ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয় পর্ব ১৫

0
371

ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ১৫

“চন্দ্র, মামনী তুমি সারা রাত ঘুমাও না। শুধু ছটফট করো। এভাবে তোমার শরীর খারাপ করবে মা।”

“ডাক্তারের এপয়ন্টমেন্ট কখন মাম্মি? বাপিও যাবে?”

“যাবে। এইতো বারোটার দিকে বের হবো আমরা।”

“ডাক্তার দেখানো শেষে আমি খান বাড়িতে চলে যাব মাম্মি।”

জেরিন সুলতানা মেয়ের পাশে গিয়ে বসেন।দু’হাতের আঁজলায় মেয়ের মুখ তুলে নিয়ে বলেন,

“চন্দ্র, মামনী খুব কষ্ট হচ্ছে? আমি তোমাকে মানা করেছিলাম মা। বুঝিয়েছিলাম যে পৃথিবীর অসংখ্য অসংখ্য দম্পতি আছে যাদের সন্তান হয় না। তারা একে অপরকে নিয়ে সুখী। মাহিম তোমাকে ভালোবাসে, তোমাকে সামান্য অবহেলা করে না। তুমি সুস্থ হলে এতিম বেবি দত্তক নিতে পারবে। সেই বাচ্চাটাও মা বাবার আদর পাবে। কিন্তু তুমি নিজেই মাহিমের দ্বিতীয় বিয়েতে মত দিলে। তোমার শাশুড়ি তোমার ব্রেইন ওয়াশ করে দিলেন কী বলে জানি না। তুমি নিজ হাতে মাহিমকে চৈতালীর হাতে তুলে দিয়েছ। এখন এভাবে মুষড়ে পড়ে নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করতে, অসহায় প্রমাণ করতে উঠেপড়ে কেন লেগেছ?”

“আমি নিজেকে অসহায়, দুর্বল দেখিয়ে সিমপ্যাথি চাইছি না। চৈতালীকে মাহিমের জীবনে আনার আমার অন্য উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু ওকে মাহিমের পাশে সহ্য করা আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব না। আমাদের কাজ হয়ে গেল চৈতালী মুক্ত হয়ে যাবে। তাই মাহিমের এত কাছাকাছি ওর না গেলেও চলবে। সবাই এমন করে মাহিমকে ভাগ করতে আমাকে জোর করছে কেন?”

“অন্য কী উদ্দেশ্য?”

চন্দ্রিমা চুপ করে যায়। লিভার ট্রান্সপ্লান্টের বিষয়টা সে মাকে কিছু বলতে চায় না। তার মা বাবাকে চেনে চন্দ্রিমা। তারা নানা ধরনের সোশ্যাল ওয়ার্কে জড়িত। এভাবে ডোনারের অজান্তে অর্গান ডোনেশন নেওয়ার বিষয়টা হয়তো কখনোই সহজ ভাবে গ্রহণ করবে না। সারোগেসির বিষয়টাও না।

“বলো চন্দ্র। কী উদ্দেশ্য?”

“কী বলবো। জানিই তো লিভার ট্রান্সপ্লান্টের পর গর্ভধারণ করা আমার জন্য সহজ হবে না। সারোগেসির মাধ্যমেও বেবি এদেশে বৈধ না। কিন্তু আম্মি বেবি দত্তক নেওয়া মেনে নিবেন না। তাই চৈতালী এসেছে আমাদের জীবনে।”

“চন্দ্র, আম্মু তোমাকে আমরা প্রচন্ড ভালোবাসি। তুমি যা চেয়েছ দিতে চেষ্টা করেছি। তুমি মাহিমকে বিয়ে করতে চেয়েছ আমরা পাশে থেকেছি। যদিও তোমার বাপি আগেই সতর্ক করেছিলেন। মাহিমের পরিবার অর্থডক্স মাইন্ডের, আমরা সাবধান করেছিলাম। আগাতে ভয় পাচ্ছিলাম আমরা। কিন্তু তোমার আত্মবিশ্বাস ছিল যে তুমি মানিয়ে নিতে পারবে। অথচ দেখ জোবাইদা বেগমের ইচ্ছের সামনে তুমি বা মাহিম কেউ দাঁড়াতেই পারলে না। দত্তক বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা ভাবার মতো মানসিকতা সেই পরিবারের নেই বলে তুমি একটা বাচ্চা মেয়েকে নিজের সতীন বানিয়েছ, যেন সে তোমাদের বেবি দেয়! এরপর মেয়েটাকে বের করে দিবে? এত সহজ? ভুলে যেও না এই মেয়ে নিচুতলার মানুষ। তার কোন মান সম্মানের পরোয়া নেই। তুমি তাকে কোন সিনক্রিয়েট ছাড়া বের করতে পারবে? ড্রামা করে লোক জানাজানি করবে।”

