দীর্ঘ ন’বছর পর প্রবাস জীবন এর ইতি টেনে ভোর পাঁচটার ফ্লাইটে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলো আরুহী চৌধুরী। নিজের ভেতরে ঠিক কি অনুভুত হচ্ছে তা ঠিক ঠাওর করতে পারছে না সে। হয়তো কিছু টা বিরক্তি বাকি টা অভিমান! এয়ারপোর্টের ভিতরের সব কাজ কমপ্লিট করে বেরিয়ে এলো আরুহী।
নিজ ইচ্ছে তে আসে নি সে বাংলাদেশ , আসতে বাধ্য হয়েছে। গভার্নমেন্ট থেকে বেশ কিছু দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়েছে যার জন্য এতো অভিমান, অভিযোগ পাশে রেখে দায়িত্বের খাতিরে এই দেশে আসা তার আর ক’দিন থাকতে হবে ঠিক জানা নেই। কিছু টা এগিয়ে যেতেই সে দেখতে পেলো দু’জন বডিগার্ড দাড়ানো। হয়তো গভার্নমেন্ট থেকে ই পাঠানো হয়েছে। আরুহী কে দেখেই তারমধ্যে একজন দৌড়ে এলো,
” গুড মর্নিং ম্যাম ”
” গুড মর্নিং ”
ব্ল্যাক এন্ড হুয়াইট চেক লং শার্ট আর ব্ল্যাক প্যান্টে মাথায় ক্যাপ পড়া সাথে ফেইস মাস্ক তো আছেই , কোন বিদেশিনী থেকে কম কিছু মনে হচ্ছে না।
আশেপাশে এক নজর তাকালো সে , অনেকটায় বদলে গেছে সবকিছু তার সাথে বদলে গেছে তার জীবনের গতিপথ, বদলে গেছে সবার সাথে তার সম্পর্কের বাধন , কম সময় তো আর অতিবাহিত হয় নি, দীর্ঘ ন’বছর!
” ম্যাম আপনার সুটকেস টা আমাকে দেন আমি গাড়ি তে রেখে দিচ্ছি। ”
আরুহী ঘাড় ঘুরিয়ে বডিগার্ড এর দিকে তাকালো।
থমথমে গলায় বলল,
” No need Mr. Sultan. আমি নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করি। ”
আরুহীর গম্ভীর কন্ঠে বলা কথায় সুলতান খানিকটা পিছিয়ে গেলো ,
আরুহী গটগট পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো, সুটকেস টা গাড়ি তে রেখে দরজা খুলে পিছনে বসলো।
আরুহী বসতেই সুলতান সামনে বসলো আর গাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে চলল। আরুহী চোখ বন্ধ করে নিজের গা এলিয়ে দিলো গাড়ির সিটে। খুব বেশি ই ক্লান্ত লাগছে তাঁর।
পিছনে পিছনে আরেকটা গাড়িও এগিয়ে আসছে ঠিক তার গাড়ির পিছনে পিছনে, সেখানে ও কিছু বডিগার্ড।
হঠাৎ মাঝ রাস্তায় গাড়ি টা জোরে ব্রেক কষলো ড্রাইভার, হঠাৎ ব্রেক কষায় আরুহী ভ্রু কুচকে উঠে বসলো,
” What’s happen? ”
” ম্যাম সামনে অনেক ভীড় গাড়ি এগুনো যাচ্ছে না , মনে হচ্ছে এক্সিডেন্ট কেস! ”
আরুহী কিছু না বলে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো,
পিছনে থেকে বেশ অনেক বার সুলতান ডেকেছে কিন্তু কে শুনে কার কথা। আরুহী গটগট পায়ে এগিয়ে গেলো সামনে। ভীড় ঠেলে সামনে যেতেই তার সামনে দৃশ্য মান হয় একটা বাচ্চা ছেলের আহত দেহ, হয়তো মিনিট পাঁচেক আগে কোন গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে ছেলেটি ছিটকে পড়ে যায় রাস্তার সাইডে যার ফলে ছেলেটার মাথার পাশ দিয়ে বেশ অনেক খানি জায়গা ফেটে র*ক্ত বের হচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই এত মানুষের ভীড় অথচ কেউ তাকে হসপিটালে নিচ্ছে না আর না তার ব্যবস্থা করছে! তবে কেউ কেউ দাড়িয়ে দেখছে কেউ বা ছবি তুলছে, আর কেউ কেউ লাইভ ও করছে! এই স্বার্থপর দেশের মানুষের কাছ থেকে আর কিই বা আশা করা যায়!
