ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয় পর্ব ১৪

0
210

ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ১৪

মাহিন ধূমপায়ী না। না এলকোহলিক। এক হাতে রেড ওয়াইনের গ্লাস আর অন্য হাতে ধূম্র শলাকা নিয়ে উঁচুতলার মানুষদের যে দুঃখ বিলাসের ইমেজ আঁকা হয় নাটক, নভেলে। তাতে মাহিমের ইমেজ বসে না। এই যেমন এখন আঁধার বারান্দায় বসে হৃদয়ের জ্বালাপোড়ায় সে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই বেদনা প্রকাশ করতে হাতে জ্বলন্ত শলাকা বা লাল পানীয়র পেয়ালা কিছুই নেই। আছে শুধু জ্বালা করতে থাকা শুষ্ক চোখ, অস্থির মন আর লিংকিং পার্ক ব্যান্ডের প্রিয় গান ” I tried so hard and got so far. But in the end it doesn’t even matter”

চোখ বন্ধ করে রকিং চেয়ারে আধশোয়া হয়ে কানে ব্লুটুথ ইয়ারবাড গুঁজে গান শুনছে মাহিম। চৈতালী নাইটির উপর আলাদা গাউন চাপিয়ে নিয়েছে। যদিও সে চন্দ্রিমার মতো সুন্দরী নয়, তবু তার এই আঠারো উনিশ বছর তরুণী বয়সে নিজেকে এতটা ফেলনাও মনে হয়নি যে কোন পুরুষ এতটা কাছাকাছি পেয়েও তাকে গ্রহণ করবে না। নিজেকে কেমন জানি সস্তা আর অপাংক্তেয় মনে হচ্ছে। জোবাইদা বেগম, শিউলি দু’জনই তাকে আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়েছে মাহিমকে কাছে টানতে হবে তারই, মাহিমের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে মাহিমের জীবনে নিজের জায়গা বানাতে হবে। সত্যি বলতে চৈতালীও তাই ই ভেবেছে। চন্দ্রিমার বরাবর নিজের অবস্থান বানাতে মাহিমের অধিকার আগে পেতে হবে এমনটাই তার ধারণা ছিল। শুরুটা হয়েছিলও চমৎকার ভাবে। মাহিম তাকে যখন গভীর ভাবে চুমু খেয়েছিল, তখনও এক মুহূর্তের জন্য চৈতালীর মনে হয়নি তার আর মাহিমের মাঝে এই শীতল কামরায় আর কেউ আছে। তারপরই মাহিম তাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,

“রাত অনেক হয়েছে। ঘুমাও চৈতালী। এভাবেও কাছে আসা যায়। কিন্তু সেই কাছে আসায় শুধু শরীর থাকে। মন না। আমাকে এভাবে নিজের দিকে টানার চেষ্টা, আমার শরীরি আকর্ষণ সবই তোমার আমার, আমাদের দু’জনেরই মনের পরাজয় হয়। মনকে ছাপিয়ে শরীরের জয় হওয়াটা উচিত নয়। সেই আকর্ষণ সাময়িক।”

তারপরই বারান্দায় চলে যায় মাহিম। আকস্মিক প্রত্যাখ্যানে সংবেদনশীল তরুণী হৃদয় অপমানে জর্জরিত হয়েছে। গত কয়েকদিনে জীবনের এত পরিবর্তন মেনে নেওয়া চৈতালীর জন্য সহজ নয়। তবু কান্না করেনি। আজ যেন সব বাঁধ ভেঙে গেল। তারই ফলাফল চাপা কান্নার শব্দে রাত গভীর থেকে গভীর হয়েছে। কিন্তু যার জন্য এই চাপা অভিমান তাকে চুপচাপ বারান্দায় আধশোয়া হয়ে থাকতে দেখে একসময় নিজেকে গুছিয়ে উঠে দাঁড়ায় চৈতালী। মুখে পানি ছিটিয়ে, কাপড় ঠিক করে বারান্দায় এসে মাহিমের মুখোমুখি বসে। চোখ খুলে তাকায় মাহিম।

“আই এম স্যরি চৈতালী। আমি তোমার নারীত্বের অহংকারে আঘাত করেছি। এভাবে রিজেকশন পাওয়াটা কারও জন্য সুখকর নয়। আমি তোমার জায়গায় হলে আমিও এটা মেনে নিতে পারতাম না যে আমার সঙ্গী আমাকে গ্রহণ করতে প্রত্যাখ্যান করছে।”

