#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_২৬
#লেখিকা_Esrat_Ety
একটা প্রেম কাহিনী,সেখানে নায়ক থাকবে,নায়িকা থাকবে অথচ সাইড নায়ক থাকবে না তা তো হতে পারে না। আমার প্রেমের কাহিনীতে সাইড নায়ক এসে গিয়েছে। যাকে মোকাবেলা করে আমার নায়িকাকে আমার পেতে হবে। কংগ্রাচুলেশনস তাশরিফ,তোমার সমস্যা নাম্বার সাত এসে গিয়েছে। সমস্যা নাম্বার সাত: গল্পে সাইড নায়কের এন্ট্রি।
নোট প্যাডে কথাগুলো তুলে তাশরিফ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তাশরিফের পিএ তনির ডাকে তার ঘোর কাটে। মুখ তুলে তাকাতেই তনি বলে,”স্যার রোদেলা ম্যাম ক্যান্টিনে।”
_ক্যান্টিনে তা তো আমিও জানি। তোমাকে দেখে আসতে বলেছি সে কি করছে।
_গল্প করছে,হাসাহাসি করছে অন্য সবার সাথে। ম্যামকে খুব খুশি খুশি লাগছে।
তাশরিফের রাগে গা জ্বলছে। বিয়ের কথা উঠতে না উঠতেই এতো আনন্দ! যত্তসব! ওই আনন্দে যদি ছাই না ঢালতে পারে তবে তার নামও তাশরিফ নয়। তনির দিকে তাকিয়ে বলে,”ওনাকে গিয়ে বলো এক্ষুনি আমি আমার কেবিনে ডেকেছি। ফাস্ট। যাও।”
তনি মাথা ঝাঁকিয়ে চলে যায়। সে বুঝতে পারছে না এই অফিসে তার কাজটা ঠিক কি। তাশরিফ স্যারের কাছে মিনিটে মিনিটে রোদেলা ম্যামের ইনফরমেশন দেওয়ার জন্যই কি পনেরো হাজার টাকা বেতন পাচ্ছে সে! এছাড়া তো অন্য কোনো কাজ সে করেই না অফিসে এসে !
তাশরিফ বিরস মুখে বসে থেকে গতকাল রাতের কথা ভাবে। তাহমিনা ছেলের কথার কোনো জবাব না দিয়েই চলে গিয়েছিলো রাতে। তাশরিফ গভীর রাত পর্যন্ত সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো। এখন বেশ বিরক্ত লাগছে তার। দুটো নারী তাকে সমানে নাচিয়ে যাচ্ছে অথচ সে সিংহ পুরুষ হয়ে চুপচাপ তাদের নিগ্রহ সহ্য করছে। তার যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে রোদেলা আমিনকে তুলে এনে বিয়ে করে নিয়ে মাকে দিয়েও জোর করে বধূবরণ করাতো। দু’জনকেই ধমকের উপরে রাখতো সে। বাঘে মোষে এক ঘাটে জল খাইয়ে ছাড়তো সে। কিন্তু তাশরিফের সেই ক্ষমতা নেই। কাউকে জোর করার ক্ষমতা নেই তাশরিফের। তাশরিফ উপন্যাসের সবথেকে বিরক্তির নায়ক!
“ম্যাম। আপনাকে তাশরিফ স্যার তার কেবিনে ডেকেছেন।”
রোদেলা খানিকটা অবাক হয়ে যায়। তারপর বলে,”আমাকে? কেনো?”
_ম্যাম তা তো জানি না। বলেছে দ্রুত যেতে।
রোদেলা সবার দিকে তাকায়। সবাই ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। রোদেলা বিরস মুখে বলে,”এখন আবার কেনো ডাকবে আমায়!”
_আরে রোদেলা কোনো ইম্পরট্যান্ট কাজ থাকতে পারে। তুমি যাও।
রিয়াজ তাড়া দেয় রোদেলাকে। রোদেলা উঠে দাঁড়ায়। মনে মনে বলে,”রাশেদুজ্জামানের থেকে কোনো অংশে কম না এই লোকটা!”
