#তোমায়_যবে_পাই_দেখিতে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৭
(প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
শিরীন কিছু বোঝার আগেই তিয়াস মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। মেয়েটা ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো। রেজওয়ান বাসায় ছিলো না বলে শিরীনের চিৎকারে ছুটে এলো অর্পা। কিন্তু তিয়াসকে ওরকম অবস্থায় দেখার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলোনা অর্পা।
ভরসন্ধ্যা! নতুন বাড়ির, নতুন ঘরে বসে আছে প্রিয়ন্তি। হুট করে বিয়ে হয়ে গেলেও আবরিশামের বাবা-মা চমৎকার আয়োজন করেছেন এতটুকু সময়। আসলে টাকা থাকলে সবকিছুই সম্ভব। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে এ বাড়িতে পৌঁছেছে প্রিয়ন্তি। আবরিশামের মায়ের প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়েছে ছেলের বউকে। অবশ্য না হওয়ার কোনো কারণ নেই। অষ্টাদশী প্রিয়ন্তি রূপে অন্যন্য। দীঘল কালো কেশ তার,ছিমছাম গড়নের শরীর।
আবরিশামের বাবা সরোয়ার হোসেন আত্মীয় স্বজনদের আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। আবরিশাম বন্ধুদের সাথে এক কোণে বসে হাসাহাসি করছে। জাহানারা বেগম অনেকবার কল দিয়েছেন অর্পাকে কিন্তু উনার ফোনে না পেয়ে রেজওয়ানকে কল করেন। রেজওয়ান পরে আসবে বলে জানায়। অগত্যা প্রিয়ন্তির বাড়ির লোকজনের অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠান হচ্ছে। রেজওয়ানের আচার-আচরণ আবরিশামের মায়ের মোটেও ভালো লাগেনি। একমাত্র মেয়ের বিয়ের পরে প্রথমবার তার শ্বশুর বাড়ি কীভাবে না এসে পারে উনারা? বিকেল থেকে বিশ্রামের জন্য কেউ বিরক্ত করেনি প্রিয়ন্তিকে। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই পার্লার থেকে লোক এসেছিল। সেই থেকে সাজগোছ এখন পর্যন্ত চলছে। প্রিয়ন্তি অবশ্য আনহাকে বলেছিলো এতো সাজগোছ ভালো লাগে না তার। কিন্তু আবরিশাম চৌধুরীর স্ত্রী’কে দেখতে অবশ্যই স্মার্ট হয়ে সবার সামনে যেতে হবে বলে জানায় আনহা। কী আর করার! সবকিছু তো মনের অমতে গিয়ে করেছে। এটুকু আর কী? রুমে ঢুকেই ফোনে চার্জ দিয়ে নিয়েছিলো সে। কয়েকবার মায়ের কাছে কল দিয়েছিলো বটে কিন্তু ওপাশ থেকে রেসপন্স করেনি। মা’কে নিয়ে সব সময় চিন্তায় থাকে প্রিয়ন্তি। আবেগের বশে সিন্ধান্ত নিয়ে কোনো ভুল হলো কি-না বারংবার ভাবে সে। আদৌও কি তার বাবা কখনো মা’কে আগের মতো ভালোবাসতে পারবে? উনার দ্বিতীয় স্ত্রী’কে কি ডিভোর্সের ব্যবস্থা করলেন আদৌও! মন ও মস্তিষ্কে অনেক প্রশ্ন জমা হয়ে আছে কিন্তু কোনো উত্তর নেই কোথাও। তিয়াস! তিয়াস কোথায় আছে? কেমন আছে? প্রিয়ন্তির চোখ ছলছল করছে। এই বুঝি আঁখি যুগল হতে মুক্তোর দানা ঝরে পড়বে।
” আপু কান্না করো না প্লিজ! চোখের কাজল লেপ্টে যাবে তো।”
পার্লার থেকে সাজানোর জন্য যে দু’জন এসেছেন তাদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলো। প্রিয়ন্তি নড়েচড়ে বসলো। যথাসম্ভব নিজেকে সামলে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো কেবল। এরমধ্যে আনহা উপস্থিত হলো ঘরে।
” এখনো সাজগোছ কমপ্লিট হয়নি?”
