ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয় পর্ব ১৬

0
342

ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ১৬

চৈতালী কাজ শেষে কলেজ থেকে বের হতে পা বাড়ায়। মাহিম বাইরেই অপেক্ষা করছে।

‘এই চৈতালী, প্রথমবার দুলাভাইকে নিয়ে এসেছিস, আমাদের ট্রিট দিবি না? বিয়েতেও দাওয়াত পাই নাই।’

‘চৈতালী, তোর গাড়িতে উঠাবি না আমাদের?’

‘যাহ্ এত মানুষের জায়গা কী করে হবে গাড়িতে। তারচেয়ে আমাদের ট্রিট দিবে ভাইয়া। সেই ভালো। এই চৈতালী ভালো কিছু খাওয়াবি।’

চৈতালী নিজের মতো ব্যাগ গুছিয়ে কাগজপত্র নিয়ে পা বাড়াতে বাড়াতো বলে,

‘তোদের ট্রিট তো দিতাম, বিয়েতে দাওয়াতও দিতাম। কিন্তু জানিসই তো ভয় লাগে। আমি যেমন একজনের ঘর ভেঙে টাকার জন্য বিয়ে করছি। তেমনি আবার অন্য কার মনে কী আছে। নতুন বিয়ে হলো, এখনই তিন চার নাম্বার সতীন চাই না। তাই অন্য বেগানা মেয়েদের আপাততঃ স্বামীর কাছে আসতে দেব না। কিছুদিন স্বামীর টাকা ভোগ করে নেই। ভবিষ্যতে সে আরও বিয়ে করলে করবে। চারটা তো করার অনুমতি তো আছেই। যাইরে দোয়া করিস।’

*****

“সব কাজ শেষ?”

“মোটামুটি। আরও কয়েকবার আসা লাগবে।”

“তোমার বান্ধবীরা সব উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে যে এভাবে দেখার কিছু আছে সেটাই তো জানতাম না।”

“আপনি না হয়ে অন্য কেউ হলেও দাঁড়াতো। কারও নতুন বিয়ে হলে বর যদি নিয়ে আসে, তখন সবাই এভাবে ভীড় করে। শ্যালিকা হওয়ার ঢং করে। দুলাভাই বলে আহ্লাদ করে। তারপর সবাই মিলে কোথাও খায়।”

“তো, আমাকে ধরলো না কেন? পছন্দ হয়নি?”

“একটু বেশিই পছন্দ হয়েছে। কিন্তু ওরা এলে আপনারই ভালো লাগতো না। আপনি হয়তো এই ধরণের হাসিঠাট্টায় অভ্যস্ত নন। চন্দ্রিমা আপার বান্ধবী আর আমার বান্ধবীরা এক নয়।”

“এক না হওয়ারই কথা। চন্দ্রিমর বান্ধবীরা বয়সে বড়। বেশ ম্যাচুয়র। এখানে সব কলেজের বাচ্চা মেয়ে।”

“ম্যাচুরিটি কি বয়স দিয়ে হয়? এদের কারও কারও বাচ্চা হয়ে গিয়েছে। এসএসসির পরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে এমন মেয়েও আছে।”

“কী বলো?”

“হুম। আচ্ছা বাদ দিন কিছু খাব।”

“কী ফুচকা খাবে? না ঝালমুড়ি?”

রাস্তার পাশে টুলে ফুচকা নিয়ে বসে থাকা লোকগুলোর দিকে ইশারা করে মাহিম। ওদের চারদিকে ভীড়।

“নাহ্। যখন অবিবাহিত ছিলাম, তখন ভাবতাম যখন টাকা হবে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খেয়ে দেখবো কেমন লাগে। ক্যাফেতে দামি ফাস্টফুড খাব। কফি খেয়ে দেখবো। জানতে চাই পঁচিশ টাকার কফি আর তিনশো পঁচিশ টাকার কফি কোনটার স্বাদে কতটা পার্থক্য। ফুচকা, চটপটি, ঝালমুড়ি তো সারাজীবনই খেলাম। বিশ টাকার সামর্থ্যে এর বেশি কী খাব। এখন তো আপনি আছেন। নিজে আয় না করলেও, আপনার সাথে খেতেই পারি এখন বড় রেস্টুরেন্টে।”

“অবশ্যই পারো। চলো নিয়ে যাই। খাওয়ার পর তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আমি চন্দ্রিমার কাছে যাব। ওর ডাক্তারের সিরিয়াল আছে।”

“আচ্ছা। আমাকেও নিয়ে যান।”

“তোমাকে না নেওয়াই ভালো। ওর শরীরটা ভালো না। তাই মনটাও কিছুটা বিক্ষিপ্ত।”

“বুঝতে পেরেছি। ঠিক আছে।”

*****

মাহিম চৈতালীকে গার্ডেন ভিউ ক্যাফেতে নিয়ে আসে। ক্যাফেটা শহরের খুব নামী ক্যাফে। চৈতালী মেনু দেখে। এক কাপ কফির দামই শুরু তিনশো পচাত্তর থেকে।

“দাম দেখা লাগবে না। কী খাবে বলো।”

“দাম দেখবো কেন। দাম তো দিবেন আপনি। কিন্তু কোনটা ভালো হবে বুঝতে পারছি না। তিতা লাগবে না কোনটা?”

“ক্যাপাচিনো নাও। সাথে ব্রাউনি দিতে বলছি। ব্রাউনি আইসক্রিম খাবে? ভালো লাগবে।”

“আপনি কি খাবেন?”

“আমি এক্সপ্রেসো খাব।”

“ওটা তিতে লাগে?”