দরজা ঠেলে ভেতরে মাথা বাড়িয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাশরিফ গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”আসুন।”
রোদেলা ভেতরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসে। তাশরিফ একমনে একটা ফাইল দেখছে। একটাবার রোদেলার দিকে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখেনি। ফাইল থেকে চোখ না সরিয়েই পাশ থেকে আরেকটা ফাইল উঠিয়ে রোদেলাকে দেয়।
“এটা দেখে দিন।”
_এটা কিসের ফাইল স্যার।
_সিরামিক ফ্যাক্টরির হিসাব।
_স্যার,আমি তো আমার কাজ শেষ করেছি লাঞ্চ টাইমের আগে। এটা তো আমার কাজ নয়।
_এটা আমি আপনাকে যখন করতে বলেছি তার মানে এটা আপনার কাজ। নিন দেখে দিন। ফাস্ট।
রোদেলা কপাল কুঁচকে ফাইলটা নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তাশরিফ বলে,”কোথায় যাচ্ছেন?”
_ফাইল দেখতে স্যার।
_এটা এখানে আমার সামনে বসে দেখবেন। আমাকে দেখিয়ে নেবেন প্রত্যেকটা হিসাব। ভুল হলে কোম্পানির লস।
রোদেলা কয়েক মূহুর্ত তাশরিফের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ধপ করে বসে পরে চেয়ারে। কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ নিজের কাজ করতে থাকে। মাঝে তাশরিফ একপলক রোদেলাকে দেখে। এভাবে এই হৃদয়হীনাকে হালকা শাস্তি দিয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাচ্ছে সে। রোদেলা ফাইলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”স্যার এখানে লাস্ট মান্থের ইমপোর্ট হিসেবের চার্ট টা খালি পরে আছে।”
_খালি পরে থাকলে হিসেব করে সংখ্যাটা বসিয়ে দিন। এটাও বলে দিতে হবে?
রোদেলা কিছুটা অবাক হয়ে তাশরিফের দিকে তাকায়। এই লোকটা এভাবে কেনো কথা বলছে তার সাথে! হলো টা কি এর!
তাশরিফ ক্যালকুলেটর এগিয়ে দিয়ে বলে,”নিন। হিসাব টা করে ফেলুন।”
রোদেলা হাত বাড়িয়ে ক্যালকুলেটর নেয়। এসব কোন ধরনের অত্যাচার রোদেলা বুঝতে পারছে না। তাকেই কেনো সহ্য করতে হবে সব! রোদেলা একমিনিটের জন্য সিদ্ধান্ত নেয় চাকরি টা সে ছেরে দেবে, আপু দুলাভাইয়ের পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করে নেবে।
“এতো অন্যমনষ্ক ভাব কেনো? কি ভাবছেন? বিয়ের কথা?”
রোদেলা চমকে ওঠে। এই লোকটা মনের কথা শুনে ফেললো কিভাবে তার!
তাশরিফ গম্ভীর হয়ে বলে,”এখন কাজ করার সময়। এসব ভেবে কাজে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। কাজ করুন।”
***
আফতাব হাসান বেশ কিছুক্ষণ ধরে কয়েকবার ঘরে ঢুকছে এবং বেড়িয়ে যাচ্ছে। সে তার স্ত্রীর মুড বোঝার চেষ্টা করছে আসলে। তাহমিনা কাঁথা সেলাই করতে থাকলেও আফতাব হাসানের কর্মকাণ্ড তার চোখ এড়ায়নি। একসময় ধমকের সাথে বলে ওঠে,”এতো লম্ফ ঝম্প করছো কেনো? সমস্যা কি?”
আফতাব হাসান দাঁড়িয়ে পরে। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার সাথে একটা বিষয়ে একটু খোলামেলা আলোচনা করতে চাই।”
তাহমিনা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”আমার সাথে কখনো পর্দাশীল আলোচনা করেছো নাকি যে আজ খোলামেলা আলোচনা করতে চাইছো? নটাঙ্কি না করে ঝেড়ে কাশো!”
