দ্বিতীয়_ফাগুন #পর্বসংখ্যা_৯ #লেখিকা_Esrat_Ety

0
322

#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_৯
#লেখিকা_Esrat_Ety

দুজন পাশাপাশি চেয়ারে বসে আছে। তিন বছর আগেও এক বিশেষ দিনে এভাবে পাশাপাশি বসে ছিলো তারা। আজো তাদের জীবনের একটা বিশেষ দিন। পার্থক্য হচ্ছে সেদিন ছিলো তাদের বিয়ের দিন,স্থান ছিলো কাজী অফিস আর হাতে ছিলো বিয়ের রেজিস্ট্রেশন পেপার কিন্তু আজ তাদের বিচ্ছেদের দিন,স্থান উকিলের চেম্বার আর হাতে তাদের ডিভোর্সের পেপার।
উকিল সাইন করার নির্দেশ দিলে মেঘলা রোদেলার দিকে তাকায়। রোদেলা বোনের কাঁধে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলে,”সাইন টা করো আপু।”
মেঘলা কাঁপা কাঁপা হাতে কলম তুলে নেয়। এই মুহূর্তে কিছুতেই পাশে বসা মানুষটার সামনে তার কোনো রকমের দুর্বলতা সে দেখাবে না, নিজেকে প্রমিজ করেছে সে।
মেঘলা চোখ বন্ধ করে সাইন করে দিয়ে পাথর হয়ে বসে থাকে। চোখ দিয়ে তার অজান্তেই দুফোঁটা তরল গড়িয়ে পরে। পাশ থেকে মাইনুল কলম তুলে নিয়ে ঝটপট সাইন করে দিয়ে উঠে দাড়ায়। নাক চোখ কুঁচকে বলতে থাকে,”নাটক শেষ! কাবিনের টাকা পরিশোধ করা আছে ! এখন তাহলে যে যার পথে।”

“দাঁড়ান।”
কড়া গলায় বলে রোদেলা মাইনুল কে আটকায়।
মাইনুল মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। মেঘলা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। রোদেলা বলতে থাকে,”এভাবে চলে গেলে তো হবে না। আপু! তুই এই লোকটাকে এভাবে বিদায় দিবি?”
_এই ,এখন আবার কি নাটক শুরু করেছো দুইবোন?
বিরক্ত ভাব নিয়ে বলে মাইনুল।
মেঘলা অবুঝের মতো তার বোনের দিকে তাকায়। রোদেলা মাইনুলের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে মেঘলাকে অত্যন্ত দৃঢ় কন্ঠে বলে ওঠে,”এই লোকটার মুখে একদলা থুতু মার আপু।”

মেঘলা চমকে ওঠে। মাইনুল চোখ বড় বড় করে আছে, দাঁত খিচিয়ে বলতে থাকে,”এই, এসব কোন ধরনের অসভ্যতামি? বেয়াদব কোথাকার!”
রোদেলা মেঘলার দিকে তাকায়,”কিরে আপু! থুতু মার!”
মেঘলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার শরীর একটু একটু কাঁপছে।
মাইনুল উকিলকে বলতে থাকে,”আপনার চেম্বারে এভাবে একজনকে অপমান করা হচ্ছে। আপনি চুপ করে দেখছেন?”

উকিল হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠতে পারছেনা। রোদেলা সাথে সাথে বলে,”তোর সাত জনমের ভাগ্য তোকে জেলের ভাত খাওয়াইনি। আপু করুনা করেছে বলে এখানে হাত খোলা দাঁড়িয়ে আছিস।”

_এই অসভ্য মেয়ে, বেয়াদব মেয়ে…….
মাইনুল রোদেলার দিকে তেড়ে যায়, প্রচন্ড রাগে সে ফুঁসছে। রোদেলা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিক তখনই মেঘলা একদলা থুতু মাইনুলের মুখের উপর ছুড়ে মারে।
হতভম্ব মাইনুল মেঘলার দিকে তাকায়। মেঘলা তার দিকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে।
রোদেলা চেঁচিয়ে মেঘলাকে বলে,”শাবাশ আপু!”