“তো মাম্মি? করলো লোক জানাজানি। হলো একটু হাসাহাসি সমাজে। এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা চৈতালীর নেই বলেই ওকে মাহিমের জীবনে আনা।এমনি বের হতে না চাইলে তার বাবার হাতে আর কিছু টাকা দিয়ে দিলেই মেয়েকে নিয়ে চলে যাবে। সৌন্দর্য, অর্থ, শিক্ষা কোন দিক থেকে সে চন্দ্রিমা আবেদিনের কাছাকাছি আসার মতো না।”

“আর বয়সে? সুস্থতায়? তোমাকে স্পষ্ট করেই বলি গত একবছরে তুমি মাহিমকে তার শারীরিক চাহিদার কতটুকু দিতে পেরেছ? রক্ত মাংসের স্বাদ একবার পেয়ে গেলে নাকি পশুও আর তা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। তেমনি বিবাহিত যে পুরুষ একবার শারীরিক সুখের সান্নিধ্য পেয়েছে তারজন্য তা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা সহজ নয়। এটা কি সিনেমা পেয়েছ? বলিউডের মুভি যে নায়ক দেবতাসম। একজন পতি*তাকে নিয়ে আসলো বাচ্চা হওয়ার জন্য। শুধু একদিন কাছাকাছি গেল। বাচ্চা হলো। এরপর সেই প*তিতা ভালো মানুষি করে বাচ্চা তাদের দিয়ে চলে গেল। এটা বাস্তব জীবন। এখানে কেউ কারও অধিকার ছাড়বে না।মাহিম যত চৈতালীর কাছাকাছি যাবে তত তার প্রতি অনুরক্ত হবে। আর সবকিছু ছাপিয়ে তার কাছে চৈতালীর কাছে পাওয়া দেহ সুখই প্রধান হয়ে থাকবে। আমি আগেও বলেছি এসব। কিন্তু তুমি বলেছ সব জেনেশুনে আগাচ্ছ।”

“আম্মি আমি পাগল হয়ে যাব। প্লিজ এভাবে বলো না।”

মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন জেরিন সুলতানা।

“তোমার কাছে দুটো পথ আছে। হয় তুমি চৈতলীকে মেনে নাও। না হয় একবারে তোমাদের জীবন থেকে সরিয়ে দাও। বাচ্চা হলে চৈতালী তোমাদের জীবনে মধ্যবর্তিনী হয়ে থাকবে। শোন আম্মু, আমরা ঠিক করেছি তোমাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর যাব। তোমার বাপি খোঁজ নিয়েছে। খরচ হবে অনেক, কিন্তু অর্গান ডোনেশন হয়তো পাওয়া যাবে। বাইরে মরণোত্তর দেহ দান করে অনেকেই। তেমন কারো লিভার তোমার সাথে ম্যাচ হলে তুমি লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করতে পারবে।”

“কেমন খরচ হবে?”

“ওখানে বেশকিছু দিন থাকতে হবে। এক কোটি ধরে রাখতে হবে।”

“হিউজ মানি আম্মি। আর যদি ডোনার নিজেদের থাকে তাহলে?”

“নিজেদের ডোনার কই আম্মু? আমি বা তোমার বাবা দিতে পারবো না। শারীরিক নানা কন্ডিশনের জন্য তো আমরা আগেই বাতিল হয়ে গিয়েছি। মাহিমের সাথে সবকিছু ম্যাচ হয় না তোমার। ও ভালো ডোনার হবে না। আর হলেও তোমার মনে হয় মাহিম ওর লিভার তোমাকে দিত বা জোবাইদা বেগম তা মেনে নিতেন?”

