#মায়াবিনী_(২)
#Ayrah_Rahman
#পর্ব_০৮
______________________________
” ম্যাম আপনার বুদ্ধির তারিফ না করে পারলাম না, মানতে হবে আপনি ভীষণ শান্ত বুদ্ধির মানুষ ”
গাড়িতে বসবার মাত্রই সুলতানের কথা শুনে আরুহী মুচকি হেসে গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো,
” ম্যাম আমি ভাবতেও পারি নি সাজিদ খন্দকার এতো তাড়াতাড়ি জালে ধরা পড়বে, যদি ও এই ব্যাটাকে বিশ্বাস নেই, ম্যাম আপনি একটু সাবধানে থাকবেন ”
আরুহী বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বলল,
” কিছু কাজ করতে শরীরের শক্তি নয় বুদ্ধি লাগে, আর কখনো প্রতিপক্ষ কে দুর্বল ভাববে না তাহলে সেই খেলায় তোমার হার সু-নিশ্চিত!কথাটা আমার মা বলতো ”
কিছু টা থেমে,
“সাজিদ খন্দকার মানুষ টা ধূর্ত হতে পারে তবে নিজেকে সে বেশি চালাক মনে করে আর এটাই তাকে তার হেরে যাওয়ার প্রধান কারণ হবে ”
সুলতান আরুহী কে উদ্দেশ্য করে বলল,
” কিন্তু ম্যাম সাবধানের মার নেই, আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে ”
পরিপ্রেক্ষিতে আরুহী কিছু ই বলল না,
গাড়ি এসে দাড়ালো ফাইভ স্টার হোটেলের সামনে,
আরুহী গাড়ি থেকে বের হয়ে রিসিপশন থেকে চাবি নিয়ে নিজের রুমে যাবে হঠাৎ তার এপার্টমেন্ট এর দরজার সামনে একটা র্যাপিং পেপারে মোড়ানো একটা বক্স দেখতে পেলো,
আরুহী ঝুঁকে সেই বক্স টা হাতে নিতেই দেখতে পেলো উপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
” মিসেস আরুহী খান ”
আরুহী চমকালো খানিকটা থমকেও গেলো, সে হয়তো বুঝতে পেরেছে বক্স টা কে দিয়েছে কিন্তু এতোদিন পর এই নাম টা শুনে আরুহী অবাক হলো বটে কিন্তু তার চেয়ে ও বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে গেলো, চোখ দুটো ছলছল করছে হয় তো আরেকটু হলে গড়িয়েই পড়বে কিন্তু আরুহী তো তা চায় না, সে চায় না কেউ তার দুর্বলতা দেখুক, সে তো স্ট্রং! ইনফেক্ট সবাই তাকে স্ট্রং বলেই জানে,
আরুহী আর কিছু না ভেবে চোখের পানি আলতো হাতে চোখে থাকতেই তা মুছে ফেলল, গড়িয়ে পড়তে তো সে দেবে না, এতোদিন এতো তপস্যা করে নিজের মন কে পাষাণ বানিয়েছে তো কাঁদার জন্য নয়, সে তো সব প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে বাংলাদেশে, সকল পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই তো সে এসেছে কিন্তু আজ এতোটুকু কথায় কেন তার চোখে জল?
আরুহী আর কিছু না ভেবে ভেতরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো..
আরুহী যাওয়ার সাথে সাথে ই কেউ আড়াল থেকে বের হলো, তার চোখে ও জল ছলছল করছে কিন্তু সে নিরুপায়, অনেকটা দেরি হয়ে গেলেও আশার প্রদীপ তার নিভে নি আর সেই আশায় বেঁচে আছে সে!
