দ্বিতীয়_ফাগুন #পর্বসংখ্যা_১৫ #লেখিকা_Esrat_Ety

0
533

#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_১৫
#লেখিকা_Esrat_Ety

সন্ধ্যার দিকে ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে একবার। এখন আবহাওয়া থমথমে হয়ে আছে। রাস্তার কাঁদা পানি ছিটকে শাড়িতে লেগে যাচ্ছে। মেঘলা শাড়ির কুচি ধরে শাড়ি সামান্য উপরে তুলে হাঁটছে। রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। দুয়েকটা চায়ের দোকান বাদে সবগুলোই বন্ধ। দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে সে। বেশ ভয় ভয় করছে তার। রোদেলার মতো রাত বিরাতে বাইরে চলাচল করার অভ্যাস তার নেই। মনে হয় এই বুঝি কোনো ছিনতাইকারী তার পিছু নেবে। ভয়ার্ত চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে হাঁটছে সে। আজ গিয়েছিলো চাকরির একটা ইন্টারভিউ দিতে। সেখান থেকে এক বান্ধবীর বাসায়। আর সেই বান্ধবীর বাসা থেকে বের হতে হতেই এতো রাত হয়ে গেলো। রোদেলা ফোন দিচ্ছে বারবার,খুব চিন্তা করছে সে।

হাঁটতে হাঁটতে একটা চায়ের দোকান অতিক্রম করতে নিলে চোখ যায় সালমান সাদাফের দিকে। চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে ছেলে পুলেদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে, ভদ্রলোক সব সময় কিছু সৈন্য সামন্ত নিয়ে হাঁটে। যারা সকাল বিকাল জপ করতে থাকে,”আমার ভাই, তোমার ভাই। সাদাফ ভাই,সাদাফ ভাই!
এই লোকটা কি সবসময়ই পাঞ্জাবির উপরে মুজিব কোট পরে থাকে!
সাদাফ একপলক তাকিয়ে মেঘলাকে দেখে তারপর আবারো কথা বলতে শুরু করে ‌। মেঘলা চোখ সরিয়ে হাঁটতে থাকে। কয়েক গজ দূরে যেতেই একটা কমবয়সী ছেলেদের দল দেখতে পায়। মেঘলার দিকে কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে আছে সবাই। নারী মানেই তো কৌতুহলের বিষয়। মেঘলার কাছে ছেলে গুলোর চাহনি ভালো লাগে না,দ্রুত তাদের অতিক্রম করতে নিলে সেই দলের মধ্যে থেকে আওয়াজ আসে,”আবহাওয়া টা বেশ ঠান্ডা ছিলো,এভাবে গরম করে দেওয়ার কি দরকার ছিলো !”

মেঘলা দাঁড়িয়ে পরে। কুঁচি থেকে হাত সরিয়ে আঁচল টেনে নিজেকে ভালোভাবে ঢেকে নেয়। বড় বোনের বয়সী একটা মেয়েকে দেখেও এদের অসভ্যতামি করতে ইচ্ছে করে! কি নোংরা মানসিকতার এরা ! বয়স কত হবে ! কলেজ পড়ুয়া সম্ভবত সবাই। মেঘলার সাহস নেই ওদের গিয়ে চড় মারার। সে রোদেলার মতো সাহসী না। তাই সামনে পা বাড়ায়। ছেলে গুলো চাপা হাসিতে ফেটে পরে।
হঠাৎ করে পেছন থেকে চড়ের বিকট শব্দে মেঘলা দাঁড়িয়ে পরে।
মাথা ঘুরিয়ে দেখে সালমান সাদাফ নামের লোকটা একটা ছেলের কলার ধরে রেখেছে। সম্ভবত সেই ছেলেটিই মেঘলাকে বাজে মন্তব্য করেছে।

মেঘলা দাঁড়িয়ে ওদের দেখে। সাদাফ তার এক শিষ্যের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”এই বান্দির বাচ্চা গুলোকে আর এই তল্লাটে দেখলে সোজা ঠ্যাং-এর উপর মারবি শাওন।”

শাওন নামের ছেলেটা চেঁচিয়ে বলে,”জ্বি ভাই।”

সাদাফের কয়েকটা ছেলে ওদের ঘার ধাক্কা দিয়ে পথ দেখিয়ে দেয়। ছেলে গুলো লেজ গুটিয়ে এক প্রকার পালিয়ে যায়।

মেঘলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সাদাফ এগিয়ে আসে। গম্ভীর কন্ঠে বলে,”চলুন আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।”

মেঘলা কয়েক মুহূর্ত আগের ঘটনায় কিছুটা অবাক হয়ে গিয়েছে। দেখতে এতো সভ্য শান্ত লোকটা গালি দিতেও জানে! অদ্ভুত!