আফতাব হাসান আমতা আমতা করে বলে,”রোদেলা মেয়েটা কিন্তু খারাপ না,এটা তো তুমি অস্বীকার করতে পারবে না বলো?”
_খারাপ না,কিন্তু ভালোও তো না।
_ভালো না কোথায়? কত চমৎকার একটি মেয়ে, সুন্দর, শিক্ষিতা বুদ্ধিমতি।
তাহমিনা কাঁথা রেখে আফতাব হাসানের দিকে তাকায়। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,”বেশ তো। এক কাজ করো, তুমি আজই গিয়ে তাশরিফের সাথে ওই মেয়েটার বিয়ে দিয়ে নিয়ে এসো। আমি ভাইয়ের বাসায় চলে যাচ্ছি। তোমার পছন্দের বুদ্ধিমতি বড় বৌমা এসে রোজ তোমায় তার বুদ্ধি রান্না করে খাওয়াবে। ভালো হবে না বলো?
আফতাব হাসান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে,”তুমি কেমন যেন নিষ্ঠুর ধরনের হয়ে যাচ্ছো তাহমিনা। আগে তো এমন ছিলে না!”
_তাই নাকি? তা আমি নিষ্ঠুর হলে সহৃদয়বান কে? আট তলার আর্কিটেক্ট সাহেবের ডিভোর্সী বোন তাইনা?
আফতাব হাসান চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে তাহমিনার দিকে। তাহমিনা দাঁত কিড়মিড় করে বলে,”আমি কিছু বুঝিনা ভেবেছো? খুব তো দেখা হলেই একেবারে খুশিতে গদগদ হয়ে কথা বলো ওই মহিলার সাথে। ছেলে একটা ভুল করতে চাচ্ছে,আর তুমি তার মদদ দিচ্ছো। কারন আমি বাড়ি ছাড়া হলেই তো তোমার সুবিধা হয়। আসলে আমারই নিজে থেকে চলে যাওয়া উচিত। ছেলেরা সবাই শিক্ষিত বৌ আনবে,তুমিও ওই শিক্ষিত মহিলাকে নিকাহ করে নিয়ে আসো তারপর সবাই মিলে এই বাড়িটাকে একটা “জাগো নারী” সংঘ বানিয়ে ফেলো।
_তাহমিনা উল্টো পাল্টা কথা না বলে ভেবে দেখো। সংসার তো আর আমরা করবো না। তাশরিফ যদি ভালো থাকে তাহলেই তো হলো!
_নিষেধ করেছে কে ওকে? যাক না,গিয়ে বিয়ে করে নিয়ে আসুক আদিলের মতো।
আফতাব হাসান চুপ করে থাকে। তাহমিনাকে কিছু বলা বৃথা।
তাহমিনা কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে,”একটা সুন্দর দেখে বৌ এনে দিলে বৌয়ের ভালোবাসায় দুদিনেই ওসব ভুত মাথা থেকে নেমে যাবে। ওসব নিয়ে ভাবছি না আমি। ভাবার দরকারও নেই।”
***
“বৃষ্টি মেঘলা আপুর সাথে তোমার কথা হয়েছে?”
বৃষ্টি শোয়া থেকে উঠে বসে। আদিলের দিকে তাকিয়ে বলে,”না তো। কেনো?”
_আপু আজ একটু দেখা করতে বললেন আমাদের।
বৃষ্টি কিছুটা অবাক হয়। তখনি তাশরিফ এসে ওদের দরজায় নক করে। আদিল দরজা খুলতেই তাশরিফ বলে,”মেঘলা আপু ফোন দিয়েছিলো। আমাকে বললো তোর সাথে যেতে বিকেলের দিকে। জানিস কিছু এ ব্যাপারে? কিসের জন্য যেতে বলেছে? আর কোথায়?”
