#চিত্রলেখার_কাব্য
চৌত্রিশতম_পর্ব
~মিহি
“দেখো অর্ণব, আমি লেখার জন্য একটা পাত্র দেখেছি। ওকে বিয়ে দাও। এভাবে আমরা এলাকায় থাকবো কিভাবে? বিকেল থেকে দশ-বারোজন এসে রসালাপ করে গেছে চিত্রলেখার ঘটনা নিয়ে। আমরা বাড়ির মানুষ জানার আগে সমস্ত এলাকা জেনে বসে আছে যে চিত্রলেখা একটা ছেলেকে হোস্টেলে এনেছিল। এ কথা আরো পাঁচকান হলে কী হবে ভাবতে পারছো তুমি?” অপর্ণার কথাগুলো কাকের বিরক্তিকর ডাকের ন্যায় শোনাচ্ছে তবে কথার যৌক্তিকতা রয়েছে। চিত্রলেখার উপর অর্ণবের রাগ যেন ক্রমশ বাড়ছে। সৎ হওয়া সত্ত্বেও নিজ বোন অপেক্ষা একটুও কম যত্ন কি সে করেছিল? করেনি তো! হঠাৎ করে তার বোন এতটা কী করে বদলে গেল? অর্ণব একটা কঠোর সিদ্ধান্ত নিল।
-অপর্ণা, ছেলেকে আগামীকালই আসতে বলো। আমার পছন্দ হলে কালকেই বিয়ে পড়াবো। ছেলের নম্বর দাও, আমি কথা বলবো।
-ছেলেকে তুমি চেনোই, কথা বলতে হবে না। আমি জানিয়ে দিব, কাল দেখো।
-বেশ।
-লেখাকে কি জানাবো?
-না! ওর জানার প্রয়োজন নেই।
অর্ণব ঘুমোতে গেল। অপর্ণা অর্ণবকে খেতে ডাকলো না আর। অর্ণবের না খাওয়াটা খাবার টেবিলে খানিকটা প্রভাব তো ফেলবে। আজ আবার অনিক নেই বাড়িতে। সে থাকলে অবশ্য বিষয়টা জটিল হতো। বোনের প্রতি তার দরদ ইদানিং বেড়েছে। অনিক একটা ইন্টারভিউয়ের জন্য ঢাকায় বন্ধুর বাসায় গেছে। তার ফিরতে কমপক্ষে দুদিন তো লাগবেই। এ সুযোগে নওশাদের বিয়ের প্রস্তাবটা পাকাপোক্ত হয়ে গেলে আর চিন্তার বালাই নেই। নওশাদ লোকটা টাকার কুমির। একবার শুধু বিয়েটা হোক। অপর্ণার ঠোঁটের হাসি ক্রমশ প্রশস্ত হয়। চিত্রলেখার এখন ঘর থেকে বের অবধি হতে পারবে না। বিকেল থেকে যত মহিলা এসে তার চর্চা করে গেছে, লাজ থাকলে এতক্ষণে গলায় দড়ি বেঁধে ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়া উচিত। তবে সাথী বোধহয় মেয়েটাকে একা ছাড়বে না আজ। আজ রূপসাও চিত্রলেখার কাছে যায়নি। সেও ফুপুর কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে। বিষয়টা বেশ মজা লাগছে অপর্ণার। কূটবুদ্ধি থাকলে আসলেই দুনিয়া জেতা যায়।
_____________________________
-লেখা একটু খেয়ে নে।
-খাওয়ার মতো জায়গা অবশিষ্ট নেই ভেতরে ভাবী।
-আরো শখ আছে সহ্য করার? আমি নিশ্চিত এই কাজটাও তার! একটা মহিলা কতটা নির্লজ্জ …
-ভাবী ছাড়ো, পরচর্চা করে কী লাভ?
-তোর মধ্যে কি কিছুই নাই লেখা? মানে সিরিয়াসলি? তুই যে ঐ মহিলাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলি তার ফল দেখতেছিস? নাকি কানা হয়ে গেছিস?
