ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয় পর্ব ১৭

0
219

ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ১৭

“গাড়িতে গান শোনার ব্যবস্থা নেই?”

“গান শুনবে?”

“জ্বি।”

মাহিম প্লে লিস্ট অন করে, “Thousand miles to go before i sleep”. মাহিমের প্রিয় গানগুলোর একটি।

“বাংলা বা হিন্দি গান নেই?”

“আছে। তবে এই প্লে লিস্টটা আমার আর চন্দ্রিমার পছন্দে সাজানো। আমরা দু’জনই এই গানগুলো শুনতে পছন্দ করি। তুমি ইংরেজি বুঝ না? মানে বুঝলে গানগুলো তোমারও ভালো লাগবে। চমৎকার লিরিক।”

“ইংরেজি পড়তে পারি। কিন্তু বলতে গেলে আটকে যাই। গান শুনলেও কী বলে বুঝি না। এত তাড়াতাড়ি বলে। তাই গানের মজা পাই না।”

“টিভিতে ইংলিশ মুভি দেখবে, খবর দেখবে। নিচে সাবটাইটেল ওঠে। দেখার সাথে সাথে সাবটাইটেল পড়লে একসময় কী বলছে সেটার উচ্চারণ বুঝতে শুরু করবে। সাবটাইটেল দেখার তখন প্রয়োজন হবে না। আর আয়নায় নিজের সাথে নিজে ইংরেজিতে কথা বলবে। আস্তে আস্তে জড়তা কাটবে। চন্দ্রিমা বাসায় এলে ওর সাহায্য নিও। ওর ইংরেজি উচ্চারণ চমৎকার। তোমার উচ্চারণের ভুল ঠিক করে দেবে।”

চন্দ্রিমার নাম উল্লেখে চৈতালীর বিরক্ত লাগে। সব ভালো গুণে চন্দ্রিমাকে মাহিম৷ টেনে আনবেই। যদিও এটাই স্বাভাবিক। তবু চৈতালী মনের বিক্ষিপ্ত ভাবটাকে দূর করতে পারে না।

“আপনার উচ্চারণ কেমন?”

“ভালোই তো যতটুকু জানি।”

“তাহলে আপনি শেখান। আচ্ছা, শোনেন আজ থেকেই শেখান একটু একটু। চন্দ্রিমা আপার সাথে তো ওনার বাবা মা আছেন। আপনি না গেলেও চলবে। ওনারাই ডাক্তার দেখাতে পারবেন। মেয়েতো ওনাদের। ওনাদেরও কিছু দায়িত্ব আছে।”

মাহিম ঝট করে চৈতালীর দিকে তাকায়। ওর মুখ দেখে মন পড়া সহজ। কম বয়সী মেয়েদের আবেগের জন্য তাদের অভিমান, হিংসা সহজেই তাদের মুখেই ফুটে ওঠে।

“চৈতালী বয়সের তুলনায় তুমি যথেষ্ট ম্যাচুয়র। তারপরও কিছু বিষয়ে না চাইলেও হয়তো নিজের তুলনায় নিয়ে আসাটাই স্বাভাবিক। এই মুহুর্তে তোমার আবদারটা ছেলেমানুষী না বরং ছোট মনেরই পরিচয় দিচ্ছে। তোমার ইংরেজি শেখাটা নিশ্চয়ই চন্দ্রিমার ডাক্তার দেখানোর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ না। শোন আমার বোন মিন্নীর একবার খুব শখ হলো বিড়াল পালবে। আম্মু রাজি না। আমিও যে বিড়াল পছন্দ করি তা না। বিড়াল বড্ড গা ঘেঁষা। আমার কুকুর পছন্দ। কিন্তু মিন্নীর জিদ আর অনুরোধের কাছে হার মেনে আম্মুকে রাজি করিয়ে বিড়াল আনা হয়। শর্ত হয় সে আম্মু আর আমার রুমে যাবে না। তারপরও যখন তখন বিড়ালকে নিজের কম্পিউটার টেবিল, বেডে চলে আসাকে মেনে নিয়েছিলাম কারণ সে অবলা প্রাণী। এখন মিন্নী যখন বাইরে পড়তে গেল, তার শখের বিড়ালকে সাথে নিতে পারলো না। তাকে আমরা ফেলেও দিতে পারলাম না তারও একটাই কারণ সে সে অবলা প্রাণী। তার প্রতি একটা মায়া কাজ করে। কিন্তু বিড়ালের জায়গা হয়েছে আউট হাউজে, ঘরে নয়। তুমিও আমার জীবনে তেমনই অবস্থানে আছ। আমি তোমাকে ফেলে দিতে পারবো না কারণ তুমি মানুষ। শখের বশে নয়, প্রয়োজনেই তোমাকে আমার জীবনে আনা হয়েছে, আমার ঘরে তোমার জায়গা হয়েছে। কিন্তু হৃদয়ে নয়। একটা কোরবানির পশুও দুইদিন আমাদের আঙিনায় থাকলে মায়া পড়ে যায়। তাই নিজেকে কখনোই চন্দ্রিমার বরাবর ভাববে না।”

