#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_২০
#লেখিকা_Esrat_Ety
“আজ জাহিনের সাথে আমার বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে। বিচ্ছেদের কারণ খুব সাধারণ, ইন্টারেস্টিং কিছু না। কারন হলো আমি একটা ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। আমার বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। আমার মা আমার বাবাকে রেখে নিজের খালাতো ভাইয়ের সাথে পালিয়ে গিয়েছিলো বলে আমারো চরিত্রে সমস্যা থাকার ১০০% সম্ভাবনা রয়েছে। এগুলো অবশ্য জাহিনের কথা না,তার মায়ের কথা। তিনি আমাকে জাহিনের অযোগ্য ঘোষণা করে দিয়েছে। আমি তার মতামতের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে তার দুধের খোকাকে টাটা বাই বাই করে দিয়ে এসেছি। বাবাকে সব বলেছি। বাবা ভাবছে আমার মন খারাপ। কিন্তু না,কথাটা মিথ্যা। সত্যি কথা হচ্ছে আমার মন শুধু খারাপ না। আমার মন ভয়ংকর খারাপ। কান্না পাচ্ছে ভীষণ। কিন্তু কাঁদা যাবে না। রোদেলা আমিন কখনোই কোনো মায়ের “সন্টু মন্টু” আঁচল ধরা ছেলের জন্য কাঁদবে না। জাহিন তুমি জাহান্নামে যাও। রোদেলা আমিন তোমার জন্য কাঁদবে না ।
_রোদেলা আমিন
_ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে।”
ডায়েরীর এই পৃষ্ঠায় এতটুকুই লেখা। তাশরিফ ডায়েরীর পাতা ওল্টায়। পরের পাতায় আরো কিছু লেখা।
“আজ অফিসে একজন ভদ্রলোকের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। ভদ্রলোকের নাম তাশরিফ হাসান। ফরসা, সুন্দর,গালে একটা কাটা দাগ আছে ক্রিমিনালদের মতো।”
এটুকু পড়ে তাশরিফ নিজের গালে হাত দেয়। হাত বুলিয়ে কাটা দাগ টা ছোঁয়। তারপর আবার পড়তে শুরু করে।
“লোকটা আমার সিনিয়র। মনে হচ্ছে রাজা রামমোহন রায়ের বংশোধর। খুবই পরোপকারী। আমাকে সাহায্য করতে এসে বিনিময়ে আমার কাছে অপমানিত হয়ে গিয়েছে। নিশ্চয়ই আমাকে খুব অসভ্য এবং অভদ্র একটি মেয়ে ভেবেছে। তার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। কিন্তু কি বলে ক্ষমা চাইবো? তাকে গিয়ে এটা বলবো? যে শুনুন গতকাল না আমার প্রেমিকের সাথে আমার ব্রেকাপ হয়ে গিয়েছে তাই আমার মন ভালো ছিলো না। আর সেজন্য আপনার সাথে বাজে ব্যবহার করে ফেলেছি। প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দিন!”
তাশরিফ এতটুকু পড়ে মুচকি হাসে। বিড়বিড় করে বলে,”এ তো আস্ত নাটক বাজ একটা মেয়ে। দেখলে তো মনেই হয়না!”
আরো কিছু পাতা পড়তে থাকে তাশরিফ। একটা পাতায় এসে সে থেমে যায়,
“সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিয়ে করবো না। বিয়ে করবো না,করবো না,করবো না,বিয়ে করবো না।”
তাশরিফ হাসতে থাকে লেখাটি পড়ে। হাসতে হাসতে আরো কিছু পাতা সে ওল্টাতে থাকে। হাবিজাবি অনেক কথা লিখে রেখেছে তার পেঁচা মুখী। ডায়েরী বন্ধ করে ফেলে সে। আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে একবার দেখে সে। কাটা দাগের জন্য আসলেই কি তাকে ক্রিমিনালের মতো লাগে? সে যাই হোক,পেঁচা মুখীর ডায়েরীতে তার নিজের নামটা দেখে খুবই আনন্দিত লাগছে। এই আনন্দে একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে খুব। এই রুমে বসে সিগারেট ধরালে ওই পেঁচা মুখী নির্ঘাত কাল বুঝে যাবে,তার চেয়ে ছাদে গিয়ে খেয়ে আসা যাক!