_বললো বড় দুলাভাই নির্বাচনে জয়ী হয়েছে তাই ট্রিট দিতে চাচ্ছে সবাইকে।
তাশরিফ এক মিনিট চিন্তা করে বলে,”আর কে কে আসবে জানিস?”
আদিল বেশ বুঝতে পেরেছে ভাইয়া রোদেলা আমিন আসবে কিনা জানতে চাইছে। তার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। কিন্তু সে বলে,”মেজো আপু ব্যস্ত ভীষণ…..”
তাশরিফ আদিলকে পুরোটা বলতে না দিয়ে বলে,
_আমিও একটু ব্যস্ত। আমিও যেতে পারবো না।
আদিল বলে,”মেজো আপু ব্যস্ত ভীষণ তবুও আসবে।”
তাশরিফ থতমত খেয়ে যায়, তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলে,”মেঘলা আপু এতো করে যখন বলছে এখন আমি না গেলে খারাপ দেখাবে তাই না? আচ্ছা আমিও যাবো তাহলে।”
কথাটি বলে তাশরিফ চলে যায়। আদিল আর বৃষ্টি দু’জনে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে উচ্চশব্দে হেসে ফেলে।
***
আদিল আর বৃষ্টির সাথে তাশরিফকে দেখতে পেয়ে রোদেলার চোখ কপালে উঠে যায়। মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলে,”উনি এসেছে কেনো?”
মেঘলা কপাল কুঁচকে ফেলে, রোদেলাকে ধমক দিয়ে বলে,”একটা চড় খাবি। তাশরিফ কি বাইরের কেউ?”
রোদেলা বিড়বিড় করে বলে,”ঘরের কেউও তো না।”
মেঘলা রোদেলাকে চোখ রাঙানি দেয়। রোদেলা মনে মনে বলে,”তুমি বুঝতে পারছো না আপু ওনাকে দেখলে আমার খুব অস্বস্তি হয়!”
তাশরিফ রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলারা বসে আছে রেস্টুরেন্টের ঠিক মাঝামাঝি পয়েন্টে। তাশরিফরা খুব কাছে চলে গেলে মেঘলা উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে তাদের স্বাগত জানায়। বৃষ্টি একটু হেঁটেই হাঁপিয়ে উঠেছে, আদিল ওকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দেয়। তাশরিফ একটা চেয়ারে বসে সুহা সিরাতের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলে,”ভাইয়া কোথায় আপু?”
_আছে,একজনকে রিসিভ করতে গিয়েছে।
_কে?
রোদেলা মনে মনে বলে,”এতো প্রশ্ন করবেন না,জানতে পারলে নিজেই আহত হবেন।”
মেঘলা কিছু বলে ওঠার আগে সুহা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,”ছোটো আন্টি, তোমার পেটটা এতো ফুলে আছে কেনো? তুমি অনেক বেশি খাও নাকি?”
ওখানে বসে থাকা সবাই বিব্রত হয়ে যায়। সিরাত বলে,”গাধা,আন্টির পেটে বাবু আছে। রোশনি ম্যামকে দেখিসনি? তার পেট এরকম ফুলে গিয়েছিলো আর সবাই বলছিলো ম্যামের পেটে বাবু আছে।”
সুহা হা করে তাকিয়ে থাকে, অবাক হয়ে বলে,”পেটের ভেতর বাবু কিভাবে থাকে?”
মেঘলা ঘাবড়ে যায় তার ছেলে মেয়ের অতিরিক্ত কৌতুহল দেখে। এখন এদের কি বলবে সে!
বৃষ্টি ভীষণ লজ্জা পেয়ে ওড়না দিয়ে পেটটা ঢাকে,ভাসুরের সামনে এমন পরিস্থিতিতে পরতে হলো তার সেজন্য লজ্জা লাগছে খুব!
আদিল বিড়বিড় করে বলে,”আল্লাহ এদের মুখ বন্ধ করি কিভাবে?”
তারপর সুহা সিরাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”এই গেমস খেলবে সোনারা?”