আরুহী দ্রুত পায়ে ছেলেটির কাছে গিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে ছেলেটির মাথায় বেধে দিয়ে পাজা কোলে তুলে নেয় তাকে।
আশেপাশে এক পলক তাকিয়ে গটগট পায়ে হেটে ফিরে এলো তার গাড়ির নিকট। তাকে দেখা মাত্র ই সুলতান গাড়ির দরজা খুলে দেয়। আরুহী গাড়ি তে বসে ছেলেটির মাথা তার কোলের উপরে নিয়ে ড্রাইভার কে তাড়া দিয়ে বলল,
” গাড়ি স্টার্ট করো ফাস্ট , সিটি হসপিটালের দিকে যাও ”
____________________
” বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট ডক্টর আরুশ খান, বয়স কি আপনার দিনে দিনে কমছে? বয়স তো আর থেমে থাকে না আটাশ বছর পার হয়ে উনত্রিশ এ পা রাখলেন, বিয়ে শাদী কি করবেন না বলে পণ করেছেন? ”
সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট টেবিলে মায়ের এমন কথা শুনে একটু ও বিচলিত হলো না আরুশ, যেন এই কথা তার নিত্যদিনের পরিচিত। চুপচাপ ব্রেক ফাস্ট করে হাতে এপ্রোন টা নিয়ে বেরিয়ে গেলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে। যেন সে ছাড়া ব্রেকফাস্ট টেবিলে আর কেউ ছিলো ই না।
ছেলের এমন আচরণে প্রতিবার ই হতাশ হয় মিরা, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মিরাজ এর দিকে, মিরাজ যেন মায়ের এমন দৃষ্টির সাথে বহু পরিচিত।
সে মায়ের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে খাওয়া থেকে উঠতে উঠতে বলল,
” আমার না খাওয়া শেষ। আমি বরং আজ উঠি অফিসের লেট হয়ে যাচ্ছে।”
বলেই টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলো, বেরিয়ে গেলো বললে ভুল হবে সোজা কথায় পালিয়ে গেলো।
মিরা কপালে হাত দিয়ে বসে পড়লো চেয়ারে, আরাফের দিকে তাকিয়ে দেখে সে এক মনে খাবার খেয়ে যাচ্ছে এত কিছু নিয়ে তার কোন মাথা ব্যথা নেই।
” একটা হয়েছে ফুফুর মতো একরোখা আর আরেকটা হয়েছে বাপের মতো ফাঁকি বাজ। বাপ আর ছেলেরা মিলে আমার হাড় মাংস সব জ্বালিয়ে খেলো। একটা ও যদি কথা শুনতো! বাপ ই শুনেনা ছেলেরা কি শুনবে! একেকটা বুড়ো হচ্ছে অথচ বিয়ে শাদীর নাম গন্ধ নেই, সারাজীবন আইবুড়ো হয়েই থাকবে! একটা আছে হসপিটাল আর রুগী নিয়ে তো আরেকটা আছে অফিস আর ব্যবসা নিয়ে। বাড়িতে যে মা একা একা আয়ার মতো খাটে সেদিকে কি কারো খেয়াল আছে? বসে যে দুদণ্ড কারো সাথে কথা বলব তাও না। ”
মিরা নিজ মনে বিরবির করতে করতে রান্না ঘরের দিকে গেলো। তার দুঃখ একটাই একটা ছেলে ও তার মতো হলো না!