সাদাফ তার বলিষ্ঠ শরীর হেলিয়ে দুলিয়ে মেঘলার সামনে হাটছে। মেঘলা তার পেছনে। নীরবতা ভেঙে সাদাফ বলে,”এতো রাতে যেসব মেয়েদের বাইরে চলাফেরা করতে হয় তাদের আরেকটু শক্ত ধাঁচের হতে হয়। আপনার বোনকে দেখি,খুব সাহসী মেয়ে। সেদিন দেখলাম একটা ছেলেকে শিস বাজানোর অপরাধে চড় মেরে হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে দিয়েছে । হাঁটাচলাও সিংহীর মতো। তা আপনি এরকম ভ্যাবলা কেনো?”

মেঘলা কি বলবে বুঝতে পারছে না। তাকে এভাবে সরাসরি ভ্যাবলা বলে দিলো লোকটা। প্রতিবাদ করতে না জানলে বুঝি তাকে ভ্যাবলা বলে!

***

“আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।”
একাউন্টস ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র কিছু এম্প্লয়ি তাশরিফকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়।
তাশরিফ মাথা নেড়ে সালামের উত্তর দেয়। রোদেলা উঠে দাঁড়িয়ে অন্যসবার মতো বলে,”আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।”
তাশরিফ দাঁড়িয়ে পরে। সবার দিকে তাকিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,”আপনাদের থেকে মাত্র দুই ধাপ উপরের পদে আছি আমি। বেতন আপনাদের থেকে মাত্র তের হাজার টাকা বেশি। এভাবে উঠতে বসতে দাঁড়িয়ে সালাম দেওয়ার কিছু নেই। এটা কোনো ক্লাসরুম না। আমিও আপনাদের টিচার নই। আমরা সবাই সবার কলিগ।”

কথাটি বলে তাশরিফ চলে যায় এবং একটা ফাকা টেবিল দেখে বসে পরে। আজ অনেকদিন পর সে ক্যান্টিনে খেতে এসেছে। কেবিনে একা একা খেতে একটুও ভালো লাগে না তার।

মেঘলার কানের কাছে মুখ নিয়ে মেহেরিন বলে,”তুমি স্যার স্যার বলছো কেনো? তুমি বলবে আসসালামুয়ালাইকুম বেয়াই সাব।”

তাদের টেবিলে চাপা হাসির রোল পরে যায়। রোদেলা চোখ মুখ শক্ত করে মেহরিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপা আপনার থেকে কোনো ফাজলামি কথা আমি আশা করিনি।”
মেহরিন হাসি থামিয়ে বলে,”সরি রোদেলা। তবে তুমি রাগ হও আর যাই হও। তুমি ঠিক করছো না কিন্তু। সেদিন রিসিপশন অনুষ্ঠানের দাওয়াত খেতে গিয়ে দেখলাম তোমার বোনকে। কি সুন্দর মানিয়েছে দুটিকে। মাশাআল্লাহ। আর দুজনেই ব্রিলিয়ান্ট। দেখবে ওরা ঠিকই একটা ব্রাইট ফিউচার গড় তুলবে ওদের। আর মুখ ফিরিয়ে না থেকে মেনে নাও ওদের। মেয়েটা খুব কষ্ট পাচ্ছে।”

_তাশরিফ হাসান কি আপনাকে উকিল ধরেছে নাকি আমাকে এসব বলার জন্য?
রোদেলা গম্ভীর কন্ঠে মেহরিনকে বলে। মেহরিন বলে,”না। একদমই না। আমি নিজে থেকে বলছি। আর জানো তোমার বোন খুব লাকি। সে তাশরিফের মতো কাউকে ভাসুর হিসেবে পেয়েছে। সেদিন তো গিয়ে দেখলাম সব, ছোটো বোনের মতো কেয়ার করে তাশরিফ তোমার বোনের। ”