***
“ওরা ঘুমিয়েছে?”
মেঘলা সুহার মাথার বালিশটা ঠিক করে দিতে দিতে নিচু স্বরে জবাব দেয়,”হু।”
সাদাফ লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,”আজ আমাদের বিয়ের প্রথম রাত আর আজই ঝামেলা হতে হলো। কি একটা অবস্থা বলো তো মেঘলা!”
মেঘলা সাদাফের মুখে তুমি সম্বোধন শুনে খানিকটা চমকায়। পর মুহূর্তেই মনে পরে তাদের তো বিয়ে হয়েছে,বৌকে তো তুমি করেই বলবে।
মেঘলা বলে,”নিচে কি ঝামেলা হয়েছে?”
সাদাফ হাত থেকে ঘড়িটা খুলে রাখে,বলে,”কিছু না। একটা বিচার করে দিয়ে এলাম। বৌয়ের গায়ে কারনে অকারণে হাত তোলে। দিয়েছি নাক ভেঙে। ইহ জনমে আর বৌয়ের গায়ে হাত তোলার সাহস পাবে না।”
মেঘলা চমকে ওঠে,বলে,”নাক ভেঙেছেন মানে?”
সাদাফ হাসে,বলে,”ও কিছু না। আচ্ছা তুমি এক কাজ করো তো মেঘলা। দুই কাপ কড়া লাল চা বানিয়ে নিয়ে বারান্দায় এসো,সাথে একটু লেবু চিপে দিও।”
মেঘলা উঠে দাঁড়ায়। অবাক হয়ে বলে,”আমি তো চা খাই না। এক কাপ নিয়ে আসবো?”
_না দুই কাপই আনবে। কারন আমি কথা বলে বলে তোমার মাথা ধরিয়ে দেবো। চা খেলে ভালো লাগবে তোমার।
সাদাফ কথাটি বলে বারান্দায় চলে যায় । মেঘলা কয়েক সেকেন্ড মানুষটাকে দেখে রান্নাঘরে চলে যায়।
চা বানিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় মেঘলা। সাদাফ তার দিকে না তাকিয়ে বলে,”বসো।”
মেঘলা সাদাফের পাশে বসে তার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দেয়। সাদাফ একপলক মেঘলার দিকে তাকিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দেয়।
“চা টা ভীষণ ভালো হয়েছে। ধন্যবাদ।”
মেঘলা মুচকি হাসে। সাদাফ বলে,”তুমি আমার ব্যপারে কিছু জানতে চাইলে বলো।”
মেঘলা অস্ফুট স্বরে বলে,”সুহা সিরাতের মায়ের মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল?”
সাদাফ কয়েক মুহূর্ত মেঘলার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,”আমি বলেছি আমার ব্যপারে জানতে চাও কি না। যাই হোক,বলছি,
সিমিন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে।”
মেঘলা চুপ করে থাকে। সাদাফ চা শেষ করে বলে,”তুমি কি জানো আমার তোমার পাশে বসে থাকতে খুবই নার্ভাস লাগছে?”
মেঘলা কিছু বলে না,মাথা তুলে তাকায় শুধু। সাদাফ বলে,”আমি এর আগে এতো ফর্সা মেয়েকে এতটা কাছ থেকে দেখিনি। সিমিনের গায়ের রঙও আমার মতোই ছিলো। তোমার গায়ের এই ফর্সা রঙ আমার চোখে বিঁধে যেতে চাইছে।”
সাদাফ মেঘলাকে অবাক করে দিয়ে মেঘলার গালে একটা আঙ্গুল ছোঁয়ায়। বলে,”আঙ্গুল টা তোমার গালে রাখতেই তোমার গাল কেমন লাল হয়ে গিয়েছে দেখো।”
মেঘলার খুব হাসি পাচ্ছে লোকটার এমন পাগলাটে আচরণ দেখে। এতটা গুরুগম্ভীর একজন মানুষের ভীতরে এতো বাচ্চামো থাকতে পারে তা দেখে বোঝার উপায় নেই।
সাদাফ মেঘলার একটা হাত ধরে। মেঘলা কিছুটা কেঁপে ওঠে, পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা চাবির গোছা বের করে মেঘলার হাতের তালুতে রেখে হাতটা মুঠি করে দিতে দিতে বলে,”চাবির সাথে সাথে এই সংসারের দায়িত্ব,সুহা সিরাতের দায়িত্ব,আমার মায়ের ওষুধের দায়িত্ব,দেয়ালের প্রতিটা ইটের দায়িত্ব,রান্নাঘরে চায়ের পাতার কৌটার দায়িত্ব, মাসিক বাজারের হিসাবের দায়িত্ব, আমার ওয়ালেটের খুচরা টাকার দায়িত্ব, লন্ড্রিতে দেওয়া আমার জামাকাপড়ের দায়িত্ব, এই আস্ত আমিটার দায়িত্ব আমি তোমার মুঠোয় তুলে দিলাম। যথাযথ ভাবে পালন করতে পারবে না?”