-আল্লাহর উপর ভরসা রাখো ভাবী। সময়টা তার ভালো চলতেছে, আমার সময় কি আসবে না? আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। আমার একটু সাহায্য প্রয়োজন ভাবী। এখন আমার কাছে আর কোনো পথ খোলা নেই।
-কী হয়েছে? বল।
-ভাইয়া আমার ফোন নিয়ে নিয়েছে। আমার একবার রঙ্গনের সাথে কথা বলতে হবে ভাবী। আমি এখন ওকে এটুকু জানাতে চাই সে যদি আমার অপেক্ষা করতে পারে তবেই যেন আমার আশা করে। আমি এখন আমার স্বপ্নের সাথে আর প্রতারণা করতে পারবো না ভাবী।
-দেখ লেখা, তোকে কিছু কথা বলি। রঙ্গনের জন্ম লন্ডনে যতদূর আমরা জানি। ফুপু হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে ফুপার সাথে সেখানে পাড়ি জমান। বছর ঘুরে ফিরে আসেন রঙ্গনকে কোলে করে। যাওয়ার আগেও আমরা এসবের কিছু জানতাম না। রঙ্গনের জন্মের সময়কার কোনো ঘটনাই আমরা জানিনা। পরিবারের সবাই মুখে বিশ্বাস করে রঙ্গন আমার ফুপুর চেলে কিন্তু আদতে কেউই তা মানেনা। তুই বুঝতে পারছিস আমি কী বলতে চাইছি?
-ভাবী, আমি রঙ্গনের মধ্যে নিজেকে দেখতে পাই। আমার শৈশবটা যেন ওর জীবনের প্রতিচ্ছবি। তবে এসব নিয়ে আমি কিছু বলবো না। আমায় একটু সময় দাও। যদি সঠিক সময় আসার পর তোমরা অমত জানাও আমি এ সম্পর্কে আগাবো না।
-নে আমার ফোন থেকে কল কর কিন্তু সাবধান। ঐ ডাইনিটা জানলে আবার কেলেঙ্কারি বাঁধাবে।
চিত্রলেখা কিছু বললো না। চুপচাপ ফোনটা নিয়ে রঙ্গনের নম্বর ডায়াল করলো। মনে মনে খুব করে চাইলো রঙ্গনের নম্বরটা যেন খোলা থাকে। চিত্রলেখার মনের আশা পূরণ হলো না। রঙ্গনের নম্বর এখনো বন্ধ। চিত্রলেখার চোখ ছলছল করে উঠলো। প্রয়োজনের সময় কাউকে পাশে না পাওয়ার যন্ত্রণাটা কি এমনই? রঙ্গনের উপর বিশাল অভিমান জন্মালো তার। রঙ্গনের নম্বরে একটা টেক্সট করে রাখলো চিত্রলেখা,
“ফোন অন করা মাত্র এই নম্বরে কল দিও। আমার নম্বরে কোনো কল বা মেসেজ করার দরকার নেই।
(রঙ্গনা)”
অতঃপর ফোনটা সাথীকে ফেরত দিল সে।
-নম্বর বন্ধ?
-হুম।
-সকালে চেষ্টা করিস। তুই ঘুমা এখন। খেতে বলরাম খেলিও না।
-তুমি যাও আমি ঘুমাচ্ছি।
-তুই ঘুমা, আমি এখানেই থাকবো আজ।
চিত্রলেখা কথা বাড়ালো না। সে বুঝতে পারছে তার ভাবী তাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছে কিন্তু এ ভয়টা অযৌক্তিক। সে এত সহজে মরে যাবে না। এখনো তো অনেক কিছু বাকি আছে, অনেককে তাদের জায়গা চেনাতে হবে। চিত্রলেখার চোখ বন্ধ করলো।
_______________________
-ভাবী, সকাল সকাল এত রান্নাবান্না? কেউ আসবে?
-হ্যাঁ। তুই তাড়াতাড়ি গোসল করে তৈরি হ।
-মানে?
-সাথীকে বল তোকে রেডি করিয়ে দিতে। তোকে আজ দেখতে আসবে!
-আমাকে দেখতে আসবে? আমি তো জানিনা কিছুই এসবের।
-তোর ভাইয়া নিষেধ করেছে জানাতে, যা তৈরি হ তুই তাড়াতাড়ি।
চিত্রলেখার কী পরিমাণ অসহ্য লাগছে সে ব্যক্তও করতে পারবে না। তার ভাই শেষমেশ এতটাই অবিশ্বাস করলো তাকে? চিত্রলেখা সাথীর কাছে এসে বসলো।
-ভাবী, এসব কী হচ্ছে?
