চিত্রলেখার_কাব্য একত্রিশতম_পর্ব ~মিহি

0
536

#চিত্রলেখার_কাব্য
একত্রিশতম_পর্ব
~মিহি

“স্যার কী অর্ডার করবেন আপনারা?” ওয়েটারের কথায় ঘোর কাটলো রঙ্গনের। চিত্রলেখার ঘোরে সে মোহিত ছিল এতক্ষণ। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ক্ষণিকের মুহূর্তটা সে উপভোগ করছিল এতক্ষণ। রঙ্গনের এখন এই ক্যাফের চার দেয়ালে থাকতে ইচ্ছে করছে না।

-দুই কাপ কফি তবে ওয়ান টাইম মগে দিয়েন ভাইয়া।

-স্যরি স্যার তাহলে আপনাদের কফি কাউন্টার থেকে নিতে হবে।

-আচ্ছা ধন্যবাদ।

রঙ্গনের চোখের ঔজ্জ্বল্য বলে দিচ্ছে সে কতটা অস্থির হয়ে পড়েছে। নিজেকে শান্ত করার কোনো সঠিক পদ্ধতি যেন সে খুঁজে পাচ্ছে না।

-তুমি বসো, আমি কফি আনছি।

চিত্রলেখা উত্তর দেওয়ার অবকাশ পেল না। রঙ্গন তড়িৎ গতিতে কাউন্টারের দিকে এগোলো। চিত্রলেখা রঙ্গনের কীর্তিকলাপে হাসছে। এতটা অস্থির রঙ্গনকে কখনো কি দেখেছিল সে?

কাউন্টারে এসেও রঙ্গনের অস্থিরতা কমলো না। বারবার নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টা করছে সে।

-স্যার এনি প্রবলেম?

-না না, দুই কাপ হট কফি প্লিজ।

-নাম কী লিখবো স্যার?

-একটাতে রঙ্গন আর…আরেকটাতে ‘রঙ্গনা’ লেখো।

দুই কাপ কফি নিয়ে বিল পে করে রঙ্গন চিত্রলেখার মুখোমুখি বসলো। চিত্রলেখা মগের উপর ‘রঙ্গনা’ লেখাটা খেয়াল করে মুচকি হাসলো।

-বাইরে হাঁটতে হাঁটতে কফি খাই আমরা?

-হ্যাঁ চলুন।

চিত্রলেখা রঙ্গনের উচ্ছ্বাস দেখে কেবল মুগ্ধ হচ্ছে। তার বলা একটি বাক্যে ছেলেটা এতটা অস্থির হয়ে উঠবে সে ভাবেইনি।

-চিত্রলেখা, তোমার একটা কথায় আমি এতটা অস্থির হইনি। আমি অস্থির হয়েছি তোমার চোখের চাহনিতে।

-আপনি কী করে বুঝলেন আমি এটাই ভেবেছি?

-আমি উত্তর দিব না। তুমি আপনি করে বলেছো।

-আচ্ছা স্যরি। তুমি কী করে বুঝলে আমি এটাই ভেবেছি?

-তোমার মুখের হাসি বলে দিয়েছে। তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি রঙ্গনা!

‘রঙ্গনা’ ডাকটা শুনে খানিকটা শিওরে উঠলো চিত্রলেখা। উষ্ণ এক মধুর হাওয়া যেন তার কানের কানে এসে স্পর্শ করলো।

-কী কথা?

-মামা হাসপাতালে আছে। গতকাল কে যেন তাকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছে।

-ওহ আচ্ছা।

রঙ্গন ভাবলেশহীনভাবে বললো কথাটুকু। চিত্রলেখা হাসলো। এই কেউ একজনটা কে তা বুঝতে তার সময় লাগেনি। রঙ্গনকে কি বলা উচিত তার এ কথা?

