ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয় পর্ব৩

0
288

ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব৩

চৈতালী বাথরুমে গিয়ে স্যারের সাথে কথা বলে। স্যার ওকে পুরানো বাসস্ট্যান্ডের কাছে চলে আসতে বলেন। আসার আগে চৈতালী যেন একটা নোট লিখে আসে যে সে স্বেচ্ছায় এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে, কারণ এই বিয়েতে সে রাজি নয়। তাকে খোঁজার চেষ্টা যেন না করা হয়। শফিক তাদের মায়ের বোরখাটা লুকিয়ে নিয়ে আসে চৈতালীর জন্য। এই পরিকল্পনায় শাহিনকে নিতে না চাইলেও নিতে হয়। কেননা একজনকে ঘরের দিকে পাহারা দিতে হবে যে কেউ আসছে কিনা। আরেকজন লুকিয়ে চৈতালীকে পেছনের গেট দিয়ে দিয়ে বের করবে। শাহিনের বয়স কম, সবে ক্লাস এইটে উঠেছে। কিন্তু ভীষণ পাকা আর মা নেওটা। শাহিনকে একশো টাকা আর নিজের ক্রিকেট ব্যাট বল দিয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে শফিক রাজি করিয়েছে। শফিক, চৈতালীর দুই বছরের ছোট হলেও, চৈতালী একবছর পড়ালেখায় বিরতি রেখেছিল বলে দু’জনের ক্লাস পাশাপাশি। চৈতালী এইচএসসি দেবে, আর শফিক ফাস্ট ইয়ারে পড়ে। বলতে গেলে সবাই ছেলেমানুষ, আর নিজেদের এই ছেলেমানুষী পরিকল্পনায় আগুপিছু কিছু না ভেবেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নোটটা লিখে শফিকের কাছে দেয় চৈতালী, প্রয়োজন মতো যেন বের করে দিতে পারে। না হয় জামিল স্যার বিপদে পড়বেন।

****
জামিল স্যারের বয়স বেয়াল্লিশ ছুঁইছুঁই। দুই সন্তানের জনক। ভালো শিক্ষক হিসেবে পরিচিত সবার কাছে। চৈতালী ও তার ভাই শফিক দুইজনই তার ছাত্র। শফিক যখন জানালো চৈতালীকে তার অমতে বিবাহিত কারও সাথে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন নিজ উদ্যোগে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলেন। পাত্রের পরিচয় কী জানায়নি শফিক, জামিল সাহেবও জানতে চাননি। হবে কোন দোজবরে, অশিক্ষিত বয়স্ক কেউ। টাকা-পয়সা হয়তো কিছু কামাই করেছে, পরিবার তাই লোভে পড়ে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। চৈতালীর সাথে ফোনে কথা হয়েছে। বাসস্ট্যান্ডের কাছে রেস্টুরেন্টে বসে আছেন জামিল সাহেব। চারটার আগে কোন বাস নেই। তারা যাবেন পাশের জেলায়। আড়াইঘন্টার পথ।

“আসসালামু আলাইকুম স্যার।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে চৈতালী?”

“জ্বি স্যার। কেউ চিনে যেন না ফেলে তাই মুখ ঢেকে রেখেছি।”

“গুড গুড। যা বলেছি এনেছ?”

“জ্বি স্যার, ভোটার আইডি কার্ড আনছি। কিন্তু আমি তো জানতাম না হঠাৎ এসব হবে। কলেজের বইখাতা, কাগজপত্র সব বাড়িতেই রয়ে গিয়েছে। সেসবের কী হবে? ওগুলো ছাড়া তো পরীক্ষা দিতে পারবো না। কাপড়চোপড়ও নাই।”

“সেসব ব্যবস্থা হবে ইনশাআল্লাহ। একবার আমি তোমার দায়িত্ব পেয়ে গেলে নিজে গিয়ে নিয়ে আসবো। তখন আমিই তোমার গার্ডিয়ান। আমাকে কে আটকাবে। আচ্ছা তোমার বিয়ের গয়নাগাটি কিছু বানানো হয়নি? শফিককে ইঙ্গিত দিয়েছিলাম, মূল্যবান জিনিসপত্র সাথে নিয়ে আসতে।”

“না স্যার। আমার বাবা মাও তো বিয়ের কথা কিছু জানতেন না। হয়তো বরপক্ষ কিছু দিতো গয়না।”

“টাকাপয়সা?”

