চিত্রলেখার_কাব্য একবিংশ_পর্ব ~মিহি

0
608

#চিত্রলেখার_কাব্য
একবিংশ_পর্ব
~মিহি

“চিত্রলেখা ভয় পেয়ো না, আমরা তোমার আশেপাশেই থাকবো। পুলিশের দুজন অফিসার সবসময় তোমার দিকে নজর রাখছে। তুমি চুপচাপ শুধু ওখানে যাবে এবং যতটা সম্ভব সত্যি কথা ওর মুখ থেকে বের করাবে।” তৌহিদের কথায় কেবল মাথা নাড়লো সে। এমনিতে যথেষ্ট সাহসী হলেও এ মুহূর্তে অনেকটা ভীত হয়ে পড়েছে সে। দীতি কি একা আসবে? কোনো পরিকল্পনা নিশ্চয়ই আছে তার! চিত্রলেখা জোরে শ্বাস নিয়ে সামনে তাকালো। তৌহিদ তখনো ফোনে তাকে নানারকম পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। চিত্রলেখা সেসব এখন কানে নিচ্ছে না। তার যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রাখতে হবে। চোখ বন্ধ করলো সে। ‘কায়া’ সত্তাটা যেন তার সামনে প্রতীয়মান হলো।

-ভয় পাচ্ছো চিত্রলেখা? তুমি যা করছো নিজের পরিবারের জন্য, ভয়কে স্থান দিও না মনে।

-আমি কি পারবো?

-তুমি অবশ্যই পারবে।

চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো। সে পারবে, তাকে পারতেই হবে। সামনে তাকালো চিত্রলেখা। নেকাবে আবৃত সমস্ত শরীর তার। দীতির তাকে চেনার কথা না, আর এ অবস্থাতে তো মোটেও না।

দীতি নির্ধারিত সময়েই উপস্থিত হলো। ক্যাফের পেছনের অংশটা নির্জন তবে খানিকটা বন-জঙ্গলের মাঝখানে একটা রাস্তার মতো সামনে এগিয়েছে। জঙ্গলের ঝোপঝাড়ে তৌহিদ এবং দুজন পুলিশ লুকিয়ে আছে। রাস্তার একপাশে একটা ডাকবাক্সের মতো বাক্স রাখা। চিত্রলেখা সেখানেই অপেক্ষা করতে বলেছিল দীতিকে। দীতি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। দীতিকে অপেক্ষা করতে দেখে চিত্রলেখা তাকে কল দিল। দীতি তৎক্ষণাৎ রিসিভ করলো।

-আ..আমি এসেছি, আপনি কোথায় আছেন?

-টাকার ব্যাগ বাক্সে রেখে সামনে এগোও।

-আপনি মেয়ে?

-ছেলে মনে হয়? চুপচাপ সামনে আয়।

চিত্রলেখার ধমক শুনে দীতির ভয় বাড়লো। তার হাত পা কাঁপতে লাগলো। এ মুহূর্তে চিত্রলেখারও মনে হলো এ মেয়ে একা কিছু করতে পারবে না কখনোই, অবশ্যই এর পেছনে কেউ আছে। দীতি সামনে এগোলো। চিত্রলেখা তার মুখোমুখি দাঁড়ালো।

-তো দীতি, তিন লাখ আছে তো?

-হ..হ্যাঁ, এখন প্রমাণটা ফেরত দিন আমাকে।

-দাঁড়াও, এত সহজে না! অনিক মাহমুদকে তো তুমি একা ফাঁসাওনি, সাথে যে ছিল সে কোথায়?

-আ..আপনি কী করে জানলেন?

-চুপচাপ প্রশ্নের উত্তর দাও!

-ওনার কথা বললে উনি আমাকে মেরে ফেলবে, উনি ভয়ঙ্কর লোক। দয়া করে আপনি টাকাটা নিয়ে আমাকে প্রমাণ দিয়ে দিন।

-এটেম্পট টু রেপের যে মিথ্যা কেস করেছো, তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে তো ভালোই টাকা পাবে। আরো দুই লাখ তোমার কাছে চাওয়াই যায়, কী বলো?

-দেখুন আপনি বাড়াবাড়ি করছেন। আপনি তিন লাখ বলেছেন, আমি দিয়েছি। এখন আমাকে প্রমাণ দিন।

-অনিক মাহমুদকে ফাঁসিয়ে কী লাভ হলো? বড়সড় পজিশনের কাউকে ফাঁসালে ক্ষতিপূরণ বেশি পাইতা!

