দ্বিতীয়_ফাগুন #পর্ব_সংখ্যা_৪ #লেখিকা_Esrat_Ety

0
385

#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্ব_সংখ্যা_৪
#লেখিকা_Esrat_Ety

১০
“আমি রোদেলা। রোদেলা আমিন। বাবার নাম রুহুল আমিন, মায়ের নাম………..যাই হোক বাদ দিন। আমার বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে আমি যখন দশ বছর বয়সী তখন। তারা এখন দুজনেই আলাদা আলাদা সংসার পেতে সুখী জীবন যাপন করছে। আমার বয়স সাতাশ বছর কিন্তু বার্থ সার্টিফিকেটে‌ ছাব্বিশ। আমার গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা,কখনো কখনো ফরসা,আবার কখনো কালো। কোনো নির্দিষ্ট রং নেই। আমার অনেক গুলো বাবা মায়ের মতো আমার গাঁয়ের রঙও অনেক গুলো। আমি একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে একাউন্টস ডিপার্টমেন্টে জুনিয়র একাউন্টস অফিসার পদে সার্ভিস দিচ্ছি। স্যালারি যা পাই তাতে আমাদের মধ্যবিত্ত সংসার বেশ ভালো ভাবে চলে যাচ্ছে।‌ আমি একজন অবিবাহিত ইন্ডিপেন্ডেন্ট ওম্যান। একটা তিন বছরের রিলেশন ছিলো, কিছুদিন হয় সেটা শেষ হয়ে গিয়েছে। তার কারন……….যাই হোক এটাও বাদ দিন। আমি এখন নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছি। তার কারন বাড়িতে আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে আমার ডলি খালা। আমার মায়ের একমাত্র বোন। পেশায় তিনি একজন “পাশের বাসার আন্টি”। অবশ্য আমার নানাবাড়ির দিকের সব লোকজনই এরকম, শুধুমাত্র আমার নানাভাই বাদে। ডলি খালার মুখোমুখি আমি হতে চাই না এজন্যই আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছি।”

এই পর্যন্ত লিখে রোদেলা লেখাটা কলম দিয়ে কাটতে থাকে। কাগজটাকে দলা পাকিয়ে ময়লার ঝুড়িতে ছুঁড়ে মারে। তার ভীষণ মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে। দরজা বন্ধ করার পরেও বসার ঘর থেকে ওই মহিলার গলা শোনা যাচ্ছে। এই মহিলার গলা নয় যেন আস্ত একটা মাইক। রোদেলা অপেক্ষা করতে থাকে কখন এই মহিলা ঘর থেকে বের হবে,এই মহিলা বের হয়ে গেলে সে একটু ছাদে যাবে। অনেকদিন হয় বিকেলে ছাদে গিয়ে হাওয়া খায়না সে।

বসার ঘরে দুইসিটের একটি সোফা পুরোটাই দখল করে বসে শামসুন্নাহার ডলি। অত্যন্ত স্বাস্থবতী একজন মহিলা। শরীরে বিশ্রী ভাবে মেদ জমে তাকে মোটামুটি বড় সাইজের একটা পেঙ্গুইনের মতো লাগে দেখতে। তিনি আজ রোদেলাদের বাড়িতে রোদেলার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। পাত্র তার ননদের ছেলে। ছেলে ইতালি প্রবাসী,বিয়ে করে বৌ নিয়ে যাবে সাথে। তার মতে রোদেলার রাজ কপাল হবে যদি এইখানে রোদেলাকে বিয়ে দেওয়া হয়। তার সামনে বসে থাকা তার ছোটো বোনের প্রাক্তন স্বামী রুহুল আমিনের দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে বলে,”তুমি আর তোমার মেয়েরা আমাদের আপন নাই ভাবতে পারো কিন্তু ওরা তো চাইলেও অস্বীকার করতে পারবে না যে আমরা ওদের আপনজন।”