কথাটি শুনে রোদেলা তাশরিফের দিকে তাকায়। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে মনে মনে তাশরিফকে বলে,”ধন্যবাদ আমার বোনের কেয়ার করার জন্য তাশরিফ হাসান স্যার।”

খাওয়া রেখে রোদেলার দিকে হঠাৎ তাকায় তাশরিফ। তার হঠাৎ করে মনে হলো রোদেলা তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু রোদেলা আর তার দিকে তাকিয়ে নেই। সে খুব লজ্জা পেয়ে যায়,মনে মনে বলে,”ধুরর তাশরিফ হাসান। পেঁচা মুখী কোন দুঃখে তোমার দিকে তাকাবে। তার বয়েই গিয়েছে তাকাতে।”

***
“কি হয়েছে বৃষ্টি কোনো সমস্যা?”
বৃষ্টি মাথা নাড়ায়। আদিল বৃষ্টির কাছে এগিয়ে যায়। মৃদু স্বরে বলে,”কি হয়েছে? বলো আমাকে!”

বৃষ্টি অনেকটা সংকোচ নিয়ে নিচু স্বরে বলে,”স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রয়োজন আমার। পিরিয়ড হয়েছে।”

আদিল বৃষ্টির দিকে তাকায়। লজ্জায় মুখটা একটুখানি হয়ে আছে। নিজের স্বামীর কাছে বলতেও এতো লজ্জা!

“এক্ষুনি এনে দিচ্ছি। ”
বিছানা থেকে নেমে গায়ে শার্ট চাপিয়ে নেয় আদিল। ড্রয়ার থেকে ওয়ালেট বের করে বলে,”এই যা। একটা কড়িও নেই। ওয়ালেট পুরো ফাকা। দাঁড়াও ভাইয়া এসেছে কিনা দেখি।”

বৃষ্টি আদিলের হাত টেনে ধরে।
_ভাইয়াকে কি বলবে?
আদিল হেসে ফেলে,বলে,”তুমি এভাবে হাত টেনে ধরলে কেনো আমার? ভয় পাচ্ছো কেনো? আমি কি ভাইয়াকে গিয়ে এটা বলবো যে ভাইয়া আমার বৌয়ের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে হবে,টাকা দাও। পাগল কোথাকার!”

আদিল হাসতে থাকে। বৃষ্টি নিস্তেজ কন্ঠে বলে,”বৌয়ের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে হবে তাও ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিতে হচ্ছে তোমার। আমার খুব খারাপ লাগছে আদিল।”

আদিল বৃষ্টির শুকনো মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ করে তার খুব আত্মসম্মানে লাগে কথাটা। সে বৃষ্টিকে বলে,”বিয়ের আগে ভাবা উচিৎ ছিলো না আমি বেকার? আমি একজন স্টুডেন্ট। আমার উপার্জন নেই,আমি অন্যের উপর নির্ভরশীল! ”

বৃষ্টি আহত চোখে আদিলের দিকে তাকায়। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে,”তুমি রাগ করলে আদিল।‌ আমি তো তোমায় দোষ দেইনি। আমি শুধু আমার খারাপ লাগার কথাটা তোমাকে বললাম….”

আদিল বৃষ্টির কথা গায়ে না লাগিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বৃষ্টি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চোখ বেয়ে দুফোঁটা তরল গড়িয়ে পরে তার।

আধাঘণ্টা পরে রুমে ফিরে এসে আদিল বৃষ্টির হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে গায়ের শার্ট খুলে টি শার্ট পরে নেয়। তারপর গিয়ে বিছানায় ওপাশ ফিরে শুয়ে পরে।

কিছুক্ষণ পরে বৃষ্টি গিয়ে বিছানায় শুয়ে মৃদু স্বরে ডাকে,”আদিল।”

আদিল কোনো সাড়া দেয়না। বৃষ্টির খুব কান্না পাচ্ছে। সে পেছন থেকে আদিলকে জরিয়ে ধরে,”সরি আদিল সরি। আমি তোমাকে অপমান করার জন্য কথাটা বলিনি তুমি বিশ্বাস করো।”