দু’জনেই মাথা নাড়ায়। আদিল ওদেরকে নিজের ফোনটা দিয়ে চুপ করিয়ে রাখে।
তাশরিফ মেঘলাকে বলে,”কাকে রিসিভ করতে গিয়েছে ভাইয়া? ভাইয়ার কোনো রিলেটিভ?”
মেঘলা আনন্দিত গলায় বলে,”আজ তোমাদের ভাইয়া তোমাদের শুধু ট্রিট দেওয়ার জন্য ডেকে আনেন নি, আজ আর একটা বিশেষ কারন রয়েছে তোমাদের ডাকার। আজ রোদেলাকে কেউ দেখতে আসবে, তোমার ভাইয়ার পরিচিত। ছেলে এখন একা এসে রোদেলার সাথে পরিচিত হবে। তারপর ঠিক করবো বিয়ের কথা এগোবো কি না।”
এটা যদি কোনো ড্রামা সিরিয়াল হতো তাহলে ক্যামেরা তাশরিফের মুখে ফোকাস করে পরিচালক ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে গুড়ুম গুড়ুম বজ্রপাতের শব্দ লাগিয়ে দিতেন।
রোদেলা তাশরিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আদিল পানি খেতে নিচ্ছিলো,মেঘলার কথা শুনে কাশতে কাশতে তাশরিফের দিকে তাকায়। তাশরিফ একবার রোদেলা, একবার মেঘলাকে দেখে। কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে বলে,”আপু এটা তো আপনাদের পারিবারিক বিষয়। আমাকে কেনো…?”
_আরে ধুর ভাইয়া। তুমি কি পরিবারের বাইরে নাকি? এই শহরে আমাদের রিলেটিভ বলতে তো শুধু তোমরাই আছো। আর তাছাড়া তুমি তো আমাদের তিন বোনের ভাইয়ের মতো।
আদিল আবারো পানির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিলো,মেঘলার এই কথাটি শুনে আদিল এবার আর নিজেকে সামলাতে পারেনা। বিষম খেয়ে কাশতে থাকে অনবরত। বৃষ্টি বিরক্ত হয়ে তাকায় আদিলের দিকে।
তাশরিফ কঠিন দৃষ্টিতে রোদেলাকে দেখে। এতো সেজে এসেছে পাত্রকে দেখানোর জন্য তবে! ঠোঁটে কড়া লিপস্টিক, হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি! সবকিছুই পাত্রকে ইমপ্রেসড করার জন্য!
তাশরিফের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। গিরগিটি একটা! খুব তো বলতো বিয়ে করবে না,বিয়ে করবে না। এখন যেই সরকারি চাকরি ওয়ালা পাত্র পেয়েছে অমনি দুই পায়ে দাঁড়িয়ে রাজি হয়ে গিয়েছে। গিরগিটি রোদেলা আমিন!
সাদাফ এসে দাঁড়ায় তাদের পেছনে। রোদেলা সাদাফের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখে হতভম্ব হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায়,সাথে সাথে বলে ওঠে,”আপনি?”
তাশরিফ মাথা ঘুরিয়ে দেখে লোকটাকে। এটা তো সেই পুলিশ ইন্সপেক্টর ! এ এখানে কেনো!
মিহির মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলে,”জ্বি। আমি। আমি মিহির।”
সাদাফ হেসে রোদেলাকে বলে,”মিহিরের সাথে তোমাদের অফিসে নাকি দেখা হয়েছিলো তোমার। মিহির বলেছে আমাকে।”
রোদেলা বিব্রত হয়ে পরে,এই লোকটা তাকেই এ্যারেস্ট করতে গিয়েছিলো সেটা বলে দেয়নিতো সাদাফ ভাইয়াকে!
তাশরিফ উঠে দাঁড়ায়। সাদাফ মিহিরের সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিতে থাকে। তাশরিফের দিকে মিহির হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”হাই তাশরিফ! আমাকে চিনতে পেরেছেন?”