ডলির কথায় রুহুল আমিন শুকনো হাসি হাসে, তারপর বলে,”দেখেন আপা। আমি কখনোই আমার মেয়েদের ওপর আমার কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিইনি। এই দেখেন মেঘলা যাকে পছন্দ করেছে তার কাছে বিয়ে দিয়েছি। রোদেলার বেলাতেও তাই, ওর পছন্দ অনুযায়ীই হবে সব। আপনি ওর সাথে কথা বলেন আগে।”

_কথা কিভাবে বলবো? আমাকে দেখলেই তোমার মেয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে তা কি আমি জানি না? সে কি ভাবছে! বয়স তো কম হলো না। এরকম করলে পরে ভালো পাত্র জুটবে? আমার ভাসুর ঝি ছিলো এরকম। সময় মতো বিয়ে করেনি,বয়স যেই তিরিশের কোঠায় পৌঁছেছে , মুখের চামড়া কুঁচকে যেতে শুরু করেছে অমনি তাদের টনক নড়েছে, কিন্তু তখন আর লাভ কি হলো, মন মতো কোনো পাত্র পেলামই না, প্রস্তাব যা আসতো তা সব ডিভোর্সী নয়তো এক বাচ্চার বাপ। কিছু মনে করো না ভাই রুহুল, রোদেলার সাথে যদি সেরকম কিছু হয়? বাপ হয়ে দেখতে পারবে সেটা?

রুহুল আমিন চুপ থাকে। ডলি বলতে থাকে,”মেঘলার তো একটা ব্যাবস্থা হলো,এখন রোদেলাকে বিয়ে দিয়ে দাও। বাকি থাকলো বৃষ্টি,ও তো আগুন সুন্দরী। তুড়ি মারলেই ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার জুটে যাবে ওর জন্য। তোমার শরীরের যে অবস্থা,একবার তো স্ট্রোক করে ফেলেছো।”

রোদেলা নিজের ঘর থেকে সবটা শুনছে। রাগে তার গা কাঁপছে। নিশ্চয়ই নাজমুন্নাহার মলি নামের ভদ্রমহিলা ওনাকে পাঠিয়েছেন এসব করার জন্য। সে চোখ মুখ শক্ত করে বসে থাকে।

রান্নাঘর থেকে উঁকি মারে আয়েশা সিদ্দিকা। রোদেলা তাকে কড়া করে বলে দিয়েছে রোদেলার নানা বাড়ির কেউ আসলে যেনো সে সামনে না যায়। তাই সে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে।

১১

“এই নে দেখ। আরে একবার তাকা তো।”

তাশরিফ কপাল কুঁচকে তার মায়ের দিকে তাকায়। তাশরিফের মা তাহমিনা রহমান একটা ছবি তাশরিফের দিকে বাড়িয়ে ধরে রেখেছে।

_আরে আমাকে দেখছিস কি। ছবি দেখ।

_মা আমাকে বিরক্ত করবে না এখন যাও। পরে দেখবো। দেখছো না কাজ করছি।

তাহমিনা মুখ ভার করে তাশরিফের পাশে বসে পরে। তাশরিফ বাধ্য ছেলের মতো বলে,”ঠিকাছে দাও। দেখে দিচ্ছি।”
তাহমিনা খুশি খুশি ছেলের দিকে ছবিটা বাড়িয়ে দেয়। তাশরিফ ছবিটা দেখে। খুবই কম বয়সী একটি মেয়ে। স্কুল ড্রেস পরে আছে। চেহারা থেকে বাচ্চা ভাবটাই এখনো যায়নি। মা বেছে বেছে আবারো একটা নাবালিকা ঠিক করেছে তার জন্য। পাশ থেকে তাহমিনা আহ্লাদী গলায় বলে,”মেয়ে এই বছর এইচ.এস.সি পরিক্ষা দিয়েছে। বাবার সিমেন্টের ব্যবসা। মোটামুটি সচ্ছল পরিবার। সব চেয়ে ভালো দিক কি জানিস,মেয়ের দেশের বাড়িও বরিশাল।”

তাশরিফ অবাক হয়ে বলে,”বরিশাল হলে লাভ?”
তাহমিনা নাক মুখ কুঁচকে বলে,”বরিশাইলারা ছাড়া বরিশাইলাদের মর্ম কেউ বুঝতে পারবে না বুঝলি। এতো বছর ঢাকায় থাকি। সবই তো দেখছি। বরিশালের মেয়েরা বর পাগল হয় বেশি। অন্য কোনো বিভাগের মেয়েকে নিয়ে আমি অন্তত সংসার করতে পারবো না!”