-আমার কিছু করার ছিল না। তাছাড়া অনিক সহজ সরল, ওকে ফাঁসানো সহজ ছিল! এখন আপনি প্রমাণ দিবেন?

চিত্রলেখা একটা ছোট বক্স দীতির দিকে বাড়িয়ে দিল। দীতি বক্সটা খুলে একটা মেমোরি কার্ড পেলো।

-এটাতে তোমার কীর্তিকলাপের রেকর্ডিং আছে। অনিকের রুমের হিডেন সিসিটিভি ফুটেজ এটা। এখন চুপচাপ এখান থেকে যাও। আশেপাশে তাকাবে না আর পিছনে তো ভুলেও না।

দীতি বোকার মতো মাথা নাড়লো। সে চটজলদি দ্রুত পায়ে মেমোরি কার্ডটা নিয়ে চলে যেতেই তৌহিদ এবং অন্যান্য পুলিশ অফিসার বাইরে এলো। এতক্ষণের দৃশ্য ভিডিও করেছে তারা। আর চিত্রলেখা দীতির বলা সমস্ত কথা ফোনে রেকর্ড করেছে। আপাতত তাদের কাজ শেষ। বাকিটা কাল কোর্টে দেখা যাবে।

যাবতীয় প্রমাণাদি নিয়ে বাড়িতে ফেরার উদ্দেশ্যে বের হলো চিত্রলেখা এবং তৌহিদ।

-আচ্ছা ভাইয়া, আমাদের কাছে তো কোনো সিসিটিভি ফুটেজ ছিল না, তাহলে ঐ মেমোরি কার্ডটাতে কী আছে?

-ইমরান হাশমির গান।

-কীহ!

-আরে মজা করছি, ঐটা একটা ভাইরাসযুক্ত মেমোরি কার্ড। ওটা যে ডিভাইসে তুলবে সেটা আর অনই হবে না। পরে আবার যখন তোমাকে কল করবে তুমি বলবে কোর্টের পর দেখা করতে। ততক্ষণে তো সব প্রমাণ হয়েই যাবে।

-আচ্ছা!

চিত্রলেখাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে তৌহিদ চলে গেল। চিত্রলেখা বাড়িতে ঢুকতেই অপর্ণার মুখোমুখি হলো। তৌহিদ যে তাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে এটাও দেখেছে সে।

-তৌহিদ তোকে কেন নামিয়ে দিয়ে গেল? কোথায় গিয়েছিলি ওর সাথে?

-ভাবী, কাজ ছিল। সবসময় সন্দেহ করা বন্ধ করো।

-তোর এক ভাই জেলে, তার উকিলের সাথে একা কী কাজ তোর?

-অদ্ভুত তো! কাজ থাকতে পারেনা? অনিক ভাইয়ের বিষয়েই কথা বলতে গিয়েছিলাম।

-অন্ধকে হাইকোর্ট চিনাও? কী ফস্টিনস্টি শুরু করছিস? খবরদার আমার বাড়িতে এসব চলবে না।

-বাড়ি তোমার একার না ভাবী।

অপর্ণার ইগোতে লাগলো কথাটা। চুপচাপ ঘরের দিকে এগোলো সে। চিত্রলেখা বিরক্ত হয়ে সাথীর ঘরের দিকে পা বাড়ালো। এ বাড়িটা তার আর বাড়ি মনে হয়না। অপর্ণার প্রতিনিয়ত চেঁচামেচি, আগে সহ্য করতো কিন্তু একটা মানুষ কতই বা সহ্য করতে পারে যখন কিনা প্রতি পদে তার চরিত্রের উপর আঙুল তোলা হয়!

_________________

অর্ণব মাত্র বাড়িতে ফিরেছে। ব্যবসা নিয়ে একরকম দুশ্চিন্তায় আছে সে, ব্যবসার কাজে মনই দিতে পারছে না। সন্ধ্যের আগে আগে অনিকের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। অনিকের শরীর দুর্বল এখনো। ক্লান্ত শ্রান্ত দেহে মাত্র বাড়ির চৌকাঠে পা রেখেছিল সে। অপর্ণা তৎক্ষণাৎ গজগজ করতে করতে এলো।

-তোমার বোন বাড়িটাকে কী পেয়েছে? কোঠা? যখন তখন যাকে ইচ্ছা তাকে নিয়ে ঘুরবে! আমাদের তো মান সম্মান আছে, ওর কি একটুও লজ্জা হয়না?