আরুহী বক্স টা বিছানার উপর রেখে ফ্রেস হয়ে আসলো, বক্স খুলতে যাবে হঠাৎ ফোন কলের শব্দে মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে, আরুহী ফোনের ডিসপ্লে তে তাকিয়ে দেখে আননোন নাম্বার, কল পিক করে লাউড স্পিকার এ দিয়ে খাটের ওপর রেখে প্যাকেট খুলতে খুলতে বলল,
” হ্যালো ”
ওপাশ থেকে রৌদসীর কন্ঠ শুনতে পেলো আরুহী,
” হ্যালো আরু! গিফট বক্স পেয়েছিস? ”
আরুহী ভ্রু কুচকে একবার গিফট বক্স এর দিকে আবার ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
” গিফট কি তুমি পাঠাইছো? ”
” তা নয় তো কি? সব আমার পছন্দে পাঠিয়েছি, দেখ তোর পছন্দ হয় কি না ”
” তুমি পছন্দ করে পাঠিয়েছো মানে আমার পছন্দ হবেই ”
” আচ্ছা ঠিক আছে একবার চেক কটে নিস, গায়ে হলুদ, বিয়ে আর রিসিপশন সকল অনুষ্ঠানের জন্য আলাদা আলাদা পোশাক দেওয়া হয়েছে ”
” হুম ঠিক আছে ”
“হুম আর শোন তাড়াতাড়ি চলে আসিস এখানে, কালকে সন্ধ্যায় গায়ে গলুদ অনুষ্ঠান।
” ঠিক আছে, রোদ আপু শোনো ”
” হুম বল ”
” প্যাকেটের উপর নাম টা কে লিখছে? ”
” কেন আমি! ওহহো..
সরি রে ভুলে আরুহী চৌধুরী এর জায়গায় খান লিখে ফেলছি, সরি রে নিজের নাম খান লিখতে গিয়ে তোর নামেও খান বসায় দিসি সরি রে ”
আরুহী মুচকি হেসে বলল,
” ঠিক আছে ঠিক আছে এতো ফর্মালিটিস দেখাতে হবে না, ভালো ভাবে প্রস্তুতি নাও বিয়ের জন্য , কাল দেখা হচ্ছে আল্লাহ হাফেজ ”
” আল্লাহ হাফেজ ”
বলেই আরুহী ফোন কেটে দিলো, ওদিকে রৌদসী ফোন কেটে রাগী দৃষ্টি তে পাশে তাকালো, রৌদসীর পাশে আরুশ গালে হাত দিয়ে বসে আছে,
” কি লিখেছো তুমি আরুহীর গিফট বক্সের উপর?”
আরুশ সোজা হয়ে বসে পকেটে হাত দিয়ে ফোন বের করে ফোন ঘাটতে ঘাটতে গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,
” যা পরিচয় তাই লিখছি, এতে এতো ঢং করার কি আছে, যা তুই, তোর না কাল বিয়ে! ”
রৌদসী উঠে যেতে যেতে বলল,
” মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তুমি মানব না! ”
রৌদসীর কথা শুনে আরুশ রাগী দৃষ্টি তে রৌদসীর দিকে তাকাতেই রৌদসী মেকি হাসি দিয়ে বলল,
” হেহেহে তুমি তো মানব না মহাআআ মানব ” বলেই এক দৌড়ে বাইরে,
আসলে মহামানব কথা টা আরুহী আরুশ কে বলত রাগ করে আজ রৌদসী তা রিপিট করেছে।
_____________________
আরুহী প্যাকেট গুলো খুলে দেখছে সব গুলো পোশাক খুব সুন্দর, তবে সব গুলোই শাড়ি যা দেখে আরুহী খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলো কারণ সে তো শাড়ি পড়তেই পারে না।
থাক পরের টা পরেই দেখা যাবে এখন সব গুলো কাবার্ডে রেখে দেওয়াই বেটার।
