাদ জানতে পারলো নিরু বাসায় নেই।আজিজুল হক আমিনাকে কল করে বলেছেন,চিন্তা না করতে, আসার সময় উনিই নিয়ে আসবেন।ওখানে একটা গানের অনুষ্ঠান দেখার জন্য নিরু রয়ে গেছে।
নিজের রুম থেকেই আসাদ আমিনা বেগমকে জিজ্ঞেস করল।

_ নিরু কখন গেছে আম্মু?

_ দুপুরের পর পরই বাহারি এসে নিয়ে গেছে।

_ আব্বু কখন আসবে জানো?

_ না তোমার আব্বু ফোন ধরছে না।ব্যস্ত আছে হয়তো।

আসাদ এমনিতেই চিন্তায় আছে।এই বৃষ্টির মধ্যে ওখানে কি করছে।কেমন পরিস্থিতিতে আছে তার ঠিক নেই। ‘আব্বু কি পারতো না একবার জানিয়ে রাখতে।’
আসাদ দ্রুত আজিজুল হকের কাছে কল দেয়।

_ হ্যালো আব্বু অনিমাকে নিয়ে আসতে গেছো?

_ আমি তো শহরের বাইরে এসেছি হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে যাওয়ায়।আমি তো ভাবছি তুমি নিয়ে এসছো।

_ আমাকে কি তুমি নিয়ে আসতে বলেছো?

_ তোমার আম্মুর ফোনে মেসেজ করেছিলাম।যেন তোমাকে পাঠায়।

_ আম্মু আমাকে জানায়নি।আমি এখনই যাচ্ছি।

আসাদ ওই মুহূর্তেই ভিজতে ভিজতে বের হয়।মাথায় ও নেই ছাতা নিতে হবে। কিছুটা পথ যাওয়ার পর মাথায় আসে নিরুকে কিভাবে আনবে।সামনের পরিচিত দোকান থেকে একটা ছাতা আর টর্চ চেয়ে দ্রুত যায়।

শিশিরে ভেজে না………. দর্শনে
আইলা না রাই বাশির সুরে,
আইলা না রাই বাশির সুরে, যমুনাতে নিতে জল
কেমন আছে রাধা বল।
আমার কাঁদে কৃষ্ণ মন,কেমন আছে রাধা বল।

মুগ্ধ হয়ে দুজনেই গানটি শুনছিলো।নিরু আসাদের দিকে একবার তাকাতেই চোখে চোখ পড়ল।নিরু চোখ নামিয়ে আসাদকে হাঁটতে বলে সামনে এগোতে থাকল।
নিরু আসাদের তাকানোর ওই গাঢ় দৃষ্টিটা ভুলতে পারছে না। আসাদ কেন ওর দিকে ওইভাবে তাকিয়ে ছিলো?
নিরু একটু হলেই পিছলে পড়ে যাচ্ছিলো। আসাদ হাতটা ধরে ফেলায় আর পড়েনি।

_ আমার হাত ধর।এই রাস্তায় পড়ে গেলে কোমড় ভাঙবে।

আবার ঝুম বৃষ্টি নেমেছে।নিরু আসাদের হাতে ছাতা দিয়ে দুজনে ছাতার মধ্যে এলো।বর্জপাতের শব্দে নিরু আসাদের কনুইয়ের কাছে দুইহাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল।তারপর ধীরে ধীরে দুজনে পথ ধরে এগিয়ে চলল।এখনো হালকা গান ভেসে আসছে।

আইলা না রাই বাশির সুরে,
আইলা না রাই বাশির সুরে,যমুনাতে নিতে জল।
কেমন আছে রাধা বল।
আমার কাঁদে কৃষ্ণ মন……

নিরু ভাগ্যিস তুই এখনো আমার মনের কথা জানিস না।যদি জানতিস,তাহলে কখন বুঝে নিতিস যে, এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে তোকে একজন শক্ত করে একবার জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছিলো।তোর কানে মৃদুস্বরে বলতে চাচ্ছিলো। তোকে ভীষণ ভালবাসি নিরু!

