চিত্রলেখার_কাব্য পঞ্চাশতম_পর্ব ~মিহি

0
446

#চিত্রলেখার_কাব্য
পঞ্চাশতম_পর্ব
~মিহি

অপর্ণার লাশ কবর দেওয়া হলো ভোরবেলা ফজর নামাযের পর। দূরের আত্মীয় স্বজনদের জন্য অপেক্ষা করা হয়নি। চিত্রলেখাকে এসবের মাঝে আসতে দেয়নি অর্ণব আর না রূপসা এবং রাদিফকে আসতে দিয়েছে। বাচ্চা দুটোকে এত বড় একটা মানসিক কষ্টের মধ্যে ফেলার সাহস তার নেই। এখানে উপস্থিত সকলে পরিবারের সদস্য হলেও সবাই সবসময় ভালো কথাই বলে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। কেউ ভুলক্রমেও যদি বিরূপ কোনো মন্তব্য কেউ করে ফেলে তার ক্ষত নিতান্তই সামান্য হবে না। তার চেয়ে বরং চিত্রলেখা ও বাচ্চারা অপর্ণার মৃত্যুর খবর একটু দেরিতেই জানুক।

লাশ দাফনের পর অপর্ণার বাবা এলেন অর্ণবের কাছে। অর্ণব তখন এককোণে দাঁড়িয়ে ছিল। পরিবারের সদস্যদের কাছাকাছি থাকতে সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না।

-অর্ণব, বাচ্চা দুটোকে এখানে রেখে যাবে কি? অপর্ণা তো নেই, অন্তত…

-অপর্ণার সাথে আমার ডিভোর্স হয়েছে কিন্তু রূপসা, রাদিফ এখনো তো আমার সন্তান। বাবা হিসেবে তাদের প্রতি আমার যে দায়িত্ব তা আমাকে পালন করতে দিন।

-আমি তোমাকে দায়িত্ব নিতে মানা করছি না অর্ণব কিন্তু বাচ্চা দুটো আমাদের কাছে কিছু সময় থাকলে আমাদের ভালো লাগতো।

-এ বাড়ির পরিস্থিতি কেমন আপনিও দেখতে পারছেন, সবকিছু স্বাভাবিক হলে আমি ওদের কিছু সময়ের জন্য এখানে রেখে যাবো। আমি এখন আসি।

-এসো।

অর্ণব আর দাঁড়ালো না। আগের মতো আবেগগুলো আর কাজ করে না। ডিভোর্সের সময়টুকুতে কিংবা বাচ্চাদের কাস্টাডি নেওয়ার লড়াইয়ের সময় এই মানুষগুলোই বড্ড নির্মম হয়ে উঠেছিল। তখন থেকেই আবেগ অনুভূতি অনেকখানি কমে এসেছে অর্ণবের। এখন সে শুধু তার বাচ্চাদের নিয়ে ভাবতে চায়।

চিত্রলেখার ঘুম ভাঙার পর থেকে সে অস্থির হয়ে আছে। অর্ণব আশেপাশে কোথাও নেই, কোথায় গিয়েছে বলেও যায়নি। নিজের ভাইয়ের এ হেন আচরণ চিত্রলেখাকে বড্ড বিরক্ত করছে। রূপসা-রাদিফের ম্লান মুখ দেখে চিত্রলেখার মন যেন আরো খারাপ হয়ে আসে। বাচ্চা দুটোকে নিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে সে। রাদিফ বরাবরই একটু শক্ত স্বভাবের ছিল তবে রূপসার মলিন মুখটা বড্ড পীড়া দিচ্ছে চিত্রলেখাকে। শত চেষ্টা করেও মেয়েটার মুখে আগের মতো হাসি ফেরানো যাচ্ছে না। চিত্রলেখা কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। এখানকার কথা এখনো ভাবীকে জানায়নি সে। জানাতে ইচ্ছেও করছে না, ওখানে বসে চিন্তা করবে। ইদানিং চিত্রলেখার মনে হচ্ছে তার ছোট ভাবী মা হতে চলেছে। এ অবস্থায় এসব কথা কেন যেন তাকে জানাতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার।

চিত্রলেখার ফোন বাজছে। রূপসা রাদিফকে নাস্তা দিয়ে উঠে এলো সে। রঙ্গন কল করেছে। চিত্রলেখার মনে পড়লো গতকাল ফেরার পর থেকে রঙ্গনকে একবারও কল করেনি সে। কল রিসিভ করলো সে।

-বাড়িতে ফিরে একটাবার জানাবে তো! এমনিতেই একা ফিরেছো, জানালে কী হতো?

