#মায়াবিনী(২)
#Ayrah_Rahman
#পর্ব_০২
_______________________________
২০৭ নাম্বার কেবিনের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে আরুহী। সকাল থেকে তেমন কিছু ই পেটে পরে নি তার। সেই এয়ারপোর্ট থেকে তো বিভিন্ন ঘটনায় তাকে সরাসরি হসপিটালেই আসতে হলো, যদিও অফিসের উর্ধ্বতর কর্মকর্তা কে সে ফোন করে তার আসার ব্যাপার টা সিউর করেছে।
অন্য সময় হলে আজ সারাদিন সে রেস্টেই কাটাতো কিন্তু সে তো আর এখন তার অ্যাপার্টমেন্টেও যেতে পারছে না। ফ্রেস হওয়া দরকার। যদি ও সুলতান কে দিয়ে তার লাগেজ পাঠিয়ে দিয়েছে আপাতত তার কাছে একটা ছোট্ট কাঁধ ব্যাগ ছাড়া আর কিছু ই নেই।
আরুহী বসা থেকে উঠে দাড়ালো। কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে এক পলক ছেলেটাকে দেখে এগিয়ে গেলো ওয়াসরুমের দিকে উদ্দেশ্যটা আপাতত মুখ টা ভালো ভাবে ধুয়ে ফ্রেস হয়ে একটা ঘুম দেওয়া। ঘুমের বড্ড অভাব তার। নিজেকে সব কিছু থেকে বাহিরে এবং ব্যস্ত রাখতেই পছন্দ করে সে ।
ওয়াসরুমে ঢুকে দরজা টা ভালো ভাবে লাগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাস্ক খুলল সে। কত বছর হয়ে গেলো বাহিরে কারো সামনে মাস্ক খোলে না আরুহী। তার পিছনেও হয়তো কিছু কারণ আছে!
মুখ টা ভালো ভাবে ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মুছে মাস্ক পড়ে তারপর বের হলো। ওয়াসরুম থেকে বের হতেই তার পা দুটো সেখানে ই স্থির হয়ে যায় সেখানেই । তার সামনে বেডের পাশে ডাঃ আরুশ খান একজন নার্সের সাথে কথা বলছে ছেলেটার ব্যাপারে। আরুহী আর সেই দিকে গেলো না, চুপচাপ বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে, পুনরায় গিয়ে বসলো কেবিনের সামনে রাখা চেয়ারে।
আরুশ কেবিন থেকে বেরিয়ে দেখে মেয়েটা মাথা নিচু করে বসে আছে হয়তো কিছু ভাবছে।
” রুগীর বাড়ির লোক কি আপনি? ”
বহু বছর পর সেই মানুষ টার কন্ঠ শুনতে পেয়ে কেঁপে উঠলো আরুহী, নিজেকে সামলে উঠে দাড়ালো।
” জ্বি, আমি ওর বাড়ির লোক। কোন সমস্যা ডক্টর? ”
আরুশ থমকে গেলো, এটা কি করে সম্ভব? কন্ঠের এতো মিল কি করে থাকতে পারে তা ভেবে পায় না সে!
আরুশ ভ্রু কুচকে তাকালো আরুহীর দিকে , চুল খোলা থাকায় ভালো বোঝা যাচ্ছে না চেহারা টা, কোথাও গিয়ে তার মনে হচ্ছে এটা তারই আরু! কিন্তু…
কিন্তু আরু এখানে কেন আসবে? সে তো নিজেই আরুকে কষ্ট দিয়েছে, খুব বেশি ই কষ্ট দিয়ে নিজের জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছে। আর আরু! সেতো তুমুল অভিমান নিয়ে হারিয়ে গেছে, চলে গেছে তার থেকে বহুদূরে , আর যোগাযোগ ও করলো না কখনো, শুধু তাকে নয়, আরু তো পুরো পরিবার কে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো, এতোদিন পর আরু আসবে? তাও আবার তার কাছে যে ওকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে! ব্যাপারটা হাস্যকর না!