তাশরিফ কঠিন দৃষ্টিতে দেখে মিহিরকে,মনে মনে বলে,”ইঁদুর মুখো বনবিড়াল কোথাকার! তুই কোত্থেকে উদয় হলি রে! একটা ঘুষি মেরে তোর চেহারার অবকাঠামো চেইঞ্জ করে দেবো!”
মুখে বলে,”জ্বি।”
সাদাফ মিহিরকে একটা চেয়ারে বসতে বলে নিজেও বসে। রোদেলা মাথা নিচু করে রেখেছে। তাশরিফ রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি রোদেলাকে বলছে,”এই লোকটার দিকে তাকাবেন না আপনি খবরদার।”
রোদেলা সে কথা শুনতে না পেলেও মিহিরের দিকে তাকায় না সে।সেও মনে মনে তাশরিফকে বলে,”কেনো এসেছেন নাচতে নাচতে এখানে? এখন দেখতে থাকুন নাটক।”
কিছুক্ষণ সবাই কথা বলে। চুপচাপ আছে শুধু তাশরিফ আর রোদেলা। মেঘলার মিহিরকে বেশ পছন্দ হয়েছে। কয়েক মিনিট হলো এখানে এসেছে অথচ এমন ভাবে কথা বলছে যেন কতদিনের পরিচয় তাদের সাথে মিহিরের।
সাদাফ খাবার অর্ডার দেওয়ার আগে একবার রোদেলাকে দেখে। তারপর মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলে,”মেঘলা। আমি একটা কাজ করেছি।”
_কি কাজ?
_ওদের জন্য মানে রোদেলা আর মিহিরের জন্য আলাদা টেবিল বুক করেছি। ওদেরকে আলাদা কথা বলতে দেই বরং।
মেঘলা হেসে বলে,”ভালোই করেছেন। ওদের তো আলাদা কথা বলতে দেওয়াই উচিত।”
তাশরিফ রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলা সাদাফের কথা শুনে তাশরিফের দিকে তাকায়। সে কেনো তাশরিফের দিকে তাকিয়েছে সে নিজেও জানে না।
তাশরিফের দৃষ্টি তাকে অস্বস্তি দিচ্ছে খুব। ক্রমশ নার্ভাস হয়ে পরছে রোদেলা। তার কারন তার জানা নেই।
সাদাফ মিহির আর রোদেলাকে খানিকটা দূরে একটা টেবিল দেখিয়ে গিয়ে বসতে বলে। রোদেলা আবারো তাশরিফের দিকে তাকায়।
***
মিহির রোদেলাকে দেখছে। রোদেলা একবার মিহিরের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি হেসে চোখ নামিয়ে নেয়। পরক্ষনেই রোদেলা চোখ তুলে তাকায় তাশরিফের দিকে। রোদেলা যেখানে বসে আছে,তাশরিফ কে সেখান থেকে সরাসরি দেখা যাচ্ছে। তাশরিফ তার দিকে কটমট দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। ওই দৃষ্টি দেখে রোদেলা নার্ভাস হয়ে পরছে কেনো রোদেলা বুঝতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে তাশরিফ তাকে বলছে,”খবরদার যদি ওই লোকটার দিকে তাকিয়ে হেসেছেন তো!”
না চাইতেও বারবার চোখ চলে যাচ্ছে তাশরিফের দিকে।
কয়েক মুহূর্ত কেটে যায়। ওয়েটার এসে ওদের টেবিলে খাবার সার্ভ করে যায়। মিহির হালকা কেশে রোদেলার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। রোদেলা মিহিরের দিকে না তাকিয়ে তাকে বলে,”বলুন।”
মিহির রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলে,”সেদিন আপনাকে ওভাবে আমি আশা করিনি। বিয়ের পাত্রীকে এরেস্ট করতে গিয়েছিলাম! হাহা !”
রোদেলা মাথা তোলে, কিন্তু দৃষ্টি তাশরিফের দিকে রেখে বলে,”আপনি সাদাফ ভাইয়াকে বলে দিয়েছেন এসব কথা?”