“আমি আসলে এত কঠিন কথা বুঝি না। আমার এত বয়স হয়নি যে অভিজ্ঞতা থেকে বুঝবো। বা এতটা শিক্ষিতও এখনো হয়নি যে পড়ালেখার জ্ঞান থেকে বুঝবো। তবে হ্যাঁ অপমান লেগেছে। তাত্ক্ষণিকভাবে মনে হয়েছিল আমি কী এতটাই অসুন্দর। কিন্তু এখন ঠান্ডা মাথায় ভেবে বুঝেছি বিষয়টা সৌন্দর্যের নয়।”

“ঠিক তাই। তুমি নিঃসন্দেহে সুন্দর। ততটাই সুন্দর, যতটা সৌন্দর্যের জন্য বহু যুবক জীবন নামক এই যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের জান বাজি রাখতে প্রস্তুত হবে। কিন্তু শুধু সৌন্দর্যের জন্য তো জান বাজি রাখা যায় না। তার জন্য ভালোবাসা প্রয়োজন। যার জন্য জীবন দেব, তাকে জানা বোঝা প্রয়োজন।”

“আমি যে সমাজ থেকে এসেছি, সেখান এসব কথা চলে না। তাই আমি জানি না। আমি যে সম্ভবত আমার বাবার আগের পক্ষের মেয়ে এটা কি আপনি জানেন?”

মাহিম একটা ধাক্কা খায়। এই কথা মাহিম জানতো না।

“কী বলো? তুমি শিউলী চাচীর মেয়ে নও?”

“নাহ। এই কথা আমি কখনো কাউকে বলিনি। এ বাড়িরও কেউ জানে বলেও আমার মনে হয় না। আমরা তো আপনাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় নই। আমার ছোটোবেলায় আপনাদের সংস্পর্শে ছিলাম না। বিষয়টা সত্যি কিনা আমি নিশ্চিতও না। কারণ আব্বা আম্মা এই কথা আমার কাছে চেপে গিয়েছেন। আমি নিজে অনেক অনুসন্ধান করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি। উপযুক্ত প্রমাণ নেই। তবে ধারণাগুলো ভুল নয়। আমার ছোটোবেলা থেকে আমি অনুভব করতাম আমাকে আমার নানাবাড়িতে সহজ করে গ্রহণ করে না। কিন্তু শফিক, শাহীনকে খুব আদর করে। আমি ছোটোবেলায় ভাবতাম হয়তো আমি মেয়ে বলে। ক্লাস এইটে পড়ার সময় নদী ভাঙনে আব্বার আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার বাহানায় আমার লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়া হলো। শফিক শাহীন ঠিকই স্কুলে যেত। আমি ঘরের কাজের পাশাপাশি মাঠেও সময় দিতাম। দুপুরে আব্বার জন্য খাবার নিয়ে যেতাম। তখন একদিন তেমনি এক দুপুরে খাবার নিয়ে একটু আগে বের হয়েছি। ক্ষেতের কাছাকাছি এসে আব্বাকে বোরখা পরে নেকাবে মুখ ঢেকে রাখা এক মহিলা সাথে গাছের আড়ালে কথা বলতে শুনি। মহিলা আব্বাকে বলছিল আব্বার বাকি দুটো সন্তানের সাথে আমার পার্থক্য করতে না। আমি কাজকর্ম করি, শিখি ঠিক আছে, কিন্তু আমাকে একদম অশিক্ষিত করে রাখতে না।
মহিলার কথাবার্তায় মনে হলো সম্ভ্রান্ত পরিবারের কেউ। আব্বা বললেন অনেক খরচ লেখাপড়া করানোয়। সেই মহিলা তখন আব্বাকে কিছু টাকা দেয়। জানি না তিনি কে ছিলেন। আব্বার সাথে সম্পর্ক কী। কিন্তু আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারি সেই পরিবারে আমি হাতের একটা বাড়তি আঙ্গুলের মতো। রাখাও যায় না, ফেলাও যায় না। রাখলে বাজে লাগে দেখতে, কাটতে গেলেও খুব একটা লাভ নেই। আমি জানতাম, আজ হোক কাল হোক আমাকে এভাবেই বিয়ে দিয়ে পিছু ছাড়ানোর কাজ করবে। অনেক চেয়েছি এরপর খুব ভালো করে পড়ালেখা করতে। যেন আমাড পড়ালেখার খরচের জন্য আমাকে বিয়ে দিয়ে না দেয়। নিজের টিউশনির টাকায় পড়তাম, বাড়তিটা আম্মার হাতে দিতাম। কারণ মাথার উপর ছাদ আর পরিচয় দরকার। আপনার সাথে বিয়ের খবরে প্রথমে মনে হয়েছে পালিয়ে যাই। স্যারের আশ্বাসে পালালামও। কিন্তু সেখানেও দেখলাম একই ঘটনা। সবাই আমার শরীরের সর্বোচ্চ ব্যবহারই করতে চায়। আর কিছু না। যখন আপনি আমাকে ফিরিয়ে আনলেন, এবং বিয়ে করলেন তখন এই রুমে একা বাসর কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম সারা জীবন এভাবে বাড়তি অংশ হয়ে কাটাতে পারি না। আপনার জীবনেও আমি সেই বাড়তি অংশ হিসেবেই যুক্ত হয়েছি। চন্দ্রিমা আপা আর আপনার জীবনে আমার গুরুত্ব হয়তো সন্তান জন্ম দেওয়া পর্যন্তই। বাচ্চা হলে আমাকেই হয়তো সরিয়ে দিবেন জীবন থেকে আপনারা। তাই এক মুহুর্তে মোহে পড়ে গিয়েছি। ভেবেছি আপনাকে এমন কিছু দেই যা এখন আপা দিতে পারছে না। তাহলে আপনি আমাকে এড়িয়ে যেতে পারবেন না। কিন্তু আপনি ঠিকই বলেছেন। শরীর দিয়ে তৈরি হওয়া সম্পর্ক ঠুনকো। আমি হয়তো সারাজীবন এমন উচ্ছিষ্ট রূপেই রইবো। আমার ধূসর কাবিনের মতো, আমার প্রণয় জীবনও ধূসরই রবে।”