আরুহী সব গুলো কাবার্ডে রেখে বেলকনির উদ্দেশ্যে পা বাড়াবে হঠাৎ ফোনের শব্দে ভ্রু কুচকে ফেললো সে, এতো এতো ফোনের যন্ত্রণায় এখন তার ইচ্ছা করছে সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে বনবাসে চলল যেতে কিন্তু সেটা তো আরুহী পারবে না, তাই বিরক্ত হওয়া সত্ত্বেও কল রিসিভ করলো সে,
” হ্যালো ”
” ম্যাম এসকে কোম্পানির সাথে এরকমই আরেকটা কোম্পানি এমন কাজ করে, তাও আবার এসকে কোম্পানির সাথে হাত মিলিয়ে ”
” নাম কি কোম্পানির? ”
” Double star company ”
আরুহী ভ্রু কুচকে বলল,
” ডাবল স্টার? এই নামে কোন কোম্পানির নাম তো শুনিনি”
” ম্যাম এটা নতুন মার্কেট পেয়েছে, কয়েকমাস হয়েছে শুধু এটা উদ্ভোদন হয়েছে ”
” বাহ্ ডিম ফুটতে না ফুটতেই ডানা গজিয়েছে, বেশ ভালো, বাট আমি ওখানে যাবো না আমার হয়ে তুমিই ওয়ার্নিং লেটার টা পাঠিয়ে দিয়ো তো সুলতান ”
বলেই আরুহী ফোন কাট করে দেয়।
হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই সে গাড়ি নিয়ে বাইরে বের হয়ে গেলো,
সিটি হসপিটালের সামনে গাড়ি পার্ক করে ভেতরে ঢুকে গেলো,
২০৭ নাম্বার কেবিনে ঢুকতে ই তার নজর কারলো এক অতি পরিচিত শুভ্র মানব, কানে stethoscope লাগিয়ে খানিকটা ঝুঁকে বাচ্চাটির হৃৎস্পন্দন দেখতে দেখতে এটা সেটা বলে হাসছে সাথে বাচ্চাটিও খিলখিল করে হাসছে।
আরুহী দরজায় দাঁড়িয়ে ওই মানব টাকে পর্যবেক্ষনে ব্যস্ত,
” আরে আপামনি যে! ”
হঠাৎ কারো সম্বোধনে নড়ে চড়ে উঠলো আরুহী, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো বাচ্চাটির মায়ের দিকে,
এক পলক ডাক্তার আরুশ খান এর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে এগিয়ে গেলো বেডের দিকে,
বাচ্চাটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” কেমন আছো বাবা? ”
” ভালো আন্টি! ”
” খাবার আর ঔষধ ঠিক মতো খাচ্ছো তো? ”
ছেলেটি মাথা ঝাকিয়ে উত্তর দিলো হ্যা, মানে সে খাচ্ছে, আরুহী মুচকি হেসে বলল,
” গুড বয় ”
এবার সে আরুশের দিকে ঘুরে বলল,
” ওকে রিলিজ দিবে কখন ডক্টর? ”
আরুশ এতোক্ষণ এক দৃষ্টিতে আরুহীকেই দেখছিলো, এই মেয়েটাকেই সে এত কষ্ট দিয়েছে! ভাবতেই তার কষ্টে আর নিজের প্রতি রাগে বুক ফেটে যাচ্ছে অথচ মেয়েটা কত সুন্দর মিথ্যা হাসি দিয়ে সব কিছু আড়াল করে রেখেছে, তার সকল কষ্ট, খারাপ লাগা সব কিছু ই একটা মিথ্যা হাসির পিছনে লুকিয়ে আছে!
আরুহীর প্রশ্নে আরুশ খানিকটা চমকে উঠে আমতাআমতা করে বলল,
” আগামী দুই একদিনের মধ্যে ই রিলিজ হয়ে যাবে ”
” ঠিক আছে, আর বিল ভাউচার টা আমাকে দিয়ে দেবেন আমি পে করে দেবো ”
বলেই আরুহী বাচ্চার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো, আরুশ আরুহীর যাওয়ার দিকে ই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, তার তো বলার কিছু ই নেই, কি বলবে সে? আর কোন মুখে বলবে?