আদিল নিজের গা থেকে বৃষ্টির হাত সরিয়ে দেয়।
***

রুবায়েত ফরাজীর নাম্বার দেখে একবার ভাবলো ফোনটা ধরবে না। তারপর আবার কি মনে করে ফোনটা রিসিভ করে রোদেলা। ওপাশ থেকে নাজমুন্নেছা মলির কন্ঠ ভেসে আসে।

“রোদেলা বৃষ্টি কোথায়। ওর ফোনের কি হয়েছে?”
রোদেলা একবার ভাবলো ফোনটা রেখে দেবে কিন্তু সে বলে,”বৃষ্টির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ও ওর শশুর বাড়ী। ফোনটা ও এ বাড়িতে ফেলে রেখে গিয়েছে।”

_বিয়ে হয়ে গিয়েছে মানে! এসব কি বলছো?
_হু, দশদিন হয়ে গিয়েছে প্রায়। আপনি আজ জানলেন।

_কিন্তু কিভাবে সম্ভব এটা। আমি কিছু বুঝতে পারছি না রোদেলা একটু পরিষ্কার করে বলো।

_বৃষ্টি আজ থেকে দশদিন আগে পালিয়ে গিয়ে ওর প্রেমিককে বিয়ে করে নিয়েছে। ও এখন ওর শশুর বাড়ীতে অবস্থান করছে।ওর শশুর বাড়ী কোথায় আমরা জানি না। ওর নতুন নাম্বার আমাদের কাছে নেই। আরো পরিষ্কার করে বলবো?

নাজমুন্নেছা মলি চুপ হয়ে থাকে। রোদেলা বলে,”প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বোধ হয় আপনার গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছিলো বৃষ্টি। তাও বৃষ্টি আপনার থেকে ঢের ভালো, আপনার মতো সংসার,বাচ্চা ফেলে রেখে পালিয়ে যায়নি। আপনার তো বুড়ি বয়সে ভীমরতি হয়েছিলো। বুড়ি বয়সে ভীমরতি হওয়ার থেকে কচি বয়সে ভীমরতি হওয়া অনেক ভালো।”

রোদেলা ফোন কেটে দেয় কথাটি বলে। সে না চাইতেও কিভাবে যেন প্রত্যেকবার খারাপ ব্যবহার করে ফেলে মলির সাথে।

ফোন রেখে উঠে দাঁড়ায় সে , মেঘলাকে খুঁজতে খুঁজতে রান্নাঘরে গিয়ে দেখতে পায় মেঘলাকে। পেছন থেকে ডেকে বলে,”কি করছো?”

মেঘলা একটা বাটিতে শাহী টুকরা পরিবেশন করে বলে,”খানিকটা তিনতলায় বাচ্চা দুটোকে দিয়ে আসি গিয়ে, বাচ্চা দুটোকে দেখলেই খারাপ লাগে খুব। বৃষ্টির ছোটোবেলার কথা মনে পরে যায়,মা ছাড়া কত কষ্টে বড় হয়েছিলো।”

রোদেলা কিছু বলে না চুপচাপ বোনকে দেখে। একবার ভাবলো বাঁধা দেবে, খামোখা কেনো অন্যের বাচ্চাকে অযাচিত ভালোবাসা দেখাবে। তারপর ভাবে,এসব করে যদি নিজের যন্ত্রনা ভুলে থাকতে পারে তাহলে ক্ষতি তো কিছু নেই।

মেঘলা আঁচল টেনে শরীরটা ভালোকরে ঢেকে চলে যায় নিচে।

কলিং বেলের আওয়াজ হতেই সাদাফ গিয়ে দরজা খুলে দেয়। মেঘলা বিব্রত হয়ে পরে। সে সাদাফকে আশা করেনি। সাদাফ মেঘলাকে এক পলক দেখে তার মাকে ডাকতে থাকে,”মা পাঁচ তলা থেকে কেউ এসেছে তোমার কাছে।”

সাদাফ দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। এখন তার পরনে পাঞ্জাবি আর মুজিব কোট নেই, তার পরনে একটা ট্রাউজার আর টিশার্ট। টিশার্ট টার খুবই নাজেহাল অবস্থা। মনে হচ্ছে বাচ্চা দুটো এতক্ষণ টানাটানি করে এই হাল করেছে। ভেতরের ঘর থেকে বাচ্চা দুটোর চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। মেঘলা ভেতরে ঢোকে। সাদাফের মা জাহানারা এসে দাঁড়ায়। মেঘলা তাকে দেখে বলে,”আন্টি শাহী টুকরা বানিয়েছিলাম,সিরাত আর সুহার জন্য নিয়ে এসেছি।”