“আমার তো লাগে না। তাহলে ওটাই দিন দুটো। আগে ব্রাউনি আইসক্রিম খাব তারপর কফি।”

চৈতালী খুব আগ্রহ নিয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে দেখে মাহিমের মজা লাগে।

“কেমন?”

“আইসক্রিম টা মজা। কেকটা একটু পুড়ে যাওয়া ধরনের। অত নরম না, তিতে ভাব আছে।”

“রাখ তাহলে। তোমার মিষ্টি পছন্দ বুঝেছি। রেড ভেলভেট খাও। ভালো লাগবে।”

ওয়েটারকে ডেকে রেড ভেলভেট দিতে হবে মাহিম। নিজে কফিতে ছোট ছোট চুমুক দেয়। ব্রাউনি আইসক্রিম তার আর চন্দ্রিমার প্রিয় আইটেম। এই ক্যাফেতে আসলে তারা এটা খেতই। অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর অনেক খাবারে চন্দ্রিমার নিষেধাজ্ঞা আছে। তবু আজ ডাক্তার দেখানো শেষে চন্দ্রিমাকে নিয়ে বের হবে ঠিক করে। একসাথে সময় কাটালে চন্দ্রিমার মনও ভালো লাগবে।

“তুমি অন্য রকম চৈতালী। মানে যেমন হয় না, একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা। তারা একটু উচ্চবিত্ত পরিবারে বিয়ে হলেও নিজের আগের জীবনটা মিস করে। তাদের রাস্তার পাশে ফুচকা খেতে ইচ্ছে করে, হকার্স মার্কেটে শপিং করতে ইচ্ছে করে।

“থাকলেন কেন? আরও আছে তো। গাড়ি বাদ দিয়ে হ্যাসবেন্ডের সাথে সাইকেলে চড়তে তাদের ভালো লাগে। লোকাল বাসে লাফ দিয়ে উঠতে ভালো লাগে। বৃষ্টিতে টং দোকানে দাঁড়িয়ে চা খেতে ভালো লাগে। আর কী বাকি আছে বলেন তো? কই দেখেছেন এসব? সিরিয়ালে না নাটক নভেলে পড়েছেন।”

বলেই ফিক করে হেসে দেয় চৈতালী। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

“আমি বুঝি না সিরিয়ালগুলোয় যার এত মধ্যবিত্ত জীবন পছন্দ সে ভালবেসে ধনী ঘরে বিয়েই বা কেন করে? আর বিয়ে করে এসব ন্যাকামিও বা কেন করে? আরে জীবনের বিশ বাইশ বসন্ত বাসে ধাক্কা খেয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে রিকশা খুঁজে কী তার ফ্যান্টাসি শেষ হয়নি যে বিয়ের পরও এই মিস করার ঢং করতে হবে? মানুষ রাতদিন পরিশ্রম করে ভালো আয় করতে। তারপর যখন আয় করে, ভালো চলতে শুরু করে তখন আগের জীবনটা মিস করে বলে কান্নাকাটি করে। ডিপ্রেশনে পড়ে। তাহলে এত কষ্ট করারই দরকার। ছেড়া কাঁথা গায়ে দিয়ে টিনের চালের ফুটো দিয়ে আকাশের চাঁদ দেখেই তো খুশি থাকতে পারে।”

“তাহলে তোমার নতুন জীবন ভালো লাগছে?”

“অবশ্যই লাগছে। আমি ছোটোবেলা থেকে অনেক পরিশ্রম করেছি। রিকশা ভাড়া বাঁচাতে লোকাল বাসে উঠেছি। হেঁটে স্টুডেন্ট পড়াতে গিয়েছে। রোদে হেঁটে গলা শুকিয়ে গেলে একটা পানির বোতল কেনার বিলাসিতা করতে পারিনি, ডাব বা জ্যুস খাওয়া দূর। আজ আমি এসি গাড়ি করে কলেজে আসলাম। কলেজে আমার অবস্থানই বদলে গেল। যে মেয়েগুলো একটু ভালো অবস্থার পরিবার থেকে কলেজে এসেছে তারা কী দেমাগ দেখিয়ে চলতো। আজ তারা আমার জামা, ব্যাগ সব খুটিয়ে দেখলো। আমার নায়কের মতো হ্যান্ডসাম হ্যাসবেন্ড দেখে সুন্দরী মেয়েগুলো জ্বলেপুড়ে গেল। আমার তো এই বেশ লেগেছে। আমার তাই পুরানো জীবনের দুঃখবিলাস করতে একদমই শখ নেই। ঘর পালাতে গিয়ে আমি ভুল করছিলাম। ভালোই হয়েছে জলিল স্যার দুই নাম্বারি করেছেন। আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। আপনি মানুষ ভালো। বয়সে একটু বড় কিন্তু বোঝাই যায় না। স্মার্ট মানুষ। আমি ঠিক করেছি তাই কোন দুঃখবিলাস করবো না। আপনি চন্দ্রিমা আপাকে ভালোবাসেন আমার কোন আপত্তি নেই। আমি আমার জীবনে নিজের জন্য সুখ খুঁজে নেব। আচ্ছা এখন আমাকে আপনার ভালো ফোনটায় কয়েকটা ছবি তুলে দেন। ফেসবুকে দেব। সবগুলোকে আরও জ্বালাবো।”

চৈতালীর সোজাসাপটা কথায় বিরক্ত হওয়ার বদলে মাহিমের মজা লাগে। মেয়েটা গোল্ড ডিগারের মতো চিন্তা ভাবনা রাখলেও মাহিমের কাছে তা স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে। ফোনে ভাইব্রেশন হচ্ছে। চন্দ্রিমা কল করছে। মাহিম কল কেটে চৈতালীর ছবি তোলায় মন দেয়। একটা সেলফিও তোলে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here