-রঙ্গন, আসলে একদম খেয়াল ছিল না। ক্লান্ত ছিলাম খুব, এসেই ঘুমিয়ে পড়েছি। ফোনের দিকে তাকানোর সময়ই পাইনি।

-ভাইয়া কেমন আছে?

-আছে একরকম। আসার পর বাড়ির পরিস্থিতি অন্যরকম দেখছি, কোথা থেকে কী হলো কিছু বুঝতে পারছি না।

-নওশাদের এরেস্ট হওয়ার কথা বলছো?

-ওটাও আবার ভাবীর হসপিটালাইজড হওয়ার ব্যাপারটাও।

-অপর্ণা ভাবী হাসপাতালে? কী হয়েছে?

-নওশাদ লোক পাঠিয়েছিল। অনেক কাহিনী এসব, দেখা করে বলবোনি। আপাতত আমার ভাবীর সাথে দেখা করা প্রয়োজন। আমি একবার ভাবীর সাথে কথা বলতে চাই।

-মাথা খারাপ তোমার? এখন এই অবস্থায় তুমি ভাবীর ওখানে যাবে? ওনার বাড়ির লোকজনের মানসিক অবস্থা ভাবো একবার! তুমি জানো তোমার দোষ নেই কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে তারা কি বুঝবে সেটা? স্বাভাবিকভাবেই তাদের রাগটা তোমার উপর এসে পড়বে।

-আমার কি তবে সত্যিই যাওয়া উচিত না একবার?

-না, এখন তো ভুলেও না। ভাইয়া কখনোই তোমাকে যেতে দিবে না দেখো। সো ঐ চিন্তা বাদ দাও।

-আচ্ছা। ঘুম থেকে উঠেছো কখন?

-ঘুমালাম কখন? সারা রাত টেনশনে রেখে ঘুমের খোঁজ নিচ্ছো! এখন ঘুমাবো।

-আচ্ছা ঘুমাও। আমি বাচ্চাদের নাস্তা দিয়ে এসেছি, ওদের কাছে যাবো।

-তুমিও খেয়ে নাও। পরিস্থিতি একটু ঠিকঠাক হলেই আমি ভাইয়ার সাথে দেখা করতে যাবো।

-আচ্ছা।

চিত্রলেখা একরাশ লজ্জার ভারে নুইয়ে পড়ে কলটা কেটে দিল। রঙ্গনের কথাগুলো তার মাথায় তখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। আসলেই রঙ্গনের কথাগুলো যুক্তিসঙ্গত। এমন সে কেন চিন্তা করলো না? চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে নিশ্চিন্তের হাসি ফুটে উঠে।

________________________________

অর্ণব বাড়ি ফিরলো রাত নয়টা নাগাদ। বাড়িতে দীর্ঘসময় সে থাকতে পারতো না আজ। অপর্ণার মৃত্যুতে বাইরে থেকে আবেগহীন ভাব দেখালেও মনে মনে সে কতটা ব্যথিত তা সে বোঝাতে পারবে না কাউকেই। অপর্ণার প্রতি তার মনে যে ক্ষীণ ভালোবাসা এখনো বহাল তার বহিঃপ্রকাশ সে কিভাবে ঘটাবে? অপর্ণার প্রতি তো তার কোনো অধিকার অবশিষ্ট নেই। দুজনের সম্মতিতেই এ সম্পর্ক শেষ হয়েছে। সবাই ধরেই নিয়েছে এ সম্পর্কে আর ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই তবে একটা সইয়েই কি ভালোবাসা চিরতরে মুছে ফেলা যায়? দীর্ঘশ্বাস ফেললো অর্ণব। অতঃপর কলিং বেলটা বাজালো। তড়িৎ গতিতে দরজা খুললো চিত্রলেখা। সে যেন অর্ণবের প্রতীক্ষাতেই বসে ছিল। অর্ণব কিছু না বলে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো।

-ভাইয়া!

-বল।

-এত দেরি হলো যে?

