চিত্রলেখার_কাব্য ঊনবিংশ_পর্ব ~মিহি

0
648

#চিত্রলেখার_কাব্য
ঊনবিংশ_পর্ব
~মিহি

চিত্রলেখা ধীর পায়ে ঘরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিল। ক্রমাগত নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো সে। ভয়ে এতক্ষণ দম বন্ধ হয়ে ছিল। কিছু মুহূর্ত এতটা স্মরণীয় হতে পারে তা সে কখনো ভাবেনি। হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসতেই ফোনটা বেজে উঠলো। চিত্রলেখা রিসিভ করলো তড়িৎ গতিতে।

-ঠিকঠাকভাবে পৌঁছেছো?

-হুম।

-আচ্ছা ঘুমাও। অনিক ভাইয়ার বেইল করা হয়েছে?

-না, কিছু জটিলতা আছে।

-আচ্ছা চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

-হুম। আপনি ফিরেছেন বাড়িতে?

-না। এখন গেলে ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাবা শেষরাতে ঘুম থেকে উঠে বই-টই পড়েন। একেবারে সকালে বাবা অফিসে গেলে বাড়িতে ঢুকবো।

– আপনি কোথায় থাকবেন আর বাইক কোথায় রাখবেন রাতে?

-বাইক বন্ধুর, ওকে সকালে ফেরত দিয়ে দিব। এখন আমি আর বাইক আরো কিছু মুহূর্ত উপভোগ করবো। তুমি ঘুমাও। টা টা।

চিত্রলেখার ফোন রাখতে ইচ্ছে করলো না তবুও অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিদায় জানালো। কণ্ঠে নিষ্ক্রিয়তা স্পষ্ট।

-তুমি কি আরো কিছুক্ষণ কথা বলতে চাইছো?

-ন..না তো।

-সত্যি?

-হ্যাঁ।

-তার মানে কথা বলতে চাও আরো?

-কখন বললাম?

-এই তো হ্যাঁ বললে।

-সেটা তো সত্যির জন্য বললাম।

-তার মানে আগেরবার মিথ্যে বলেছিলে!

-ধূর! কথার প্যাঁচে ফেলছেন।

-আচ্ছা স্যরি। মজা করছিলাম। তোমার ঘরের পিছনের জানালাটা রাস্তার উল্টো পাশে হওয়ায় ভালো হয়েছে। এদিকে সারারাত দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউ টের পাবে না।

-মানে?

-পিছনের জানালাটা খোলো বোকা মেয়ে।

চিত্রলেখা দ্রুত জানালাটা খুললো। এ জানালা সবসময় বন্ধ থাকে। জানালাটা খুলতেই ক্যাচ ক্যাচ ধরনের একটা শব্দ হলো। চিত্রলেখা ভয়ে আঁতকে উঠলো। নিস্তব্ধ পুরীতে শব্দটা যেন আতঙ্কের ন্যায় শোনালো। জানালার নিচে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা রঙ্গনের হাস্যোজ্জল চেহারা মুহূর্তেই তাকে আতঙ্ক ভুলিয়ে দিল।

-কী ম্যাম? শকড?

-না, সারপ্রাইজড যে এখনো যাননি!

-নিশ্চিত হলাম যে তুমি ঠিকমতো ফিরেছো।

-এখন তবে চলে যান।

-বিদায় করার সবচেয়ে কঠোর তরিকা ব্যবহার করলে! একটু ভালোমতোও বলতে পারতে, এভাবে অর্ধচন্দ্র দেখিয়ে বিদায় করা ঘোরপাপ।

-আপনি কি লিটারেচারের স্টুডেন্ট? এত ড্রামাটিক কথা কী করে বলেন?