_না, বিয়ের পরে বলে দেবো। সবাই চমকে যাবে শুনলে।
রোদেলা অবাক হয়ে যায়। কথা বার্তা এখনো কিছুই ঠিক হয়নি অলরেডি বিয়ের কথা চিন্তা করে রেখেছে!
মিহির বলে,”আপনার আর আমার নামের বেশ মিল দেখেছেন। আপনি রোদ,আমি সূর্য। দু’জনেই উত্তপ্ত। আচ্ছা আপনার রাগ কি খুব বেশি? সাদাফ ভাইয়া বললো। আমার রাগ কিন্তু আপনার তিন গুণ। যেসব ঘুঘুদের রিমান্ডে নিয়েছি তারা বলতে পারবে।”
রোদেলা কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। ওই তাশরিফ হাসান তার দিক থেকে চোখই ফেরাচ্ছে না। রোদেলার ইচ্ছা করছে গিয়ে তার পা ধরে বলতে,”অনেক হয়েছে। আমার অস্বস্তি হচ্ছে খুব।এবার চোখ নামান। আমি এই মিহির লোকটার সাথে একটুও হেসে কথা বলবো না।”
কথাটা ভেবেই রোদেলা চোখ বড় বড় করে ফেলে। কি আশ্চর্য ! সে তাশরিফকে কৈফিয়ত কেনো দেবে! কে ঐ লোকটা! নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে রোদেলার। ইচ্ছে করছে রাগে নিজের চুল ছিঁড়তে।
মিহির বলে,”সেদিন রাশেদুজ্জামানকে কি সুন্দর গালি দিলেন। আচ্ছা আপনি এতো চমৎকার গালাগাল কোথায় শিখেছেন?”
রোদেলা চুপ করে আছে। মিহির রোদেলার দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছন ফিরে তাকায়। তারপর মাথা ঘুরিয়ে রোদেলাকে জিজ্ঞেস করে,”আপনি ওদিকে কি দেখছেন বারবার?”
রোদেলা চমকে ওঠে,”না। নাতো,কাউকে দেখছি না।”
মিহির হেসে বলে,”খাচ্ছেন না কেনো। খান।”
রোদেলা এক চামচ স্যুপ মুখে দিতে নিয়েও দেয়না। তার এখন প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে।
“তাশরিফ খাচ্ছো না কেন?”
মেঘলা তাশরিফের দিকে তাকিয়ে আছে। তাশরিফ আমতা আমতা করে বলে,”খেতে ইচ্ছে করছে না আপু। আপনারা খান,আমি বরং দেখি।”
_শরীর খারাপ নাকি তোমার ভাই?
সাদাফ উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে।
তাশরিফ কপাল কুঁচকে ফেলে,মনে মনে বলে,”আপনার আর দরদ দেখাতে হবে না বেঈমানের বেঈমান। এতো পোংটামি করতে কে বলেছে? রোদেলা আমিন কি আপনার অন্ন খাচ্ছিলো যে ওনাকে বিয়ে দিতে উঠে পরে লেগেছেন।”
মুখে বলে,”জ্বি না ভাইয়া।”
সাদাফ রোদেলা আর মিহিরকে দেখিয়ে মেঘলাকে বলে,”দুজনকে কি সুন্দর মানাবে দেখেছো?”
তাশরিফ মনে মনে বলে,”বাল মানাবে।”
কথাটি বলে সে অবাক হয়ে যায়। রাগের চোটে এসব কি কথা মুখ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তার। ছিঃ ছিঃ।
মেঘলা বলে,”ঠিক বলেছেন। খুব মানাবে।”
তাশরিফ মনে মনে মেঘলাকে বলে,”আপনাকে খুব শ্রদ্ধা করতাম। এখন থেকে আই হেট ইউ আপু।”
আদিল আর বৃষ্টি খাওয়া থামিয়ে তাশরিফের দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি আদিলকে খোচা মেরে ফিসফিসিয়ে বলে,”ভাইয়ার হাবভাব একটুও ভালো ঠেকছে না,কেমন থম মেরে আছে। এখন কি হবে?”