মাইনুল টিস্যু পেপার দিয়ে নিজের মুখ মুছতে মুছতে বলে,”এই অপমানের শোধ আমি তুলবো মেঘলা।”

মেঘলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রোদেলা হেসে ওঠে,”হু। আসিয়েন এক্স দুলাভাই। আমরাও প্রস্তুত আছি।”

মাইনুল রাগে গটগট করতে করতে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। মেঘলা সাথে সাথে ধপ করে ফ্লোরে বসে পরে গগন কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে শুরু করে। রোদেলা গিয়ে বোনকে আগলে নেয়।
“চুপ আপু একদম চুপ। কিচ্ছু হয়নি!”

মেঘলা কান্নার গতি কমিয়ে ধরা গলায় রোদেলাকে বলে,”আমার যে খুব সাধ ছিল রে রোদেলা একটা সংসারের।”

রোদেলা বোনকে আরো শক্ত করে ধরে, মৃদু স্বরে বলতে থাকে,” হবে আপু। তোর একটা খুব সুন্দর সংসার হবে। একটা সুখের সংসার হবে তোর, অবশ্যই হবে।”

***
অফিসে আজ তাশরিফের পদোন্নতি উপলক্ষে ছোটোখাটো একটা পার্টি রাখা হয়েছে জেনারেল ম্যানেজার রাশেদুজ্জামানের পক্ষ থেকে। তিনি এসে ফুল দিয়ে তাশরিফকে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি ঘোষণা দিলেন তাশরিফকে আজ থেকে আলাদা কেবিন দেওয়া হয়েছে।

রোদেলা চুপচাপ এক কোনায় বসে আছে। তারা এখন আছে সাত তলায় সেমিনার হলে। তার হাতে একটা কোকের বোতল। একটু চুমুক দিয়েই বোতলটা দূরে সরিয়ে রাখে। সবাই কত আনন্দ করছে,হৈ হৈ করে কথা বলছে,হাসছে অথচ সে এখানে চুপচাপ বসে আছে। এটা অন্য সবার কাছে যেমন ভালো লাগেনা,তেমনি তার কাছেও যথেষ্ট অস্বস্থিকর। কিন্তু সে কি করবে! তার যে এতো হৈ হুল্লোড় ভালো লাগেনা কখনোই। তার উপর এখানে জিএম স্যার রয়েছে। রোদেলার একটুও ইচ্ছে করছে না তার চোখের সামনে পরতে।

“বসতে পারি”
রোদেলা মুখ তুলে তাকিয়ে তাশরিফকে দেখে। তারপর একটা ম্লান হাসি দিয়ে কিছুটা সরে বসে তাশরিফকে সোফাতে জায়গা ছেড়ে দেয়।
তাশরিফ বসে পরে। রোদেলার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে,”চুপচাপ বসে আছেন যে।”
_আসলে খুব মাথা ব্যথা।
তাশরিফ মৃদু হাসে,বলে,”আপনি এখানে এসে কেনো বসে আছেন তা আমি জানি।”
রোদেলা একটু অবাক হয়। চোখ তুলে তাশরিফের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।
তাশরিফ বলে,”জিএম স্যারের জন্য তাই না?”
রোদেলা কিছু বলে না। তাশরিফ বলতে থাকে,”জিএম স্যারের একটা নীতি আছে জানেন? সে কখনো বিবাহিতা মেয়েদের বিরক্ত করে না। আপনিও একটা বিয়ে করে ফেলুন। দেখবেন আপনাকে আর বিরক্ত করছে না!”
রোদেলা তাশরিফের দিকে শীতল দৃষ্টি দেয়। তাশরিফ খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে মনে মনে বলে,”এইরে! এরকম একটা সস্তা ধরনের রসিকতা করে ফেললাম! মাইন্ড করলো না তো আবার!”

রোদেলা উঠে দাঁড়ায়। কাঁধে ব্যাগ রেখে বলে,”আমি উঠছি। পরিবেশ টা আমার সাথে যাচ্ছে না। গিয়ে বরং একটু কাজ করি।”

রোদেলা চলে যাওয়ার পরে কয়েক মুহূর্ত পর্যন্ত তাশরিফ সেদিকে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েটা কি দ্রুত মুড বদলে ফেলে! চট করে মাথায় একটা পরিকল্পনা ঘুরঘুর করতে থাকে তার। সেও এখন থেকে জিএম স্যারের মতো রোদেলাকে নিজের কেবিনে ডেকে নিয়ে বিরক্ত করবে। রোদেলাকে প্রতিদিন কেবিনে ডেকে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলবে,”মিস রোদেলা! আপনি একঘন্টা আমার সামনে বসে থাকবেন। আপনার আজকের কাজ হচ্ছে এক ঘন্টা আমার সামনে বসে বসে হাসা। আপনি হাসবেন। আমি দেখবো।”
কথাটি ভেবেই তাশরিফ আনমনে হেসে ফেলে।