মেঘলা নিশ্চুপ হয়ে আছে। এতো সুন্দর করে কথা কিভাবে বলে এই লোকটা! জনগনকে পটাতে পটাতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে বোধ হয়।
মেঘলা অস্ফুট স্বরে জবাব দেয়,”চেষ্টা করবো।”
***
বিছানায় এপাশ ওপাশ করে উঠে বসে রোদেলা। তার ঘুম আসছে না। সে কখনোই নিজের বিছানা ছেড়ে অন্য কারো বিছানায় ঘুমোতেই পারেনা। তার ওপর সেতু আপুর নাক ডাকার স্বভাব। রোদেলা অবাক হয়,এর সাথে এর হাজবেন্ড ঘুমায় কিভাবে! নাক ডাকার শব্দে পুরো রুম আলোড়িত হয়ে গিয়েছে।
রোদেলা বিছানা থেকে নামে। জানালার কাছে গিয়ে তার মন ভালো হয়ে যায়। আজ রাতের চাঁদটা এতো চমৎকার ! জানালা দিয়ে সৌন্দর্য পুরোটা উপভোগ করা যাচ্ছে না! এই সৌন্দর্য খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়। ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ হেটে আসবে সে? কিন্তু কেউ দেখে ফেললে তাকে পাগল ভাববে যে। দুমিনিট রোদেলা চিন্তা করে। তারপর বিড়বিড় করে বলে,”ভাবলে ভাবুক! রোদেলা থোরাই কাউকে পরোয়া করে!”
ধীরে ধীরে পা ফেলে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে থাকে রোদেলা। ছাদের দরজার কাছে আসতেই তীব্র সিগারেটের গন্ধ তার নাকে যায়। রোদেলা নাক চোখ কুঁচকে ফেলে। সিগারেটের গন্ধ আসছে কোথা থেকে! অদ্ভুত।
ছাদে পা ফেলে মাথা ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখতে থাকে সে। একটু দূরেই একটা আবছায়া দেখে চমকে ওঠে সে। কিছুটা ভীত হয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”কে ওখানে!”
অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে প্রিয় নারী কন্ঠটি শুনতে পেয়ে তাশরিফও কিছুটা চমকে ওঠে। তার হাতে জ্বলন্ত একটা সিগারেট। মাথা ঘুরিয়ে সে দেখে রোদেলা আমিন তার কিছুটা পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, চেহারায় ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
তাশরিফ অবাক হলেও রোদেলার ভীত মুখ দেখে বলে,”ভয় পাবেন না। আমি তাশরিফ হাসান।”
রোদেলা কাঁপা কন্ঠেই বলে,”আপনি এখানে কি করছেন!”
_আরেহ আপনি তো ভীষণ ভয় পেয়েছেন দেখছি। আমি কোনো জ্বীন ভুত নই। এই দেখুন,আমার হাতে সিগারেট। জ্বীন সিগারেট খায় না।
রোদেলা একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”আপনাকে জ্বীন ভেবেছি কে বললো? সবসময় সস্তা ধরনের রসিকতা করতেই হবে?”
তাশরিফ হাসে। বলে,”এগুলো খুবই দামী ধরনের রসিকতা। যার তার সাথে আমি করি না। আপনি কৃপণ তাই আপনার কাছে সস্তা রসিকতা মনে হয়।”
রোদেলা চুপচাপ মাথা ঘুরিয়ে চলে যেতে নিলে তাশরিফ পেছন থেকে ডাকে,”আপনি এসেছিলেন কেনো এতো রাতে এখানে?”