_তুমি যেমন অন্য বিভাগের মেয়ে দেখে নাক সিটকাচ্ছো মা,তেমনি অন্য বিভাগের মেয়ের মায়েরাও আমাকে দেখে নাক সিঁটকায় গিয়ে দেখো, সবাই তো জানে বরিশাইলা মানে বাটপার,চালবাজ।
হো হো করে হাসতে থাকে তাশরিফ কথাটি বলে।
তাহমিনা বিরক্ত হয়ে বলে,”নাক সিঁটকাবো কেনো,আমি বলতে চাচ্ছি তারা তো রুটি পিঠা, নারিকেলের ঝোলই চিনবে না তোকে বানিয়ে কিভাবে খাওয়াবে? তুই রুটি পিঠা আর নারিকেলের ঝোল কত পছন্দ করিস।”
তাশরিফ মায়ের কথায় উচ্চস্বরে হেসে ফেলে।
তাহমিনা অবাক হয়ে বলে হাসছিস কেনো?
তাশরিফ হাসতে হাসতেই জবাব দেয়,”মা বিয়ে কি মানুষ রুটি পিঠা আর নারিকেলের ঝোল খাওয়ার জন্য করে?”

_তোর বাপ তো তাই করেছিলো। আমি ভালো রান্না বান্না জানি,তাই দেখেই তো করেছিলো।

_মা,বাবার পছন্দ আর আমার পছন্দ আলাদা। আমি তো রান্না করার বাবুর্চি খুজছি না।
_তাহলে কি খুজছিস তুই? শহুরে মডার্ন কোনো মেয়ে? গাঁয়ে ওড়না থাকে না, চাকরি করবে। কথায় কথায় টাকার গরম দেখাবে। এমন মেয়ে?

তাশরিফ হাসে,”আমি এমন কাউকেই খুঁজছি না মা। আমি খুঁজছি অতি সাধারণ একটা বুঝদার মেয়ে, বেশি রুপবতী হবার দরকার নেই তবে মনটা খুবই ভালো হতে হবে। তুমি বেছে বেছে এসব বাচ্চা মেয়ে গুলোকে ধরে এনো নাতো,আমার আনইজি লাগে মা। কত ছোটো একটা মেয়ে। এর তো বোধহয় ভোটার আইডি কার্ডও হয়নি। তুমি ছবিটার দিকে ভালো করে দেখো,আমার মনে হচ্ছে নিজের সর্দিই মুছতে পারে না এই মেয়েটা।
তাহমিনা বলে,”মেয়েরা নিজের সর্দি না মুছতে জানলেও বিয়ে হতে না হতে বাচ্চার সর্দি কিভাবে মুছতে হয় তা শিখে ফেলে । এই মেয়েও পারবে।
তাশরিফ মায়ের কথায় বিরক্ত হয়ে চোখ মুখ কুঁচকে তার দিকে তাকায়।

_ঠিকাছে। তুই খুজে বের কর তোর পছন্দ মতো মেয়ে।
তাহমিনা গটগট করতে করতে চলে যায়। তাশরিফ হাসতে থাকে মনে মনে, সে যেমন মেয়ে চায় আজকাল এমন মেয়ের পৃথিবীতে অস্তিত্ব তো রয়েছে, তবে খুব কম। খুজে পাওয়া মুশকিল। সে কিভাবে খুজে বের করবে!

