চিত্রলেখার_কাব্য আটচল্লিশতম_পর্ব ~মিহি

0
520

#চিত্রলেখার_কাব্য
আটচল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

-সাথী তোমার মাথা ঠিক আছে? রঙ্গনের সাথে লেখাকে কেন পাঠাতে হবে? তাও আবার একরাত আগে এসব বলতেছো আমাকে! দেখো, আমি জানি রঙ্গন যথেষ্ট ভালো কিন্তু …

-তোমার কাল সকালে মিটিং। তুমি পারবে যেতে? আমি গেলে তোমার রান্না কে করবে? আরেকটা বিয়ে করে তারে দিয়ে করাও!

-আজব তো, এতো রাগ করার কী আছে? পাঠাও তোমার ভাইয়ের সাথে। একেবারে বিয়ে করায়েই পাঠায়ে দাও। নিজে প্রেম করছে, এখন চৌদ্দ গোষ্ঠীরে লাভ ম্যারেজ না করায়া শখ মিটতেছে না।

-অনিক!

-আচ্ছা রাগ কোরো না। রঙ্গনকে সকালে আসতে বলবা, আমি ওরে ইনস্ট্রাকশন দিব।

-তুমি প্রেম করার সময় এত জ্ঞান মাথায় ছিল?

অনিক চুপ হয়ে গেল। প্রেমের বিয়ে বস্তুটা আসলে এক প্রকার ফ্যাসাদ ছাড়া কিছুই না। প্রেমিকা বউ হলে তাকে কিছু বলাই যায় না। কিছু বলতে গেলেই ছ্যাঁত করে ওঠে। রঙ্গন ছেলে ভালো হলেও অনিকের মনে একটু ভয় কাজ করছে। চাইলেই তো বোনকে এত লম্বা সফরে কারো হাতে ছাড়া যায় না। সে ঠিক করলো অর্ণবের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিবে কিন্তু সাথীকে সে কথা আর জানালো না।

সাথী চলে যাওয়ার পর অনিক বেশ কয়েকবার অর্ণবের নম্বরে কল করলো। নম্বর এখনো বন্ধ বলছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে অর্ণবের নম্বর কখনো বন্ধ থাকে না। অনিকও এবার চিন্তায় পড়লো। পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে তাদের মোটেও সখ্যতা নেই। এ মুহূর্তে কাকে কল করবে বুঝে উঠতে পারলো না অনিক। এর চেয়ে রঙ্গনকে বিশ্বাস করাটাই অধিক শ্রেয় মনে হলো তার নিকট।

_______________

সকাল সাড়ে সাতটার ট্রেন। এখন বাজে সাতটা তিপ্পান্ন। ট্রেন এখনো আসেনি। রঙ্গন স্টেশনের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে। অপর পাশেই অনিক চিত্রলেখার পাশে দাঁড়িয়ে। রঙ্গন কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে না। ইতোমধ্যে অনিক বাসায় ডেকে তাকে শাসিয়েছে কথাবার্তা কম বলতে। রঙ্গন মনে মনে যে কত গালাগাল করেছে তার এই শালাকে, পরমুহূর্তে আমার দুলাভাই ভেবে মাফও করে দিছে। তবে অনিকের এই হিটলারপনা দেখে রঙ্গনের মাথায় কেবল একটা বাক্যই ঘুরে বেড়াচ্ছে,”আমিও যদি এমন করতাম, এই শালা আমার বোনের সাথে প্রেম করতে পারতো?” কথাটা মনে মনেই সীমিত রাখলো সে। সামনাসামনি বলার সাহস তার নাই। ট্রেন আসলো কাঁটায় কাঁটায় সাতটা আটান্ন। বাংলাদেশের ট্রেন সিস্টেমটা অদ্ভুত। ভুলক্রমেও কোনদিন পাঁচ মিনিট আগে আসবে না। যদি কখনো দেখেন আটটার ট্রেন সাতটায় এসেছে তাহলে ধরে নিবেন এটা আগেরদিনের ট্রেন, এখন এসেছে মাত্র। ট্রেন আসাতে রঙ্গনের মুখে খুশির ঝলক দেখা দিলেও সে তা আড়াল করার চেষ্টা করলো। অনিক দেখতে পেলে নির্ঘাত আবার বলবে দুইজন দুই প্রান্তে বসো।