রোদেলা মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। বলে,”যে কারনেই আসিনা কেনো আপনার জানতে হবে না,আপনি সিগারেট ফুঁকুন।”
কথাটি বলেই রোদেলা হনহন করে হেঁটে চলে যায়। তাশরিফ দাঁড়িয়ে আছে। বিড়বিড় করে বলে ” কি চাবুকরে বাবা!”
***
তাশরিফের ঘোর কাটছে না। এটা কি তার ভ্রম না সত্যি? রোদেলা আমিন এভাবে হঠাৎ করে তাদের বাড়িতে এসেছে! তাও এই ছুটির দিনে, দুপুর বেলায়। এরকম হুট করে তো পেঁচা মুখী কখনো আসেনি। রোদেলা তাশরিফকে বলে,
“আপনি যদি দরজা থেকে সরে দাঁড়ান তাহলে আমি ভেতরে আসতে পারি।”
তাশরিফ সরে দাঁড়ায়। রোদেলা বলে,”সকালে ফোনে কথা বলতে গিয়ে টের পেলাম বৃষ্টি হাপাচ্ছে। ওকে দেখতে এলাম। কোথায় ও?”
_হ্যা খানিকটা অসুস্থ হয়ে পরেছিল। ডক্টর ডেকেছিলো আদিল, চেক আপ করে দিয়ে গিয়েছে।
রোদেলা হেটে বৃষ্টির রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়। দরজায় টোকা দিয়ে বলে,”আসতে পারি?”
ওপাশ থেকে ধরা গলায় বৃষ্টি জবাব দেয়,”এসো আপু।”
রোদেলা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে। বৃষ্টি শুয়ে আছে। তার মাথার কাছে বসে আছে তাহমিনা। তিনি রোদেলাকে পছন্দ না করলেও শুকনো হাসি হাসে। রোদেলা সালাম দিলে সালামের উত্তর দেয়।
রোদেলা বৃষ্টির কাছে যায়,”কদিন ধরে এই অবস্থা? বলিসনি কেনো? বাবা,আপু সবাই শুনে টেনশন করছে খুব।”
_আপু তেমন কিছুই না। তুমি টেনশন করো না। আমি ঠিক আছি।
_তা তো দেখতেই পাচ্ছি কেমন ঠিক আছিস।
তাহমিনা বিরক্ত হয়। এই মেয়েটা সবসময় কাট কাট কথা বলে। খুব সুক্ষ্ম ভাবে খোঁচা দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করে যেন তারা বৃষ্টির খেয়াল রাখতে গাফিলতি করছে।
বৃষ্টি রোদেলাকে বলে,”তুমি আমাকে একটু রামেন করে খাওয়াবে আপু? আমার তোমার হাতের রামেন খেতে ইচ্ছে করছে খুব।”
রোদেলা বোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। কতদিন পরে ছোট্টো সেই বৃষ্টি তার কাছে আবদার করছে। তাকে তো এই আবদার রাখতেই হবে।
তাশরিফ রান্নাঘরের কাছে এসে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,”মা একটু চা পাওয়া যাবে?……”
তারপর রান্নাঘরে রোদেলাকে দেখে থমকে যায়। শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে রান্নাঘরে কিছু একটা নাড়াচাড়া করছে সে, হাতে খুন্তি। অপলক দৃষ্টিতে তাশরিফ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তাশরিফের কাছে মনে হচ্ছে তার সামনে যে দৃশ্যটি সে দেখছে তাতে পৃথিবীর সমস্ত মুগ্ধতা লুকিয়ে আছে। রোদেলা আমিনকে পুরোদস্তুর একজন গৃহিণী লাগছে। তাশরিফের মুগ্ধতার রেশ কাটছে না।
রোদেলা কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে পেছনে ফিরে তাকায়। তাশরিফ মুগ্ধতার ঘোর থেকে বের হয়ে বলে,”মা কোথায়? আমি ভেবেছি মা রান্নাঘরে। চা চাইতে এসেছিলাম।”
রোদেলা চুলার আঁচ কমিয়ে দিয়ে বলে,”আপনার মা বৃষ্টির কাছে। চা আমি বানিয়ে দিলে হবে?”
