চিত্রলেখার_কাব্য চতুর্বিংশ_পর্ব ~মিহি

0
594

#চিত্রলেখার_কাব্য
চতুর্বিংশ_পর্ব
~মিহি

সিয়াম একমনে বসে আছে। কিছু বলার কিংবা কাউকে কিছু জানানোর ক্ষমতা তার নেই, বিশেষ করে সুবহাকে। শাহজাহান আলীকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। আপাতত তার সাথে সকাল অবধি কাউকে দেখা করতে দেওয়া হবে না। সিয়ামের মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আচমকা তার চাচা এমন সিদ্ধান্ত কেন নিতে চাইছেন বুঝে উঠতে পারলো না সে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। সিয়াম বুঝতে পারলো তার উচিত তার চাচী এবং সুবহাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসা। এভাবে সারারাত এখানে বসিয়ে রাখা উচিত না তাদের।

-চাচী, রাত তো অনেক হচ্ছে। আমি আছি এখানে, সুবহা আর আপনাকে পৌঁছি দিয়ে আসি?

-না সিয়াম। আমি এখান থেকে সরবো না। আমি আছি, তুমি সুবহাকে দয়া করে রেখে এসো।

-কিন্তু চাচী।

-ওর জেগে থাকার অভ্যেস নেই, মাইগ্রেন বাড়বে। ওকে রেখে আসো তুমি।

সিয়াম না করতে পারলো না কিন্তু সুবহার আশেপাশে থাকতেও তার ইচ্ছে করছে না। অদ্ভুত একটা অস্বস্তিতে পড়েছে সে। চাচীকে নিষেধও করতে পারলো না সে। সুবহা হ্যাঁ না কিছু বললো না। সে মূর্তির ন্যায় হয়ে আছে। কান্নাও করছে না। সুবহার এ নীরবতা ভয়ঙ্কর লাগছে সিয়ামের কাছে।

সুবহা বাড়িতে ঢোকামাত্র যথারীতি নিজের ঘরে ঢুকলো চুপচাপ। সিয়াম ভাবলো সে হয়তো ঘুমোনোর জন্য গেছে। চাচীকে কল দিল সে।

-চাচী, আমি সুবহাকে পৌঁছে দিয়েছি। আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি অল্প সময়ের মধ্যেই আসছি।

-সুবহা একা ভয় করতে পারে, তুমি ওখানেই থাকো সিয়াম। ভোরে চলে এসো বাবা। আমার সমস্যা হবে না।

সিয়াম আবারো অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। পৃথিবীর সব সূত্র কি আজ তার বিপক্ষে? যাই হোক, সে আপাতত এসব ভাববেই না। পানি খাওয়ার জন্য ডাইনিংয়ে আসতেই সিয়াম দেখলো সুবহার ঘরের আলো এখনো জ্বালানো। তার মানে কি সে এখনো ঘুমায়নি? সিয়াম সুবহার ঘরের দিকে এগোল। ঘরের দরজায় আসতেই অবাক হলো সিয়াম। সুবহা একদম পাথরের ন্যায় মেঝেতে বসে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে আছে। চোখ নির্জীব, ঠোঁট খানিকটা কাঁপছে। সিয়ামের ভয় বাড়লো। মেয়েটা কি বড়সড় শকের মধ্যে আছে এখনো। সিয়াম সুবহার পাশে বসে সুবহার কাঁধে হাত রাখলো।

-চাচ্চুর কিছু হবেনা, সুবহা। চিন্তা করিস না তুই। সব ঠিক হয়ে যাবে।

-বাবা ঠিক হবে? আবার আগের মতো?

-হুম, একদম ঠিক হয়ে যাবে চাচ্চু।

-আমার জন্য সব হয়েছে। সব আমার দোষ ভাইয়া, সব আমার দোষ।

চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো সুবহা। সিয়াম আলতো করে সুবহার মাথায় হাত রেখে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। সুবহা কোনোক্রমেই থামতে চাইলো না। কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি উঠতে শুরু করলো তার। সিয়াম আলতো করে সুবহাকে ধরে বিছানায় বসালো।

-সুবহা, শান্ত হ। তুই না চাচ্চুর স্ট্রং মেয়ে? তুই এতটা ভেঙে পড়ছিস? নিজেকে স্বাভাবিক কর। তোকে শক্ত থাকতে হবে। এখন চুপচাপ ঘুমা, সকালে উঠে দেখতে যেতে হবে না?

