চিত্রলেখার_কাব্য অষ্টাদশ_পর্ব (রঙ্গন-চিত্রলেখা স্পেশাল) ~মিহি

0
667

#চিত্রলেখার_কাব্য
অষ্টাদশ_পর্ব (রঙ্গন-চিত্রলেখা স্পেশাল)
~মিহি

চিত্রলেখার হাত পা কাঁপছে। রঙ্গনকে কী জবাব দিবে সে? রঙ্গন ব্যাকুলতা তার জন্য অস্থিরতা হয়ে ধরা দিচ্ছে। রঙ্গন বোধহয় ঘোর ছেড়ে বেরোলো। হন্তদন্ত হয়ে চিত্রলেখার দিকে এগোলো।

-স্যরি, এরকম পরিস্থিতিতে আমার আসলে তোমাকে এসব বলা উচিত হয়নি। আমি জানিনা কেন বললাম। তোমার চোখ দেখে মনে হলো তোমার সাথে আরো কিছুক্ষণ থাকলে তোমার ভালো লাগবে।

-সবকিছু নিজে নিজেই ভেবে ফেলেন নাকি?

-তুমি যাও। আমরা পরে কথা বলবো।

-আপনাকে ভোর চারটে অবধি সময় দেওয়া হলো। আমার শহরে আমাকেই ঘোরাতে রাজি আছেন?

রঙ্গনের মনে হলো সে বোধহয় স্বপ্ন দেখলো। চিত্রলেখা সত্যিই তার কথায় রাজি হয়েছে? চোখ বড় বড় করে তাকালো সে। চিত্রলেখার মুখে তখন বিরক্তি ভেসে উঠলো।

-আশেপাশের কেউ দেখার অপেক্ষা করছেন?

-না না, আসো।

চিত্রলেখা চাদরটা আরো ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো। রঙ্গন বাইকে বসলো। চিত্রলেখা বেশ সাবধানে এক পাশ হয়ে বসে আলতো করে রঙ্গনের কাঁধে হাত রাখলো। রঙ্গন বাইক স্টার্ট করলো।

এলাকার রাস্তা পেরোনোর পর চিত্রলেখা খানিকটা স্বস্তি পেল। রাস্তা যথেষ্ট নিরিবিলি। মানুষজনের সমাগম নেই। রাতের নিস্তব্ধতা ছুঁয়েছে দিনের ব্যস্ততাকে।

-আমরা কোথায় যাচ্ছি?

-‘আফটার’ মুভি দেখেছো?

-না।

-আচ্ছা তাহলে জায়গাটা তোমার জন্য সারপ্রাইজ থাকুক।

চিত্রলেখা চুপ করে বাতাসের শব্দ শুনতে লাগলো। গভীর রাতে এভাবে লুকিয়ে রাস্তায় ঘোরার স্পর্ধা তার কোনোকালেই ছিল না কিন্তু মোটেও খারাপ লাগছে না। জীবনের টানাপোড়েনের মাঝে এ ক্ষণিকের মুহূর্তটুকু তাকে প্রশান্তি দিচ্ছে।

-তুমি কখনো এভাবে রাতে লুকিয়ে বের হওনি তাইনা?

-আমার প্রাণের ভয় আছে। একবার কেউ জানতে পারলে কেটে ফেলে দিবে।

-এত ভয় পাও কেন?

-জানিনা। অভ্যাস হয়ে গেছে হয়তো এমন রেস্ট্রিকশনের কারণে।

-ভুল অভ্যেস বানিয়েছো। রেস্ট্রিকশনের শিকলে পড়ে লাইফটা মিস করতেছো। ভার্সিটি লাইফ চলে আসলে জীবনের অর্ধেক সুখ এমনেই কমে যাবে।

চিত্রলেখা জোরে নিঃশ্বাস নিল। মন্দ মধুর ঘ্রাণ তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। চাদরের আবরণেও শীতল হাওয়া তাকে স্পর্শ করছে ঠিকই। চিত্রলেখা খেয়াল করলো তারা মেইন রাস্তা পেরিয়ে কাঁচা রাস্তায় এসেছে।

-এদিকে কোন জায়গায় যাচ্ছি আমরা?