তাশরিফ যেন আনন্দে নেচে ওঠে। এ তো মেঘ না চাইতেই জল! হঠাৎ করে পেঁচা মুখী এতো ভদ্র হয়ে গেলো কিভাবে! সব থেকে বড় কথা কয় মিনিটের জন্য এই ভদ্রতা! ঠিকই তো কিছুক্ষণ পরে তাশরিফের সাথে কিচকিচ করে কথা বলবে!
তাশরিফ আনন্দ মাটি চাপা দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,”যদি আপনার সমস্যা না হয় তো….”
_দিচ্ছি।
রোদেলা এক শব্দে উত্তর দিয়ে আরেকটি চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে দেয়।
চা বানিয়ে তাশরিফের হাতে চায়ের কাপ দিতেই তাশরিফ প্রস্বস্ত একটা হাসি দিয়ে বলে,”ধন্যবাদ।”
তাহমিনা বৃষ্টির রুম থেকে বেরিয়ে এই দৃশ্য দেখে কিছুটা থমকে যায়। দৃশ্যটি খুবই স্বাভাবিক। রোদেলা তার ছেলেকে চা দিচ্ছে। তার ছেলে রোদেলাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। কিন্তু এই স্বাভাবিক ব্যাপারটি তাহমিনার কাছে অস্বাভাবিক ঠেকে। তার ছেলের চোখে মুখে এতো আনন্দের ছটা কেনো! তাহমিনা খেয়াল করেছে, রোদেলাকে দেখলেই তাশরিফ কেমন যেনো অন্যরকম হয়ে যায়। লাজুক ভঙ্গিতে হাসে। এসব তো সুবিধার লক্ষন না। তাহমিনা সব বুঝতে পারে। বুড়ো তো বাতাসে হয়নি সে। কিছুটা ভ্রু কুঁচকে ফেলে সে। রোদেলা রান্নাঘরে চলে গিয়েছে। তাশরিফ চায়ে চুমুক দিয়ে রোদেলাকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে। আর তাহমিনা দেখছে ছেলের চোখে ওই রোদেলা নামের মেয়েটির জন্য মুগ্ধতা।
***
চায়ের কাপটা সাদাফের পাশে রেখে মেঘলা শুকনো জামাকাপড় গুলো হাতে নেয় গুছিয়ে রাখবে বলে। সাদাফ একটা নিউজপেপার পড়ছিলো। নিউজপেপার থেকে চোখ না সরিয়েই মেঘলাকে বলে,”তুমি কি জানো নীল শাড়িতে তোমাকে অপরাজিতা ফুলের মতো লাগছে? আজ থেকে সব নীল রঙের শাড়ি কিনবে। সবসময় নীল রঙের শাড়ি পরে থাকবে।”
মেঘলা চমকে তাকায় সাদাফের দিকে। লোকটা তো নিউজপেপার থেকে মুখ সরালোই না,তার শাড়ির রং লক্ষ্য করলো কিভাবে!
অবশ্য সাদাফের এই অভ্যাস সম্পর্কে মেঘলা অবগত হয়ে গিয়েছে। আড়চোখে মেঘলাকে লক্ষ্য করে খুব। মেঘলা কখনো কখনো টের পায়। সাদাফ নিউজপেপার পাশে সরিয়ে রেখে মেঘলার একটা হাত ধরে মেঘলাকে টেনে তার পাশে বসিয়ে দেয়। এখনো জড়তা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি মেঘলা। তাই সাদাফের হুটহাট ছোঁয়ায় তাকে চমকাতে হয় রোজ। কিন্তু একটা ব্যাপার তার অদ্ভুত ভালো লাগে। সাদাফের ধৈর্যশীলতা তাকে মুগ্ধ করেছে। স্বামী স্ত্রী হয়েছে বলে কখনো মেঘলার সাথে জোর জবরদস্তি করে না লোকটা। কখনো মলিনতা নিয়ে সে ছোয়না মেঘলাকে। মাইনুলের মতো মেঘলাকে কেবল নিজের কৃতদাসীর চোখে দেখে না। স্বামী স্ত্রীর কাছাকাছি আসার সময়টাতে কখনোই মেঘলার মনের উপর জোর দেয়না সে। সে আগে সম্মানের সাথে জানতে চায় মেঘলা তার ভালোবাসা পেতে ইচ্ছুক কি না। অন্তরঙ্গ মুহূর্তে মাইনুলের মতো কখনোই তার দৃষ্টি শুধু মেঘলার শরীরে নিবদ্ধ রাখে না। মেঘলার চোখে চোখ রাখে। কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে স্ত্রী হিসেবে সম্মানিত করে সবসময় ।
চুপচাপ বসে আছে মেঘলা। সাদাফ মেঘলার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,”সিরাত আর সুহার মায়ের কি মন খারাপ?”