__________________
” এখানকার নিউরোলজিস্ট কে? উনাকে একটু কল করে বলেন ২০৭ নাম্বার বেডের রুগীর অবস্থা ভালো না”
রিসিপশনের মেয়েটি চোখ তুলে তাকালো আরুহীর দিকে, কালো মাস্ক পড়া অদ্ভুত ধরনের মেয়ে দেখে বেশ অবাক হলো।
” জি আপনি যান, আমি মেম কে বলছি ”
” এক্ষুনি বলেন, কুইক ”
মেয়েটি টেলিফোন হাতে নিয়ে কারো নাম্বারে কল করে বলল,
” মেমকে বলো ২০৭ নাম্বার বেডের পেসেন্ট এর অবস্থা ভালো না মেম যেন তাড়াতাড়ি ওখানে যায়। ”
ফোনের ওপার থেকে কেউ কিছু বলল , যা শুনে রিসিপশনের মেয়েটি বলল,
” আরে মাত্র ই একটা এক্সিডেন্টের পেসেন্ট এনে ভর্তি করালো যে বাচ্চাটিকে তার কথা বলছি! এতো কথা না বলে মেম কে বলো গিয়ে পেসেন্ট এর অবস্থা চেক করতে।”
ফোনটা রেখে মেয়েটি আরুহীর দিকে তাকিয়ে বলল,
” আপনি পেসেন্ট এর কাছে যান, মেম এক্ষুনি আসছে।”
আরুহী চলে এলো ২য় ফ্লোরের ২০৭ নাম্বার বেডে, দরজায় দাঁড়িয়ে ছেলেটাকে দেখতে লাগলো , মাথায় ব্যান্ডেজ করা হাতে সেলাইন চলছে, বয়স আর কত হবে হয়তো ৭ কিংবা ৮।
এসব ভাবনার মধ্যে ই পিছনে থেকে কেউ বলে উঠলো,
” একটু সরেন তো, মেম কে ভেতরে যেতে দেন।”
আরুহী ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো,
থমকে গেলো আরুহী, গলায় Stethoscope ঝুলানো গায়ে সাদা এপ্রোন পরিহিত একজন মেয়ে। এপ্রোনের গায়ে জ্বলজ্বল করছে ” ডাঃ রৌদসী খান মেহের” নাম টা।
আরুহী অবাক চোখে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,
“রোদ আপু”
রৌদসী এক পলক আরুহীর দিকে তাকিয়ে ভেতরে চলে গেলো। সে তো আরুহীকে চিনতেই পারে নি, দীর্ঘ ন’বছর পর এভাবে মাস্ক পড়ে কারো সামনে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই কেউ কাউকে চিনবে না।
“নার্স, দ্রুত পেসেন্ট এর সিটিস্ক্যান এর ব্যবস্থা করো।”
বলেই রৌদসী কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে যেতে নিলে আরুহী পিছনে থেকে ডেকে উঠলো,
” রো.. আই মিন ডক্টর? ”
রোদ থমকে গেলো, আধো আধো পরিচিত কন্ঠ, হঠাৎ শুনে মনে হলো এটা তার আরুর কন্ঠ কিন্তু এখানে আরু আসবে কি করে? তার ছোট্ট বোন টা তো নয় বছর আগে ই তার সাথে অভিমান করে দেশ ছেড়েছে। কথা টা মনে হতেই রোদের চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু পানির কনা এসে জমা হলো।
গোপনে চোখের পানি মুছে পিছনে ফিরে তাকালো সে,
” কিছু বলবেন? ”
“রোগীর অবস্থা কেমন দেখলেন? ”
“সিটিস্ক্যান এর রিপোর্ট হাতে আসার আগ পর্যন্ত আমি কিছু ই বলতে পারছি না, রুগী কি আপনার ছেলে? ”
” এক্সেক্টলি রুগী আমার কেউ হয় না। রাস্তায় এক্সিডেন্ট হয়ে পড়ে ছিলো তাই মানবিক মূল্যবোধ থেকে তাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছি। আর তার দায়িত্ব যেহেতু নিয়েছি তাকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য। ”
রোদ অবাক হলো, এখনো এমন মানুষ বাংলাদেশে আছে!
“জি অবশ্যই, আমি আমার যথাসাধ্য আপনাকে হেল্প করবো মিস, এখন তবে আসি ”
বলেই রোদ চলে গেলো, আরোহী তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো যতক্ষণ তাকে দেখা যায়।
রোদের অবয়ব অদৃশ্য হওয়ার পর আরুহী করিডর দিয়ে হাটতে হাটতে সামনে তাকিয়ে দেখে একজন এপ্রোন পরিহিত ডক্টর বারান্দার শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে এক মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
আরুহী ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেলো। আরুহী গিয়ে সেই ডক্টরের পাশে দাঁড়াতেই ওনি ঘাড় ঘুরিয়ে আরুহীর দিকে তাকালো,
আরুহী উনার দিকে তাকাতেই আরুহীর পা আবারো থমকে গেলো, সামনে দাঁড়ানো পুরুষটা যে তার বড্ড চেনা। দীর্ঘ ন’বছর পর ও চেহারার খুব বেশি পরিবর্তন হয় নি, ভ্রু এর উপর কাটা দাগ টা এখনো জ্বলজ্বল করছে। সে ধীর পায়ে পিছনে ঘুরে হাটা লাগালো, আর কিছু ক্ষন এখানে থাকলে নির্ঘাত কেউ চিনে ফেলবে।
আরুহী চলে এলো ২০৭ নাম্বার কেবিনে। আসার সময় যদি সে একবার পিছনে ফিরতো তাহলে কারো অবাক দৃষ্টি সে হয়তো দেখতে পেতো…
#চলবে….
#মায়াবিনী_(২)
#Ayrah_Rahman
#সূচনা_পর্ব
[ অনেকেই #মায়াবিনী_সিজন_২ চাচ্ছিলেন, তাই দিয়ে দিলাম , আশা করি গঠন গত মন্তব্য করবেন ]