***
“বৃষ্টি তুই ঠিক আছিস তো?”
রোদেলার ডাক শুনে বৃষ্টি খানিকটা উঁচুতে মুখ তুলে তাকায়। চোখ দুটো লাল হয়ে গিয়েছে প্রচন্ড জ্বরের কবলে পরে। ধীরে ধীরে জবাব দেয়,”এখন কিছুটা কম আছে আপু!”

রোদেলা ব্যাগ গোছাতে থাকে। বৃষ্টির দিকে না তাকিয়ে বলে,”আমি আপুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। আপুর শরীরটা ঠিক যাচ্ছে না। তুই একটু একা থাকতে পারবি না? আমরা যাবো আর আসবো।”

_কেন? বাবা আর আন্টি কোথায়?
_তারা তো বাড়িতে নেই। ওহহ তোকে বলাই হয়নি। তুই তখন ঘুমাচ্ছিলি । কাল রাত দেড়টার দিকে আন্টির বাপের বাড়ি থেকে ফোন এসেছিলো, ওনার মা মারা গিয়েছে,বয়স হয়েছিলো অনেক। বাবাকে নিয়ে আন্টি ফজরের দিকে রওনা হয়েছে। তাই তুই টের পাসনি কিছু।

_ওহহ।
মৃদু স্বরে বলে বৃষ্টি। রোদেলা বলে,”দুপুরের আগে চলে আসবো। রান্না করা আছে। খেয়ে নিস। জ্বর উঠলে আমাকে ফোন দিস ঠিকাছে?

বৃষ্টি মাথা নাড়ায়।

রোদেলা মেঘলাকে নিয়ে চলে যায়। বৃষ্টি হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে নেয়। আদিল সতের বার কল করেছিলো তাকে। বৃষ্টি আনমনে হেসে ফেলে। এই পাগল ছেলেটার এই একটা বদ অভ্যাস, বৃষ্টি ফোন না তুললে ফোন দিতেই থাকে। বুঝতেও চায়না এর জন্য বৃষ্টি বিপদে পরতে পারে। আদিলের নাম্বারে ফোন দিতেই সাথে সাথে আদিল ফোনটা রিসিভ করে বলে ওঠে,”কি অবস্থা তোমার? আমি কত টেনশন করছিলাম জানো?”
_আদিল , আপু ছিলো পাশে এতক্ষণ। তুমি কেনো এতো পাগলামি করো?
_আচ্ছা আর করবো না। জ্বর কি বেশি?
_এতক্ষন ছিলো না। আবারো মনে হচ্ছে জ্বর উঠছে গায়ে। অসহ্য লাগছে খুব।
ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে বৃষ্টি। সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছে তার।
_ডাক্তার দেখাবে না? এখনো বসে থাকবে?
_বাড়িতে কেউ নেই। বাবা আন্টিকে নিয়ে কিশোরগঞ্জ গিয়েছে। মেজো আপু গিয়েছে বড় আপুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে। দুপুরে ফিরবে। বিকেলে আপুকে বলবো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা। এতো টেনশন করো না তুমি।
_বাড়িতে কেউই নেই?
_নাহ।
বৃষ্টি হাঁপাতে থাকে। জ্বরের তীব্রতা বাড়ছে। আদিল জানে বৃষ্টি রাজি হবে না তবুও খুব সাহস করে বলে ফেলে,”আমি আসবো বৃষ্টি? তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করছে! পাঁচ মিনিটের জন্য আসি? প্লিজ বৃষ্টি!”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে দুজন। আদিলকে অবাক করে দিয়ে বৃষ্টি অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”এসো। আমারো তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।”