-আমি এমনই। তুমিও আমার সাথে বেশি বেশি মেশার চেষ্টা করো, দেখবে মুখের ম্লান ভাব কমবে।

-একটু পর আযান দিবে, যাতায়াত বাড়বে এ রাস্তায়। এখন আপনার যাওয়া উচিত।

-আচ্ছা নিজের খেয়াল রেখো। আল্লাহ হাফেজ।

চিত্রলেখা বিদায় জানিয়ে কল কাটলো। বিছানায় বসতেই যেন জগতের সমস্ত ঘুম তার চোখে নেমে এলো। ঘুমে চোখই খুলতে পারলো না সে।

________________

হইচইয়ের শব্দে ঘুম ভাঙলো চিত্রলেখার। লাফ দিয়ে উঠে বসলো সে। ফোনে সময় দেখলো। নয়টা বাজে। মাথায় হাত দিয়ে বসলো সে! নির্ঘাত বড় ভাবী চেঁচামেচি করছে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে ঘর ছেড়ে বেরোলো সে। বাইরের পরিবেশ আশঙ্কাজনক। অর্ণব চুপচাপ ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। অপর্ণা রান্নাঘরে কিছু একটা করছে আর সমানে চেঁচাচ্ছে। চিত্রলেখাকে দেখে তার রাগের মাত্রা আরো বাড়লো।

-এসেছে মহারানি! তো রানীসাহেবা, শাহী ভোজ আনি আপনার জন্য? জমিদারের ঘরে জন্মাইছেন, কাজ কামে তো মন থাকবে না। হোস্টেলে থেকে এখন নিজের বাড়িতে রান্নাও করতে মন চায় না?

-স্যরি ভাবী, তুমি সরো আমি করছি।

-কী এমন রাজকার্য করছিস রাতে যে ন’টা অবধি ঘুমাস? খুব ভাব হইছে সবার! একজন দরজা লাগায়ে বসে আছে কাল থেকে, আরেকজন ঘুমাচ্ছে! সব আমার করা লাগে!

চিত্রলেখা অবাক হলো। সাথী এতক্ষণ দরজা বন্ধ করে কখনোই থাকেনা।

-ভাইয়া, ছোট ভাবী তো এতক্ষণ দরজা বন্ধ করে কখনো থাকেনি। একটু দেখবে?

-হ্যাঁ চল! আমিও অনেকক্ষণ দেখিনি ওকে।

চিত্রলেখা অর্ণবকে সাথে করে সাথীর দরজার বাইরে দাঁড়ালো। দরজায় বার কয়েক শব্দ করলো।

“ভাবী? দরজা খোলো!” অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পরেও সাড়াশব্দ না পেয়ে চিত্রলেখার মনে ভয় ঢুকলো। সে অর্ণবকে বললো দরজা ভাঙতে। অর্ণবেরও মনে হলো এছাড়া উপায় নেই। অপর্ণা ভ্রু কুঁচকে কেবল দৃশ্রগুলো অবলোকন করছে। অর্ণব সজোরে দরজার দিকে এগোতে যাবে এমন সময় সাথী দরজা খুললো। সাথীর চোখেমুখে রক্তিম আভা। চিত্রলেখা সাথীর এ রূপ দেখে ভয় পেল।

-ভাবী কী হয়েছে তোমার? এমন লাগছে কেন তোমাকে?

-আমি কি খুব দুর্বল লেখা? আমার সহ্যক্ষমতা নাই? আমার স্বামীর এ পরিস্থিতিতেও আমি ধৈর্য রেখেছি। আর কী চাস তোরা আমার থেকে? আমার স্বামী হসপিটালাইজড, কথাটা জানলে কি আমি নিজেকে শেষ করে ফেলতাম? অনিকের অসুস্থতায় ওর পাশে থাকার অধিকার আমার নাই?

-ভাইয়া হসপিটালাইজড! মানে? কেন? কী হয়েছে ভাইয়ার?

-সেটা তোর বড় ভাইয়া বলতে পারবে। অর্ণব ভাইয়া, হসপিটাল থেকে কল করে আপনার নম্বরে যোগাযোগ করতে না পেরে আমাকে কল করেছিল। অনিকের সকালে জ্ঞান ফিরেছে। আমি এতটা দুর্বল নই ভাইয়া যতট আপনি ভেবে নিয়েছিলেন। দয়া করে পরেরবার আমার স্বামী সংক্রান্ত কিছু আমার থেকে লুকোবেন না।

সাথীর শান্ত কথায় অর্ণব মাথা নত করলেও অপর্ণার মনে যেন আগুন জ্বলে উঠলো দাউদাউ করে।

-তোর স্বামী হওয়ার আগে সে আমার স্বামীর ভাই! নিজের ভাইয়ের জন্য চিন্তা করা ভুল নাকি? অর্ণব ঠিকই করেছে। আমার স্বামীকে দোষারোপ করা বন্ধ কর।

-আমি দোষ দিচ্ছি না ভাবী, শুধু আমার মনের কথাটা বলেছি।

-তুই স্পষ্টত আমার স্বামীকে অপমান করেছিস!