১২

ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে সে। এমনিতেই মেজাজ টা প্রচুর গরম হয়ে আছে,এখন এই ফোনটা রিসিভ করে মেজাজের রফা-দফা করতে চায়না সে। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে অবশেষে ফোনটা রিসিভ করে রোদেলা। ওপাশ থেকে তার দুলাভাই মাইনুল ইসলামের কন্ঠ,”হ্যা হালো।”
রোদেলা গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”জ্বী বলুন দুলাভাই। সব ভালো?”
_আরে রাখো তো সব ভালো। আগে বলো তোমার আপার ফোন বন্ধ কেনো?
মাইনুলের কন্ঠে ধমকের সুর।
_আপুর ফোন আমি বন্ধ করে আলমারিতে তালা দিয়ে রেখেছি। ফোনটার একটু রেস্ট দরকার।
_মানে? কি সব বলছো তুমি। তোমরা কি আমার সাথে ফাজলামি করছো রোদেলা?
_জ্বী আপনার সাথে তো আমার ফাজলামিরই সম্পর্ক দুলাভাই।
_শোনো রোদেলা, তোমার আপুকে বলবে কালকের মধ্যে যদি বাড়িতে গিয়ে আমার মায়ের কাছে ক্ষমা না চায় তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।
_কি খারাপ হবে শুনি একটু।
রোদেলার পাল্টা প্রশ্নে মাইনুলের মেজাজ বিগড়ে যায়।
_তোমাদের সব বোনদের তেজ টা একটু বেশি রোদেলা।
_জ্বী। তা তো একটু বেশি। এখন বলুন খারাপ কি করবেন? আপুকে ডিভোর্স দিয়ে দিবেন? শুনুন দুলাভাই বাচ্চাটা একবার পৃথিবীতে আসুক। তারপর আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আপনার আর আপুর ডিভোর্স করিয়ে দেবো।

_এই মেয়ে ! বেয়াদবের মতো কথা কেনো বলছো।

_কারন আমি বেয়াদব। শুনুন, বাচ্চাটাকে জন্মাতে দিন। আপনাদের বাড়ীর বংশধর আপনাদের হাতে তুলে দিয়ে আমি আপুকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসবো। এমনিতেও ওই বাচ্চা আপনার আর আপার ভালোবাসায় জন্ম নিচ্ছে না। ও হচ্ছে আপনার মতো একটা ইতরের কামনা আর আপুর মতো নির্বোধ মেয়ের বোকামির ফসল।

কথাটি বলেই রোদেলা ফোন কেটে দেয়। ফোন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। মৃদু বাতাসে রোদেলার কপালের কাছে চুলগুলো উড়ছে। সেগুলো আঙ্গুল দিয়ে কানের পাশে সরিয়ে রেলিং-এ হাত রাখে। বিষন্ন দুটি চোখের দৃষ্টি শূন্যে রেখে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর নিচের দিকে তাকায়। আচ্ছা সে যদি এখান থেকে,এই ছয়তলার উপর এখন হঠাৎ করে নিচে পরে যায় তাহলে কি হবে?

কথাটা মনে আসতেই রোদেলা রেলিং টাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। তারপর আবারো নিচে তাকায়। নিচের দিকে তাকাতেই রোদেলার চোখে পরে সেদিনের সেই ছেলেটি। এই ছেলে এখানে কি করছে ! হাত নাড়িয়ে কাকে ডাকছে! কি সাংঘাতিক ছেলে। রোদেলা দুমিনিট ছেলেটাকে দেখে সিঁড়ির দিকে দৌড়ে যায়। এই ছেলেকে আজ উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে সে !