***
ডাক্তারের চেম্বারে প্রচুর ভীড়। মেঘলাকে ওয়েটিং রুমের একটা ফাঁকা সিটে বসিয়ে রেখে রোদেলা দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরপর ঘড়িতে সময় দেখছে সে। তারা এসেছে নারী ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডক্টর নাফিজা রহমানের চেম্বারে। ওয়েটিং রুমে যারা আছে তাদের বেশিরভাগই নবাগতা মা ও শিশু। কিছুক্ষণ পরপর পুরো রুম কাঁপিয়ে কেঁদে ওঠে তারা। একজনের কান্না থামতেই আরেকজন কেঁদে ওঠে। সেই সদ্য প্রস্ফুটিত ফুল গুলোর কান্নার আওয়াজ মেঘলার মস্তিষ্কে তীব্র যন্ত্রণার সৃষ্টি করে। বুকের মধ্যে হাহাকার লাগিয়ে দেয়। মেঘলা শাড়ির আঁচল খামছে ধরে বসে থাকে। চোখের পানি আটকে রাখার যুদ্ধে সে জয়ী হবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রোদেলা তার বোনকে ভালো করে লক্ষ্য করে। তার ইচ্ছা করছে মেঘলাকে এখান থেকে সরিয়ে নিতে,ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন নেই।
এরই মধ্যে রোদেলাদের ডাক পরে ডাক্তারের কেবিনে। বোনের এক হাত ধরে বলে,”আয় আপু। আমার সাথে আয়।”

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ গুলো কিনে নেয় রোদেলা। মোট তিন হাজার টাকা বিল হয়েছে। মেঘলা পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। মনে মনে ভীষণ অপরাধ বোধে ভুগছে সে। হসপিটালে এতো গুলো টাকা বিল হয়েছে,যা সবটাই রোদেলা দিয়েছে। এখন আবার তিন হাজার টাকার ওষুধ। তার পেছনে এতো টাকা খরচ করছে মেয়েটা। চাকরি করে যেটুকু পাচ্ছে তার পুরোটাই সংসারের পেছনে খরচ করছে। তার ওপর এখন মেঘলা এসে রোদেলাকে বাড়তি খরচ দিচ্ছে। এতো খাটে মেয়েটা,নিজের জন্যে কখনো কোনো শখ করতে দেখে না সে রোদেলাকে। মেঘলা মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, পুরোপুরি সেরে উঠলে সে একটা চাকরি নেবে। তার জীবন টা তো শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু সে রোদেলার জীবনটা এভাবে হেলায় হেলায় শেষ হতে দেবে না।

ওষুধ কিনে একটা সিএনজি ঠিক করে দু’বোন সিএনজিতে উঠে বসে। রোদেলা চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে,ডান হাত দিয়ে ফোনটা কানে ধরে রেখেছে সে। মেঘলা বলে,”কাকে ফোন দিচ্ছিস?”
_বৃষ্টিকে। ফোন ধরছে না। জ্বর উঠলো নাকি! টেনশন হচ্ছে খুব!
_চিন্তা করিস না। ঘুমাচ্ছে বোধ হয়। সারাদিন এতো চিন্তা করিস কেনো বলতো? একটু নিজের দিকে তাকা। চেহারা দেখেছিস? কেমন বুড়ি বুড়ি লাগছে তোকে।
রোদেলা হেসে ফেলে,”আসলে আপু এখন দু মিনিট টেনশন ছাড়া বসে থাকলে মনে হয় এভাবে বসে থাকা ঠিক না, আমার অবশ্যই টেনশন করা উচিত ‌কিছু নিয়ে।”

মেঘলা বোনের কথায় ম্লান হাসে।

সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে নেমে পরে তারা ‌। এপার্টমেন্টের সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকে দুজন। আজ এপার্টমেন্টের পরিবেশ টা কেমন অদ্ভুত ঠেকছে রোদেলার কাছে। সিঁড়ি বেয়ে এতো ওঠা নামা করে সে,কখনো কোনো ফ্ল্যাটের দরজা খোলা দেখেনি সে। আজ লোকজন এভাবে নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কেনো! উপর থেকে কেমন হট্টগোলের আওয়াজ আসছে। উপরে তো চার তলা এবং সেখানে একটা মহিলা মাদ্রাসা রয়েছে। কিছু কি হয়েছে উপরে ! কিন্তু চারতলায় এসে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পরে না তাদের,বরং হট্টগোলের আওয়াজ টা আসছে ছয়তলা থেকে। রোদেলা দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে থাকে। তাদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে এই এপার্টমেন্টের কেয়ার টেকার এবং নিচতলার কিছু মহিলা উঁকি দিচ্ছে ভেতরে। ভেতর থেকে বাড়ি ওয়ালা দিদারুল ইসলামের রাশভারী গলার আওয়াজ ভেসে আসছে। সে কাউকে ধমকাচ্ছে।
রোদেলা তড়িঘড়ি করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে, তার পিছু পিছু ঢোকে মেঘলা।