” আপনি কিছু বলছেন না কেন ডক্টর আরুশ খান? আর আপনি তো একজন কার্ডিওলজিস্ট তাহলে পেসেন্ট এর কি হার্টের কোন প্রবলেন হয়েছে? ”
আরুশ চোখ উচিয়ে আরুহীর দিকে তাকালো, এই চোখ জোড়াও যে তার বড্ড চেনা চেনা ঠেকছে কিন্তু আজ কেন তার এমন মনে হচ্ছে? কখনো তো কাউকে দেখে এমন অনুভূতি হয় নি তবে এই মেয়েকে দেখে কেন তার এমন অস্থির অস্থির লাগছে? কে এই মেয়ে?
” আপনি কি বোবা? ”
আরুশ চমকে উঠলো, চোখ বড়ো বড়ো করে আরুহীর দিকে তাকালো, এক্সেক্টলি মেয়েটা কি তাকে বোবা বলছে?
” সরি? আপনি কি আমাকে বলছেন? ”
আরুহী মনে মনে হাসলো, এই ছেলে তো দেখি এখনো সেই আগের মতো ই ভিন্ন জগতের বাসিন্দা রয়ে গেছে। একটুও চেঞ্জ হয় নি।
” জি আপনাকে ই বলছি ডক্টর আরুশ খান, আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করলাম আর আপনি কোন কথা ই বলছেন না! ভিন্ন দুনিয়াই বিরাজ করছিলেন? সে যায় হোক , পেসেন্ট এর কি প্রবলেম সেটা একটু ক্লিয়ার করে বললে ভালো হতো। ”
আরুশ থমথমে গলায় বলল,
” পেসেন্টের মাথার সিটি স্ক্যান করা হয়েছে যদিও এখনো রিপোর্ট হাতে আসে নি আর শ্বাসপ্রশ্বাস এর প্রবলেম থাকায় আমার মনে হচ্ছে ওর হার্টে হয়তো কোন সমস্যা আছে তাই আগে পরীক্ষা করে দেখতে হবে, তারপর একটা ডিসিশনে আসতে পারবো”
” জি চিকিৎসা যেন ঠিক মতো হয় টাকার জন্য চিন্তা করবেন না , সব ব্যবস্থা আমি করবো, আসি! ”
বলেই আরুহী কেবিনের ভেতরে ঢুকে গেলো, আরুশ পিছনে থেকে আরুহীর দিকে তাকিয়ে রইলো, কেন জানি মেয়েটাকে তার সন্দেহ হচ্ছে! মেয়েটা কে?
আরুহী ভিতরে ঢুকতেই তার ফোনে কল আসে , ফোন বের করে দেখে সুলতান কল করেছে,
” কি অবস্থা সুলতান? কোন খবর পেয়েছো? ”
” ম্যাম দুটো খবর আছে, একটা ভালো, একটা খারাপ! ”
” খারাপ টা আগে শুনি ”
“মেম শহরের অবস্থা ভালো না, আপনাকে কাল থেকেই ইনভেস্টিগেশন স্টার্ট করতে হবে ”
” হুম, ভালো টা বলো ”
” মেম ওই ছেলেটার বাড়ির খবর পাওয়া গেছে,ওর মাকে নিয়ে আমি হসপিটালে আসছি ”
” হুম ওকে, নিয়ে আসো, আমাকেও অ্যাপার্টমেন্টে যেতে হবে ”
” জি ম্যাম রাখি ”
” হুম ”
আরুহী চুপ করে বসলো ছেলেটার মাথার কাছে, এক হাত ছেলেটার মাথায় রেখে ছেলেটার চুলে হাত বুলাতে লাগলো, ভীষণ মায়া হচ্ছে তার ছেলেটার জন্য! ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে তাকে তাই সে ঘুমাচ্ছে।
হঠাৎ একজন মাঝ বয়সী মহিলা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে কেবিনে ঢুকলো, দৌড়ে এসে জরিয়ে ধরে চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগলো ছেলেটার মুখ। চিৎকার করে ডাকতে লাগলো ছেলেটাকে..