“না স্যার, ভাড়ার দুইশো ছাড়া কিছু নাই।” বলতে গিয়ে লজ্জায় কেঁদে দেয় চৈতালী। আসলেই টাকাপয়সা ছাড়া কী হয় দুনিয়ায়। স্যার দয়া করে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন ঠিক। কিন্তু এই যে তার থাকা-খাওয়া, পরীক্ষার ফরম ফিলিপ কতরকম খরচ আছে। একদম শূণ্য হাতের কারও দায়িত্ব নেওয়া তো সহজ নয়।

“আচ্ছা আচ্ছা কান্নাকাটি করো না চৈতালী। আমি দেখছি সব। তুমি অন্য ভাবে শোধ দিও।”

“অবশ্যই স্যার। আপনার এই ঋণ আমি কখনও ভুলবো না। আমি পড়ালেখা শেষে চাকরি করে আপনার দেনা শোধ করবো।”

“সে তো অনেক সময়। এতদিন অপেক্ষা করার প্রয়োজন নাই। শোন ভাবছি তোমাকে আমার বোনের বাড়িতে দিয়ে আসবো না। মনে করো আজ থেকে তোমার দায়িত্ব আমি নিলাম। তুমি আমার দায়িত্ব নিবা। ব্যস। তোমার ভাবি দুইছেলে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমি সারাদিন কলেজের ক্লাস, আর ছাত্র পড়িয়ে ক্লান্ত থাকি। যত্ন পেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সেই যত্ন করার মানুষ নাই। সারাজীবন মানুষের জন্য করে গেলাম বুঝলা চৈতালী। আমার খেয়াল রাখার কেউ নাই। যত্ন করবা না?”

“অবশ্যই স্যার। আমি তো আপনার মেয়ের মতো। আমাকে কি আপনার বাসায় নিয়ে যাবেন তাহলে? ভাবিকে হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দেব। ভাবিও তাহলে বিশ্রাম পাবে। আপনার দুই ছেলে আমার কাছে আমার ভাইদের মতোই আদর পাবে।”

“আরে কী জ্বালা। কথা বোঝার চেষ্টা করো চৈতালী। বাচ্চা মেয়ে তো না তুমি। আঠারো পার হয়েছে না? শোন, সম্ভব হলে তোমাকে এখনি বাড়িতে নিয়ে যেতাম। কিন্তু শর্মী, মানে আমার স্ত্রী ঝামেলা করবে। বুঝোই তো মেয়ে মানুষের এক আছে নাকি কান্না। একটু ম্যানেজ করে তোমাকে নিয়ে যেতে হবে। তোমার ব্যাপারে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে যাব। তখন মিলেমিশে থাকবে। বাচ্চাদের নিয়ে ভাবতে হবে না। ওদের জন্য শর্মী আছে। তুমি শুধু আমার খেয়াল রাখবে। ততদিন তোমাকে অন্য জায়গায় রাখবো। আমার বোনের বাড়ি নিয়ে যেতে পারতাম। সেখানেও এক অশান্তি। বোন জামাইটা টাউট। কী ঝামেলা করে কে জানে। তাছাড়া আড়াই ঘন্টার দূরত্বে আসাযাওয়া ঝামেলা আমার জন্য। কোচিং থাকে, ক্লাস থাকে। তাই আপাততঃ কয়েকদিন হোটেলে থাকবা। আমি এসে যেয়ে খেয়াল রাখবো। এরপর ঘরে তুলবোনে। সারাদিন শেষে তোমার কাছে আসবো একটু বিশ্রাম নিতে। তুমি একটু যত্ন করে দিবা। ব্যস এইটুকুই তোমার কাজ। বাকি খাবা দাবা, পরিপাটি থাকবা। মন চাইলে পড়তে পারো, আমি মানা করবো না। ভোটার আইডি কার্ড এনেছ না। রেজিস্ট্রি করার জন্য ওতেই চলবে।”