“আম্মি, চৈতালী ডোনার হতে পারে না?”

“চৈতালী? ও তোমাকে লিভার কেন দেবে?”

“জেনেশুনে দেবে না। কিন্তু না জানিয়ে আমরা যদি নেই।”

জেরিন সুলতানা মেয়ের কথা শুনে অবাক হয়ে যান। চন্দ্রিমা মায়ের হাত ধরে আকুতি জানায়।

“চৈতালী তো মারা যাবে না মা। কিন্তু ওর লিভারের কিছু অংশ পেলে আমি নতুন করে বাঁচবো। ও সুস্থ, কমবয়সী একটা মেয়ে। আমাকে লিভারের কিছু অংশ দিলে ওর কোন ক্ষতি হবে না। আমাদের ব্লাড গ্রুপ সহ অনেককিছুই ম্যাচ করে। আমার বাচ্চার দরকার নেই। জোবাইদা বেগম কী চান সেটা আর আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি শুধু আমার মাহিমের সাথে বাঁচতে চাই। বাপিকে রাজি করিয়ে তুমি আমাকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করো আম্মি। চোখের সামনে মাহিমকে অন্য কারও হতে দেখলে মৃত্যুর আগেই আমি মারা যাব। যতদ্রুত সম্ভব আমি সুস্থ হতে চাই।”

জেরিন সুলতানা হতবিহ্বল হয়ে যান। একদিকে ক্রন্দনরত কন্যার চেহারা অন্যদিকে চৈতালীর নিষ্পাপ মুখ। দুটোই তার অন্তর কাঁপিয়ে দেয়।

“একটু অপেক্ষা করো চন্দ্র। আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলি। দেখি কী করা যায়। আমরা তোমার কিছু হতে দেব না।”

*****

চৈতালী কলেজে এসেছে। মাহিম নিজে ওকে কলেজে নিয়ে এসেছে। কাজ শেষে আবার নিয়ে যাবে। হাওয়াই মিঠাই রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে চৈতালী। রাতারাতি বেশভূষা পাল্টে যেন এ এক অন্য মেয়ে। দামী ব্যাগ, জুতো, ঘড়ি। কিন্তু ক্লাসের মেয়েরা চৈতালীকে দেখতে গেটে ভীড় করেনি। তারা এসেছে চৈতালীর বরকে দেখতে। ব্লু জিন্স, সাদা শার্ট, চোখে কালো সানগ্লাসে মাহিমকে ভীষণ স্মার্ট লাগছে। দামি গাড়িতে করে চৈতালীর আগমন আর সাথে মাহিমকে দেখে অবাক হোন জলিল স্যারও। তিনি চেষ্টা করেছিলেন চৈতালীর পরীক্ষা দেওয়া আটকাতে। তিনি ভেবেছিলেন চৈতালীর দোজবর স্বামী মধ্যবয়স্ক কোন লোক হবে। যে হয়তো এমনিতেই চৈতালীকে পড়ালেখা করাতে আগ্রহী হবে না। আর চৈতালী তারপরও চেষ্টা চরিত করে কলেজ পর্যন্ত এলেও চৈতালী আর তার ভাই শফিককে একটা শিক্ষা দিয়ে ছাড়বেন তিনি। পরীক্ষাই দিতে দিবেন না। কিন্তু এখন আর ভেজালে না জড়ানোই ভালো মনে করেন।

“এই চৈতালী, এই হিরো কিভাবে জোটালি? তলে তলে এত কাহিনি ”

“চৈতালী, তুই নাকি ছোট বৌ? না মানে দ্বিতীয় বৌ। ছোট বলা যায় না। দেখতে শুনতো তো তোর বর নায়ক মানুষ। আরও দুইটা তো নিশ্চয়ই করবে।”

“সুন্দর চেহারা আর টাকা দেখে আরেকজনের ঘর ভাঙলি চৈতালী। কারও ঘর ভেঙে কেউ সুখী হয় না। একদিন তোর ঘরও কেউ ভাঙবে।”

চৈতালী ভালমন্দ সব কথাই শোনে। কিন্তু কাউকে কোন ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here