ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয় পর্ব ১

0
606

ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ১

আজ চৈতালীর বিয়ে। যদিও চৈতালী এই বিয়েতে রাজি নয়। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। চৈতালীর বাবা, মা রাজি। খান বাড়িতে চৈতালীর বিয়ে হচ্ছে এই আনন্দে তারা আত্মহারা। খান বাড়ির সাথে চৈতালীদের আত্মীয়তার সম্পর্ক পুরানো হলেও মর্যাদার ছিল না। চৈতালীর বাবা খান বাড়ির দূরসম্পর্কের আত্মীয়। বংশ গৌরব বা অর্থ কোনকিছুতেই খান বাড়ির বরাবর নয়। মূলত খান সাহেবের বিঘা বিঘা জমি দেখাশোনা করে যেসব মানুষ, তাদেরই একজন চৈতালীর বাবা রহিম তরফদার। বাংলাবাজারে খান সাহেবের একদাগে অনেকখানি জমি আর কয়েকটা পুকুর আছে। সেগুলোই দেখাশোনা করেন রহিম তরফদার। চৈতালীর সাথে খান সাহেবের নাতির বিয়ে হতে চলেছে। এই বিয়ের সুবাদে বসতভিটার অধিকারের পাশাপাশি একটা পুকুর আর নারকেল বাগান পেতে চলেছেন রহিম তরফদার। একদম ফকিরের সাথে তো আত্মীয়তা করতে পারেন না খান সাহেব। তাই নিজেই জায়গা জমি দিয়ে দিলেন। একে তো কোন খরচ ছাড়াই এত বড় বাড়িতে মেয়ের বিয়ে। আবার সেই বিয়ের সাথে সম্পদ প্রাপ্তি। স্বাভাবিকভাবেই রহিম তরফদার আর তার স্ত্রী ভীষণ খুশি।

“আম্মা, চলেন যাই বাড়ি চলে যাই। এই বিয়েতে কোন ঘাপলা আছে বোঝেন না কেন? এর আগে কোনদিন এই বাড়িতে দাওয়াত পেয়েছেন? ঈদের সময় আসলেও আত্মীয় হিসেবে কখনও খাতির পাইনি আমরা। সবসময় কাজের মানুষের মতোই আচরণ ছিল। আমাকে দাদী বলতো ‘চৈতালী যা বিছানাগুলো করে ফেল।’ আপনাকে বলতো ‘রহিমের বৌ বসে না থেকে হাতে হাতে কুটা বাছা করে দাও তো, কাজের বেটিরা সবাই ব্যস্ত।’ আর মাহিম ভাইয়ের আম্মা তো ঠিক মতো কথাই বলতেন না। একবেলাও এই বাড়িতে কাজ না করে খাওয়া জুটেনি যে আমাদের সেই আমাদের হঠাৎ দাওয়াত করে খাওয়ানোতে অবাক হয়েছিলাম। আবার ভালো রুম দিয়েছে থাকার জন্য। আর এখন আমাকে ঘরের বৌ করতে চায়। এসবে কোন গন্ডগোল আছে। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। এখন বিয়ে করা যাবে না।”

“বেশি পাকা পাকা কথা বলিস না চৈতালী। এইটুকু মাইয়া এত বেশি কথা বলার কী দরকার বুঝি না। এসব চিন্তা করার জন্য তোর বাপ আছে, আমি আছি। আর কোন বাড়িতে যাবি? বসতবাড়ি তোর বাপের? থাকিস তো অন্যের ভিটায়। নিজেদের জায়গাজমি সব নদী গিলেছে। পেটে খেলে পিঠে সয়। এই খান বাড়ির দয়া যে আত্মীয় বলে জায়গা দিয়েছে। এই যে মুখে এত বুলি ফুটেছে, পেটে খাওয়া না থাকলে এই বুলি ফোটা লাগতো না। পরীক্ষা দিয়ে বিদ্যার জাহাজ হবি?”