পূব আকাশে ভোরের সূর্য উঁকি দিচ্ছে। কথায় কথায় রাত ভোর হতে চললো। এতক্ষণ মাহিম মন্ত্রমুগ্ধের মতো চৈতালীর কথা শুনছিল। আসলেই যার জুতো নেই, সে জুতোর শোকেই বিহ্বল থাকে। অপরের পদ না থাকাটা তার চোখে পড়ে না। মাহিম, নিজের আর চন্দ্রিমার জীবন নিয়ে এতটাই নিমগ্ন ছিল, চোখের সামনে চৈতালীর ভাঙাগড়া তার চোখেই পড়েনি।

“চৈতালী ভোর হতে চললো। সারারাত না ঘুমিয়ে থাকাটা অবশ্য বৃথা গেল না। তোমার গল্প আমি শুনলাম। আরেকটা রাতে আমার গল্পটা তোমাকে শোনাবো। কোন একদিন চন্দ্রিমার গল্পটাও শুনবে। তবে হয়তো আমাদের তুমি বুঝতে পারবে। চৈতালীর কোলের উপর থেকে হাতটা নিয়ে নিজের হাতের মুঠোয় নেয় মাহিম। একটা শ্বাস নিয়ে বলে,

” তুমি ভীষণ যোগ্য একটা মেয়ে। তোমার প্রতি আমার মুগ্ধতা আর শ্রদ্ধা বাড়ছে। কিন্তু সেই মুগ্ধতা এত বেশি নয় যে আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলবো। আমার প্রতি তোমার রয়েছে ইনসিকিউরিটি, তোমার ভয় আমি তোমাকে যেকোন সময় জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলবো। তুমিও কিন্তু আমাকে ভালোবাসো না। সুতরাং আজকের এই ভোর থেকে আমরা নতুন শুরু করতে পারি। আমি তোমার বিশ্বাস অর্জন করি আগে। তারপর তোমাকে এমন কিছু কথা এভাবেই জানাতে চাই, যা জেনেশুনে বুঝে তুমি আমাকে গ্রহণ করবে, আমি তোমাকে। সে পর্যন্ত আমি আমার দায়িত্ব অবশ্যই পালন করে যাব। আমি মন থেকে না পারি, বাহ্যিক ভাবে অবশ্যই তোমার আর চন্দ্রিমার মাঝে পার্থক্য করবো না। তুমিও নিজের লক্ষ্য ভুলো না। পড়ালেখা করতে চেয়েছ, তা করো। আমার সর্বাত্মক সাহায্য পাবে। চলো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেই। অন্ততঃ দু ঘন্টা না ঘুমালে আমি ফ্রেশ মাথায় কাজ করতে পারবো না। তোমারও বিশ্রাম প্রয়োজন।”

(চলবে)।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here