-আমিও সকালে উঠে জানলাম। সঙ সেজে কিছুক্ষণ বসে থাকিস, রিজেক্ট করে দিবনি আমরা পরে।
-আমার মন কু-ডাকছে ভাবী। প্রচণ্ড ভয় হচ্ছে আমার।
সাথী কিছু বলার আগেই তার ফোনটা বেজে উঠলো। চিত্রলেখার বুক ঈষৎ কেঁপে উঠলো। রঙ্গন কল করেছে? সত্যিই রঙ্গন কল করেছে। চিত্রলেখা ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই তার গলা মিইয়ে আসলো। সে যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল।
-রঙ্গন কোথায় ছিলে তুমি? একটাবার আমার কল রিসিভ করা যেত না?
-স্যরি রঙ্গনা। আশ্রমে আগুন লেগেছিল গতকাল রাতে। ফোনের দিকে একদম নজর দিতে পারিনি।
-আশ্রমের সবাই ঠিক আছে?
-হ্যাঁ। কিছু জিনিসপত্রের ক্ষতি হয়েছে এই আর কী। তুমি বলো, কোনো সমস্যা হয়েছে?
-আমি সবকিছু এখন বলতে পারবোনা। তুমি শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবে?
-তুমি যত সময় বলবে আমি অপেক্ষা করবো রঙ্গনা।
-আমি সিরিয়াস রঙ্গন। হতে পারে এটাই আমাদের শেষ কথা, এরপর ঠিক কত বছর পর আমি তোমার সাথে আবার কথা বলবো তা জানা নেই।
-লেখা কী হয়েছে? আমি অপেক্ষা করতে রাজি আছি কিন্তু কী হয়েছে সেটা তো বলবে।
-আমি জানাবো তোমাকে। এখন যে ঝামেলা দুয়ারে এসেছে, তাকে বিদায় করতে হবে। রাখো।
চিত্রলেখা ফোন কান থেকে নামিয়ে রাখলো। সাথীর চোখেমুখে চিন্তার ভাঁজ।
-তোর রঙ্গনকে বলে দেওয়া উচিত। আল্লাহ না করুক অন্য কারো থেকে এসব জেনে তোকে ভুল বুঝলে?
-আমি রঙ্গনকে বিশ্বাস করি ভাবী। সে যদি অপেক্ষা করতে পারে তবে বিশ্বাসও রাখতে পারবে।
-তুই তৈরি হ। ছেলে আসলো বলে। এভাবে গেলে ভাইয়াও রাগ করবেন। বুঝতেই পারছিস বাড়ির যে অবস্থা!
চিত্রলেখা মাথা নেড়ে সায় দিল। সাথীর মেলে রাখা শাড়িটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো সে। পরিস্থিতি বিপরীতে চলার বোধহয় কোনো সীমা অবশিষ্ট নেই। পৃথিবী কি তার বিপরীতে ঘুরছে এখন?
সবুজ বর্ণের শাড়িটা গায়ে মেলে বেরোলো চিত্রলেখা। অপর্ণা তাড়া দিচ্ছে। ছেলে নাকি আসলো বলে। চিত্রলেখা খানিকটা বিরক্ত হয়েই রান্নাঘরে ঢুকলো। অপর্ণার শকুনের মতো কণ্ঠটা তার কানে ঠোকর মারছে যেন।
-ভাবী, কিছু হেল্প লাগবে?
-হ্যাঁ, ছেলে আসছে বুঝছিস! এই চায়ের কাপটা নিয়ে যা। ছেলে একাই আসছে, এক কাপই নিয়ে যা।
-আচ্ছা।
চরম অনিচ্ছাসত্ত্বেও চিত্রলেখা চায়ের কাপটা নিয়ে বসার ঘরের দিকে এগোলো। শাড়ির কুঁচি বারবার পায়ের সাথে ধাক্কা খাচ্ছে। বাধ্য হয়েই মাথা নিচু করে হাঁটতে হচ্ছে চিত্রলেখার। বসার ঘরে আসতেই চেনা এক কণ্ঠস্বরে বুক কেঁপে উঠলো চিত্রলেখার। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো সেই নরপশুর দৃষ্টি! সাথে সাথে চিত্রলেখার হাত থেকে চায়ের কাপ মেঝেতে পড়ে মুহূর্তে চুরমার হয়ে গেল।
চলবে…