সাথী চুপ করলো। এ মুহূর্তে অপর্ণার সাথে ঝগড়া করার সময় তার নেই। হসপিটালে যেতে হবে তার। অর্ণব এ মুহূর্তে নিজের ক্রোধ সংবরণ করতে পারলো না। অপর্ণার দিকে রক্তচক্ষু মেলে তাকালো সে।

-নারীজাতির প্রতি আমার যথেষ্ট সম্মান। তুমিও সেই নারীজাতির অন্তর্ভুক্ত। নিজের ঘৃণ্য কার্যকলাপ দ্বারা নিজেকে আরো নীচ প্রমাণ করার চেষ্টা না করলেও চলবে।

অপর্ণা রাগে জ্বলে উঠলো কিন্তু অর্ণব সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে চুপচাপ সাথীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরোলো। চিত্রলেখা তখনো সেখানে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে। অপর্ণার রাগ সরাসরি চিত্রলেখার উপরেই পড়লো।

-তুই ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো নাটক দেখছিস কেন?

– গৃহপালিত ছাগলের বাচ্চা তো তাই কখনো বনের গাধার হাঁকডাক দেখিনি। তাই দেখছিলাম আর কী!

বলেই আর সেখানে দাঁড়ালো না চিত্রলেখা। একদৌড়ে রান্নাঘরে জুট লাগালো। যতক্ষণে অপর্ণা চিত্রলেখার কথার অর্থ বুঝতে পেরেছে, ততক্ষণে সে আর তার হাতের নাগালে নেই। অপর্ণা রাগে গজগজ করতে করতে নিজের ঘরের দিকে এগোলো।

_____________

অনিকের শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে উন্নত। কেস কোর্টে যেতে আর চারদিন সময় আছে। অনিককে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করবে আজ তবে তার সাথে সর্বদা একজন পুলিশকে রাখা হবে কেননা বিষয়টা এখন সাধারণ কেইস থেকে তার কর্মরত প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়ে পৌঁছেছে। অনিককে ইতোমধ্যে জব থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। সাথীকে হাসপাতালে দেখামাত্র অনিক কান্নায় ভেঙে পড়লো। পুরুষ মানুষের কান্না নাকি দুর্লভ অথচ অনিক মনের সমস্ত যন্ত্রণা অবাধে কিছু অশ্রুকণা দ্বারা সাথীর নিকট প্রকাশ করলো। সাথী চুপচাপ অনিকের বুকে আলতো করে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বুঝিয়ে দিল সে সবসময় তার পাশে আছে।

“তোমার সত্যটা আমি জানি। যদি নিজেকে বাঁচাতে চাও, চুপচাপ তিন লাখ টাকা আমাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। ভুলেও পুলিশকে হাবিজাবি বোঝানোর চেষ্টা করো না। তোমার বিরুদ্ধে প্রমাণও আছে আমার কাছে। টাকা নিয়ে জায়গামতো এসো, নিজের বাঁচার প্রমাণ নিয়ে দূর হও।” মেসেজটা দেখামাত্র দীতির পায়ের নিচ থেকে জমিন সরে গেল। ভয়ে নখ কামড়াতে লাগলো সে। স্বভাবতই সে ভীতু। অনিককে ফাঁসানোর সাহসও তার মধ্যে ছিল না। দীতির ভয় ক্রমশ বাড়তে লাগলো। দীতির সত্য কে জানতে পারলো? এটা তো দীতি নিজের সহযোগীকেও জানানোর সাহস পাচ্ছে না। সে যদি জানে তবে সর্বপ্রথম দীতিকে মেরে ফেলবে। একটা টেক্সট দীতির পুরো জীবনের মোড় ঘুরিয়ে ফেলেছে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here