-কাজে ব্যস্ত ছিলাম।

-দোকান থেকে কল এসেছিল। তুমি যাওনি দোকানে। তবে ব্যস্ততা কোথায় ভাইয়া? হাসপাতালে গিয়েছিলে বলতে পারো আমায়। আমি আর যেতে চাইবো না। আমি বুঝেছি আমার এখন যাওয়া উচিত না।

-অপর্ণা আর নেই লেখা। গতকাল রাতেই ও মারা গেছে। ওর জানাযা ছিল ভোরে।

চিত্রলেখার হাত পা শিরশির করে উঠলো। মাথাটা ঠিক চক্কর দিয়ে উঠলো নাকি ভূমিই কম্পিত হলো বুঝতে সময় লাগলো তার। নিজের ভাবীর প্রতি তার হয়তো জমানো রাগ ছিল ঠিকই তবে তার মৃত্যু কামনা সে কোনোক্ষণেই করেনি। আজ তার মৃত্যুর খবর চিত্রলেখার অন্তর কিছুক্ষণের জন্য হলেও নাড়িয়ে তুললো। চিত্রলেখা বারবার নিঃশ্বাস নিয়ে একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। বাচ্চা দুটো ঘুমাচ্ছে। ওদের কথা ভেবে চিত্রলেখার চোখ ভিজে এলো।

-লেখা, বাচ্চাদের জানাস না এসব। আমিও জানিনা কিভাবে কী বোঝাবো ওদের। আমি শুধু চাই আমার বাচ্চারা কোনোরকম মানসিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে না যাক। ওদের দায়িত্বটা আমি ভালোভাবেই পালন করতে চাই।

-আ..আচ্ছা ভাইয়া। তুমি বোসো, আমি খাবার বাড়ছি। বাচ্চারা খেয়ে ঘুমিয়েছে।

-আমি খাবোনা। তুই খেয়ে নিস।

অর্ণবের রক্তিম চোখ অনেককিছু জানিয়ে দিল চিত্রলেখাকে। চিত্রলেখার চোখের কোণেও জলেরা ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকলো। রূপসা ও রাদিফের ঘরের দিকে এগোলো সে। ঘর অন্ধকার। চিত্রলেখা গুটি গুটি পায়ে বাচ্চাদের বিছানার কাছে এসে বসলো। নোনা জল অবিরত চোখ বেয়ে গড়াচ্ছে তার। নিঃশব্দে কাঁদছে সে। রূপসা কী যেন বিড়বিড় করছে। চিত্রলেখা চোখের জল মুছে রূপসার মুখের কাছে খানিকটা এগোলো। রূপসা অস্পষ্টভাবে কিছু বলছে। চিত্রলেখা কিছু বুঝতে না পারলেও মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলো।

“মা..আমি আর দুষ্টুমি করবো না মা…আ..আমার কাছে..ফিরে আ..আসো মা। ভাইয়া তোমাকে ছাড়া কান্না করেছে মা..মা তুমি আসবেনা? বাবার উপর রাগ করেছো? আমাদের কী দোষ মা? আমরা ভালো হয়ে থাকবো মা…আমাদের কাছে ফিরে আসো মা। দেখো আমি গুড গার্ল হয়ে গেছি মা…”

রূপসার কথার ভারটুকু কতখানি তা চিত্রলেখার বুঝতে বাকি নেই। অপর্ণার মৃত্যুর খবর এই বাচ্চাগুলোকে কিভাবে জানাবে সে? মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করলে কী-ই বা জবাব দিবে সে? অদ্ভুত এক দোটানায় সৃষ্টিকর্তা তাকে ফেলেছে। প্রাপ্তির খাতা পূরণের আগেই অপ্রাপ্তির খাতা ভরে উঠছে। এ বিপরীতকরণের শেষ কোথায়?

চলবে…

[আসসালামু আলাইকুম। কথা বলতে চেয়েছিলাম এই গল্পের সিজন টু আসা নিয়ে। আমি আসলে এখন আমার আপুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছি, এখানে গল্প লেখার সময় বের করতেই হিমশিম খাচ্ছি তবে সিজন টু নিয়ে আলাপ করবো আমি। ইনশাআল্লাহ সোমবারে বাসায় ফিরে এটা নিয়ে আপনাদের সাথে আলাপ করা হবে। আর দুঃখিত গতকালকের মন্তব্যগুলো আমি পড়েছি তবে রিপ্লাই করতে পারিনি। ধন্যবাদ আপনাদের মতামতের জন্য 💚]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here