-একটা কথা কী জানো রঙ্গন? আমি অন্যদের মতো বলবোনা তুমি কখনো মারামারি করো না, ঝামেলায় জড়িয়ো না। আমি চাইবো তুমি প্রতিবাদ করো। নওশাদ নামক লোকটার প্রাপ্য শাস্তি সে পেয়েছে। আমি কখনোই তার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে বলবো না সে তোমার মামা হয়, তার সাথে এমন করা অনুচিত।

-তুমি বড্ড আলাদা রঙ্গনা। সবসময় এমন থেকো আর আমার পাশে থেকো।

চিত্রলেখা মুগ্ধ দৃষ্টিতে রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে তার এক হাত নিজের এক হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো। রঙ্গনের মনে হলো সে বোধহয় ক্ষণিকের জন্য জমে গেল। এ মুহূর্তটা কি কোনোভাবে থামানো যায়? রঙ্গনের মাথায় সে চিন্তা ভর করলো।

_______________________

-সুবহা, আমি ঠিক করেছি আঙ্কেল হাসপাতালে থাকা অবধি আমরা রাজশাহীতে থাকবো এবং সব গুছিয়ে নিব। আঙ্কেল সুস্থ হয়ে ফিরলে আঙ্কেল আন্টিকে আমাদের সাথে নিয়ে যাবো।

-আচ্ছা। আমাদের বিয়ের কথাটা লেখাকে জানালে হতো না একবার?

-জানাও, অসুবিধা নেই তো। তবে আন্টি যেহেতু বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বলতে বলেছে, আন্টিকে এটা জানানোর প্রয়োজন নেই যে তুমি লেখাকে ডেকেছো আজ।

-আচ্ছা। থ্যাংকস কিন্তু তুমি আমাকে তুমি করে ডাকছো কেন ভাইয়া?

-তুই যাতে ভাইয়া না ডাকিস সেজন্য। আর ঘণ্টা দেড়েক পর বিয়ে আর তুই আমাকে ভাইয়া ডাকতেছিস!

সুবহা মুখ টিপে হাসলো। রেহানা সুলতানা হাসপাতালে আছেন। সুবহার বাবার শরীরটা আগের চেয়ে একটু ভালো। বিয়ের দৃশ্যটুকু যেন ফোনের স্ক্রিনে হলেও তিনি দেখতে পারেন তাই সুবহার মা হাসপাতালেই আছেন। সুবহা চিত্রলেখার সাথে কথা বলার জন্য ফোন হাতে নিল। সিয়াম নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে এ মুহূর্তে। যত যাই হোক, চিত্রলেখার সামনে নিজের পূর্ব অনুভূতির বিন্দুমাত্রও প্রকাশ করতে চায় না সে। সুবহার সাথে নিজের নতুন জীবনের সূচনালগ্নে প্রাক্তন অনুভূতিগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করা শোভা পায় না।

রাস্তার এক পাশে ব্রিজের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল রঙ্গন এবং চিত্রলেখা। আচমকা চিত্রলেখার ফোন বেজে উঠলো। চিত্রলেখার ধ্যান ভাঙলেও রঙ্গন বেমালুম চিত্রলেখার দিকেই তাকিয়ে রইলো। চিত্রলেখা ফোন রিসিভ করলো।

-সুবহা, আঙ্কেল সুস্থ আছেন?

-হ্যাঁ শোন। রাগ করিস না, একটা খুব সিরিয়াস কথা আছে।

-বল।

-না ফোনে না, তুই আধঘণ্টার মধ্যে আমার বাড়িতে আয়।

-তুই ঠিক আছিস তো? তোর কিছু হয়নি তো?

-আমি ঠিক আছি, তুই প্লিজ আয়।

খট করে কলটা কেটে দিল সুবহা। চিত্রলেখার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। চিন্তিত মুখে রঙ্গনের দিকে তাকাতেই দেখলো রঙ্গন ফোনে কিছু একটা করছে। কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে তাকানোর পর বুঝলো রঙ্গন তার ছবি তুলছে। বুঝতে পেরেই দুহাতে মুখ লুকালো সে।

-আরে! ছবিটা সুন্দর আসছে, এটা আমার সিক্রেট ফোল্ডারে থাকবে।

-আচ্ছা শোনো, সুবহা ডেকেছে আমাকে। আমার যেতে হবে একটু। তাছাড়া এখন আড়াইটা বাজে। তুমিও বাসায় যাও।

-চলো তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসি রিকশা করে।

-আমি যেতে পারবো তো।

-প্রথম প্রেমের পর প্রথম রিকশায় ওঠার দিনটা একই হোক। একটু প্রোটেক্টিভ তো হতে দাও!