আরুহী গাড়ি চালিয়ে একটা বড় বিল্ডিং এর সামনে এসে ব্রেক করে, জানালা দিয়ে সেই বিল্ডিং এর দিকে তাকাতেই নজরে এলো বিল্ডিং টির নাম,
” Chowdhury Group ” আরুহী মুচকি হাসলো, মায়ের সাথে অভিমান করে বাবার সাথে ও কথা কম বলে সে, তবে মাঝে মাঝে মেসেজে কথা হতো বাপ বেটির.
আরুহী ভেতরে ঢুকে রিসিপশনে আসতেই রিসিপশনের মেয়েটি উঠে দাড়ালো,
” কাকে চান? ”
আরুহী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মেয়েটার দিকে,
ওভার স্টাইলিশ মেয়েটা, চুল গুলো ঘোড়ার লেজের মতো স্ট্রেইট করে কালার করা, আর অতিরিক্ত আটা ময়দা মাখা মুখে। আরুহী নাক মুখ কুঁচকে বলল,
” আবরার চৌধুরী আছেন? ”
রিসিপশনের মেয়েটি আরুহীর পা থেকে মাথা অবদি পর্যবেক্ষন করতে লাগলো,
আরুহী নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে একটা লং শার্ট আর প্যান্ট যা আবার নিচ দিয়ে ফোল্ড করা, মাথায় ক্যাপ আর মুখে মাস্ক চুল গুলো ছেড়ে দেওয়া সাথে লেডিস সু। একটা বাচ্চা মেয়ে মনে হচ্ছে তাকে।
” আমাকে দেখা শেষ হলে যদি বলতেন যে আবরার চৌধুরী কোথায় তাহলে ভালো হতো ”
রিসিপশনে থাকা মেয়েটা মুখ বেকিয়ে বলল,
” স্যার একটা ইম্পর্টেন্ট মিটিং এ আছে, এখন দেখা করা যাবে না ”
আরুহী ভ্রু কুচকে বলল,
” কত তলায় মিটিং? ”
” সপ্তম তলায় কিন্তু এখন স্যার দেখা করতে পারবে না ”
আরুহী মেয়েটার আর কোন কথা না শুনে লিফটে ঢুকে ৭ম বাটন ক্লিক করতেই লিফট বন্ধ হয়ে যায়, রিসিপশনের মেয়েটি বেশ অনেক বার ডাকাতেও আরুহীর কিছু হলো না।
সে সপ্তম তলায় উঠে সোজা মিটিং রুমে ঢুকে গেলো উইথআউট পারমিশন।
হঠাৎ করে মিটিং রুমে কারো প্রবেশে সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে আরুহীর দিকে তাকালো,
আবরার তখন কোন কিছু নিয়ে ডিসকাস করছিলো হঠাৎ একটা মেয়ে মিটিং রুমে ঢুকাতে তার মনোযোগ নষ্ট হলো কিন্তু মেয়েটাকে দেখা মাত্র ই আবরারের বিরক্ত হবার বদলে মুখে এক চিলতে হাসির রেখা দেখা গেলো, মেয়েকে চিনতে তার ভুল হয় নি!
সে সোজা দাঁড়িয়ে গেলো,
আরুহী এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
” কেমন আছেন মিস্টার আবরার চৌধুরী? ”
আবরার মুচকি মুচকি হেসে বলল,
” আমি তো ভালোই আছি, আপনার কি খবর মিস আরুহী চৌধুরী? ”
আরুহী দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো,
আবরার ও আলতো হেসে মেয়েকে বুকে টেনে নিলো, কতদিন পর সে মেয়েটাকে একটু ছুঁয়ে দিলো, খুশিতে আবরারের চোখে জল চলে এসেছে।
রুমের সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আবরার ও আরুহীর দিকে তারা তো কিছু ই বুঝতে পারছে না…
চলবে…
[ হেই জনগন কেমন হয়েছে জানাবা আর সবাই রৌদসীর বিয়েতে চলে এসো আর গিফট আনতে ভুলবে না কিন্তু!
হ্যাপি রিডিং ]