-বিশ্বাস রাখতে পারো একটু।

চিত্রলেখা বলার মতো কোনো উত্তর পেল না। রাস্তাটা সুন্দর। অর্ধচাঁদ আকাশে ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছে। রাস্তাটা যেন অসীম। মাথায় একটা গান ক্ষণে ক্ষণে বাজছে,”এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো।”

রঙ্গন বাইক সাইড করলো। চিত্রলেখা কল্পনার জগত থেকে বেরোল যেন। সামনে তাকাতেই চোখে পড়লো রাতের নিকষ কালোতে ঝিলের পাড়ে জোনাকিদের বিচরণ। এত সুন্দর জায়গা সে আদৌ আগে কখনো দেখেছে কিনা মনে করতে পারছে না সে। চোখজোড়ায় মুগ্ধতা খেলা করছে।

-এত সুন্দর এ জায়গাটা! এটার কথা তো আমি জানতামও না।

-অনেকেই জানেনা। এ জায়গাটা ‘আফটার’ মুভির একটা দৃশ্যের মতো। তুমি যেহেতু মুভিটা দেখোনি, তাই বুঝবেনা। তুমি বরং জায়গাটার সৌন্দর্য উপভোগ করো।

চিত্রলেখা ধীরে ধীরে ঝিলের পাড় ঘেঁষে বসলো। টলটলে জলে অর্ধচাঁদের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে। চিত্রলেখার চোখে মুগ্ধতার রেশ বিন্দুমাত্র কমলো না। শীতল জলে হাত স্পর্শ করতেই সর্বাঙ্গ ঝনঝন করে উঠলো তার।

-এই ঝিলে কি সাপ আছে?

-আরে নাহ, তাছাড়া পানিতে সাপ কামড়ায় না। তুমি সাপ ভয় পাও?

-মারাত্মক ভয় পাই। বাঘ ভাল্লুক থেকেও বেশি ভয় পাই।

-আরে সাপ নেই এখানে।

চিত্রলেখা যেন এ কথারই অপেক্ষা করছিল। সে ঝিলের আরো কাছাকাছি বসলো। রঙ্গনের একবার ভয় হলো মেয়েটা বেশি নিকটে যাচ্ছে না তো! চিত্রলেখা ঝিলের পানিতে পা ভেজালো। বরফের মতো শীতল সে পানি। তবুও চিত্রলেখার মোটেও খারাপ লাগলো না বরং সে মুহূর্তটাকে ভালোবেসে ফেললো।

-ঠাণ্ডা লাগবে চিত্রলেখা, এখন পানি যথেষ্ট ঠাণ্ডা।

-কিছু মুহূর্তের আনন্দের জন্য একটূখানি রোগে জড়ালে কিচ্ছু হয়না।

চিত্রলেখার কথাটা বোধহয় ভালো লাগলো রঙ্গনের। সেও ঝিলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসলো।

-জীবনের অজস্র ঝামেলার মধ্যে কিছু মুহূর্ত নিজস্ব থাকা দরকার, চিত্রলেখা।

-আপনার অভ্যেস আছে এভাবে রাতে পালিয়ে ঘুরে বেড়াবার, তাইনা?

-ঠিক অভ্যাস না, হঠাৎ হঠাৎ ভালো লাগে এসব করতে।

অতঃপর নীরবতা। রঙ্গনও আজ নীরব। পাশাপাশি বসে কথা বলার মতো কিছু যেন আর মুখে আসছে না তার অথচ জমানো কথাগুলো মনে ঠাঁই দেওয়ার জায়গা নেই। রঙ্গন গুনগুনিয়ে করতে লাগলো।

-আপনি গানও জানেন?

-টুকটাক।

-শোনার অনুমতি পেতে পারি?

রঙ্গন হাসলো। মেয়েটার কাব্যিক কথার ফোয়ারা তাকে মাঝে মাঝে অভিভূত করে। ‘নিশ্চয়ই..” মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল রঙ্গন। ক্ষীণ স্বরেই গেয়ে উঠলো,

“তুমি বৃষ্টি চেয়েছো বলে
কত মেঘের ভেঙ্গেছি মন
আমি নিজের বলতে তোমায় চেয়েছি

তুমি যাওনি কিছুই বলে
আজও পাল্টে ফেলিনি মন
শুধু নিজের বলতে তোমায় চেয়েছি

তুমি জানতেই পারো না তোমায়
কত ভালোবেসেছি
ও, তুমি জানতেই পারো না তোমায়
কত ভালোবেসেছি”

চিত্রলেখা অভিভূত হলো। এত সুন্দর কণ্ঠস্বর বুঝি হয় কারো! রঙ্গনের কণ্ঠে মোহিত হলো সে।

-আমি কিন্তু খুব একটা খারাপ গাই না, বলো চিত্রলেখা!

-আপনি প্রফেশনাল গায়কদের মতো গান গাইতে পারেন! আমি সত্যিই অবাক হয়েছি। এত সুন্দর কণ্ঠস্বর মনে হচ্ছে গড-গিফটেড বা জেনেটিক্যাল!