রঙ্গন ও চিত্রলেখাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে চলে আসার সময় অনিক কেবলমাত্র রঙ্গনের কানে কানে ‘অল দ্য বেস্ট’ বলে চলে গেল। রঙ্গন বিব্রত হলো। অনিকের মুখে এমন কথা কেন যেন বেমানান। চিত্রলেখা বসেছে জানালার পাশে আর রঙ্গন তার পাশে। মেডিকেলের রেজাল্ট দেওয়ায় ভালোই ভীড় ট্রেনে। রঙ্গন অবশ্য আশেপাশে তাকানোর সুযোগ পাচ্ছে না। চিত্রলেখার নজর জানালার বাইরে আর রঙ্গনের নজর চিত্রলেখাতেই সীমাবদ্ধ।

___________________________________

-ভোররাতে একজন রেসপেক্টেড পার্সনকে এভাবে তুলে আনার সাহস হয় কী করে আপনার? আপনি নতুন এলাকায়? আমার পরিচয় জানেন না নাকি?

-দেখুন স্যার, আপনি কো-অপারেট করুন। আপনার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে। আপনাকে আমরা শখের বসে অ্যারেস্ট করিনি।

নওশাদের মনে এবার ভয় কাজ করে। প্রমাণগুলো তো সে পুড়িয়ে ফেলেছে তবে কমপ্লেইন কে করলো? আর পুলিশই বা কোনো প্রমাণ ছাড়া কেন তাকে এখানে ধরে আনবে? এটা কি বিরোধী দলের ঐ শামসুর কাজ হতে পারে? নওশাদ বোঝার চেষ্টা করলো কে এমন করতে পারে তার সাথে। দীর্ঘসময় চিন্তা করতে হলো না। একটু পরেই আশফিনা আহমেদ এলো নওশাদের সাথে দেখা করতে। বোনকে পেয়ে নওশাদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এবার সে নিশ্চয়ই মুক্তি পাবে। আশফিনা আহমেদ নওশাদের মুখোমুখি দাঁড়ালেন।

-সব পাপের বিচার একদিন হয়, এটা মানো নওশাদ?

-আপা, এখন এসব কথা বলার সময় না। আমার বেইল করানোর ব্যবস্থা করো।

-ব্যবস্থা তো করবো তবে তোমায় যতটা বেশি শাস্তি দেওয়া যায় সেটার। তোমার মতো নরপশু আমার ভাই ভাবতেও আমার ঘৃণা লাগে! কতগুলো মেয়ের জীবন নষ্ট করেছো। অপর্ণা নাহয় দোষ করেছিল সামান্য কিন্তু বাকিরা? ওদের কী দোষ? আর অপর্ণা ভুল করে থাকলেও তাকে এমন নিকৃষ্ট শাস্তি দেওয়ার তুমি কে? একটা মেয়ের ইজ্জত নষ্ট করা কিছুই না তাইনা? আরে অপর্ণা হয়তো লোভ করেছিল কিন্তু তার জন্য ও এখন যে ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তা কতটুকু যন্ত্রণার জানো? একটা মেয়ে রেইপ হলে তার মধ্যে বেঁচে থাকার ইচ্ছে অবশিষ্ট থাকে? অপর্ণার বডি রেসপন্স করছে না! চিত্রলেখার জীবনটাও তুমি বরবাদ করতে উঠেপড়ে লেগেছো। আমি সব দেখেও চুপ থাকবো ভেবেছিলে?

-ভুল করছো আপা। আমাকে বেশিদিন আটকে রাখতে পারবেনা। কী প্রমাণ আছে তোমার কাছে?

-তোমার নিজস্ব স্বীকারোক্তি। জেলে পচার জন্য তৈরি থেকো নওশাদ!

আশফিনা আহমেদ আর কথা বাড়ালেন না। গা গুলাচ্ছে তার। এই লোকটার উপস্থিতিও তার জন্য ঘৃণিত! অপর্ণার অবস্থা দেখলেও করুণা হয় আশফিনা আহমেদের। মেয়েটার বাচ্চা দুইটার অসহায়ত্ব প্রতিমুহূর্তে তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। নিজের এই ভাইটাকে প্রথমবারেই শাস্তি দিলে হয়তো এত কিছু হতোই না। অন্তত বাচ্চা দুটোর জীবন এতটা নির্মম হতো না! অর্ণব এবং তৌহিদকে ঘটনাগুলো জানানো দরকার। আশফিনা আহমেদের চোখের কোণে জল চিকচক করছে। বাম হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে জলটুকু মুছে তিনি পুলিশ স্টেশনের বাইরে পা রাখলেন। এখন থেকেই চিত্রলেখা এবং রঙ্গনের জীবনটা বাধামুক্ত করলেন তিনি। এখন কেবল দুজনের চারহাত এক করার পালা।