-হু।

সুবহার কান্নার গতি কমলো। বিছানায় হেলান দিল সে। সুবহার গায়ে কাঁথা দিয়ে আয়াতুল কুরসী পড়ে ফুঁ দিল সিয়াম। সুবহা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করলো। লাইট অফ করে নিজের ঘরের দিকে এগোলো সে। আচমকা সিয়ামের মাথায় একটা কথা খেলতে লাগলো, সুবহা কেন বললো সব দোষ ওর? কিছু কি হয়েছে? প্রশ্নটা মাথায় আসলেও সিয়াম ভাবলো সুবহা শোকে দুর্বল হয়ে পড়েছে তাই নিজেকে দোষ দিচ্ছে। এটা মনুষ্য স্বভাব। কাছের মানুষজনের বিপদ হলে মানুষ নিজের ছোট ছোট কাজগুলোর দোষ দিতে থাকে সেই বিপদের কারণ হিসেবে। সুবহাও তার ব্যতিক্রম নয়। সিয়ামের ঘুম হলো না। চাচার বলা কথায় সে চিন্তিত। এত বছরে এমন কোনো বিষয় ঘটেনি যার জন্য তার চাচা তাকে এমন শর্ত দিতে পারে! নির্ঘুম, চিন্তিত রাত কাটলো সিয়ামের ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে।

___________________

অনিক চিত্রলেখাকে বেশ সকালেই হোস্টেলে রেখে গেছে। অনিক বাড়তি কথা না বললেও চিত্রলেখার প্রতি অনিকের সামান্য হলেও স্নেহ অনুভব করতে পেরেছে চিত্রলেখা। নিজের ভাগ্যের উপর করুণা হচ্ছে তার। এক ভাই ভালোবাসে তো আরেক ভাই মুখ ফিরিয়ে নেয় অথচ সে তো চাইতো দুই ভাইয়ের নয়নের মণি হয়ে থাকতে। এ আশা বোধহয় তার কখনো পূরণ হওয়ার নয়। কলেজের ক্লাস বারোটায়। চিত্রলেখা বেশ তাড়াহুড়ো করেই ক্লাসে গেল। আশেপাশে সুবহাকে খুঁজলো, না আসেনি মেয়েটা। সুবহাকে ছাড়া ক্লাসে চিত্রলেখার নিজেকে এতিম মনে হয়। একটাই বন্ধু তার, সেও আসেনি। আগের ক্লাসগুলোও মিস করেছে চিত্রলেখা। কেইস চলার কয়েকদিন সে কলেজে আসেনি, সুবহাকে জানানোও হয়নি এসব ঘটনা। এখন জানালেও রাগ করবে। চিত্রলেখা ঠিক করলো কলেজের পর সুবহার বাড়িতে গিয়ে দেখা করবে আর নোটগুলোও নিয়ে আসবে। দুইটার পর আর ক্লাস হলো না। কলেজ থেকে বেরিয়েই সুবহাকে কল করলো সে।

-সুবহা কই তুই? বাসায় আছিস? আমি আসবো একটু তোর ওখানে।

-লেখা…

-তোর কণ্ঠ এরকম কেন? কী হয়েছে তোর?

-লেখা বাবা..হা..হাসপাতালে।

-আঙ্কেলের কী হয়েছে? তুই কোন হাসপাতালে? আমি আসছি দাঁড়া।

-সেন্ট্রাল হাসপাতাল।

-আচ্ছা তুই নিজেকে সামলা, আমি এসে সব শুনবো।

চিত্রলেখা কল রেখে দ্রুত হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বের হলো। সুবহা এমন সমস্যায় আছে কল্পনাও করেনি সে। না জানি আঙ্কেলের কী হয়েছে! অবশ্যই সিরিয়াস কিছু বোধহয়। চিত্রলেখার মনটাও বিমর্ষ হয়ে উঠলো। সুবহার বাবা তাকে নিজ মেয়ের মতোই দেখতেন। তার অসুস্থতা চিত্রলেখাকেও পীড়িত করছে।