১৩
এখন তার হাতে দুটো অপশন। এখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া নয়তো এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আসামীর মতো পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ সহ্য করা। প্রথমটা করা যেতে পারে, কিন্তু এতে সে ভবিষ্যতে কাপুরুষ হিসেবে চিহ্নিত হবে। তাই পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে বীরপুরুষের মতো টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে এখানে কেনো এসেছে এই প্রশ্নের কিছু ভুলভাল উত্তর দিয়েই সটকে পড়বে এখান থেকে।
রোদেলা দ্রুতপায়ে আদিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। রোদেলার বাজপাখির ন্যায় আগমন আদিলকে কিছুটা ভীত করে। বন্ধু বান্ধবের কাছে থেকে যা শুনেছে বৃষ্টির এই বোনটা খুবই সাংঘাতিক। এখন যদি দু একটা থাপ্পর মেরে দেয়?
রোদেলা আদিলের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার ভালো করে দেখে নেয়। ফর্সা মুখ, সুন্দর চোখ, মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল, উচ্চতায় বেশ লম্বা। সেদিন রাতে ভালো করে দেখেনি সে ছেলেটাকে, চেহারা মোটেও চাপা ভাঙ্গা নয়। হঠাৎ তার মনে হলো চেহারাটা কেমন চেনা চেনা লাগছে। কার সাথে যেন মিলছে খুব চেহারাটা। কয়েক মুহূর্ত পরে ধমকে ওঠে,”এই ছেলে! তোমার নাম কি?”
আদিল একবার ঢোক গিলে নেয়। এই মহিলার গলার স্বরও এই মহিলার আচরণের মতো ভয়ংকর। অথচ বৃষ্টি কি মিষ্টি একটা মেয়ে। কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে ভদ্রভাবে বলে সে,”আমার নাম আদিল হাসান আপু।”
_কিসে পড়ো তুমি?
_আমি একজন এডমিশন ক্যান্ডিডেট আপু।
_এডমিশন ক্যান্ডিডেট পড়ার টেবিলে থাকবে। মহিলা মাদ্রাসার নিচে কি করছো? জানো এই বিল্ডিং-এর চার তলায় মহিলা মাদ্রাসা আছে?

আদিল মাথা ঝাঁকিয়ে বলে ,”না আপু জানতাম না। আমি আসলে এখানে বন্ধুদের সাথে এসেছি।”

_বন্ধুদের সাথে এসেছো, তোমার বন্ধুরা কই? আর তোমরা এই চাপা গলির ভেতর কি করছো? এটাতো বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেওয়ার মতো জায়গা না। পাশেই একটা বড় মাঠ আছে। ওখানে যাও।

_জ্বি আপু। এক্ষুনি যাচ্ছি।
বলেই আদিল মাথা ঘুরিয়ে দুই পা ফেলে। পেছন থেকে রোদেলা ডেকে ওঠে,”শোনো।”
আদিল ঘুরে তাকায়।
_বৃষ্টিকে চেনো?
_কোন বৃষ্টি আপু? আমি কোনো বৃষ্টিকে চিনি না।

রোদেলার এক মূহুর্ত মনে হলো ধমকা ধমকি করে ছেলেটাকে শাসিয়ে দেবে পরক্ষনেই মনে হলো বখাটে টাইপের ছেলে,যদি আক্রোশ টা বৃষ্টির উপর গিয়ে পরে। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”কিছু না তুমি যাও,আর যেনো এই রোডে না দেখি।”
রোদেলার মুখ থেকে কথাটা বের হতে যেটুকু দেড়ি হলো,আদিলের ওই স্থান থেকে গায়েব হয়ে যেতে সেটুকু দেড়ি হলো না।

ছয়তলা থেকে বৃষ্টির রুমের বেলকোনী দিয়ে সবটা দেখছিলো বৃষ্টি। সে আতংকে জমে গিয়েছে। এই মেজো আপু থাকতে এ জীবনে বোধ হয় তাদের প্রেম সফল হবে না। আপাতত এই কথাটাই মাথায় আসছে তার।

১৪
“এই,এই রোদেলা।”
মাথা ঘুরিয়ে মেহরিনের দিকে চায় সে।
“কি মেহরিন আপা? কিছু বলবেন?”
মেহরিন চেয়ার টেনে বসে। রোদেলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”কি ব্যাপার বলো তো। আজকাল অফিসে সারাক্ষণ কাজ নিয়েই ডুবে থাকছো। প্রমোশন তো নাচতে নাচতে এলো বলে।”
রোদেলা হেসে ফেলে,”কি যে বলেন আপা।”

_তুমি অবশ্য প্রমোশন ডিজার্ভ করো। এই অফিসে,আমার দেখা দ্বিতীয় পরিশ্রমী এম্প্লয়ি হচ্ছো তুমি।

_প্রথম জন কে?
কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রোদেলা মেহরিনের দিকে।