______________________

চিত্রলেখা বেশ কিছুক্ষণ ধরে খেয়াল করছে তাদের মুখোমুখি বসে থাকা মেয়েটা আড়চোখে রঙ্গনের দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটাকে দেখে নাইন-টেনের বাচ্চা মনে হচ্ছে। রঙ্গনকে এভাবে আড়চোখে দেখাটা তার মোটেও ভালো লাগছে না। সে ফিসফিস করে ডাকলো রঙ্গনকে।

-এই সামনের মেয়েটা তোমায় এভাবে দেখছে কেন? চেনে তোমাকে?

-আরে নাহ! আমি কখনো দেখিইনি একে, এ আমায় কিভাবে চিনবে?

-তো তাকায়ে আছে কেন?

-সুন্দর ছেলে দেখলে তো মেয়েরা তাকাবেই। তুমি তো পাত্তা দিচ্ছো না, তাই বলে কি সবাই গাধা?

-তুমি আমাকে গাধা বললা?

-পাশে এত সুন্দর ছেলে রেখে কেউ যদি বাইরে তাকায়ে থাকে তাকে গাধা বলাটা কি আমার অন্যায়?

চিত্রলেখা খানিকটা রাগত স্বরে বলে উঠতেই রঙ্গন হালকা কেশে উঠলো। সামনে বসে থাকা মেয়েটা যেন এ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। পানির বোতলটা তৎক্ষণাৎ রঙ্গনের দিকে বাড়িয়ে দিল।

-ভাইয়া পানিটা খেয়ে নিন। সমস্যা হচ্ছে কি?

-না আপু ধন্যবাদ।

-আরে পানিটা খান। অসুবিধা নেই।

চিত্রলেখার এবার আরো মেজাজ খারাপ হলো। পানির বোলতটা নিয়ে ছিপি খুলে সমস্ত পানি সে মেয়েটার মাথায় ঢালতে উদ্যত হলে রঙ্গন কোনমতে বসালো তাকে। চিত্রলেখা তখনো অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাচ্ছে মেয়েটার দিকে।

-সমস্যা কী মেয়ে তোমার? আরেকজনের বরের দিকে তাকাও কেন?

-ওহ! ভাইয়া আপনি ম্যারিড?

-কেন আমি বলতেছি বিশ্বাস হচ্ছে না? ভাইয়াকে জিগানো লাগবে কেন? অসভ্য মেয়ে, সেই থেকে তাকায়ে আছো! লজ্জা নাই? এই তোমার গার্ডিয়ানের নম্বর দাও! তাদেরও জানা উচিত তাদেদ মেয়ে এসব করে বেড়ায়।

চিত্রলেখার কথা শুনে মেয়েটা তৎক্ষণাৎ তার ব্যাগপত্র নিয়ে অন্য সীটের উদ্দেশ্যে কেটে পড়লো। চিত্রলেখার সাপের মতো ফুলে ফেঁপে উঠা দেখে রঙ্গনের মজা লাগছে। এতক্ষণ মেয়েটা তার দিকে তাকাচ্ছিলই না অথচ অন্য কেউ তাকানোতে যে অনর্থ বাধালো, তাতে রঙ্গন নিশ্চিত এ মেয়ে থাকতে তার জীবনে ভালোবাসার বিন্দুমাত্র কমতি হবে না।

-রঙ্গন স্যরি, বেশি রিএক্ট করে ফেলছি। নিব্বি টাইপ ব্যবহার করে ফেললাম?

-ধূর পাগলী! আমি তো চাই তুমি এমন অধিকার দেখাও। অন্য কেউ আমাকে চেক আউট করবে আর তুমি চুপচাপ থাকবে তাহলে কিছু হলো? ভালোবাসো বলেই তো অধিকার দেখাবে!

চিত্রলেখা উত্তর দিলো না। ট্রেনের জানালা বেয়ে তীব্র বাতাস আসছে। চিত্রলেখার কপালের কাছে চুলগুলো বড্ড বিরক্ত করছে। এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে রঙ্গনের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুঁজলো সে। সফরটা সাত ঘণ্টার না হয়ে সাতশো বছরেরও তো হতে পারতো।

চলবে…

[খুব বেশি পর্ব বাকি নেই আর, সকলে গল্প সম্পর্কে নিজের মতামত জানাতে পারেন🧡]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here