মেঘলার চোখ ভিজে ওঠে। লোকটা যখনি তাকে আদুরে কন্ঠে এই নামে ডাকে মেঘলার মন ভরে যায়। বুকের মধ্যে কেমন শান্তি অনুভূত হয়।
মাথা ঝাঁকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,”না তো। মন খারাপ কেনো থাকবে?”
_তাহলে মুখটা এতো শুকনো লাগছে কেনো?
মেঘলা মাথা নিচু করেই বলে,”ভুল ভাবছেন। আমার মন খারাপ নেই।”
_সুহা সিরাত ঘুমিয়েছে?
_দাদীর কাছে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়েছে।
_আজ বৃষ্টি পেয়ে ঘুমাচ্ছে। নয়তো ওদের বিকেলে ঘুম পাড়ানো কার সাধ্যি!
মেঘলা মুচকি হাসে,”যতটা বলেন,আমার ছেলে মেয়ে দুটো অতটা দুষ্টু নয়। অনেকটা লক্ষী!”
_হু,শুধু মাঝে মাঝে মাথার তার ছিঁড়ে যায় তোমার ছেলে মেয়ের।
মেঘলা হাসছে। সাদাফ মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,”চা টা তো ঠান্ডা হয়ে গেলো। যাও আরো দুকাপ চা বানিয়ে নিয়ে এসো। খেতে খেতে গল্প করবো।”
মেঘলা চা বানিয়ে ঘরে ঢোকে,তার দুহাতে দুই কাপ চা । সাদাফ বলে,”দরজার সিটকিনি টা লাগিয়ে দিয়ে এসো।”
মেঘলা বলে,”কেনো?”
_কিছু গল্প দরজা বন্ধ করে করতে হয় তাই।
***
তাহমিনা ছেলের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। তাশরিফকে একটু বাজিয়ে দেখা দরকার। মনটা কেমন অশান্ত হয়ে আছে তার। তার ধারণা যদি সত্যি হয় তাহলে সে মানতেই পারবেনা কিছুতে এসব।
তাশরিফ কিছু পেপার্স দেখছিলো। মাকে দেখে অবাক হয়ে বলে,”কি মা? এতো রাতে?”
তাহমিনা হাসতে হাসতে বলে,”তোর সাথে কথা বলতে এলাম।”
তাশরিফ হেসে বলে,”আবার কোনো পাত্রীর ছবি নিয়ে এসেছো নাকি? তাহলে মা দরজা থেকেই ফেরত যাও। ভেতরে ঢুকবে না প্লিজ।”
তাহমিনা শুকনো মুখ করে ভেতরে ঢোকে। তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে শুরু করে,”তোর বাবা বরিশাল থেকে একটা সম্মন্ধ নিয়ে এসেছে। তোর বাদল চাচার বড় ছেলে আছে না? তার জন্য একজন উচ্চশিক্ষিতা মেয়ে লাগবে। আমি আর তোর বাবা মিলে ঠিক করেছি বৃষ্টির বাবার কাছে রোদেলার জন্য প্রস্তাব টা রাখবো।”
তাশরিফ মায়ের দিকে তাকায়। তার হাতের কাগজটা পরে যায়। তাহমিনা ছেলেকে দেখতে থাকে। তার যা বোঝার বোঝা হয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবে বলে,”ভালো হবে তাই না। কি বলিস?”
তাশরিফ চাপা স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে,”না।”
_না মানে ? মেয়েটার বয়স বেড়ে যাচ্ছে দেখেছিস?
_তাতে হয়েছে টা কি?
তাহমিনা কপাল কুঁচকে বলে,”তুই এতো বাধ সাধছিস কেনো? তোর সমস্যা কোথায়?”
তাশরিফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ছাড়ে। তারপর দৃঢ় কন্ঠে বলে ওঠে,”কারন আমি রোদেলা আমিনকে পছন্দ করি। রোদেলা আমিনকে আমি বিয়ে করতে চাই মা!”
চলমান….