চৈতালীকে বাড়ির গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে যায় মাহিম। চৈতালী ঠোঁট কামড়ে কান্না গিলে নেয়। নিজের বাচ্চামির জন্য মাহিমকে রাগিয়ে দিয়ে ঠিক করেনি বুঝতে পারছে। একটু একটু করে মাহিম সহজ হচ্ছিল ওর সাথে। বারবার নিজেকে চন্দ্রিমার সাথে মেলাতে গিয়ে যে বরং দূরত্বই বাড়বে এই বিষয়টা চৈতালী বুঝেও বুঝতে পারছে না। না চাইলেও প্রতিযোগিতার ভাব, হিংসা ওর আচরণে চলেই আসে।

*****

“মাহিম, থ্যাংক ইউ।”

“কেন?”

“আমার মনে হয়েছিল তুমি আসবে না। কাজের বাহানায় হয়তো আজ আমার পাশে তুমি থাকবে না। সত্যি বলছি তোমাকে দেখলে আমি এমনিতেই সুস্থ অনুভব করি। মুঠো মুঠো ঔষধ খেয়েও যেখানে কাজ হয় না।”

“তোমার চেয়ে কাজ আমার কাছে কখনোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।”

“লাভ ইউ।”

“লাভ ইউ টু।”

আজ চন্দ্রিমাকে নিয়ে মাহিম, আর চন্দ্রিমার বাবা মা যাচ্ছেন বাংলাদেশের একজন সনামধন্য লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জনের কাছে। লিভার কেয়ার হাসপাতালের সার্জারিগুলো ইতোমধ্যে দেশে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আশি ভাগ সফলতার হার রয়েছে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারিতে। যকৃতের জটিল সব রোগ নিয়ে আলাদা করে গবেষণা হয় এখানে। যকৃতের চিকিৎসা ব্যয়বহুল চিকিৎসাগুলোর একটি। তারউপর এখানে খরচটা তুলনামূলক অন্য জায়গার চেয়ে বেশি। তাই নিতান্ত সচ্ছল পরিবারেরই আগমন ঘটে হেপাটোবিলিয়ারি সার্জন হীরক চন্দ্র রায়ের চেম্বারে।

হীরক চন্দ্র রায় চন্দ্রিমার রিপোর্টগুলো শুরু থেকে দেখেন। চন্দ্রিমার লিভার সিরোসিসের কারণ হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের সংক্রমণ। এই ভাইরাস সাইলেন্ট ভাবে সময় নিয়ে যকৃতকে একটু একটু করে নষ্ট করেছে। কোন লক্ষণ প্রকাশ করেনি। যখন লক্ষণ প্রকাশ করেছে তখন কিছু বোঝার আগেই দেখা গেল চন্দ্রিমার যকৃতের অনেকখানি অংশ কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। অচিরেই লিভার ট্রান্সপ্লান্ট না করা হলে যা প্রাণঘাতী রূপ নেবে।

“ডোনার রেডি আছে?”

চন্দ্রিমা মাহিমের দিকে তাকায়। মিস্টার এন্ড মিসেস আবেদিন চেম্বারের বাইরে অপেক্ষা করছে। চেম্বারের ভেতর চন্দ্রিমাকে নিয়ে মাহিম প্রবেশ করেছে।

“জ্বি মোটামুটি।”

“ডোনার হতে পারবে কিনা, তা জানার জন্য বেশকিছু টেস্ট দরকার।”

“কিছু টেস্ট করানো আছে। চন্দ্রিমা ব্যাগ খুলে চৈতালীর রিপোর্টগুলো বের করে দেয়।”

হীরক চন্দ্র রায় টেস্টগুলো উল্টেপাল্টে দেখে সন্তুষ্টির চিহ্ন আঁকেন মুখে।

“আর কিছু ফাইনাল টেস্ট লাগবে। ডোনারকে নিয়ে আসবেন। ডোনারের কিছু ফাইনাল কাউন্সিলিং লাগবে। লিখিত অনুমতি লাগবে। তবে ডোনার সিলেকশন ভালো হয়েছে। আশা করি ভালো একটা রেজাল্ট আমরা পাব।”

“কতদিনের ভেতর ট্রান্সপ্লান্ট করা উচিত? আমরা কিছুদিন পর করতে চাইছিলাম।”

“যত দেরি করবেন, তত সফলতার হার কমতে থাকবে। ভালো হয় কয়েক মাসের ভেতর করে ফেলা। অনেক সময় সিরোসিস ক্যান্সারে রূপ নেয়। তখন ট্রান্সপ্লান্টও কাজে আসে না। মিসেস চন্দ্রিমার কিছু টেস্ট আমি দিচ্ছি। এগুলো যতদ্রুত সম্ভব করে আমাকে দেখান।”

ডাক্তারের চেম্বার থেকে চন্দ্রিমা উজ্জ্বল মুখ নিয়ে বের হলেও মাহিমের চেহারায় রাজ্যের দুশ্চিন্তা।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here