ভদ্রমহিলা খুবই খুশি হয়। তারপর বলে,”ওরাও খুব পছন্দ করে। তুমি দাঁড়াও। আমি ওদের ডেকে দিচ্ছি। দেখো কিরকম খুশি হয়ে যায় দুজন।”
ওদের ডাকার আগেই সুহার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে। সিরাত তার পিছু পিছু আসে তাকে মারবে বলে। সাদাফ সুহাকে আগলে নিয়ে সিরাতকে ধমকায়। সিরাত বাবার কথা না শুনে সুহাকে মারতে থাকে। মেঘলা গিয়ে সিরাতকে ধরে। সিরাত মেঘলার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রানপন চেষ্টা করে,”ছাড়ো আমাকে,ছাড়ো আমাকে।”
চেঁচাতে থাকে মেঘলার উপর। মেঘলা হাসে,বলে,”আগে বলো বোনকে আর মারবে না। বোন কাঁদছে দেখো।”
সিরাত জেদ করে মেঘলার হাতে কামড় দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। টি-টেবিলের উপর ম্যাগাজিনের পেপার গুলো একটা ছোট্ট পেপার ওয়েট দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা ছিলো। দৌড়ে গিয়ে সিরাত সেটি উঠিয়ে মেঘলার দিকে ছুড়ে মারে। ঘটনার আকস্মিকতায় সাদাফ হতভম্ব হয়ে যায়, সুহা ও এতক্ষনে কান্না থামিয়ে তাকিয়ে থাকে। মেঘলা কপালে হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। কপালের ডানপাশটায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। আঙ্গুলের ফাক দিয়ে তিরতির করে রক্ত বের হচ্ছে। সিরাত দৌড়ে বাবার ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেয় ভেতর থেকে।

সাদাফ মেঘলার দিকে উৎকণ্ঠা নিয়ে এগিয়ে আসে। মেঘলা হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”আমি ঠিক আছি।”

“এ কিরে আপু! ভালো মানুষ নিচে গিয়েছিলি,কপালে ব্যান্ডেজ নিয়ে ফিরলি কেনো?”
রোদেলা একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে মেঘলাকে ধরে। মেঘলা অস্ফুট স্বরে বলে,”একটা পেইন কিলার দে আমাকে। খুব যন্ত্রনা করছে।”

আয়েশা সিদ্দিকা রান্নাঘর থেকে ওদের দেখছিলো। তিনি একটা পেইন কিলার আর এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে মেঘলার হাতে দেয়।

রোদেলা বলে,”কিভাবে হলো এসব?”
_সিরাত পেপার ওয়েট ছুড়ে মেরেছে।

_পেপার ওয়েট ছুড়ে মেরেছে মানে! পেপার ওয়েট ছুড়ে মারতে যাবে কেনো? আর ওর বাড়ির লোক কি করছিলো? তারা মুখে আঙ্গুল দিয়ে বসেছিলো?

_আরে চেঁচাচ্ছিস কেনো। ছোটো মানুষ,জেদী কিছুটা। জেদ করে বাচ্চারা তো কত কিছুই করে।

রোদেলা শীতল দৃষ্টি দিয়ে বোনের দিকে তাকায়। তারপর ধমকের সুরে বলে,”তুই কখনো শুধরাবি না তাই না? তোকে তো কেউ খুন করে দিলেও বলবি,বাদ দে রোদেলা বেচারার কত ইচ্ছে ছিলো আমাকে খুন করার। করতে দে না।
যত্তসব।”

মেঘলা চুপ করে থাকে। রোদেলা ধমকে ওঠে,”আর যদি আমি দেখেছি ওই বাঁদর দুটোর আশেপাশে গিয়েছিস তোর একদিন কি আমার একদিন।”