” হ্যাঁ ম্যাম হয়ে গেছে। দেখুন তো কেমন লাগছে? ”
প্রিয়ন্তিকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে আনহা মুচকি হাসলো।
” মাশা-আল্লাহ! আমার ভাই ব্যতীত অন্য কারো নজর না লাগুক। ”
প্রিয়ন্তি আনহার দিকে তাকাতেই আনহা গলা খাঁকারি দিয়ে ফের বললো,
” আচ্ছা আপু আপনারা খাওয়াদাওয়া শেষ করে যাবেন। আমি ভাবীকে নিয়ে যাচ্ছি। ”
” ঠিক আছে ম্যাম।”
আনহা এখন প্রিয়ন্তিকে ভাবি বলেই ডাকে। পথে আসতে আসতেই দুজনের মধ্যে বেশ ভাব হয়ে গেছে। এ বাড়ির লোকজনের আচরণ ভালোই কিন্তু যে সম্পর্কের ভিত্তিতে এখানে আসা সেই সম্পর্কে কতদিন অবিচল থাকতে পারবে সে বিষয় সন্দিহান প্রিয়ন্তি।
” তোমার কথামতো সবকিছুই হলো। এবার শুধু অর্পাকে ডিভোর্স পেপারে সাইন করানো বাকি।”
রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে আসমা ও রেজওয়ান। রেজওয়ানের মুখে তৃপ্তির হাসি। আসমারও খুশি যেনো ধরে না।
” এবার তাড়াতাড়ি ওটাকে বিদায় করো। আমি আর তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না। টাকার কোনো অভাব আমার নেই। স্বামী ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু সব সুখ সে দিতে পারতোনা বলেই তোমার কাছে আসা। তোমার কাছে আমি তৃপ্তি পাই। ”
” সবাই তো আর রেজওয়ান না।”
নিজেকে নিয়ে ভীষণ গর্ব হচ্ছে তার। আসমা মুচকি হাসে। আসলে নারী হচ্ছে সবচেয়ে বড়ো ফেতনা। একজন নারী হয়ে কীভাবে অন্য একজন নারীর সাজানো সংসার নষ্ট করে? উপরন্তু নিজের স্বামী, সন্তানের কথাও ভাবেনা। এরকম নারী সমাজের জন্য অভিশাপ।
জ্ঞান ফেরার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো কথা বলেনি তিয়াস। অর্পার মা সবকিছুই খুলে বলেছে তিয়াসের খালা ও খালুকে। তিয়াসের অবস্থা দেখে কেউ কোনো প্রকার টুঁশব্দ করেনি। বোনপোর এরকম অসুস্থতা দেখে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন পারভীন। মজিবুর বাইরে পায়চারি করছে। ছেলেটার জীবনটা কেনো এরকম সেই নিয়ে চিন্তায় নিমজ্জিত তিনি। শুনেছি মানুষের এক কাল কাটে দুঃখে আরেক কাল সুখে। কই তিয়াসের তো গোটা একুশটি বসন্ত কাটলো দুঃখের সাগরে। তিয়াসের এরকম অবস্থার কথা শিরীনের কাছ থেকে রিক্তা শুনে তিয়াসের বাড়ি এসেছে। বিছানায় শুয়ে আছে তিয়াস,পাশে অর্পা বসা। পারভীন তিয়াসের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এতক্ষণ অনেক কথা বলানোর চেষ্টা করেছে তারা দু’জন। কিন্তু তিয়াস নির্বাক। রিক্তাকে দেখে অর্পা উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরে।
” আন্টি প্লিজ কাঁদবেন না। আপনি কাঁদলে তিয়াস ভাইয়ের আরো কষ্ট হবে। ”
” আমি এক অসহায় মা রিক্তা। না পারলাম মেয়েটাকে সুখী করতে আর না তো এই অভাগা ছেলেটাকে। ”
রিক্তা তিয়াসের দিকে তাকালো একবার। কেমন ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিয়াস। যেনো প্রাণহীন নির্জীব হয়ে গেছে মানুষটা।
” এভাবেও কাউকে ভালোবাসা যায়! ”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে ভাবে রিক্তা। অর্পাকে বুঝিয়ে তিয়াসের পাশে বসে রিক্তা। বারকয়েক ডাকাডাকি করলেও কোনো কথা বলে না তিয়াস। ডাক্তার এসেছিলো, তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু তিয়াস নিজে থেকে কথা বলতে চাইছে না। সেকারণেই চুপ করে আছে বলে জানিয়েছেন।
” প্রিয় আপনাকে একটা কথা বলতে বলেছে ভাইয়া।”
রিক্তার মুখে প্রিয়ন্তির নাম শুনে দৃষ্টির পরিবর্তন ঘটে তিয়াসের। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে অস্ফুটে স্বরে বলে,
” কী?”