রঙ্গনের ছেলেমানুষের মতো আবদারে চিত্রলেখার মুখে হাসি ফুটলো। আজ একদিনে সে যতটা খুশি হয়েছে, তা কি সে এত বছরের জীবনে কখনো হতে পেরেছিল? প্রথম প্রেমের অনুভূতি কি এমনই হয়?

রঙ্গন রিকশা ডাকলো। চিত্রলেখা সাবধানে রিকশায় বসলো। রঙ্গন আগের মতোই কিছুটা দূরত্ব রেখে বসলো। চিত্রলেখা এখন তার প্রেমিকা তবুও সে চিত্রলেখার কমফোর্ট জোনের খেয়াল রাখতে চায়। সে তো প্রেমিক হওয়ার আগে চিত্রলেখার প্রিয় বন্ধু হয়ে থাকতে চায় সবটা সময়।

-রঙ্গন, আপনার বোধহয় বাড়িতে ফেরা উচিত ছিল।

-আপনি?

-হুম। সবসময় তুমি বললে ‘তুমি’ শুনতে আর ভালো লাগবে না।

-কে বলেছে তোমাকে? তোমার মুখে ‘তুমি’ শব্দটা আমি জনমভরে শুনলেও বিরক্ত হবো না। বুঝেছো রঙ্গনা?

-বুঝলাম। অহম কেমন আছে?

-তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল। কবে নিয়ে আসবো বলো।

-আজকে যেহেতু দেখা হলো, এ সপ্তাহে আমার বেশি বেরোনো ঠিক হবে না। সামনের সপ্তাহে দেখা করি?

-মানে এক সপ্তাহ তুমি দেখা করবে না? আমি ঢাকা ফিরে গেলে মিস করবা দেখো!

-দূরত্ব বাড়লে ভালোবাসা কমে?

-আমার ভালোবাসা তোমার ফিজিক্সের নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ বলের মতো না যে দূরত্ব বাড়লেই কমে যাবে! আমার ভালোবাসা তিনটে সূত্রে সীমাবদ্ধ না, আমার ভালোবাসা সাহিত্যের মতো বিস্তর।

-আপনার নিজেরই তো সাবজেক্ট ফিজিক্স!

বলেই জিভ কাটলো চিত্রলেখা। মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। এবার নিশ্চিত রঙ্গন জেরা করবে সে কিভাবে জানলো।

-তো তুমি স্টক করতে আমাকে?

-না স্টক না ঠিক…একদিন দেখেছিলাম আর কী!

-বুঝেছি ম্যাম।

চিত্রলেখা লজ্জা পেল। এভাবে ধরা না পড়লেও তো পারতো! বেশি কথা বলা এজন্যই উচিত না। সুবহার বাড়ির গলিতে এসে রঙ্গন নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিল। চিত্রলেখার থেকে বিদায় নিলো চোখে চোখে। রঙ্গনের চোখে বিদায়ের বিষাদটা বোধহয় আজ একটু বেশিই দেখলো চিত্রলেখা।

সুবহার বাড়ির সামনে রিকশা থামলো। চিত্রলেখা নেমে কলিং বেল বাজাচ্ছে। ভেতর থেকে কারো সাড়াশব্দ নেই।

-দরজাটা খোলো তো ভা….

-ভাইয়া বলা লাগবেনা খুলতেছি। রেডি হ তুই।

সিয়াম চাইছিল না দরজা খুলতে তবে আজ হোক কিংবা কাল মুখোমুখি তো হতেই হতো। সিয়াম যত তাড়াতাড়ি চিত্রলেখাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবে, ততটাই ভালো তার জন্য। দরজা খুললো সে।

সিয়ামকে পাঞ্জাবি পড়া দেখে চিত্রলেখা খানিকটা হতভম্ব হলো। এভাবে বর সেজেছে কেন সে? প্রশ্নটা মাথায় ঘুরলেও বলতে সংকোচবোধ হলো। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই সুবহা ছুটে এলো। সুবহাকে দেখে চিত্রলেখার বিস্ময় আরো বাড়লো।

চলবে..

[তিনটা প্রাইভেট মিস দিয়ে, মেডিসিন নিয়ে, সাড়ে তিন ঘণ্টা ঘুমানোর পর এই পর্ব লেখা। বানান ভুল থাকতে পারে, কাইন্ডলি একটু ধরিয়ে দিবেন আর আমার জন্য দোয়া করার জন্য জাযাকাল্লাহু খাইরান💛]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here