বসার ঘরে বাড়িওয়ালা দিদারুল ইসলাম বসে আছে। আরো রয়েছে এই এপার্টমেন্টের কিছু পরিচিত মুখ,যাদের সাথে রোদেলার কখনো তেমন কথা হয়নি। বসার ঘরে এককোণে বসে কাঁদছে বৃষ্টি। বৃষ্টিকে এভাবে কাঁদতে দেখে রোদেলা চমকে ওঠে, তারচেয়েও বেশি অবাক হয় বৃষ্টির পাশের ছেলেটিকে দেখে। এই ছেলে এখানেও চলে এসেছে! কত্ত বড় সাহস! ও বৃষ্টির সাথে উল্টো পাল্টা কিছু করেনি তো! রোদেলা আঁতকে ওঠে কথাটি ভেবেই!
চেঁচিয়ে উঠে বলে,”এখানে কি হচ্ছে? কি হচ্ছে এখানে!”

বাড়িওয়ালা দিদারুল ইসলাম তার পান খাওয়া লাল দাত বের করে বলে,”অনেক কিছু হয়ে গিয়েছে এখানে। এখনো অনেক কিছু হওয়া বাকি।”
রোদেলা কিছু বুঝতে পারছে না। মেঘলা দৌড়ে গিয়ে বৃষ্টিকে ধরে। রোদেলা আদিলের দিকে তেড়ে যায়,”এই ছেলে! তুমি এখানে কি করছো? তোমার কতবড় সাহস,তুমি বাসায় এসে বৃষ্টিকে বিরক্ত করছো!”
আদিল মাথা নিচু করে বসে আছে। বৃষ্টি কেঁদেই যাচ্ছে।
দিদারুল ইসলাম বলে,”উহহ। কথাটা ভুল রোদেলা। এই ছেলেটা বিরক্ত করতে আসে নি, তোমার এই “দুধের বাচ্চা” বোনটিই তাকে ফাঁকা বাড়িতে ডেকে এনেছে বিরক্ত হওয়ার জন্য।”
রোদেলা চমকে উঠে দিদারুল ইসলামের দিকে চায়। দিদারুল ইসলাম বলে,”ছিঃ। এই এপার্টমেন্টে একটা মহিলা মাদ্রাসা রয়েছে। আর এখানে কি না তোমার বোন ফাঁকা বাড়িতে তার প্রেমিক নিয়ে….”
“মুখ সামলে কথা বলুন।”
চেঁচিয়ে ওঠে রোদেলা। দিদারুল ইসলাম বলে,”চেচিও না। দুজন অবিবাহিত প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে মেয়েকে ফাঁকা বাড়িতে দেখলে কি ভাববো? তারা এখানে কি করছিলো?”
রোদেলা বৃষ্টির দিকে তাকায়। তার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। কি হতে যাচ্ছে এখানে এখন!
তিনতলার একজন লোক বাড়িওয়ালাকে বলে ফেলে,”এখন কাজী ডেকে এদের বিয়ে পড়িয়ে দিন। এতো বড় অনাচার, ব্যভিচার দেখেও চুপ করে বসে থাকা যায় না। আমরাও এর ভাগীদার হবো। ছেলে মেয়ে যখন একে অপরকে ভালবাসে তখন বিয়ে পড়িয়ে দিন। ছেলের বাড়িতে খবর দিন।”
দিদারুল ইসলাম মাথা নাড়ায়। রোদেলা ধমকে বলে,”বিয়ে পড়িয়ে দিন মানে? ফাজলামি হচ্ছে? আমার বোনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আপনি কে?”
দিদারুল ইসলাম রোদেলাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”তুমি যে একটা বেয়াদব মেয়ে তা তো আমরা সবাই জানি। তবে শোনো মেয়ে, তোমার বোনকে তুমি বিয়ে দাও,কেটে নদীতে ভাসিয়ে দাও সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু আমার এপার্টমেন্টে মহিলা মাদ্রাসা রয়েছে, এই তল্লাটে আমার সুনাম রয়েছে,এখানে এই ব্যাভিচার আমি বরদাস্ত করবো না। তিন দিনের মধ্যে তোমরা আমার এপার্টমেন্ট ছেড়ে দেবে। তোমার এই চরিত্রহীনা বোনকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাবে।”
রোদেলার মাথা ঘুরছে। তার মনে হচ্ছে সে এখনি পরে যাবে। বাড়িওয়ালা দিদারুল ইসলাম এবং বাকি লোক ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে যায়।
রোদেলা আদিলের দিকে তেড়ে যায়।
“এই অসভ্য ছেলে! তুমি এক্ষুনি এখান থেকে বেরিয়ে যাও। এক্ষুনি।”