” বাজান ওও বাজান উঠ না বাবা, দেখ বাবা তোর মা তোর লগেই, তোর কিছু হইবো না, আর কোন সময় তোরে একলা কোন হানে যাইবার দিমু না, উঠ না বাবা ”
মহিলাটা ছেলেটাকে জরিয়ে কাঁদতেই লাগলো, আরুহীর আর বুঝতে বাকি নেই, ইনিই ছেলেটার মা কিন্তু যেভাবে চিৎকার করছে তাতে ছেলেটার ব্রেনে মারাত্মক ইফেক্ট পরতে পারে ,
” আপু, ও ঘুমাচ্ছে। ওকে এভাবে ডাকবেন না, মাথায় সমস্যা হবে ”
কোন অচেনা মেয়ের কন্ঠ শুনতে পেয়ে মহিলাটি পিছনে তাকালো,
ধীরে ধীরে আরুহীর কাছে এলো সে, আরুহী বোঝার চেষ্টা করছে আসলে মহিলা করছে টা কি?
হঠাৎ মহিলা আরুহীর পায়ে পরে গেলো যা দেখে আরুহী ছিটকে দুরে সরে গেলো,
” এইইই কি করছেন আপনি? আমার পায়ে পড়ছেন কেন? ”
মহিলাটা দু হাত জরিয়ে আরুহী কে বলতে লাগলো,
” আপা আপনে মানুষ না আপনে ফেরেস্তা আপনে যদি হগ্গলের মতো আমার পোলা ডারে ফালাইয়া আইতেন তাইলে আজকা আমি আর আমার পোলারে জিন্দা পাইতাম না, আপনেরে যে কি বলে ধইন্যবাদ দিমু আপা আমি জানি না ”
বলেই মহিলাটি অঝোরে কাঁদতে লাগলো, কেন জানি মহিলার কান্না টা বেশ ভালো লাগছে! কতটা ডেস্পারেট হলে একজন মা তার সন্তানের জন্য এতো টা আকুতি করতে পারে, মা তো মাই হয়!
আরুহী এগিয়ে গেলো মহিলার দিকে, নিচু হয়ে মহিলার বাহু ধরে উপরে তুলে মহিলার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,
” মায়েরা হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা! তাদের চোখে পানি মানায় না, চোখের পানি তো দুর্বলতার প্রতিক আর মায়েরা কখনো দুর্বল হতেই পারে না। আমাকে আপনি যদি সত্যি ধন্যবাদ দিতে চান তবে নিজের ছেলের পুরোপুরি খেয়াল রাখবেন, কখনো কাছ ছাড়া করবেন না, একজন সন্তান ই বোঝে মা ছাড়া দুনিয়া কতটা কষ্টের।”
প্রথম কথা গুলো স্বাভাবিক ভাবে বললেও শেষ কথা গুলো বেশ আবেগ দিয়ে বলল আরুহী।
মহিলা মাথা নাড়িয়ে নিজের ছেলের কাছে চলে গেলো, আরুহী কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে ই খেয়াল করলো বাইরে ডাঃ রৌদসী দাঁড়িয়ে। তার চোখে মুখে সন্দেহ বিদ্যমান।
আরুহী ভাবলো রোদ কি তাকে চিনে ফেলল কিন্তু পোশাক সব তো ঠিক ই আছে তাহলে এভাবে তাকানোর মানে কি?
আরুহী ওকে পাত্তা না দিয়ে বেরিয়ে গেলো আর রৌদসী তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমার সন্দেহ যদি ঠিক হয় তাহলে তোর কপালে শনি আছে বলে দিলাম আরু!”
চলবে….
[ যারা বলছেন #মায়াবিনী র সাথে #মায়াবিনী_সিজন_২ এর মিল আছে নাকি তাদের বলছি, # মায়াবিনী গল্পের পরবর্তী জেনারেশন নিয়ে সিজন ২ লিখা হচ্ছে, চাইলে শুধু সিজন ২ পড়তে পারেন তবে ক্যারেক্টার গুলো চেনার ও বোঝার জন্য আগের সিজন টা পড়ে নিলে ভালো হবে, এটা আপনাদের ইচ্ছে, তবে কাহিনীর মিল নেই ]