“এসব কী বলেন স্যার?”
জামিল স্যারের কথার ইঙ্গিত ধরতে পেরে হতভম্ব হয়ে যায় চৈতালী।

“ছিঃ! আপনি এমন মানসিকতার লোক বুঝলে আমি কোনদিন আপনার ভরসায় বাড়ি থেকে বের হতাম না। স্যার বলে আপনাকে সম্মান দিয়েছি।”

“চৈতালী উঁচু গলায় কথায় বলো না। তোমাকেও অসহায় মেয়ে ভেবে সম্মান দিয়ে ঘরে তুলতে চেয়েছি। না হলে তোমার মতো মেয়েদের মানুষ নিয়ে খারাপ পাড়ায় বিক্রি করে দেয়। ভালো চেয়ে আমার নাম দিতে চাইলাম তাই তেজ দেখাচ্ছ? শরীর ছাড়া কী আছে তোমার? তোমার বাপ মা ও তোমার বিয়ে একজন বয়স্ক লোকের সাথেই দিচ্ছে। আমি এখনও শক্তিশালী পুরুষ, টাকাপয়সা আছে। এমন দু তিনটি বৌ রাখা আমার জন্য কোন ব্যাপার না। ভালো থাকবা আমার সাথে। তা না হলে জায়গা হবে রাস্তায়। না হলে ঐ বুড়ো জামাইয়ের ডায়াপার পাল্টাতে হবে, বিছানায় হাগুমুতু করলে তা সাফ করতে হবে।”

চৈতালীর আর কথা বলার রুচি হয় না। সামনের গ্লাসের পানিটা জামিল সাহেবের গায়ে ছুঁড়ে মেয়ে বের হয়ে যায়। জামিল সাহেব হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন। আশেপাশে তাকিয়ে দেখেন সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাই চৈতালীকে কষে থাপ্পড় লাগাতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেন।
দাঁতে দাঁত ঘষে বলেন,

“কাজটা তুমি ভালো করলে না চৈতালী। সময় মতো উচিত শিক্ষা পাবে।”

চোখের কোল ঘেঁষে অশ্রু নামে। বাড়িতেও নিশ্চয়ই এতক্ষণে সবার খোঁজ পড়ে গিয়েছে। আবার ফিরে গেলে মার একটাও নিচে পড়বে না। আবার না ফিরেও উপায় নেই। স্যারের কথাই সত্যি। শরীর ছাড়া এমুহূর্তে তার কাছে আর কিছু নেই। আর সেই শরীর তাকে বিপদে ফেলবে শুধু। দিনের আলো নিভে গেলেই চারপাশের এই মানুষরূপী চেহারাগুলোর ভেতর থেকেই কেউ দানবরূপে হাজির হতে পারে। ফোন বের করে চৈতালী। শফিককে ফেন দিয়ে পেছনের গেট দিয়ে আবার ওকে নিয়ে যেতে বলবে। একটা ভরসা আছে। ও পালিয়ে যাওয়ার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে বলে মাহিম ভাইয়ের মা বিয়ে ভেঙেও দিতে পারেন। মহিলা খুব রুক্ষ আর রাগী। এতটা সহ্য করার কথা না।

চৈতালী এলোমেলো পা ফেলছিল। হঠাৎ ওর কাছ ঘেঁষে একটা গাড়ি ব্রেক করে। চমকে উঠে থেমে যায় চৈতালী। গাড়ির কাঁচ নেমে যায়। মাহিমকে দেখে অবাক হয় চৈতালী।

“গাড়িতে উঠে বসো চৈতালী।”

আদেশ দেয় মাহিম।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here