“আম্মা, আমি এসএসসিতে জিপিএ ফাইভ পেয়েছি। আপনি কত খুশি হয়েছিলেন তখন। বলছিলেন এভাবে মন দিয়ে পড়তে। কারও দয়া লাগবে না। আমি ভালো করে লেখাপড়া করে চাকরি নেব। তাছাড়া মাহিম ভাইয়ের বৌ আছে। বয়সেও আমার কত বড়।”

“বৌটা অসুস্থ। বাচ্চা কাচ্চা হয় নাই। খান বাড়ির বড় নাতির সন্তান দেখার খায়েশ খান সাহেবের। তাই তো তিনি সুস্থ থাকতে থাকতে নাতিটার আবার বিয়ে দিতে চাইছেন। এতে ঘাপলার কিছু নাই। আর পুরুষ মানুষের বয়স কিছু না।”

“আম্মা, জোর করে বিয়ে দিলে হয় আমি বিষ খাব, না হলে বিষ খাওয়াবো।”

ঠাস! করে একটা চড় এসে পড়ে চৈতালীর গালে। শেফালির হাতের চারটা আঙ্গুলের দাগ বসে যায় চৈতালীর গালে।

“অসভ্য মাইয়া। কত বড় স্বার্থপর তুই। নিজে না খাইয়া না পইরা তোরে খাওয়াইসি। ভালো পরাইসি। লেখাপড়া করাইসি। আর আইজ আমারে চোখ দেখাস। এইখানে তোর বিয়া হইলে আমাদের ভবিষ্যতটা নিশ্চিন্ত হইয়া যায়। তোর ছোট দুইটা ভাই আছে তাদের কথাও ভাবিস না। কেমন বোন তুই?”

“আমি কেমন বোন? আমি খারাপ বোন। আর আপনারা কেমন মা বাবা? কোরবানির হাটে ভালো দাম পাইতে যে খামারি গরুর যত্ন করে, দলাইমলাই করে চামড়া চকচকে করে, ভালো খাওয়ায়। সে ব্যবসায়ী। গরুর প্রতি তার ভালোবাসা শুধু ভালো দাম পেতে। তোমরাও তাই। কিন্তু আমি গরু না, মানুষ। বেশি জোর করলে গলায় দড়ি দেব।”

আরেকটা থাপ্পড় এসে পড়ে চৈতালীর গালে।

“জবান টেনে ছিঁড়ে ফেলবো বেয়াদ্দব মাইয়া। পড়ালেখা কইরা একটা বেয়াদব পয়দা হইছে। আইজ বাদ মাগরিব তোর বিয়া এই বাড়িতেই হইবো। জায়গাজমি বুইঝা পাই, এরপর তুই মন চাইলে দড়িতে ঝুইলা যা। মানা করুম না। মরণের আগে বাপ মা এর ঋণ চুকায়ে যাবি।”

শেফালির রণমূর্তি দেখে চৈতালী বুঝে যায় তার কান্নাকাটি, আত্মহত্যার হুমকি কিছুই বাবা মাকে টলাতে পারবে না। আসন্ন অর্থ আর সম্পদ লাভের হাতছানিতে তারা আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মনে মনে অন্য পরিকল্পনা কষে ফেলে চৈতালী। এরজন্য তার প্রয়োজন ফোনের। ফোনটাও তার নিজের কাছে নেই। কিন্তু ফোন ছাড়া পরবর্তী পরিকল্পনা কাজে লাগাতে পারবে না। এইবাড়িতে বিয়ে হলে তার আর এইচএসসি দেওয়া হবে না। পড়ালেখার যে এখানেই ইতি তা সকালে জোবাইদা বেগম স্পষ্ট বলে দিয়েছেন।

জোবাইদা বেগম খান সাহেবের বড় ছেলের স্ত্রী, মাহিম খানের মা। খান সাহেবের বড় আদরের এই ছেলের বৌ। দেখতে যেমন সুন্দরী, আচার আচরণেও তেমনই জাঁদরেল। খান সাহেবেরই মহিলা রূপ যেন। আর হবেনই বা না কেন। খান বংশের রক্তই যে বইছে জোবাইদা বেগমের শরীরে। ফজলে আলী খান সাহেবের ছোটভাই শেহের আলী খানের কন্যা জোবাইদা বেগম। এই বংশের নিজেদের বংশ নিয়ে একটা চাপা অহংকার আছে। বিয়েশাদিও তারা নিজেদের ভেতরই দিতে পছন্দ করেন। এই এলাকার জমিদার না হয়েও জমিদার পরিবার তাদের। এলাকার বেশিরভাগ জমিই একসময় খান বংশের ছিল। আস্তে আস্তে ওয়ারিশানদের ভেতর জমি ভাগ হতে হতে জমি হাত বদল হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এখনও তারা অন্যদের চেয়ে নিজেদের শ্রেয় ভাবেন। বর্তমানে লেখাপড়া করে এলাকার অনেকের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটলেও খান বাড়ি এখনও ভাবেন তারা সবসময়ই ভূমি প্রধান ছিলেন আর অন্যরা ভূমিদাস। তাই সবার সাথে তাদের আত্মীয়তা মানায় না।