_আরে কে আবার। তাশরিফ হাসান। যেমনি পরিশ্রমী,তেমনি একজন ভদ্রলোক।
তাশরিফের নাম শুনতেই রোদেলা চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। মেহরিন উৎফুল্লের সাথে বলতে থাকে,”আচ্ছা তাশরিফ হাসানকে তোমার কেমন লাগে রোদেলা?”
মেহরিনের কথায় রোদেলা চমকে উঠে বলে,”আমার কেমন লাগে মানে?”
_কেমন লাগে মানে কেমন লাগে? ছেলেটা সুন্দর না বলো ! আমার তো বেশ লাগে।

রোদেলা এক পলক তাশরিফের দিকে চায়। একমনে ডেক্সটপে কি যেনো করছে সে।
_হু তথাকথিত সুন্দর। তবে পারসোনালি আমার ভাল্লাগে না।
রোদেলা জবাব দেয়।
মেহরিন অবাক হয়ে বলে,”কেনো? ভাল্লাগে না কেনো?”
_সুন্দর ছেলেদের দেখলে আমার রবীন্দ্রনাথের অপরিচিতা গল্পের অনুপমের কথা মনে পরে যায়। মাকাল ফল।
রোদেলা কথাটি বলে আরো একবার তাশরিফের দিকে চায়।
মেহরিন বলে,”ওমা। কি কথা বলো তুমি রোদেলা। তাশরিফ আর অনুপম কি এক হলো? তাশরিফ কতো ব্যক্তিত্ববান একজন পুরুষ। আমি তো ঠিক করেছি আমার ননদের জন্য ওর কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখবো। ”
রোদেলা চোখ বড় বড় করে মেহরিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
“সত্যিই নাকি আপা?”
_হু।
_বেশ। তাহলে আমি আমার বক্তব্য ফিরিয়ে নিলাম। তাশরিফ হাসান কোনো মাকাল ফল নয়। তিন হচ্ছেন হাই-ভাইটামিনস সমৃদ্ধ একটি অতি সুস্বাদু ফল।
মেহরিন হাসতে হাসতে বলে,”যাই বলো। ওর মতো ছেলে হয় না। আমি তিন বছর ধরে দেখছি। হি ইজ আ ট্রু জেন্টেলম্যান।”

“রোদেলা আপনাকে জিএম স্যার ডাকছে।”
শিরিন আক্তারের কাছ থেকে আবারো সেই ভয়ংকর লাইনটি শুনতে পেলো রোদেলা। তার শমন এসে গিয়েছে। তাশরিফ নিজের ডেস্ক থেকে রোদেলার আতংকিত মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।
রোদেলা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। আজ ভেবেছিলো একটু কাজের চাপ কম থাকবে,কিন্তু না। এই রাশেদুজ্জামান তার পেছনে হাত ধুয়ে নেমেছে।

বাইরে থেকে জিএম রাশেদুজ্জামানের রাশভারী পুরুষালি গলার আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। তিনি রোদেলাকে কড়া গলায় কথা শুনিয়ে যাচ্ছে, ধমকাচ্ছে। কেবিনের বাইরে অনেকগুলো কৌতুহলী চোখ। তাদের মধ্যে কারো কারো চোখে রোদেলা নামের চুপচাপ মেয়েটির জন্য দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। তবে বেশিরভাগ লোকজনের চোখেই চাপা আনন্দ। কারন তারা রোদেলাকে হিংসা করে, রোদেলা নামের মেয়েটি তাদের কাছে কেবলই দেমাগী একটি মেয়ে, এর সাথে এমনটাই হওয়া উচিত।
তাশরিফ কিছুক্ষণ নিজের ডেস্কে থম মেরে বসে থাকে। এই মুহূর্তে তার কি করা উচিত সে ভাবতে থাকে। সে আজ চাইলে রোদেলা নামের খিটখিটে মেজাজের মেয়েটিকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। এজন্য হয়তো তাকে কিছু কথা শুনতে হতে পারে। এখন তার কি করা উচিৎ? রোদেলাকে বাঁচাবে নাকি এখানে বসে বসে অন্যসবার মতো মজা দেখবে?

চলমান….

রোদেলা, বৃষ্টি,মেঘলার সাথে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ 🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here