#চিত্রলেখার_কাব্য
পঞ্চম_পর্ব
~মিহি
“আপনি একা বসে আছেন যে?” রঙ্গনের প্রশ্নে চমকে গেল চিত্রলেখা। অনেকক্ষণ এক ধ্যানে বসে থাকায় খানিকটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল সে। আচমকা রঙ্গন প্রশ্ন করাতে খানিকটা অপ্রস্তুতই হয়ে পড়লো সে।
-না আসলে আন্টি বললেন অহম কী যেন কাজ করছে, একটু পর আসবে।
-আমি আপনাকে আধঘণ্টা আগে রেখে গেলাম, বাইরে থেকে কাজ সেরে চলেও আসলাম অথচ আপনার ছাত্রের কাজ শেষ হলো না! থামুন আমি দেখে আসি কী করছে।
-আচ্ছা।
রঙ্গন বুঝতে পারছে তার মা ইচ্ছে করেই চিত্রলেখাকে এখানে বসিয়ে রেখেছে। তবে এটা নিয়ে মায়ের সাথে তর্কে জড়াতে চায় না সে। চিত্রলেখার জন্য মায়ের সাথে ঝগড়া করা মানেই অশান্তি সৃষ্টি করা যেখানে মা মেয়েটাকে পছন্দই করে না, তার চেয়ে বরং অহমকে খুঁজে বের করে এখানে পাঠানোটা ভালো।
রঙ্গন চলে যাওয়ার পর চিত্রলেখা ফোনের দিকে তাকালো। ভাবীর আইডিতে লগইন করেছে সে। তার ফেসবুক আইডি এখনো খোলা হয়নি। কলেজ গ্রুপে কী যেন একটা নোটিশ দিয়েছে। নোটিশ সিন করতেই সুবহার আইডি থেকে মেসেজ আসলো।
-লেখা? কাল কলেজে সিনিয়রদের বিদায় অনুষ্ঠান, যাবি?
-মনে হয় না, গেলেই আমাদের দিয়ে সব কাজ করিয়ে নিবে।
-আরে, তুই এত বোরিং ক্যান! প্লিজ আয়, মজা হবে।
-কাজ করতে আবার কিসের মজা?
-তুই আসবি কি না?
-আচ্ছা দেখি, রাতে কল করে জানাবোনি। ওহ হ্যাঁ, বড় ভাবী নতুন ফোন কিনে দিয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপে নক দিচ্ছি তোকে দেখ।
-আচ্ছা রাতে দেখবোনি, এখন কাজ আছে।
চিত্রলেখা একবার দরজার দিকে তাকালো, অতঃপর আবারো নিরাসক্তের মতো ফেসবুক স্ক্রল করতে লাগলো। ‘পিপল ইউ মে নো’তে একজন পরিচিত মুখ দেখা গেল। ‘সিয়াম শাহরিয়ার’ নামটা স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে। সাদারঙা শার্টটা মানিয়েছে বেশ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসটার সাথে হেলান দিয়ে যেন নিজেকে ভারমুক্ত মনে করছে। চিত্রলেখার হাত কাঁপছে। একবার ইচ্ছে হচ্ছে ব্লক করে ফেলতে, আবার পরক্ষণেই ইচ্ছে করছে আইডিটাতে ঢুঁ মারতে। চিত্রলেখা দুইটার একটাও করলো না। এটা ভাবীর আইডি, অযথা বেশি ঘেঁটে লাভ নেই। হোয়াটসঅ্যাপ খুলে সুবহাকে টেক্সট করলো চিত্রলেখা। আর কিছু করার আগেই পায়ের শব্দ পেল। দরজার দিকে তাকালো সে। অহম মলিন মুখে এগিয়ে এসে তার সামনে বসলো।
-স্যরি ম্যাম, গেম খেলতে খেলতে বুঝতেই পারিনি আপনার আসার টাইম হয়েছে।
-দেখো, শিক্ষককে বসিয়ে রাখা অবশ্য বেয়াদবি তবে তুমি যেহেতু নিজের ভুল বুঝতে পেরেছো এটাই যথেষ্ট। এখন বলো সমস্যাগুলো খুঁজে বের করেছো কিনা।
-আমার সবকিছুই সমস্যা লাগছে। পড়ছি কিন্তু বুঝতে পারছি না পড়া ঠিক হচ্ছে কিনা।
-এটার একটা বুদ্ধি আছে। এখন থেকে আমি প্রতিটা চ্যাপ্টার বুঝিয়ে পরেরদিন সেটার পরীক্ষা নিব। পরীক্ষা নিলেই তোমার সমস্যা বের করা যাবে।