আসাদ কথা গুলো মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে যাচ্ছিলো।সামনেই ছোট একটা গর্ত পড়ায় নিরুকে নিয়েই ধপ করে পড়ে গেল।

_ এই আপনার শক্তি।হাত ধরে হাঁটতে বললেন। তা না হলে আমার কোমড় ভেঙে যাবে।আপনার হাত ধরে হাঁটার জন্য আমার এই দশা। নিজেই ঠিক ভাবে হাঁটতে পারে না।আবার আমাকে হাত ধরে নিয়ে যাবে।

আসাদ উঠে দাঁড়ানোর আগেই,নিরু উঠে দাঁড়াল।আসাদ কোন কথা না বলে।নিরুর হাতে ছাতা আর টর্চ ধরিয়ে, নিরুকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা শুরু করল।নিরু কিছু বলতে যাবে তার আগেই আসাদ বলল।

_ একটা কথা বলবি না।সোজাসুজি টর্চ ধরবি।

নিরু কোন কথা বলেনি।অবচেতন মন আসাদের কাঁধটা দুই হাত দিয়ে আরও শক্ত করে ধরল।নিরুর চোখ পিটপিট করছিলো।নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হচ্ছিলো।কাঁধটা শক্ত করে ধরতে চেয়েও বার বার আলগা হয়ে যাচ্ছিলো।অদ্ভুত কিছু মিশ্রিত এক অনুভূতির সন্ধান নিরু পেল।

নিরুর এতো কাছে আসাদ কখনো আসেনি।আসাদের শুধু মনে হচ্ছিলো নিরু এইভাবেই কাছে থাকুক।পুরো একটা জীবন অনায়াসে পার করা যাবে।
পাকা রাস্তায় আসার পর আসাদ নিরুকে নামিয়ে দেয়।দুজনেই ভিজে একাকার হয়ে গেছে। এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে ছাতাতে রক্ষা পায়নি।নিরু বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করে।কিন্তু মামানির জন্য ভেজা হয় না।নিরু ছাতাটা বন্ধ করে ফেলে।

_ ছাতা বন্ধ করলি কেন?

_ ভিজেই তো গেছি।ছাতা নিয়ে কাজ কী?

_ মাথাটা তো শুকনো আছে?

_ একটুখানি ভিজলে কিছু হবে না।

আসাদ আর বাঁধা দেয় না।সোজা বাসার দিকে যায়। আজিজুল হক এখনো বাসায় ফেরেনি।কি একটা অবস্থা হতো?

ড্রয়িংরুমেই আমিনারা বসে আছে।নিরুরা চলে এসেছে বুঝতে পেরে মাহিয়া সামনে এগিয়ে গেল।

_ মাহিয়া আপু কেমন আছো?

_ এইতো ভালো আছি। তুমি?

_ আমিও ভালো আছি।

_ তুমি তো ভিজে একাকার হয়ে গেছো।আগে ওয়াশরুমে যাও।

আসাদের বাইকটা বাইরে ছিলো।বাইকটা গ্যারেজে রেখে এলো।

_ তোয়ালে নাও।ভিজে কি হইছো।

_ আমার রুমে তোয়ালে আছে।

_ নিরু হাতে পায়েই বড় হয়েছে।না হয় এমন জ্ঞানহীন কাজ করে। সবাইকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলো।

আসাদের হাঁচি শুরু হয়ে গেছে।ভিতরে এসে দেখে নিরুকে তার খালামণি কথা শোনাচ্ছে।

_ এমন জ্ঞানহীন কাজ কেউ করে।শুনি তো বাসার বাইরেই যাও না।এমন আর করবা না। বাধ্য হয়ে থাকবা।সবাই চিন্তায় পড়ে গেছিলো।মা বাবা মরা মেয়েদের অন্যের বাসায় বাধ্য হয়ে থাকতে হয়।

আমিনা বেগম তার ছোট বোন মনিকাকে থামিয়ে বলল,

_ নিরু বাধ্য মেয়েই,কোথাও যায় না।আমাকে না বলে কোথাও দুই মিনিট থাকে না। নিরু গোসল করে নিবি।বৃষ্টির পানি যেন শরীরে না থাকে।

নিরু ওখানে আর এক সেকেন্ড দাঁড়াল না।চোখ দুটো জলে টলমল করছে। রুমের দরজাটা কোনরকম ঠেলে বাথরুমে চলে গেল। নিরুর টলমলে চোখ দু’টো অন্য এক জোড়া চোখের আড়াল হয়নি।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here