হাসপাতালে আসতে মিনিট পনেরো লাগলো। চিত্রলেখা হাসপাতালে ঢুকে রিসেপশনে থাকা মহিলার থাকা কেবিন নম্বরের খোঁজ নিল। হার্টের ওয়ার্ডে! খানিকটা ভয় পেল চিত্রলেখা। দ্রুত পায়ে সেদিকে এগোলো।

চিত্রলেখাকে দেখেই সুবহা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। কান্নাগুলো আবারো বাঁধ মানলো না তার। চিত্রলেখা বুঝে উঠতে পারলো না কী ফলে সুবহাকে শান্ত করবে। বাবার ভালোবাসা সে পায়নি তবুও লোকটার মৃত্যুতে বুকের ভেতরটা ধক করে উঠেছিল সেখানে মেয়েটার সবচেয়ে কাছের মানুষ তার বাবা আর সেই বাবাই এখন এ অবস্থায় আছে! চিত্রলেখা সুবহাকে ছাড়ালো না, কিছুক্ষণ জড়িয়ে থাকুক তাতে যদি যন্ত্রণা কিছুটা কমে।

দুপুরের দিকে সুবহার মাকে এলাও করা হলো। শাহজাহান আলীর জ্ঞান আছে তখন, তিনিই দেখা করতে চেয়েছেন। চোখের পানি মুছে সুবহার মা রেহানা সুলতানা কেবিনে ঢুকলো। নিজের স্বামীর শরীরের দিকে তাকিয়ে চোখ ছলছল করে উঠে তার। অসুস্থতা যেন তাকে কাবু করে ফেলেছে। শাহজাহান আলী বেশ কষ্টেই একটু কথা বলার চেষ্টা করলেন।

-রেহানা, তো..তোমার সাথে আমার দরকারি কথা আছে। তুমি একটু শোনো আমার কথা।

-বলো আমি শুনছি।

-তোমার দুর্জয়ের কথা মনে আ..আছে?

-এমপির ভাইপো? যার উপর তুমি তোমার এক ছাত্রকে খুন করার সাক্ষী দিয়েছিলে?

-হ্যাঁ, সে আগামী মাসে ছাড়া পাচ্ছে। ওর লোক আমাকে কল করেছিল, এতদিন নাকি দুর্জয়ের জেল থেকে বের হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। সুবহার উপর নজর ওদের।

-সুবহা? ওরা সুবহার ক্ষতি করতে চায়?

-ওরা সুবহাকে কষ্ট দেওয়ার কোনো চেষ্টা বাকি রাখবে না। আমি চাই সুবহাকে সিয়াম বিয়ে করে রাজশাহী নিয়ে যাক। দুর্জয়ের নাগালের বাইরে নিয়ে যাক।

-সিয়াম কি রাজি হবে?

-সিয়ামকে বোঝাও রেহানা, ও যেন আমার মেয়ের ক্ষতি হতে না দেয়। সুবহার অন্য কোথাও বিয়ে হলে আমার দুশ্চিন্তা থাকবেই তবে সিয়ামের কাছে সে নিরাপদ। ও…ওকে..বো…বোঝাও …

-তুমি শান্ত হও, শান্ত হও তুমি।

শাহজাহান আলীর হৃদস্পন্দন দ্রুত চলতে লাগলো। রেহানা বেগম চেঁচিয়ে ডাক্তার-নার্সকে ডাকলেন। পরিস্থিতি ক্রমাগত হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। রেহানা সুলতানা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সুবহা আবারো পাথরের ন্যায় হয়ে পড়লো। সিয়াম দূরে দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রলেখার দিকে তাকানোর সাহস সে পাচ্ছে না আর না পারছে সুবহার আশেপাশেও থাকতে। এ কেমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে বাঁধা পড়েছে সে?

চলবে…

[আগামী তিনদিন আমার টানা পরীক্ষা দুইটা করে। এ তিনদিন গল্প দেওয়া কোনভাবেই সম্ভব না আমার পক্ষে। তিনদিন পর থেকে নিয়মিত গল্প পাবেন। ধন্যবাদ 💛]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here