আদিল চোখ তুলে রোদেলার দিকে তাকায়। সে প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে রোদেলাকে, কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে,”আপু। বৃষ্টির কোনো দোষ নেই। ও আমাকে ডাকেনি। ওকে ভুল বুঝবেন না।”

_তোমাকে এই মুহূর্তে যেতে বলেছি আমি। নয়তো আমি পুলিশ ডাকবো।
আদিল বৃষ্টির দিকে তাকায়। বৃষ্টি তার দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ হয়ে কাঁদছে।
আদিল উঠে দরজার কাছে যায়। আজ তার জন্য বৃষ্টিকে এতো বড় বিপদে পরতে হয়েছে। সে পেছন ফিরে বৃষ্টিকে আরো একবার দেখে। রোদেলা এসে আদিলের মুখের সামনে ধপ করে দরজা লাগিয়ে দেয়।

দরজা লাগিয়ে রোদেলা বৃষ্টির দিকে তাকায়। বৃষ্টি ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বলে,”বিশ্বাস করো আপু। আমরা খারাপ কিছু করিনি। তুমি বিশ্বাস করো!”
রোদেলা গিয়ে প্রচন্ড জোরে বৃষ্টির গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়। চড়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে বৃষ্টি মেঘলার গায়ের ওপর গিয়ে পরে। মেঘলা বৃষ্টিকে আগলে রেখেছে, কাতর কন্ঠে রোদেলাকে বলে,”মাথা ঠান্ডা কর রোদেলা । মেয়েটার গায়ে প্রচন্ড জ্বর!”

রোদেলা মেঘলার কথাতে মাথা ঠান্ডা করে না। বৃষ্টির চুলের মুঠি ধরে ওকে টেনে তোলে, চেঁচিয়ে বলে,”অসভ্য মেয়ে কোথাকার! নিজের এতো বড় সর্বনাশ করে ফেললি !”

_আপু তুমি বিশ্বাস করো আমি খারাপ কিছু করিনি। ও শুধু আমাকে দেখতে এসেছিলো। খারাপ কিছু করিনি আমরা।
কাঁদতে থাকে বৃষ্টি। রোদেলা ওকে ধাক্কা দিয়ে মেঘলার গায়ে ফেলে দিয়ে নিজে ধপ করে ফ্লোরে বসে পরে। হাপাচ্ছে সে।

কয়েক মুহূর্ত পরে বলতে থাকে,”নিজের জীবনের কোনো স্বপ্নই পূরণ হলো না আমার। দিন রাত শুধু ভাবতে থাকি নিজে যা করতে পারি নি বোনটাকে দিয়ে সেটা করাবো। কখনো তোর কোনো ব্যাপারে অবহেলা করিনি আমি। ভালো স্কুল,ভালো কলেজ,ভালো টিচারের কাছে টিউশন পড়তে দেওয়া। সব সময় ভালোটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি তোকে। সবসময় বাসে যাতায়াত করি কারণ দুই টাকা বাচলে সেটা দিয়ে তোর আরেকটা ভালো ড্রেস হবে,তুই তোর বড়লোক বান্ধবীদের পাশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবি। আর তুই আমার তোকে মানুষ করবার সব চেষ্টায় পানি ঢেলে এখানে বসে একটা নেশা খোরের সাথে…..”
মেঘলা বৃষ্টিকে রেখে এসে রোদেলাকে ধরে। রোদেলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে,”সব শেষ আপু। হতভাগী নিজেও বুঝতে পারছে না ওর কি সর্বনাশ ও করে ফেলেছে।”

চলমান….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here