“কি হবে তা জানিনা। তবে কিছু একটা হবে!”
***
“কি ব্যাপার। তোমরা চলে এলে এখানে,কথা বলা হয়ে গিয়েছে?”
মিহির একটা চেয়ার টেনে বসে বলে,”স্বল্প আলাপই থাকুক। সব কথা এখন বলে শেষ করে ফেলার তো মানে হয় না।”
রোদেলা মাথা নিচু করে রেখে। একবার আড়চোখে তাশরিফের দিকে তাকিয়ে দেখে তাশরিফ আর তার দিকে তাকিয়ে নেই। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে রোদেলা তার বৌ আর পরপুরুষের সাথে কথা বলার অপরাধে রোদেলার থেকে অভিমানী মুখ সরিয়ে রেখেছে।
মিহির সাদাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”ভাইয়া এবার যে উঠতে হবে আমার। ডিউটি ফেলে এসেছি।”
_ওহহ,হ্যা শিওর। যাও তুমি। তোমার ভাইয়ার সাথে আমি কথা বলে নেবো। রোদেলার ফোন নাম্বার নিয়েছো?
_জ্বি ভাইয়া।
মিহির সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,”আমি আসছি। আপনারা ভালো থাকুন।”
তারপর শুধু রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলে,”আসছি।”
রোদেলা কোনো জবাব দেয়না। সে বুঝতে পারছে না তাশরিফের অভিমানী মুখ দেখে তার এতো খারাপ লাগছে কেনো। ইচ্ছে করছে এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে।
মিহির চলে যেতেই তাশরিফ উঠে দাঁড়ায়। মেঘলা আর সাদাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমারো এখন উঠতে হবে।”
_তুমি তো কিছু খেলেই না তাশরিফ।
তাশরিফ তার কোনো উত্তর না দিয়ে বিরস মুখে বেড়িয়ে যায়। সাদাফ আর মেঘলা কিছুটা অবাক হয় তাশরিফের অস্বাভাবিক আচরণ দেখে। আদিল তাদের আশ্বস্ত করে বলে,”ভাইয়ার মাথা ব্যথা রোগ আছে। হুট হাট হয়। তাই ভাইয়া এমন করছে।”
রোদেলা চুপচাপ বসেছিলো। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”আপু আমিও বাড়িতে যাবো।”
***
আদিল বৃষ্টিকে নিয়ে আজ শশুর বাড়ীতে এসেছে। রাতটা এখানে থাকবে তারা। বসার ঘরে বাবার পাশে বসে বাবার কাঁধে মাথা দিয়ে রেখেছে বৃষ্টি। আদিল দূর থেকে তাদের দেখছে। তার বেবীটা পৃথিবীতে এলে সেও এভাবেই আদরে রাখবে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসবই ভাবতে থাকে সে। ফোনের রিংটোনে তার ঘোর কেটে যায়। স্ক্রিনে তাশরিফের নাম্বার দেখে দ্রুত রিসিভ করে কানে ধরে সে, ওপাশ থেকে সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষ বলে ওঠে,”এই ফোনটা যার আপনি তার কি হন?”
আদিল অবাক হয়ে বলে,”ভাই। কিন্তু আপনি কে? ভাইয়ার ফোন আপনার কাছে কি করছে?”
লোকটা তাশরিফের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে,”আপনার ভাইয়ের একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আপনি শিঘ্রই আসুন।”
আদিল ফোন কেটে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে একটা বিকট চিৎকার দেয়।
রোদেলা নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়েছিলো। হকচকিয়ে উঠে বসে ঘরের দরজার দিকে চায়। বৃষ্টি কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে দরজায় এসে দাড়িয়ে বলে,”আপু ভাইয়া এক্সিডেন্ট করেছে!”
চলমান…..