অহম মাথা নাড়লো। চিত্রলেখা পড়ানো শুরু করলো। দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রঙ্গন চিত্রলেখার কথাগুলো শুনে মুচকি হাসলো। মেয়েটা বয়সের তুলনায় একটু বেশিই ম্যাচিউর। রঙ্গন দরজার কাছ থেকে সরে গেল। মায়ের চোখে পড়লে তার বিপদ বাড়বে। চিত্রলেখার উপস্থিতি তার বেশ ভালোই লাগে। মেয়েটার মধ্যে একটা পজিটিভ এনার্জি আছে। যতক্ষণ আশেপাশে থাকে, পজিটিভিটি ছড়ায়। অবশ্য রঙ্গনের পজিটিভিটির খুব প্রয়োজন। ভার্সিটি লাইফ খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। বন্ধুত্বের বিচ্ছেদটা অন্যান্য বিচ্ছেদ থেকে বেশি যন্ত্রণাদায়ক। রঙ্গন এই দুঃসহ মুহুর্তটাই পার করছে। আচমকা সব বন্ধুদের দূরে সরে যাওয়া তার জন্য ধাক্কার মতো। বন্ধু বলতে তার জীবনে দুইজনই ছিল, অবনী আর রাহাত। অদ্ভুতভাবে দুইজন প্রেমে জড়িয়ে পড়লো আর বন্ধুত্বটা ফিকে হয়ে আসলো। এখন জগতটা তাদের দুইজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। রঙ্গনের নিজেকে আউটসাইডার মনে হয়। তবে চিত্রলেখাকে দেখলে আবার ভালো লাগে, এই ভালো লাগার কোনো কারণ নেই। বন্ধুহীন জীবনে চিত্রলেখার সংস্পর্শ তাকে খানিকটা মানসিক শান্তি দেয়। তাই হয়তো আজ কিছু মুহূর্ত ধার চাইতে ছুটে গিয়েছিল সে।
_____________
পড়ানো শেষ হতেই চিত্রলেখার ফোনে সুবহার নম্বর থেকে কল আসে। চিত্রলেখা প্রথমে অবাক হলেও রিসিভ করলো।
-হ্যাঁ সুবহা বল।
-তুই কোথায় আছিস?
-একটা কাজে, কেন?
-এমনি তোর সাথে দেখা করবো। বল না কোথায় তুই? না দাঁড়া, তুই এড্রেসটা টেক্সট কর তো।
-কিন্তু কেন?
-যা বলছি কর।
চিত্রলেখা কিছু না ভেবে সুবহাকে রোড নম্বরটা জানিয়ে দিল। সুবহা পরক্ষণেই তাকে রিপ্লাই দিল,’ওখানেই থাক, আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি।’
চিত্রলেখা ঘড়ির দিকে তাকালো। পাঁচটা পঞ্চান্ন বাজে, সন্ধ্যে হয়েই এসেছে। এখন সুবহা কেন তার সাথে এখানে দেখা করতে আসতে চাইছে? বাড়িতে আসলেই পারতো। চিত্রলেখা বের হতেই ড্রাইভার তাকে ডাকলো।
-মা, চলো। যাবেনা?
-না আঙ্কেল। আজ আমার এক বান্ধবী আসবে, ওর সাথে যাবো। আপনার যেতে হবে না।
-কিন্তু একা কী করে? স্যার রাগ করবেন।
-অসুবিধা হবে না আঙ্কেল। আপনি চিন্তা করবেন না।
-আচ্ছা সাবধানে যেও মা।
চিত্রলেখা মাথা নেড়ে রাস্তার দিকে এগোতে লাগলো। ড্রাইভার মজিদ চাবি দেওয়ার জন্য ভেতরে প্রবেশ করতেই রঙ্গনের মুখোমুখি হলো।
-আরে আঙ্কেল, আপনি চিত্রলেখাকে রাখতে যাননি?
-উনার বন্ধু আসবে স্যার, বললাম রেখে আসি। আমার কথা তো শুনলেন না। রোডেই দাঁড়িয়ে আছেন হয়তো।
-আচ্ছা।
রঙ্গন একবার ভাবলো চিত্রলেখাকে রেখে আসবে। পরক্ষণেই ভাবলো বন্ধুকে ফেলে সে নিশ্চয়ই যেতে চাইবে না। তার চেয়ে বরং যতক্ষণ বাইরে আছে, ততক্ষণ কথা বলা যাক। রঙ্গন আশেপাশে তার মাকে খুঁজলো। পরক্ষণেই তার মনে পড়লো এখন তার মা আশফিনা আহমেদ অফিসের ফাইল নিয়ে ব্যস্ত। মাশরুর সাহেবের অনেকাংশ কাজ তিনি রি-চেক করেন। রঙ্গন নিশ্চিন্তে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার দিকে এগোলো। চিত্রলেখা তখন রাস্তার এ পাশে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। রঙ্গন টি-স্টল থেকে দুই কাপ চা নিলো। বিল পরিশোধ করে একটা কাপ চিত্রলেখার দিকে বাড়িয়ে দিল। আচমকা পেছনে ফিরতেই তাল সামলাতে কষ্ট হলো রঙ্গনের। গরম চায়ের খানিকটা ছিটে রঙ্গনের হাতে এসেও পড়লো।
-দুঃখিত! আপনি এখানে? লেগেছে কি আপনার? আমি আসলে খেয়াল…
-ওয়েট ওয়েট! আস্তে, এত সিরিয়াস কিছু হয়নি। নিন চা ধরুন।
চিত্রলেখা ভ্যাবাচাকা খাওয়ার মতো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ঠিক কী প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত বুঝতে পারলো না।
-কী হলো, চা কি নিবেন না?