-কী হয়েছে অপর্ণা? বাড়িতে না ঢুকতেই কী শুরু করেছো?

-তোমার বোন তৌহিদের সাথে রঙঢঙ করে বেড়াচ্ছে। আমি জিজ্ঞাসা করাতে বলেছে ওর বাড়ি, ওর যা ইচ্ছে করবে।

এমনিতেই সারাদিনের ক্লান্তিতে অর্ণবের মেজাজ সপ্তম আসমানে ছিল। তার উপর অপর্ণার কথাবার্তায় আরো বিরক্ত হয় সে। অপর্ণার উপর জমে থাকা ক্রোধ আগ্নেয়গিরি মতো বেরিয়ে আসতে চায়। চেঁচিয়ে চিত্রলেখাকে ডাকে সে। বড় ভাইয়ের ডাক শুনে চিত্রলেখাও ধড়ফড় করে বসার ঘরে আসে। অর্ণবের অগ্নিদৃষ্টি দেখে খানিকটা ভীত হয়ে পড়লো সে। অপরদিকে অর্ণবের অপর্ণার উপর করা রাগের ঝাঁঝ গিয়ে পড়লো চিত্রলেখার উপর।

-তুই তৌহিদের সাথে বেরিয়েছিলি?

-হ্যাঁ ভাইয়া কিন্তু …

-ও তোকে রেখে গেছে?

-হ্যাঁ।

-তুই তোর ভাবীকে বলেছিস তোর বাড়ি, যা ইচ্ছে করবি তুই!

-ভাইয়া তুমি ভুল বুঝছো!

চিত্রলেখা আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। অর্ণবের রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটলো সজোরে একটা চড়ের মাধ্যমে। চিত্রলেখা ছিটকে দূরে সরে গেল। যে বড় ভাই তাকে আগলে রাখতো, আজ সে-ই তার গায়ে হাত তুলেছে। সাথীও তৎক্ষণাৎ ছুটে এলো সেখানে। অর্ণবের চোখ দিয়ে তখন আগুন ঝরছে।

-এত সাহস তোর! ছেলে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে বাসায় এসে দাপট দেখাস? কী সম্পর্ক তোর তৌহিদের সাথে?

চিত্রলেখা কিছু বললো না। কষ্টে, যন্ত্রণায় সে কথাও বলতে পারছে না। সাথী বুঝতে পারছে সবটাই। সে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই চিত্রলেখা হাতের ইশারায় তাকে আটকালো। অর্ণবের এই রূপের ষাথে কেউই পরিচিত নয়। অপর্ণাও ভাবেনি অর্ণব এমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে তবে তার বিষয়টা দেখতে ভালোই লাগছে।

-তোর তৌহিদের সাথে কী সম্পর্ক বল!

-কোনো সম্পর্ক নেই।

-আমাকে ছুঁয়ে তুই প্রতিজ্ঞা কর আমি যার সাথে বিয়ে ঠিক করবো, তুই তাকেই বিয়ে করবি!

চিত্রলেখা পাথরের ন্যায় জমে গেল। এতটা অবিশ্বাস! চোখ ছলছল করে উঠলো তার তবুও অর্ণবকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলো সে। পরক্ষণেই নিজের ঘরের দিকে ছুটলো। অর্ণবের ব্যবহার তাকে আজ ভেঙে চুরে ফেলেছে। আজ প্রথমবার অর্ণবও তাকে উপলব্ধি করালো সে তার সৎ বোন। চিত্রলেখার অশ্রুকণাগুলোও যেন চোখ বেয়ে গড়াতে চাইলো না, অভিমান হয়ে বুকে জমা থাকতে চাইলো। যন্ত্রণা এবং প্রচণ্ড মনোকষ্টে চিত্রলেখার দুর্বল সত্তাটা আবারো যেন সক্রিয় হতে চাইলো। চুপচাপ, নিরীহ, দুর্বল চিত্রলেখা ফিরলো বোধহয় তার মধ্যে।

চলবে…

[বড় করে দেওয়ার কথা ছিল তবে ফেসবুক অ্যাপের ঝামেলা নিয়ে বড় পর্ব পোস্ট করতে খানিকটা ভয়ই লাগলো, রেস্ট্রিকশনে না ফেলে দেয় আবার!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here