***
আদিল এই মাত্র বাসায় ফিরেছে। বৃষ্টি শুনেছে তার গলা,সে তার যায়গা থেকে একটুও নড়ছে না। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে বাইরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে। সে যাবে না আদিলের সামনে। সারাদিন বাইরে থেকে কাটিয়ে এসেছে, একটাবার বৃষ্টিকে ফোন দেয়নি। বৃষ্টিও রাগ করে দেয়নি। কাল রাতে ইচ্ছা করে তো আদিলকে কথা শোনায়নি‌ সে। একটা সামান্য কারনে রাগ করে সারা রাত বৃষ্টির দিকে ফিরেও তাকায় নি আদিল, কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো বৃষ্টি। প্রতিদিন সকালে আদিল খোজ নেয় বৃষ্টি খেয়েছে কি না। আজ কিছু না বলেই বেরিয়ে গিয়েছে। অভিমানী বৃষ্টি সারাদিন কিচ্ছু না খেয়েই থেকেছে। সবাইকে ফেলে যে মানুষটার হাত ধরে চলে এসেছে সে যদি এভাবে কষ্ট দেয় তাহলে বৃষ্টি কোথায় যাবে!

“সারাদিনে কিছু খায়নি তোর বৌ।”

আদিল তাহমিনার কথায় ঘুরে তার দিকে চায়। অবাক হয়ে বলে,”খায়নি মানে?”
_খায়নি মানে কিছুই খায়নি। মন খারাপ দেখলাম। তুই আবার ভাবিস না আমি কিছু বলেছি তোর বৌকে। আমি কিন্তু কিছুই বলিনি।

_মা তুমি থামবে?
বিরক্ত হয়ে আদিল রুমের দিকে যায়। বৃষ্টি সারাদিন না খেয়ে ছিলো। কি সাংঘাতিক কথা!

বৃষ্টি টের পায় তার পেছনে এসে আদিল দাঁড়িয়েছে। আদিলের গায়ের পারফিউমের গন্ধে ছেয়ে গেছে আশপাশ। বৃষ্টি মাথা ঘোরায় না। যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। আদিল দুমিনিট দাঁড়িয়ে থেকে এসে বৃষ্টির হাত ধরে টানতে টানতে রুমের মধ্যে নিয়ে যায়। রুমের মধ্যে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেয়, তারপর সেও পাশে বসে। বৃষ্টি মাথা একেবারে নিচু করে রেখেছে। আদিলের দিকে তাকায় না। আদিল ধমকে বলে,”সমস্যা কোথায়?”

বৃষ্টি চুপচাপ। আদিলের মেজাজ বিগড়ে যায়। বৃষ্টির থুতনি ধরে জোর করে উপরে তুলে তার চোখে চোখ রাখে। বৃষ্টির চোখ দুটো ছলছল করছে। সে ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে আদিলকে জরিয়ে ধরে, কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আমি আর কখনো, কোনোদিন এমন কথা বলবো না যাতে তুমি কষ্ট পাও। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও।”

আদিল বৃষ্টিকে জরিয়ে ধরে থাকে। মৃদু স্বরে বলে,”হয়েছে। কাল সারারাত কেদেছো। এখন থামো।”

বৃষ্টি থামে না। আদিল বলে,”আরে কান্না থামাও না প্লিজ। স্বামী বাড়িতে এলে তার সেবা যত্ন করতে হয়। এতটুকু জানো না? যাও গিয়ে ভাত বাড়ো। কিছু খাইনি সারাদিন।”

বৃষ্টি চোখের পানি মুছে অস্ফুট স্বরে বলে,”কোথায় ছিলে সারাদিন?”

_সত্যি কথা বলবো?
_হু
_আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের সাথে ছিলাম।

_এবার মিথ্যা কথা টা বলো।
_মিথ্যা কথাটা হচ্ছে সারাদিন এক বন্ধুর সাথে ছিলাম,সন্ধ্যায় দুটো স্টুডেন্ট পড়িয়ে বাড়িতে আসলাম।

বৃষ্টি অবাক হয়ে তাকায়।
_স্টুডেন্ট মানে?
_টিউশনি করাবো এখন থেকে। বৌয়ের স্যানিটারি ন্যাপকিন নিজের টাকায় কিনবো।

কথাটি বলে আদিল দাঁত বের করে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।
বৃষ্টি অপলক দৃষ্টিতে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে।

চলমান….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here