তিয়াসের খালার খুব রাগ হয়। একটা মেয়ের জন্য এভাবে চোখের সামনে শেষ হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা।
” আপনাকে সব সময় ভালো থাকতে বলেছে। নিজেকে অনেক বড়ো স্থানে পৌঁছে সবাইকে দেখিয়ে দিতে বলেছে। আর বলেছে ভালোবাসা মানে শুধু পাওয়া নয়,একসাথে থাকা নয়। দূর থেকেও ভালোবাসা যায়। ভালোবাসা পবিত্র, অস্পর্শী।”
কী যে হলো কেউ বুঝলোনা। হুট করেই রিক্তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলে লাগলো তিয়াস। রিক্তা নিজেও জমে গেছে। মানুষটাকে এভাবে দেখবে কখনো ভাবেনি। সেই প্রথম দেখা থেকেই তো ভালোলাগা ছিলো তিয়াসের প্রতি। কিন্তু বান্ধবীর জন্য নিজের আবেগ,অনুমতি সবকিছু চাপা দিয়ে রেখেছিলো হৃদয়ে। রিক্তা তিয়াসের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো একবার। মিনিট পাঁচেক পরে তিয়াস স্বাভাবিক হলো কিছুটা। প্রিয়ন্তির মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
” একবার কথা বলতে বলবেন প্রিয়কে? শুধু একবার। ”
” আমি বলবো। তুমি শান্ত হও।”
” সরি রিক্তা, আমি আসলে তখন নিজেকে সামলাতে পারিনি। ”
” ইট’স ওকে। আপনি নিজের খেয়াল রাখুন। ইনশাআল্লাহ সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ”
তিয়াস তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,
” হ্যাঁ সবকিছুই ঠিকঠাক হচ্ছে আমার জীবনে আর হবেও।”
সবার দৃষ্টি মাটিতে। তিয়াসের এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে কারো কিছু বলার নেই। সবকিছু কি মানুষের হাতে থাকে? শত চেষ্টা করেও কাজ হয় না যদি না উপরওয়ালা চান। কথায় আছে না জন্ম,মৃত্যু, বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে।
খাওয়াদাওয়ার পরে বেশিরভাগ অতিথি চলে গেছে। কিছু আত্মীয়স্বজনরা আছেন যারা একেবারে নিজেদের। উনারাও চলে যাবেন অবশ্য পরে। যতটুকু না খেলেই বাঁচা সম্ভব না ঠিক ততটুকু খেয়েছে প্রিয়ন্তি। তাও খেতো না কিন্তু আনহা সব সময় জোঁকের মতো সেঁটে থাকে। তাই খেতে হয়েছে। আবরিশামের চাচাতো বোন শিল্পী প্রিয়ন্তিকে ঘরে বসিয়ে রেখে বেরিয়েছে। হুট করে বিয়ে হওয়াতে অনেক আত্মীয় স্বজনরা আসতে পারেনি। আনহা ছোটো বলে আগেই মায়ের বকা খেয়ে ঘুমাতে গিয়েছে। ফুলের সাজে সজ্জিত বিছানায় একা বসে আছে প্রিয়ন্তি। বুকটা কেমন ধুকপুক করছে। স্বামী নামক লোকটার সাথে আর কোনো কথা হয়নি তার। এখন এলে সরাসরি সে-ও বলে দিবে সবকিছু । তবে একটা বিষয় নিশ্চিত লোকটা অন্তত স্বামীর অধিকার ফলাতে আসবে না। কারণ সকালে আবরিশাম অগ্রীম বলেছিলো ,স্ত্রী হিসেবে মানতে পারবে না তাকে। মায়ের সাথে কথা হয়েছে প্রিয়ন্তির। তিয়াসের কথা শুনে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল তার। মনস্থির করেছে তিয়াসের সাথে ফোনে কথা বলবে সে। কিন্তু এতো লোকজনের মধ্যে সুযোগ হয়ে উঠেনি। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো প্রিয়ন্তি। রাত বারোটা ছুঁইছুঁই। আবরিশাম হয়তো না-ও আসতে পারে ভেবে ফোন হাতে নিলো। ব্লকলিস্ট ঢাকা সরালো তিয়াসের নম্বর। হুট করে কল দিলে কী বলবে কিংবা কল আসলে প্রিয়ন্তি এলোমেলো হয়ে যাবে বলেই ব্লক করে ছিলো নম্বরটা। কী অদ্ভুত বিষয় তাই না? একটা সময় যেই নম্বরগুলো আমাদের কল লিস্টের সবার উপরে থাকে, সময়ের আবর্তনে আবার সেই নম্বরগুলোই হারিয়ে যায় সব নম্বরের শেষে। অথবা জমা হয় গিয়ে ব্লক লিস্টে! পরিস্থিতি বুঝি এভাবেই সবকিছু বদলে দেয়? আসলে বিষয়টা অন্যভাবে ভাবলে বোঝা যায়, মানুষ সব সময় পরিস্থিতির শিকার হয় না। মাঝে মধ্যে পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে। প্রিয়ন্তি চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে কল দিলো তিয়াসকে। রিং হচ্ছে! দু’জন নরনারীর বুকের ভেতর কী নিদারুণ অস্থিরতা খেলে যাচ্ছে তা ব্যাখ্যা করতে পারছি না। একজন কল আসায় অস্থির হয়ে গেছে আরেকজন কারো কন্ঠস্বর শোনার অপেক্ষায় অস্থির হয়ে গেছে। তিয়াস আর দেরি না করে কল রিসিভ করলো। প্রিয়ন্তি চোখ বন্ধ করে ফেললো। কতদিন পরে সেই কন্ঠ!
” ফুলসজ্জার রাতে ফুলের বিছানায় বসে আমাকে কল দিলে যে প্রিয়? তোমার স্বামী কি পাশে নেই? ”
প্রিয়ন্তির হৃদয়ে সরু ছুরি দিয়ে আঘাত করার মতো চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো। কী নিষ্ঠুরতম কথা! অথচ এসব তো বাস্তবতা। প্রিয়ন্তি কাঁদছে। তিয়াস বুঝতে পেরেছে সেটা আগেই।
” আমাকে ক্ষমা করে দিও। ”
” তোমার কোনো ভুল নেই প্রিয়। আমি তোমাকে ভালোবাসতাম, ভালোবাসি, ভালোবাসবো। বিশ বছর পর যদি কয়েক বাচ্চার মা হও,কোনো কারণে আমার কাছে ফিরে আসো তবুও তুমি আমার সেই দেবী হয়ে থাকবে, যাকে হৃদয় আসনে বসেয়েছিলাম খুব আদরে। যদিও আমি চাই না তোমার সংসার কখনো ভাঙুক। ”
” এসব বলো না আর। আমি ভুল করেছি। মায়ের সুখের কথা ভাবলে মা’কে নিয়ে লোকের বাড়ি কাজ করে খাওয়াই শ্রেয় ছিলো। মা মুখে কিছু না বললেও তার কথায় বুঝেছি আমি কোনো কিছু ঠিক হয়নি তিয়াস। আমি যে নিজেই নিজের জন্য মরে যাচ্ছি। ”
চলবে,