ফজলে আলী খানের স্ত্রী জোহরা বেগম ভীষণ স্বামী ভক্ত মানুষ। সারাজীবন সংসারে স্বামীর কথাই শেষ কথা মেনে এসেছেন। স্বামীর সংসারে কর্তৃক করার কপাল অবশ্য তার হয়নি। বিয়ের পর শাশুড়ি মা অন্দরমহল নিয়ন্ত্রণ করতেন। শাশুড়ি কমবয়সী শক্তপোক্ত মহিলা ছিলেন। জীবিত থাকতে তিনিই ছড়ি ঘুরিয়েছেন। তার কর্তৃত্ব শেষ হতে না হতে ঘরে আসে বড় বৌ জোবাইদা। ফজলে আলী খানের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে ঘরের কর্তৃত্ব এবার চলে যায় জোবাইদার হাতে। আসলে ফজলে আলী খান জোহরার প্রতি বিরক্ত ছিলেন। ওনার মনে হয়েছিল জোহরা নিজের দুই ছেলেকে বড় করার কাজ ঠিক ভাবে করতে পারেনি। ছেলেদের দুর্বল মানসিকতার পেছনে জোহরা বেগমকেই দায়ী করতেন। জোহরা বেগমের বড় ছেলে হামিদ আলী খান কিছুটা হাবাগোবা প্রকৃতির ছিলেন। বুদ্ধি কম ছিল তা নয়। বরং সহজ সরল ছিলেন। কিন্তু এটাই খান সাহেবের অপছন্দ ছিল। ছেলে বিশ বছর বয়সে পা দিতেন তাই ভাইয়ের মেয়ে জোবাইদার সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। চৌকস মেয়ে জোবাইদা স্বামীকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিবে এই বিশ্বাস ছিল খান সাহেবের। ছোটো ছেলে হাসান আলী খান দীর্ঘদিন পরিবার থেকে তাজ্য ছিল। তার অপরাধ ছিল খান সাহেবের অনুমতির বাইরে গিয়ে বিয়ে করা। পড়ালেখায় ভালো ছিল হাসান আলী খান। কলেজে পড়ালেখা করার সময়ই প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে নিজ গ্রামেরই মেয়ে ফাহিমার সাথে। খান সাহেবের কানে খবর পৌঁছাতে সময় লাগে না। ফাহিমার বাবার বংশ নিচু বংশ বলে তিরস্কার করেন ফজলে আলী খান। এবং নিজের পছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করেন। বিয়ের দিন সকালে পালিয়ে যান হাসান আলী খান। ফাহিমা বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিল। কোন কিছু না ভেবেই ফাহিমাকে নিয়ে ঢাকার পথে রওয়ানা দেন। এক বন্ধুর মেসে উঠে বিয়েও সেরে নেন। ফজলে আলী খান ছেলেকে ধরে আনার কোন চেষ্টা করেননি। ছেলে পালিয়েছে জানতে পেরে সাথে সাথেই তাকে ত্যাজ্য করেছিলেন। হাসান আলী খান ভেবেছিলেন আদরের ছোটোছেলে তিনি। বাবা রাগ করলেও বিয়ে মেনে নিবেন। নিজের মা আর বড়ভাইয়ের প্রতিও ভরসা ছিল যে তারা বাবাকে মানিয়ে নিবেন। কিন্তু ফজলে আলী খানের বাড়ির দরজা হাসান আলীর জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। তার লাশেরও জায়গা হয়নি এই বাড়ির আঙিনায়।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here