-হুম, নিচ্ছি।
চিত্রলেখা চায়ের কাপটা নিল। মুখে বিরক্তির ভাঁজ তার। সুবহা কেন আসছে না? অযথা তার এখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
-আপনার বন্ধু কখন আসবে?
-বললো তো পনেরো মিনিট।
-ততক্ষণ ভেতরে বসলেই পারতেন।
-সমস্যা নেই তো এখানে।
-এই সন্ধ্যাবেলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে একা মেয়ে মানুষ, কেউ এসে হামলা করলে?
-আশেপাশে অনেক মানুষ আছে, কেউ না কেউ তো বাঁচাবে।
-আশেপাশের মানুষ কখনো আপনাকে বাঁচাবে না চিত্রলেখা, তারা দূরে দাঁড়িয়ে শুধু দেখবে।
রঙ্গনের গম্ভীর মুখ দেখে চিত্রলেখার হাসি পেল। কিছু মানুষকে গাম্ভীর্য মোটেও মানায় না। ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো সে।
-এত সিরিয়াস কথায় এই প্রতিক্রিয়া?
-আপনাকে আসলে গাম্ভীর্য ঠিক মানায় না।
-ভালো চিনেছেন আমাকে।
চিত্রলেখা আর কিছু বলার আগেই রাস্তার দিকে দৃষ্টি পড়লো তার। সুবহা এসেছে, সিয়াম ভাইয়ের বাইকে। রঙ্গন তখনো চিত্রলেখার পাশে দাঁড়িয়ে। চিত্রলেখা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। এই মেয়েটা সিয়াম ভাইকে কেন এনেছে! সুবহা বাইক থেকে নেমে চিত্রলেখার পাশে এসে দাঁড়ালো। রঙ্গন বুঝলো তার কিছু মুহূর্ত সে ব্যয় করে ফেলেছে। এখন চিত্রলেখার থেকে ক্ষণিকের বিদায় নেওয়াটাই সমীচীন।
-আপনার বান্ধবী এসে গেছে। স্যরি বান্ধবী সাহেবা, আপনি আসার আগে আপনার বান্ধবীকে এক কাপ চা অফার করেছিলাম, আপনার জন্যও এক কাপ বরাদ্দ। আমি এনে দিচ্ছি।
-না ভাইয়া, আমি চা খাইনা।
-ওহ, স্যাড! আচ্ছা গল্প করুন। আমি আসছি।
রঙ্গন অনিচ্ছাসত্ত্বেও সরে গেল। সিয়াম তখনো বাইকে বসে দৃশ্যগুলো অবলোকন করছে। রঙ্গনের উপস্থিতি তার গা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। রঙ্গন চলে যেতেই সিয়াম এগিয়ে আসলো।
-আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।
-তুমি তো ডুমুরের ফুল হয়ে গেছো চিত্রলেখা।
-না ভাইয়া, সেরকম না।
-আচ্ছা, কাল চলে যাচ্ছি আমি। সুবহা ট্রিট নিবে বলছিল। এদিকে সামনেই ফুচকার একটা স্টল আছে। চলো দুজনকেই ট্রিট দিই।
সিয়াম চিত্রলেখা এবং সুবহাকে রিকশায় তুলে দিয়ে নিজে বাইকে উঠলো। চিত্রলেখার হাসিটা তার চোখে ভাসছে। একইসাথে অপরিচিত ছেলেটাকেও। অদ্ভুত একটা দহনে পুড়ছে সে। এ দহনের নাম কিংবা কারণ এখনো চিত্রলেখাকে জানানো হয়নি।
সুবহা ঝাল ঝাল ফুচকা খাচ্ছে। ওর খাওয়া দেখে চিত্রলেখার নিজেরই ঝাল লাগছে। খাওয়া থামিয়ে সিয়ামের কাছে পানি চাইতে গেল সে।
-ভাইয়া পানি আছে?
-তোর সাথে আমার কথা আছে।
-কী কথা?
-নোট খাতা দিয়েছি, পড়েছিস?
-ব্যাগেই আছে, দেখিনি এখনো। ধন্যবাদ তোমাকে।
-তোর ধন্যবাদটা আমি নিব না।
-কেন?
-আমার ইচ্ছে।
-অদ্ভুত তো!
সিয়াম চিত্রলেখার দিকে খানিকটা এগিয়ে গেল। চিত্রলেখার কানের কাছে মুখ রেখে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,’ভালোবাসি চিত্র…’।
চলবে..