-আমার বংশের কেউ গায়ক নাই, আমিই বোধহয় গড-গিফটেড।

-আমাদের বোধহয় এখন যাওয়া উচিত।

-হ্যাঁ চলো।

রঙ্গন চটজলদি উঠে বাইক স্টার্ট করলো। চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে হাসি খেলা করছে। এতটা ‘বিশেষ’ কেউ তাকে কখনো অনুভব করায়নি। কিছু মুহূর্ত যে মানুষকে এতটা প্রশান্তি এনে দিতে পারে তা সে কখনোই বোঝেনি। বাইকের গতি স্বাভাবিক হলেও তার কাছে মনে হচ্ছে বাইকটা যেন জোরে চলছে। আরো আস্তে কেন চালাচ্ছে না রঙ্গন? চিত্রলেখার তো বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করছে না। মুহূর্তগুলো আরেকটু দীর্ঘায়িত হলে মন্দ হয় না।

-আপনি এই ঝিল খুঁজে পেলেন কিভাবে?

-জানিনা। হঠাৎ একদিন খুঁজে পেয়েছি। আমার ভাগ্য খুব ভালো, আমি সবসময় ভালো ভালো জিনিস খুঁজে পাই।

-তা বোধহয় সত্যি।

-তুমি কখনো রাত তিনটায় ফাঁকা রাস্তায় আইসক্রিম খেয়েছো?

-রাত তিনটায় আইসক্রিম কোথায় পাওয়া যায়?

-সামনে একটা দোকান খোলা, বসো একটু।

চিত্রলেখাকে কিছূ বলার সুযোগ দিল না রঙ্গন। বাইক সাইড করে ঝড়ের গতিতে আইসক্রিম আনতে গেল। চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে হাসি তখনো বহাল। অদ্ভুতভাবে তার অপ্রত্যাশিত সবকিছু যেন আজ ঘটছে। সে কি কখনো ভেবেছিল রাত বিরাতে এভাবে বাইরে বেড়াবে তাও রঙ্গনের সাথে? সে কতটুকুই বা চেনে রঙ্গনকে? ছেলেটা তো তার ক্ষতিও করতে পারতো! এতটা অবলীলায় কী করে বিশ্বাস করতে পারলো সে? একবারও তো চিত্রলেখার মনে হলো না ছেলেটা তার ক্ষতি করতে পারে কিংবা ছেলেটার দৃষ্টি তার জন্য অসুবিধের।

রঙ্গন দুই হাতে দুইটা কোণ আইসক্রিম আনলো। বাইক থেকে নেমে সেখানেই হেলান দিয়ে দাঁড়ালো চিত্রলেখা। রঙ্গন তার দিকে আইসক্রিম বাড়িয়ে দিয়ে নিজেও আরেকটা প্যাকেট খোলা শুরু করলো।

-শীতের রাতে তিনটের কাছাকাছি সময়ে এভাবে ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাওয়া, অনেকটা সিনেম্যাটিক না চিত্রলেখা?

-পুরোটাই সিনেম্যাটিক।

-তোমার ঠাণ্ডা লাগবে বোধহয়। স্যরি।

-মানুষ যখন মন থেকে শান্তি পায়, তখন এসব ঠাণ্ডা লাগার আক্রমণ হয় না।

-তুমিও দেখি আমার মতো কথা বলতে শিখে গেছো। তাড়াতাড়ি শেষ করো, তোমাকে রেখে আসি। নাহলে দেখা যাবে তোমার বাড়িতে তোমাকে খুঁজতে হট্টগোল পড়ে যাবে।

-হুম।

রঙ্গনের খানিকটা মন খারাপ হলো। এতক্ষণ চিত্রলেখার সঙ্গ বেশ উপভোগ করছিল সে। এখন যেন পৃথিবীর সমস্ত একাকীত্ব তাকে ঘিরে ধরবে।

খুব সাবধানে চিত্রলেখাকে মেইন রাস্তার কাছে নামিয়ে দিল সে। অতঃপর বিদায়ের প্রহরটা নীরবেই কাটলো তাদের।

-ধন্যবাদ একটা সুন্দর সন্ধ্যার জন্য।

-যাও সাবধানে। আল্লাহ হাফেজ।

-আল্লাহ হাফেজ। আপনিও সাবধানে যাবেন।

চিত্রলেখা সামনে এগোলো। চিত্রলেখা চোখের আড়াল হওয়া অবধি রঙ্গন সেদিকে তাকিয়ে রইলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here